ছোটগল্প: অব্যক্ত সিঁদুর
Sajjad alom
উৎসর্গ:: Shihab Shahoriar
.
.
(১)
মেঘলা আকাশে চাঁদটা লুকোচুরি খেলছে। চারদিকে মেঘের মাঝে কিছুটা আলোর ঝলকানি। নিশ্চুপ নিরবতা পৃথিবীর সবখানেই বিরাজমান। হ্যাঁ, এখন মধ্যরাত্রি। সারাদিনের ব্যস্ততম দিন অতিবাহিত করে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। জমিদার বাড়ির সব প্রদীপ নিভে গেলেও গিন্নীর ঘরের প্রদীপটা দপদপ করে জ্বলছে। গিন্নীর বয়স যতটা তারচেয়ে দ্বিগুণ বয়স কর্তাবাবুর। কর্তাবাবু জরুরী কাজে কলকাতার বাইরে। আজকে ফেরার কথা কিন্তু এখনো ফেরার খবর হাতে পাননি গিন্নী। গিন্নীকে সবসময় চোখে চোখে রাখেন কর্তাবাবু। গিন্নী তার চেয়ে শ্রী যতটা কর্তাবাবু চেয়েছেন। তাইতো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবেন। ঘুম আসছে না নন্দিতার। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছে। চাঁদটা মাঝে মাঝে হাসছে আবার কখনো ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। নন্দিতার আজকে মন ভালো নেই। গত দু'বছরে কর্তাবাবুকে সুখে রাখতে গিয়ে বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের সুখটুকু। মনটা আজকে কাঁদছে। বুঝতে পারছে না কেন? শুধু অনুভব করছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি? জমিদার বাড়ির সব কিছুই তো ঠিক আছে। তাহলে অপূর্ণতা কোথায়? মনের ভিতর আগুন দবদব করে জ্বলেই চলছে। চোখ দিয়ে অপ্রত্যাশিত কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে ছাদের উপর স্পর্শ করে। মনে পরতে থাকে বছর তিনেক আগের দৃশ্যপটগুলি।
কতইনা মধুর ছিলো সেগুলো। আজো সেদিনগুলো ফিরে পেতে চায় নন্দিতা। বদ্ধ জলাশয়ে দু'বছর থেকে হাপিয়ে উঠেছে। শাড়ীর আঁচলে ডজনখানেক চাবি। পুরো সংসার তাকে একলাই সামাল দিতে হয়।
বেশিরভাগ সময় কর্তাবাবু কাজের কারণে বাড়ির বাইরে থাকেন। ছোট মানুষ হলেও গত দু'বছরে অনেক কিছু নিরবে শিখে নিয়েছে সে। ছাদের উপর হঠাৎ কিসের যেন শব্দ পেয়ে চমকে উঠে নন্দিতা। পিছনে ফিরে দেখে একটা ছোট বিড়াল। বিড়ালটা নন্দিতাকে দেখেই ম্যাঁও ম্যাঁও করছে।
স্বভাষায় কিসের যেন অভিযোগ পেশ করছে বিড়ালটা। কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও গেল। শুধু নন্দিতা কিছু বুঝলো না, শেষপর্যায়ে স্মিত হেসে আবার চেয়ারে বসে পড়লো। একসময় বিড়াল খুব পছন্দ ছিলো নন্দিতার যখন সে নিজ গ্রামে ছিলো। সারাদিন লুটোপুটি আর আনন্দে মাতিয়ে রাখতো পাঠশালা কিংবা পুরো গ্রাম।
মানুষ কিছুটা অতিষ্ঠ হলে সবকিছু মেনে নিত নিরবে। কারণ একটাই সবসময় হাস্যজ্বল মুখ। পাঠশালায় পড়া না পারলে মাস্টার মশাই দাঁড়িয়ে রাখতো ঠিকই কিন্তু বেতের ঘা গায়ের উপর বসাতে না।
একবার মাস্টার মশাইয়ের দু'ঘা বেতের বারি খেয়ে দু'দিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি সে। মাঝে মাঝে কথাটা স্বরণ হতেই খিক করে হেসে দেয় নন্দিতা।
সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে মাখনদার সাথে। বয়সে চার বছরের বড় মাখন হলো তার জেঠাতো দাদা। মাঝে মাঝে নাও নিয়ে দু'জনে শাপলা তুলতে যেত নদীর ওপারে। দুষ্ট-মিষ্টি স্বৃতিগুলো আজো কাঁদায় নন্দিতাকে।
কি বা করার ছিলো তার! হিন্দু পরিবারের জন্ম হয়েছে বলে বাবার সব কথাই মেনে নিতে হয়েছে নীরবে। বিসর্জন দিতে হয়েছে ছোট্ট হৃদয়ের ভালোবাসাটুকু।
যার পুরোটা জুড়ে ছিলো মাখন দা। মাখনদা কি ভালো আছে? নাকি সেও পাগলের মত ধুঁকে ধুঁকে মরছে? অপেক্ষায় প্রহর গুনছে কি তার নন্দিতার জন্য? চোখ ফেঁটে কি দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে না?
