āĻŦুāϧāĻŦাāϰ, ⧝ āφāĻ—āϏ্āϟ, ⧍ā§Ļā§§ā§­

681

"আমরা দুজনে রচনা করেছি একে অপরের ক্ষতি
সিনি মনি

১. 
আমাদের দোতলা বাড়ির গেইট পেরিয়ে পাঁচ মিনিট হাটবার পর একটা এবড়োথেবড়ো বুড়ো কড়ই গাছের নিচে যে নড়বড় চায়ের দোকানটা দেখা যায় , আমি খানিকটা দ্রুত পায়ে হেঁটে সরাসরি সেই দোকানে গিয়ে ঢুকলাম । জং ধরা লালচে টিনে ঘেরা ভাঙ্গাচোরা একটা দোকান । দোকানটার একপাশে কোনার দিকে একটা শক্তপোক্ত বেঞ্চ – তাতে হাফহাতা শার্ট আর লুঙ্গি পরা কাঁচাপাকা চুলের একজন মানুষ খবরের কাগজ নিয়ে গভীর মনোযোগে প্রায় ডুবে আছেন । যদিও দোকানে আরো চার পাঁচটা বেঞ্চ খালি পড়েছিল , কিন্তু আমি সেসবের দিকে বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না করেই গডগড করে হেঁটে গিয়ে সেই কাঁচাপাকা মানুষটার পাশে ধুপ করে বসে পড়লাম । মফস্বলের দোকান ; পুরোদিন জুড়ে সাধারনত রিকশা-ভ্যানচালকেরাই বাঁচিয়ে রাখে এই দোকানগুলোকে- আর রাতের বেলা এখানে বসে এলাকার দাদা-চাচা টাইপ মুরুব্বিদের সভা । এসব চায়ের দোকানে কোন মেয়ে কখনো একা এসে বসেনা ;  তাই আমার এভাবে গডগড পায়ে এখানে এসে ধুপ করে বসে পড়াতে চার পাঁচটা উৎসাহী চোখেরা অবাক দৃষ্টি মেলে তাকালেও তাতে আসলে বিস্মিত হবার কিছু নেই । কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল , এখানে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে একজনও তাকিয়ে নেই – সবাই যার যার মত কাজ করছে । যেন আমি এখানে আসব , বসব , সময় কাটাব –এইটাই স্বাভাবিক ।

চোখ থেকে রোদ চশমাটা খুলে নিয়েই আমি মাথায় উঁচু করে বাঁধা চুলগুলোকে মুক্ত করে দিলাম । বাড়ী থেকে বের হবার সময় চুল না বেঁধে আম্মু কখনোই বের হতে দেয়না , অথচ আমার খোলাচুলই বেশি পছন্দ । আমার যা পছন্দ তার সবকিছুই আম্মুর অপছন্দ । রোদের মাঝে রোদ চশমা পরব – তাতেও তার আপত্তির শেষ নেই । খোলাচুল , রোদ  চশমা , গডগড করে হাঁটা অথবা দ্রুততা – এইসব উচ্ছলতা আর চাঞ্চল্য মেয়েদের নাকি মানায় না । মেয়েদের অস্থির হলে চলবেনা , তাদের হতে হবে নরম স্বভাবের , শান্ত- শিষ্ট এবং খুব সম্ভব হলে লেজবিশিষ্ট !