হাজারো প্রশ্ন মাথায় গিজগিজ করে নন্দিতার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
(২)
'মাখন দা, আজকে পাঠশালায় যাবি না?' পুঁথি হাতে মাখনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নন্দিতা। ষোড়শী বয়সের কিশোরী মেয়েটা দেখতে চাঁদের মতন। মাখন মাঝে মাঝে নন্দিতার মাঝে তার ভালোবাসাকে খুঁজে। নন্দিতা কিছুটা বুঝলেও না বোঝার ভান করে সবসময়। মেয়ে বলে কথা! লজ্জাবতী হওয়াই স্বাভাবিক। নন্দিতাকে দেখে ফিক করে হেসে দেয় মাখন। বিছানা থেকে দ্রুত উঠে নন্দিতার কানে কানে বলে, 'আজ পাঠশালা যাবো না, আজ শাপলা তুলতে যাবো। তুইও আমার সাথে যাবি। গতকাল সদাই করে ঘরে ফেরার সময় দেখলাম ওপারের জমিদারের পুকুরে কি সুন্দর শাপলা!'
মাখনের কথায় কিছুটা বিব্রতবোধ করে নন্দিতা- 'কিন্তু দাদা, পাঠশালা না গেলে মাস্টার মশাই দাঁড় করিয়ে রাখবেন। তাছাড়া বাড়িতে টের পেলে কি জবাব দিবো?'
মন খারাপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নন্দিতা। মাখন ঠোঁটের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে মাথা ঝোঁকাতে ঝোঁকাতে আঙুল ফুটিয়ে হাস্যজ্বল চোখে বলে ওঠে-, 'পাইছি, চল এবার। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলে বলবি সাঁকো থেকে পানিতে পরে গেছিলাম।'
মাখনের কুবুদ্ধি শুনে নন্দিতার পছন্দ হয়ে যায়। চুপিসারে দু'জনে ঘাটের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। পিছন থেকে নন্দিতা চেঁচিয়ে বলে-, 'আস্তে দৌঁড়া দাদা। আমি তো তোর মতো দৌঁড়াতে পারছি না।' কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে মাখন বলে-, 'তুই আর কি পারবি? না পারিস খেতে না পারিস কোন কাজ-কর্ম করতে। তোকে যে বিয়ে করবে তার কপালে দুঃখ আছে।' কথাটা বলেই নন্দিতার হাত ধরে একসাথে দৌঁড়াতে থাকে দু'জন। ঠোঁট উঁচিয়ে নন্দিতা বলে-, ' বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। আমি কখনো বিয়েই করবো না।'
নন্দিতার কথা শুনে মুচকি হাসে মাখন। দু'জনে বেশ ক্লান্ত। ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে। এক লাফ দিয়ে মাখন নৌকায় উঠে পরে। আস্তে আস্তে নন্দিতাও মাখনকে অনুসরণ করে নৌকায় উঠে। নৌকা চালাতে বেশ পারদর্শী মাখন। নৌকা থেকে পানির সাথে খেলায় মত্ত থাকে নন্দিতা। মাখন অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে নন্দিতার দিকে। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, বাঙ্গালীর রীতিমত গায়ে কাপড় পরা, কপালে লাল টিপ কিংবা লাল-সবুজ ফিতার আবরণ। শাপলা তোলা হলে দু'জনে সাবধানে বাড়িতে ফিরে আসে। পাঠশালা না যাবার জন্য অভিযোগ করেন মাস্টার মশাই। নন্দিতার বাবা নরেন্দ্র রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান।
'নন্দিতা কোথায় গিয়েছিলে? তোমার শাড়ী ভেজা কেন?'