এমন কোমলমতি মা আমার হাজারো শাসন দিয়েও কেন যেন আমাকে জাতে উঠাতে পারেন নি - আর এই কারনে তার যতটা না আহাজারি এর চাইতে আমার আফসোস খানিকটা হলেও বেশি ।  একটা মায়াহরিনের জন্ম যদি সুন্দরবনের বদলে মিরপুর চিড়িয়াখানাতে হয়ে যায় তাহলে মুক্তবনের জন্য তার যেমন প্রতিমুহূর্তে আফসোস হতে থাকে , আমার আফসোসের লেভেলটা ঠিক সেইরকম ।   যা অথবা যা কিছু থেকে আমার আম্মু আমাকে বিরত থাকবার জন্য সেই শিশুকাল থেকে বিপদসঙ্কেত দিয়ে আসছেন , কোন এক অদ্ভুত গ্র্যাভিটেশনের কারনে ওইসব নিষিদ্ধ জিনিসপাতির উপর আমার অতিমাত্রায় আকর্ষণ । অহর্নিশি মায়ের শাসনে বাঁধা পড়ে আর সেই বাঁধা ভেঙ্গে টাঙ্গাইলের এই ছোটখাট এলাকায় আমার শৈশব আর কৈশোর কেটে গিয়েছে ; বুয়েটে ভর্তি হওয়ার কারনে ইদানিং শুধুমাত্র ছুটি কাটাতেই বাড়িতে আসা হয় । এই যেমন এখন পরীক্ষা শেষ -তাই বেশ বড় সাইজের একটা ছুটি পেয়ে গেছি আর সেই ছুটি কাটাতেই আমি তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ীতে চলে এসেছি । হ্যা, ছুটি কাটাতেই এসেছি বটে - আমার মত ছটফটে একটা মেয়ে কারো মায়া থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা ভাবতে আমার ভাল লাগছেনা , একটুও ভাল লাগছেনা ।

এতদিন বাদে ঢাকা থেকে বাসায় এসেছি ,কোথায় সবার সাথে আনন্দ করে নিজেকে ফিরিয়ে আনব তা না ! বাসাতেও কিনা রক্ষা নেই আমার , সকাল থেকে শুরু হয়েছে মায়ের আহাজারি - ঢাকায় গিয়ে আমি নাকি পুরোপুরিই উচ্ছন্নে গিয়েছি, জিন্স ছাড়া ড্রেস কিনছি না , ব্যাগে শুধু ডিপার্টমেন্টের টিশার্ট - এই হ্যান এই ত্যান - একারনেই আমাকে ঢাকায় না পাঠিয়ে বাসার কাছাকাছি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলেন ; অভিযোগের তো শেষ পাইনা ! আম্মুর এত কথার অবশ্য কোন জবাব আমি দেইনি , শুধুমাত্র মধ্যমস্তিস্কে যখন গরম লাভার উপস্থিতি আবিষ্কার করেছি তখন রান্নাঘরে গিয়ে কাঁচের একটা জগ আর আমার কফিমগটা খুব ঠান্ডা মাথায় সর্বোচ্চ কম্পনে ভেঙ্গে রেখে এসেছি- আর কিচ্ছু না !   

আপনমনে গজগজ করে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা এক মুহূর্তে শেষ করতেই আমি দেখলাম পাশের ভদ্রলোক তাঁর মুখের সামনে থেকে পেপারটা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । ভদ্রলোককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে , আমার এতক্ষনের নীরব আস্ফালন দেখে তিনি চুপিচুপি হাসছিলেন –আচ্ছা পাঠকের সাথে রহস্য না করে বরং বলেই দিই , এই মানুষটি আমার বাবা । 
“কি  ? ভীষণ রাগ নাকি ?”  
আমি বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম , “ জি না ,গামলা গামলা আনন্দে আমি মারা যাচ্ছি ।’’  
বাবা চোখ নাচিয়ে বলল ,“ তা আম্মুজান , তোমার এরকম বিপজ্জনক আনন্দের উৎস কি কোন ছেলে ? বাসায় এসে শুধু কি তাকেই মনে পড়ছে ?” 
আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম , “ বাবা ! ” 