রাগকে সংযত করে কথার বলার চেষ্টা করেন নরেন্দ্র বাবু। বাবার কথায় কাচুমাচু করতে থাকে নন্দিতা-, 'আসলে বাবা সাঁকো থেকে পরে গেছিলাম। আর যাইনি পাঠশালা।'
'মিথ্যা বলছো কেন? মাখনের সাথে শাপলা তুলতে গেছিলে পাঠশালা কামাই দিয়ে। ঘরে যাও, এ ভুল আর দ্বিতীয়বার করলে গায়ে বেতের ঘা উঠবে।'
বাবার কথায় স্বস্তি ফিরে পায় নন্দিতা। টুপ করে ঘরের ভিতর ঢুকে পরে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে থাকে বারবার। মাখনের জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছে নন্দিতার। জেঠামশাই জানতে পারলে তার আর রক্ষে নেই। অবশ্য নন্দিতার অনুমানই সঠিক হয়েছিলো কারণ পাঠশালা কামাই করার জন্য ভীষণ মার খেতে হয়েছে মাখনকে। মাখনের বাবা অমল বাবু ছেলের কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট।তাইতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন, কলকাতার বাইরে।
.
( ৩)
বকুল ফুলের গাছটার নিচে পা দুখানা ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে নন্দিতা। মুখটা বেশ গোমরাহ। যেকোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে দু'চোখ বেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাখন এসে পাশে বসে। অভিমানের সুরে নন্দিতা বলে, 'তুই নাকি জেঠা মশাইয়ের সাথে কলকাতার বাইরে যাচ্ছিস?'
পায়ের নিচে একটা ইটের টুকরো খুঁজে পায় মাখন। কুড়িয়ে নিয়ে ঢিল মারতে মারতে বলে, 'হুঁ যাচ্ছি তো। আমার বাবাটা না বড্ড জেদি রে কত করে বললুম, আমি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাব না কে শোনে কার কথা! গ্রামে থাকলে নাকি লেখাপড়া হবে না। তাই তার সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। কারখানায় দেখাশুনা করার জন্য বাবার সুবিধা হবে নাকি।'
মুখ উঁচিয়ে নন্দিতা প্রশ্ন করে, 'আমারে তোর মনে পরবে না রে মাখনদা?'
মাখন জানে নন্দিতা তাকে কতটা ভালোবাসে। এই ভালোবাসাটুকু পাবার জন্য বারবার জন্মাতে চায় পৃথিবীতে। কিছুক্ষণ নীরবতা পালক করে বলে উঠে,
'তা হবে বৈকি, কিছুদিন পর সব সব ঠিক হবে। আর বাবা বলেছে দু'মাস পরপর বাড়িতে নিয়ে আসবে। থাক রে, বাবা যাওয়ার জন্য তৈরি।'
কথাটা বলেই দাঁড়িয়ে পরে মাখন। দু'চার পা সামনের দিকে হাঁটা দেয়। পিছন থেকে নন্দিতা ডাক দেয়,
'মাখন দা! একটু দাঁড়াবি?' নন্দিতার কথায় সায় দিয়ে পিছনে হাসি মুখে দাঁড়ায় মাখন। একটা বকুল ফুলের মালা মাখনের দিকে এগিয়ে দেয়। মুচকি হেসে মাখন বলে, 'এটা দিয়ে আমি কি করবো নন্দিতা?'
'সকালে গাছতলা থেকে কুড়িয়েছি। গন্ধটা থাকবে ঢের সময়। আমার কথা মনে পরলে মালাটাকে কাছে রাখিস। কাছ ছাড়া করিস না যেন?'
নন্দিতার কথায় না হেসে পারে না মাখন। মালাটা হাতে নিয়ে ভালো করে আরেকবার তাকিয়ে দেখে পকেটে রেখে বলে, 'হ্যাঁ রে ফেরার সময় তোর জন্য কিছু আনবো?' খানিকটা লজ্জা পায় নন্দিতা। মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলে উঠে।
'কি আনবো বল? মিঠাই নাকি শাড়ি? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
'বারে এসব আমার চাই না। তুমি বরং এক জোড়া নূপুর নিয়ে এসো।'
কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় নন্দিতা। স্মিত হেসে মাখন আচ্ছা বলে সামনে এগিয়ে যায়। নন্দিতা তাকিয়েই থাকে মাখনের দিকে। বুকের বাম পাশটা চিনচিন করে উঠে। ভাবতে থাকে কিভাবে কাটবে তার সময়? যদিনা পাশে মাখন দা থাকে! চোখের কোণে পানি টলমল করতে থাকে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌঁড়ে ছুটে যায় নন্দিতা।
আকাশে ভেসে বেড়া শুভ্র মেঘমালার মাঝে কিছু অতীত স্মৃতি খুঁজতে চেষ্টা করছিলো নন্দিতা। একা সময় যেন কাটতেই চায় না। মাসখানেক হয়ে গেল মাখন দাদার কোন খোঁজ পায়নি সে। শরমে জেঠাই মার কাছে বলতে পারে নি মাখন দাদার কথা। সেদিনটির অপেক্ষায় পঞ্জিকায় দাগ দিতে থাকে সে। মাখন দাদা কি আমার কথা সত্যি ভাবে? আমার নিয়ে কি স্বপ্নের জাল বুনে? নাকি কারখানায় কাজে ব্যস্ত? সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত নন্দিতা। মাঝে মাঝে দোলনায় দোল খাচ্ছে আর ভাবছে। ঘরের ভিতর থেকে খুশির আমেজ আসছে। নন্দিতা জানে না কিসের খুশি। দোলনা থেকে নেমে দৌঁড়ে ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে মাকে প্রশ্ন করে বসে,
'মাগো, কি হয়েছে গো? সবাই এত খুশি কেন?'
মেয়েকে দেখে মুচকি হাসি দেন লক্ষী রানী। মেয়েকে কাছে টেনে বলেন, 'এতোদিনে ভগবান আমাগো দিকে চেয়েছেন রে মা। যেমনটা চেয়েছিলাম ঠিক তেমনটা পেয়েছি। জমিদার বাবু তোকে পছন্দ করেছেন। সামনের সপ্তাহে তোর বিয়ে।'
বিয়ের কথা শুনে মুখটা ম্লান হয়ে যায় নন্দিতার। আলোকিত মুখ হয়ে যায় মেঘে আচ্ছাদিত। চোখে পানি টলটল করতে থাকে। দু'দিন আগে জমিদার বাবু নন্দিতার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। নিচু স্বরে প্রশ্ন করে, 'কোন জমিদার গো মা?'
' রায়পুরের জমিদার। সেদিন পাঠশালা থেকে ফেরার পথে তোকে দেখেছিলো। তোর রুপে নাকি উনি মুগ্ধ। দুগ্গা দুগ্গা।' কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান লক্ষী রানী। ছলছল চোখে মাকে বলে, 'মাগো আমি তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি? এত তাড়াতাড়ি পরের ঘরে পাঠাচ্ছো কেন?' লক্ষী রানী পিছনে ফিরে তাকায় না। নন্দিতার দিদা বলে উঠে,