বাবা জোরেজোরে  হাসতে লাগল আর আমি চুপ করে  বাবার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকলাম । আম্মুর উপর রেগে আছি, কেন যে আম্মুটা কিছু বোঝেনা ! এই যে এত বকে , তবুও তো ঢাকায় গিয়ে শুধু আম্মুকেই মনে পড়ে । যখন থেকে কোন এক ভাষাহীন যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে শেখা শুরু করেছি তখন থেকেইতো শুধু আম্মুকে মিস করেই মাঝরাতে নিয়ম করে কাঁদি ; তবু কেন বোঝেনা আমার আম্মুটা ? এত সাধ করে মেয়ের নাম আলো রেখেও কেন সে কেবলই আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায় ,  আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা । তবে ছোট থেকে এখন পর্যন্ত আমি আমার সব কাজে যার একান্ত সাপোর্ট পেয়েছি সেই মানুষটা আমার বাবা ; কখনো বা যদি মনের ভুলে ভুল করতে যেতাম তবে বাবা একদম পাশে থেকে আমাকে শুধরে দিয়েছে । আর মায়ের সামনে আমাকে শাসনের সেই চিরায়ত অভিনয় । আমার আর বাবার সব প্ল্যানের ঘটনাস্থল তাই রফিকমামার এই চায়ের দোকান - সেই ছোট থেকে এখন পর্যন্ত এই দোকানটাই আমার আর বাবার মিটিং স্পট । বাবা আর মেয়ের এই গোপন কথা আমার সাবধানী মা কোন দিনই ধরতে পারেন নি ।

পাঠক হয়ত এতক্ষনে মুচকি হেসে ভাবছেন , বাবা- মেয়ে না জানি আজকে আবার কি প্ল্যান করতে মিটিং বসালো , তাই তো ? সত্যি বলতে কি , বাবার সাথে আজকে এই সময়ে দেখা করবার পেছনে আমার কোন প্ল্যান নেই , তবে হ্যা- একটা কারন অবশ্য আছে । আর পুরো ব্যাপারটাই আমার বাবার পিচ্চিকালের বন্ধু শওকত চাচাকে নিয়ে । কয়েকদিনের স্ট্রেসে তাল হারিয়ে কাল যখন রান্নাঘরে গিয়ে উচ্চমাত্রার ভাংচুর করে নিজের ঘরে এসে নিম্নমাত্রায় কান্নাকাটি করছিলাম , বাবা সেই মুহূর্তে আমার মন ভাল করতে ঠিক কি করবেন বুঝতে না পেরে তাঁর বন্ধুর চিরায়ত অদ্ভুত স্বভাবের বর্তমান অবস্থার গল্প বলা শুরু করলেন । আর সেই গল্প শুনেই আমার আজকে বাসা থেকে বের হওয়া । আমার বাবাটা কিভাবে যেন বুঝে গেছে আমার ভেতরে একটা কিছু ভীষণ ভাবে উল্টেপাল্টে গেছে – আমি ভয়ে আছি , ভদ্রলোক কবে না জানি এই ব্যাপার নিয়ে জিজ্ঞেস করে আমাকে !

যাই হোক, শওকত চাচা আমাদের খুব আপন একজন মানুষ । আমাদের এলাকায় হাতে গোনা কিন্তু হোমড়াচোমড়া ব্যক্তিদের একজন হলেন তিনি – তাঁর বিশাল ব্যবসা , ব্যাপক টাকা পয়সা কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি বড্ড অদ্ভুত স্বভাবের । খুব ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি শওকত চাচার রসবোধটা কেমন যেন আলাদা রকমের – মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই তিনি বিশাল রসিকতার উৎস হয়ে দাঁড়ান । উৎসাহী পাঠককে চাচার অদ্ভুত স্বভাবের ইঙ্গিত বুঝাতে আমার অবশ্য একটা ঘটনা বলাই যথেষ্ট , সেই ঘটনাটিই তাহলে শোনানো যাক । এইবার চেয়ারম্যান ইলেকশানে আমাদের শওকত চাচার ইচ্ছে হল তিনি প্রার্থী হবেন – তো তিনি খুব কোমড়ে গামছাটামছা বেঁধে বেশ সিরিয়াস প্রার্থী হয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন ।ইদানিংকালে টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচলিত ফ্রুটিকার বিজ্ঞাপন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চাচা করলেন কি- আমাদের পুরো এলাকার মানুষের হাতে হাতে ফ্রুটিকার বোতল ধরিয়ে দিলেন এবং অতি উচ্চ লেভেলের আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন ,“ভাইয়েরা আমার , ফ্রুটিকা খেয়ে ভেবে দেখেন , চেয়ারম্যান হিসেবে কে যোগ্য – মূল্যবান ভোটটা তাকেই দিয়েন ।” মানুষজন ফ্রুটিকা নিল, খেল , খেয়ে ভেবেও দেখল এবং ফলাফল হল - শওকত চাচা তাঁর এপিক লেভেলের ভাবসমেত বিশাল ভোটের ব্যবধানে ইলেকশানে ফেইল মেরে গেলেন । এহেন দুর্ঘটনার পরে চাচার প্রতিক্রিয়া ছিল– “ মানুষের মধ্যে থেকে কৃতজ্ঞতা উইঠা গেছে ,বুঝলা আলো ? আত্মা থেকে কৃতজ্ঞতা নাই হয়ে গেছে !’’

তো পাঠক বুঝতেই পারছেন , এই হল আমাদের শওকত চাচা ! ইদানিং নাকি তাঁর মাথায় ভুত ঢুকেছে যে তিনি নিজের পোট্রেট ( চাচার ভাষায় তৈলচিত্র !! ) করাবেন । ঢাকা থেকে তিনি নাকি মোটা টাকার বিনিময়ে আর্টিস্টও ডেকে নিয়ে এসেছেন , এমনকি পোট্রেট আঁকানোর জন্য নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা , কাশ্মীরী শাল পর্যন্ত কিনেছেন । এই গরমের মাঝে শাল গায়ে দিয়ে কিভাবে তিনি মডেল হচ্ছেন সেই কাহিনী চাক্ষুষ দেখার লোভ আর আমি সামলাতে পারিনি ,তাই সেই দৃশ্য দেখতেই বাবার সাথে বের হওয়া ! এইরকম একটা দৃশ্য কি মিস দেওয়া উচিত , পাঠক আপনারাই বলুন ?

২.  
শওকত চাচার আলিশান বাড়ির প্রতিটা কোনাতে খুব ছোটবেলা থেকেই আমার ছুটাছুটি । বাড়িতে ঢুকেই তাই বাবাকে পেছনে রেখে আমি চাচাকে খুঁজতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম । মাঝপথে চাচীর সাথে দেখা – চাচী দীর্ঘ দেড়মিনিট আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন ছাড়লেন , আমি উত্তেজনা চেপে বললাম , “ চাচা কই, চাচী ?”
চাচী ভ্রু কুঁচকে বলল , “ ও ! তুমি তাইলে তেনার রঙ্গো দেখতে আসিছো ? বারান্দার পাশের ঘরে যাও ।’’  আমি ঐদিকে পা বাড়াতেই শুনলাম চাচী বিড়বিড় করছে , “ বুড়াকালে ভিমরতি ! যত্তসব মরন আমার !!”

আমি হাসি চাপতে চাপতে বারান্দার পাশের রুমে গিয়ে দেখি , শওকত চাচা আরএফএল খানদানি চেয়ারের উপর বেশ আয়েশ করে বসে আছেন – পরনে গরদের উপর কাজ করা পায়জামা পাঞ্জাবী , কাধ থেকে মোটা শাল ঝুলছে এবং যথারীতি চাচা হাঁসফাঁশ করছেন । আমাকে দেখেই চাচা হাত বাড়িয়ে ডেকে বললেন , “ আয় রে মা, কাছে আয় । ভাল আছিস ? কবে আসছিস বাড়িতে ? ”

আমি চাচার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করে বললাম , “ কি অবস্থা চাচা ? শুনলাম পোট্রেট আঁকাচ্ছ ,তা বেশ কিন্তু এই গরমে ফ্যান বন্ধ রেখে হাপাচ্ছ কেন ? ”

চাচা করুন মুখে বলতে লাগলেন , “ বলিস না আর ! আমার ভাইগ্না আরাফকে বলছিলাম শহর থেকে শিল্পী পাঠাতে – তৈলচিত্র করাব । হারামজাদা পাঠায় দিছে তার এক বন্ধুরে – যার কিনা রঙ সং ঢঙ্গের কোন সীমাই নাই ! ফ্যান ছেড়ে কাজ করেনা , আমি একবার নড়লে দশবার রাগ হয় । ছবি আঁকার মাঝে হঠাত হঠাত উধাও হয় , চায়ের সাথে সিগারেট খায় – কত যে কি ! ”