'তাড়াতাড়ি বলতেছিস ক্যান? ষোলতে পা দিলি, এটাই বা কম কিসে? মাইয়া মানুষরে বেশিদিন ঘরে রাখা ঠিক না। আমারেই দ্যাখ না, তোর দাদু বার বছরে ঘরে তুলেছিলো। তাছাড়া রায়পুরের জমিদার বলে কথা। তুই ম্যালা সুখে থাকবি।' কাঁপা গলায় বলতে থাকলো নন্দিতার দিদা। নন্দিতা এবার স্পষ্ট হলো কেন সেদিন হাতে বন্দুক নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অবশ্য তার তাকানো দেখে কিছুটা লজ্জায় পরে গিয়েছিলো নন্দিতা নিজেই। সইদের সাথে লক্ষন বাবুর আমবাগান থেকে ফেরার পথের ঘটনা। জমিদার বাবু পাখি শিকার না করে আস্ত জলজন্ত একজন তরুনীকে শিকার করে বসলো। নন্দিতা ঘর থেকে ফিরে এসে দোলনায় বসে চোখের জল ফেলছে। এ জলে মিশে আছে মাখনদার প্রতি অগাধ ভালোবাসার স্রোত। কেউ জানে না, শুধু ভগবান জানে। চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। দোলনার পাশের গাছটায় বসে থাকা ময়না পাখিটা জানান দিচ্ছে,
'কি গো নন্দিতা সুন্দরী? তুমি কাঁদছো কেন? তোমার মাখনদা আসবে। শীঘ্রই আসবে।' পাখিটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ থাকিয়ে থাকে নন্দিতা। মনে মনে ভাবে, 'তোর মতো যদি পাখি হতাম তাহলে মাখনদার কাছে উড়ে চলে যেতাম। আর কখনো ফিরতাম না। পৃথিবীর মানুষগুলো বড়ই স্বার্থপর। কেউ কারো মন বোঝে না।'
সত্যি তো নন্দিতার মন তার বাবা-মা বুঝলো না। পা ধরা সত্ত্বেও জমিদার বাবুর সাথে বিয়ে পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হলো ষোড়শী বছরের নব যুবতী। বিয়ের পিঁড়িতে বসেও মাখনদাকে খুঁজছিলো সে। নাহ! সে কেন আসলো না? সে কি তাহলে আমাকে ভালোবাসে না? নাকি তাকে খবর দেয়া হয়নি! হাজারো প্রশ্নের ভীরে চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পরে নন্দিতার। কেউ বুঝলো না, হাজারো কষ্টের ভীরে চাপা পরে গেল নন্দিতা-মাখনের দুষ্টু-মিষ্টি ভালোবাসার গল্পের শেষ দৃশ্য। সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া ঠিকই পরলো কিন্তু সেটা জমিদার বাবুর ছোঁয়া,মাখনদার নয়।
.
(৪)
বিয়ের কয়েকমাস পর কর্তাবাবু নন্দিতাকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। কর্তাবাবু পরীর মতো গিন্নী পেয়ে বেজায় খুশি। নন্দিতা কখনো বুকের ভিতর চাপা কষ্টটাকে কর্তাবাবুকে বুঝতে দেয় নি। মনটা ভালো হলেও বেশ রাগি আর জেদি মানুষ তিনি। গ্রামের হালচাল অনেকাংশই পরিবর্তন হয়েছে এই কয়েকমাসে। নতুন একটা খবর শুনে বিস্মিত নন্দিতা। ঘরের দরজা দিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। কর্তাবাবু ঘরে না ঢুকলে হয়তো চলতেই থাকতো। কর্তাবাবুকে দেখা মাত্রই চোখের জল মুছে ফেলে। কর্তাবাবু নন্দিতার পাশে বসে, 'তোমার গ্রামটাতো ঘুরে দেখালে না নন্দিতা। এখন বিকেলবেলা, চল ঘুরে আসি। আজ দু'জনে হাঁটবো। টমটম বা ঘোড়া সাথে নিবো না।'
কর্তাবাবুর কথায় না করে না নন্দিতা। লোকটার বয়স একটু বেশি হলেও সবসময় তার খোঁজ-খবর রাখে। প্রচণ্ড ভালোবাসেন নন্দিতাকে। যদিও কর্তাবাবুর প্রথম স্ত্রী বিয়ের কয়েকমাস পরেই চিতায় জ্বলেছে। এসব কিছু ঘটার পর বছর পাঁচেক বিয়ের পিঁড়িতে বসেন নি, লোকমুখে শোনা যেত কর্তাবাবু দ্বিতীয় বিবাহ করবেন না। কিন্তু সকলের মুখে জল ঢেলে দিয়ে দ্বিতীয়বার বেলতলাতে বসে পরলেন কর্তাবাবু। এসব কিছুর কোনটাই অজানা নয় নন্দিতার। কর্তাবাবু নন্দিতার হাত ধরে হাঁটছেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই অবাক! জমিদার সবসময় পেয়াদা,ঘোড়া,টমটম নিয়ে ঘুরেন,আর আজ! হেঁটে হেঁটে। জামদানী শাড়ি,সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখাপলা আর সমস্ত শরীরে গায়নায় দেখতে বেশ লাগছিলো নন্দিতাকে। হঠাৎ চোখ যায় বকুল গাছটার নিচে। একটা পাগল বসে বসে কি যেন প্রলাপ বকছে। মাথায় চুল ভর্তি, দাড়ি-গোঁফে মুখখানা একাকার। শরীরটা বেশ শুকিয়ে গেছে। পরণে ছেঁড়া একটা পাঞ্জাবির সাথে সাদা ধুতি। এটাই নন্দিতার মাখনদা। মাখনদাকে দেখে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মাখনদার দিকে। মাখন বলে উঠে,
'যাহ যাহ, এখান থেকে চলে যাহ। তুইও ছল করবি আমার সাথে? আমি আর শাপলা তুলতে যাবো না। বড়ই পেড়ে দিবো না। আমি রাগ করেছি, ভীষণ রাগ করেছি। কেউ কথা রাখেনি।'
কথাগুলো বলে হুহু করে কেঁদে উঠে মাখন। মাঝে মাঝে কান্নার মাঝেই হিহিহি করে হেসে উঠে। সকলের মুখে শোনা যায় কোন মেয়ে মানুষকে দেখলে এভাবেই নাকি প্রলাপ বকে মাখন। বাড়িতেও যায় না, কাউকে ঠিকমতো চিনেও না। নন্দিতার কার্যকলাপ দেখে বেশ খানিকটা বিরক্ত কর্তাবাবু। নন্দিতাকে ছুঁড়ে দেয় 'এখান থেকে চলো' নামক বাক্যটি। নন্দিতার চুপ করে তাকিয়েই থাকে। হঠাৎ চোখ যায় মাখন পাগলের গলার দিকে, বকুল ফুলের সেই মালা! পায়ের সাথে বাঁধা আছে এক জোড়া নূপুর। কেউ না বুঝলেই ঠিকই বুঝতে পেরেছে নন্দিতা। বুঝতে পেরেছে কথাগুলোর সঠিক অর্থ। কর্তাবাবু বলে উঠে, 'নন্দিতা! একজন পাগলকে দেখার কি আছে বুঝি না? চলো তো।' কান্নাজনিত কণ্ঠে বলে উঠে, 'কর্তাবাবু আমার দাদা।'
হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় কর্তা। বলতে থাকে, 'পাগল আবার দাদা হয় নাকি? হলেও ভুলে যাও। তোমার মনে রাখা আবশ্যক যে, তুমি রায়পুরের জমিদারের গিন্নী।' নিরবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে হাঁটতে থাকে নন্দিতা। বুকের ভিতর কষ্টটা আরো বাড়তে থাকে। মাখনদা তাহলে তাকে সত্যিই ভালোবাসতো! কই কোনদিন তো মুখ ফুটে বলেনি। হয়তো এভাবেই কিছু ভালোবাসার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। শেষ কথাটা বারবার মনে পরতে লাগলো, 'কেউ কথা রাখে নি।'
.
(৫)
'নন্দিতা'...
ডাকটা শুনে ঘোর কাটে নন্দিতার। পিছনে ফিরে দেখে সাদা পাঞ্জাবি,ধুতি ও গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্তাবাবু। চোখ থেকে পানিগুলো দ্রুত মুছে ফেলে। কিছুটা এগিয়ে আসে কর্তাবাবু। ভাঙ্গা গলায় বলে, 'কখন আসলেন? সন্ধ্যায় তো আসার কথা ছিলো। এতো রাত হলো যে?'
'আসলে কলকাতা গিয়েছিলাম,তোমাদের বাড়ি। তাই একটু দেরি হয়ে গেল। রাতে খেয়েছো?
কর্তাবাবুর কথার মাথা নেড়ে না বলে উত্তর দেয় নন্দিতা, 'বাবা-মা কেমন আছেন? দিদার অসুখটা কি কমেছে?'
গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে কর্তাবাবু বলে উঠে, 'নন্দিতা তুমি এমন কেন? আমার জন্য না খেয়ে বসে আছো! নিজে খেয়ে নিলেও পারতে। ও বাড়িতে সবই ঠিক আছে। তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো তাইনা?'