আমি হাসি চেপে বললাম , “ চাচা , আর্টিস্টরা একটু এমনই হয় । তোমার ভাল না লাগলে না করে দাও ।”
“ সে ভাল তৈলচিত্র করে বলেই চুপ আছি ,বুঝলি ? কাজ পছন্দ হচ্ছে আমার ।”

আমি ঘুরে ঘুরে চাচার পোট্রেটের দিকে তাকাতে লাগলাম , “হু কেবল তো শুরু করেছে– পুরো কাজটা শেষ হলে খারাপ হবেনা বোধ হয় ! কিন্তু চাচা তোমার আর্টিস্ট কোথায় ? ”

চাচা মুখ উলটে বললেন , “ ওই যে বললাম না ? উধাও !”

আমি হাসতে লাগলাম । আমার হাসি দেখে চাচা বলতে লাগল , “ আরো শুনবা ? জীবনে প্রথম তৈলচিত্র করাব , একটু ভাব নিতে হয়না ? তাই  আমার আব্বার বাক্স থেকে জিন্নাহ টুপিটা বাইর করে মাথায় দিয়ে চেয়ারে বসছিলাম – আর সেই ছেলে ব্রাশ হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকায় আছে তো তাকায়ই আছে । আমি বললাম , কি হইছে বাবা ? কোন সমস্যা ? ছেলে গজগজ করতে করতে বলে কি – আপনি যে রাজাকার সেইটা তো আরাফ আমাকে বলেনাই ! আমি তো রাজাকারের পোট্রেট করিনা , ইমপসিবল ! শেষমেশ আমি টুপিটা ডাস্টবিনে ফেলানোর পর সে আঁকতে বসছে ! বল তো মা , আমি নাকি রাজাকার ? ভাব নিছিলাম একটু ...”

আমি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলাম । হঠাত ফ্যানের সুইচ অফ করার শব্দে আমি টের পেলাম , ঘরে অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে । মাথা ঘুরিয়ে দেখতে নেব ঠিক এমন সময় চাচা একদম স্বর পালটে মাখন গলায় বললেন ,
“ এই যে আলো , আমার  আর্টিস্ট এসে গেছে । আর্টিস্ট আসো আসো , এইটা আমার ভাতিজি – আলো ।”
আমি একটু আবছা চোখে অদ্ভুত পাগলাটে  সেই আর্টিস্টের দিকে তাকালাম । একবার তাকাতেই কি যেন এক বিস্ময় এসে আমার পুরো শরীরে খেলা করে গেল । আমি একইসাথে হতভম্ব এবং বিস্মিত চোখে দেখতে লাগলাম তার এলোমেলো চুল , অসংলগ্ন পোশাক , বাদামী চশমা আর রাজ্যের রহস্য দিয়ে আঁকা তার অসম্ভব মায়াবী চোখদুটোকে । আমার এরকম বিচ্ছিরি দৃষ্টির সামনে সেই পাগলা আর্টিস্ট তার চশমার আড়ালে একবার শুধু দুষ্টুমিরাঙ্গা চোখ নাচিয়েই রংতুলিতে মন দিল । আমি আর সেখানে থাকলাম না ,চাচাকে কোন রকমে বিদায় জানিয়ে প্রায় ছিটকে বের হয়ে আসলাম ঘর থেকে । ফেরার সময় কোনমতে বাবাকে বললাম , বাড়িতে যাচ্ছি আমি  । 

বাড়ী ফিরে মায়ের প্রশ্নবিদ্ধ চোখের সামনে দিয়েই নিজের ঘরে এসে হাঁপাতে লাগলাম । এইটা কাকে দেখলাম আমি ? যার কাছে পালাতে চেয়ে এক্সাম শেষ হতেই আমি টাঙ্গাইল চলে এসেছি , সেই ছেলে এখানে কেন এসেছে ?
আমি অসহায়ের মত ভাবতে লাগলাম - বাংলাদেশে এত জায়গা থাকতে কুশল কেন এসে জুটেছে এখানে ? কেন এসেছে কুশল ?

৩ . 
কুশলকে আমি প্রথম দেখেছিলাম তিনবছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈশাখী মেলার জন্য আলপনা আঁকতে গিয়ে – এলোমেলো এই কেমন কেমন ছেলেটা সেদিন আমার গায়ে আধা মগ রঙ ফেলে দিয়েছিল । ভুল করে রঙ ফেলে দিয়েছে , কোথায় সে মুখ কাচুমাচু করে ‘ দুঃখিত’ বলবে তা নয়, উলটো আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে ছেলেটা হাসতে শুরু করেছিল । হাসি শেষে আমাকে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেছিল, “ এত কটমট করার তো কিছু নাই । রঙকে এত ঘৃণা কেন ?”

এই রাতের বেলায় রঙ উঠাতে গোসল করতে হবে ভেবে রাগে রীতিমত আগুন লাগছিল নিজেকে  , খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি – যান না , রংকে ভালবেসে নাকে মুখে রং লাগিয়ে সং সেজে বসে থাকেন গিয়ে , যান ! কিন্তু তখনই শুনলাম সে বলছে ,

“ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ,আমি দুঃখিত ! কি , ফার্স্ট ইয়ার নাকি ?”

বুঝলাম , ব্যাটা সিনিওর – নাইলে এত ভাব নিয়ে প্রশ্ন করত না । মাথা নেড়ে হ্যা বলে ওই ভাবওয়ালার সামনে থেকে চলে এসেছিলাম সেদিন ।

পরদিন বৈশাখী উৎসবেও তাকে দেখলাম , গলায় ডিএসএলআর লাগিয়ে উসকোখুসকো চুলে ঘুরে বেড়াতে । জানিনা , কেন যেন ইচ্ছে করছিল , ভদ্রলোককে একটা চিরুনি গিফট করি - চুলে কতমাস চিরুনি লাগায়নি কে জানে ! তারপর ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতেই হঠাত একসময় খেয়াল করে দেখলাম , আশেপাশে বড় আপুরা কি সুন্দর শাড়ি পরে সেজেগুজে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাকে – ভাব বিসর্জন দিয়ে ভদ্রলোক সবার ছবিই তুলে দিচ্ছেন, মাঝেমাঝে নিজেও মডেল হচ্ছেন ! বুঝে নিলাম , তিনি আমাদের ক্যাম্পাসের  “লুল”  ক্যটাগরির সেলেব্রেটি টাইপ মানুষ – যদিও তখন আমি তার নাম , ডিপার্টমেন্ট আর ব্যাচ কিছুই জানতাম না । 

পরবর্তী দুই তিন মাসের কথা আমি বরং বাদ দিই । উৎসাহী পাঠকের উদ্দেশ্যে শুধু এতটুকু বলছি যে, বুয়েট ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কল্যানে এই মহীয়ান পুরুষকে আমি খুব ভালভাবে চিনতে পারার সুযোগ পেয়েছিলাম । জানতে পেরেছিলাম , তার নাম কুশল এবং সে আর্কিটেকচারের ছাত্র ।  ছেলেটাকে ভালকরে চিনবার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই বলছি , এই ব্যক্তিত্বের মত ‘বিখাউজ’ লেভেলের ব্যক্তিত্ব আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি । পাঠক হয়ত মাথা চুলকে ভাবছেন , বিখাউজ লেভেলের ব্যক্তিত্ব আবার কি ধরনের জিনিস , তাইতো ? আচ্ছা আমিই বলছি, পুরো একটা মাস ধরে যে ছেলে কিনা তার আধাময়লা টিশার্টটি পুরোপুরি ময়লা হবার পরেও নিতান্তই কিছু আলসেমির কারনে ধুয়ে দেবার প্রয়োজন মনে করেনা অথবা যে ছেলেটি কিনা বাজি ধরে একবারে দশটা সিগারেট টেনে দশদিন যক্ষ্মা রোগির মত কাশতে থাকে অথবা যে ছেলেটি কিনা সারারাত ধরে মুভি দেখবার পর সকালে বাস ধরবার জন্য দাঁত না মেজেই বাসা থেকে বের হয় এবং সকলের কানের কাছে মাইক লাগিয়ে তার এই কৃতিত্বের খবর প্রচার করে – তাকে ‘ বিখাউজ’ গ্রুপ ব্যতীত অন্য কোন গ্রুপে স্থানান্তর করা যায় কিনা সেই ব্যাপারে পাঠক চাইলে এই মুহূর্ত থেকেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিতে পারেন !