কর্তাবাবুর কথা কোন উত্তর দেয় না নন্দিতা। মূর্তির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর কর্তাবাবু নিজেই বলে উঠে, 'কোনদিন তো তোমার মাখনদার কথা আমাকে বলো নি। তুমি মাখনকে ভালোবাসতে,মাখনও তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। এই কথাটা তোমার বাবা-মা কিংবা আমার সাথে ভাগাভাগি করতেও পারতে। জীবনের চরম ভুল এখানে নন্দিতা। আমি জানি নন্দিতা, আমি কষ্ট পাবো বলে তুমি কিছু বলো নি। অনেকবার বুঝেছি তুমি কতটা ভালোবাসো আমাকে। ছোট্ট একটা ভুলের কারণে দুটি তরতাজা জীবন ঝরে গেছে নিমিষেই। এসব আমি জানতাম না, তোমাদের গ্রামে শুনলাম। চোখের সামনে চিতায় জ্বলতে দেখলাম মাখন নামে একজন প্রেমিক পাগলকে।'
কর্তাবাবুর কথা শুনে আকাশ যেন ভেঙ্গে পরলো নন্দিতার উপর। এক ফোঁটা দু'ফোঁটা করে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। মাখনদা মারা গেছে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নন্দিতার। ঝরঝর করে বৃষ্টির সাথে কেঁদে দেয় সে। কর্তাবাবু এক জোড়া নূপুর নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, 'তোমার মাখনদা কিনেছিলো তোমার জন্য। ওর পুরনো একটা ডায়েরী অনেককিছু লেখা ছিলো। বৃষ্টি আসছে, ভিতরে আসো।' বলেই কর্তাবাবু ভিতরে চলে গেলেন। বুকের ডান পাশটা খাঁ খাঁ করছে, অতৃপ্ততায় ভুগছে হৃদয়। নূপুর জোড়া হাতে নিয়ে ভালো করে একবার দেখে বুকের ভিতর জড়িয়ে কাঁদতে থাকে নন্দিতা। কেন বাবা-মাকে বললাম না? মাখনদাই বা বিয়েতে কেন আসলো না? চারদিকে হাজারো প্রশ্নের মাঝে হতাশায় ভুগছে নন্দিতা। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। জীবন তুমি এমন কেন? নিজেকে প্রশ্ন করে বসে নন্দিতা। আকাশে আর চাঁদের লুকোচুরি খেলাটা নেই। হয়তো চাঁদটা ডুবে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। নন্দিতা নিরবে ছাদের উপরে দাঁড়িয়েই আছে। ডানপাশটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কল্পনার রাজ্যে নন্দিতা-মাখনের বাসর সেই কবেই হয়েছে। মাখন চাপা স্বভাবের না হলেও কেন সে বিয়ের মণ্ডপে এসে মুখ ফুটে বললো না, 'নন্দিতা আমি তোকে ভালোবাসি। তুই আমার ছাড়া অন্য কারো হতে পারবি না। তুই ছাড়া মাখন যে অচল রে।' কই আসে নি তো। একবারের জন্য বলেনি, 'চল দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। যেখানে কোনকিছুর বাঁধা থাকবে না। দু'জনে ঘর বাঁধবো,সুখের ঘর।'
হৃদয়ের মাঝখানে আরেকটা নন্দিতার সিঁথির সিঁদুর বৃষ্টির পানিতে দু'গাল বেয়ে পরছে। পুরোহিত মশাই শাখাপলা দু'টো ভেঙ্গে ফেলেছেন। পরণে উঠেছে সাদা শাড়ি। আকাশটা অঝোর ধারায় কাঁদছে। আকাশের কান্নায় ম্লান হয়ে গেছে নন্দিতার চোখের জল। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে চিৎকার দিয়ে ওঠে নন্দিতা, 'মাখনদা।'
(সমাপ্ত)
āĻāϞ্āĻĒ āϏংāĻ্āϰāĻš āĻāϰা āĻāĻŽাāϰ āύেāĻļা। āϰোāĻŽাāύ্āĻিāĻ, āĻৌāϤিāĻ, āϰāĻŽ্āϝ, āĻৌāϤুāĻ āϏāĻš āĻšাāĻাāϰো āĻāϞ্āĻĒ āĻāĻে āĻāĻŽাāϰ āϏংāĻ্āϰāĻšে।
āĻļুāĻ্āϰāĻŦাāϰ, ā§§ā§§ āĻāĻāϏ্āĻ, ⧍ā§Ļā§§ā§
685
āĻāϰ āĻĻ্āĻŦাāϰা āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰা
Rahathossain1010100@gmail.com
āĻāĻ āϏāĻŽā§ে
ā§Ž:ā§Ļā§Š PM

āĻāϤে āϏāĻĻāϏ্āϝāϤা:
āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝāĻুāϞি āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ (Atom)
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