ছবি তুলবার এক বাতিক থেকেই কুশলের সাথে আমার পরিচয় –এখানেই যেমন দেখেছি সে কি প্রচণ্ড অগোছালো এবং ভাবলেশহীন এক তরুন , ঠিক তেমনি এখানেই জেনেছি সে কি অসাধারণ একজন আর্টিস্ট এবং ফটোগ্রাফার । মাঝেমাঝেই ছেলেটা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার পাশে বসে কথার তুবড়ি ছোটাত এবং ঠিক একইভাবে কোন বিদায় না জানিয়েই সে ফুট করে উধাও হয়ে যেত । তার এই হুটহাট আসা যাওয়াটা প্রথম প্রথম নিজের কাছে আজব লাগলেও একদিন আমি হঠাত করে আবিষ্কার করি , আমি ক্যাম্পাসে উদাসীনভাবে বসে থাকি শুধুমাত্র কখন সে হুট করে চলে আসবে সেই প্রতীক্ষায় । তারপর একসময় নিয়মিত সকালে ঘুম ভেঙ্গে ফেসবুকে গিয়ে আমি আমার ইনবক্সে তার মাঝরাতের বিচরন আবিষ্কার করতাম । রাত তিনটা চারটা বাজে হঠাত হঠাত এই ছেলে প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রভাষা হিব্রুতে টেক্সট দিতে বেশ পছন্দ করত , যদিও বেশিরভাগ টেক্সটই প্রথমপ্রথম আমি বুঝতে পারতাম না । তার টেক্সটগুলো হত অনেকটা এই টাইপের– “আচ্ছা আলো , রাতের আঁধারেরা এত ভয়ংকর সুন্দর হয় কেন যে আমার ক্যামেরার লেন্স তা ধরেই রাখতে পারেনা ?” অথবা ,“ আলো ,তারার আলো খেতে অনেক সফট হয় । আমি খাচ্ছি , তুমি খাবা ?”  সে রাত জেগে এসব টেক্সট করত আর আমি সকালে তার টেক্সটের দিকে চেয়ে হিপ্নোটাইজড হয়ে যেতাম – একদিন দুইদিন , এভাবেই কাটল অনেকদিন । তারপর একদিন এই ছেলেটার আমাকে হিপ্নোটাইজ করার ক্ষমতা  এতটাই ভয়াবহ হয়ে গেল যে আমি রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে এফবিতে বসে থাকতাম তার একটা পাগলাটে মেসেজের জন্য – কিন্তু পাজি , বদমাশ , অসভ্য ওই ছেলে তখন  ভ্যাম্পায়ারের মত আমার ঘুম শুষে নিয়ে নিজে ঘুমিয়ে থাকত । অতঃপর একদিন আমি মাথা চাপড়ে চাপড়ে মেনে নিতে বাধ্য হলাম , আমি আর আমার মধ্যে নেই । একদমই নেই । আমি ভেঙ্গে চুড়ে গুড়োগুড়ো হয়ে ওই বেতমিজ বেলেহাজ ছেলেটার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি ।  

আমি জানতাম না , আমার জন্য কি বিশাল একটা শক এগিয়ে আসছিল । কিন্তু সেই শকটা যখন এসেই গিয়েছিল তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম , আমার ভেতর থেকে কুশলের মায়া কাটানো ছাড়া আমার আর ভিন্ন কোন উপায় নেই । শকটা প্রথমে পেয়েছিলাম তার নাম শুনে – জি পাঠক , আপনি ঠিকই দেখছেন  - আমি যেদিন  জানতে পেরেছিলাম , তার পুরো নাম এন্টোনিও গোমেজ ; আমি যেদিন জানতে পেরেছিলাম সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে চার্চে গিয়ে -  আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমার গুড়ো হয়ে যাওয়া অস্তিত্বটাকে ইন্টিগ্রেট করে আবার আগের মত করে আনতে হবে । বিশ্বাস করুন পাঠক, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি , নিজেকে অনেকখানি হয়ত গড়েছিও –কিন্তু নিজের যে অংশটাকে আর খুঁজে পাইনি সেইটা আমার হৃৎপিণ্ড, বেয়াক্কেল হৃৎপিণ্ড আমার জাত ভুলে কুশলের কাছেই থেকে গিয়েছে । তবে দুইটা হৃৎপিণ্ড নিয়ে কুশলের ব্লাড সার্কুলেশন এখন কেমন চলছে সেইটা জানতে মাঝমাঝেই আমার ভীষণ ইচ্ছে করে । 

এই হল আমার মাঝে জমাট বাঁধা কুশল রহস্য । অনেকদিন ধরে নিজেকে ফেসবুকের জগত থেকে ‘নাই’ করে দিয়েছি – তার টেক্সটের রিপ্লাই না দেওয়াটা আমার পক্ষে অসম্ভব ,আর এই অসম্ভব সম্ভব করতেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি –বাসায় ফিরে গা ঢাকা দিয়েছি । কিন্তু আজকে শওকত চাচার বাসায় আবার তাকে দেখে আমার চেপে রাখা বিচ্ছিরি রকমের ভালবাসা ভালবাসা টাইপ আবেগগুলোর আবার হাত পা গজানো শুরু করে দিয়েছে । এই মুহূর্তে আমার ঠিক কি করা উচিত সেটা বুঝতে না পেরে আমি হঠাত করেই আবিষ্কার করলাম আমি কাঁদছি – ভালবাসতে পারে আর কাঁদতে  পারেনা, এইরকম মানুষ পৃথিবীতে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব ? আমার মনে হয়না ।  

হঠাত কাঁধে কারো হাত অনুভব করতেই বুঝে ফেললাম , বাবা এসেছে । আমি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে মুখ হাসিহাসি করার চেষ্টা করলাম । বাবা বলল , “ হয়েছে । কান্না কান্না চেহারা নিয়ে আর হাসি দিতে হবেনা ।”
আমি আমতা আমতা করে বললাম , “ ধুর বাবা কি বল ? কিসের কান্না ? ”

“ ঘটনা কি ? জানতে ইচ্ছে করছে ।”

আমি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গীতে বললাম  , “ ধুর কি ঘটনা ,কিছু না । ”

বাবা চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলল , “ নায়ক যে পাগলা আর্টিস্ট সেইটাতো বুঝলাম , কিন্তু সমস্যাটা কি ? আমার তো ছেলেটাকে পছন্দ পছন্দই লাগল ।”

আমি কান্না আটকাতে  ঠোঁট কামড়ে বললাম , “ বাবা, ও খ্রিস্টান – মা  কোনদিন জানলে অজ্ঞান হয়ে যাবে ।”

বাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল , তারপর আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । আমি বুঝতে পারলাম , আমার বাবাটার কিচ্ছু করার নেই ।

৪.
“ কারো চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারো ,আলো ?”
প্রশ্নটা শুনে একটু হকচকিত হলেও কেন যেন মাথাটা তুলে সোজা তার চোখের দিকে তাকালাম । মায়া মায়া কাল চোখদুটো ছিল কুশলের ।
“ ভাল মেয়ে । এবার বল, এভাবে ‘নাই’ হয়ে যাবার মানেটা কি ?”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম , “ মানে নেই ।”
“আছে । অবশ্যই আছে । ”

আমাদের বাসার পেছনে একটা খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা , সময়টা সন্ধ্যার কাছাকাছি । দমবন্ধ করা কিছু অনুভূতি নিয়ে পার করা দিনগুলো শেষ হয়ে আবার বুয়েটলাইফে ফিরে যাবার দিন এগিয়ে আসছে । তাই একাএকা কিছুটা সময় বাসার পেছনে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম , একদম হঠাত করেই তখন কুশলের সাথে দেখা ।

দমকা একটা বাতাস এসে কুশলের এলোমেলো চুলগুলো যখন আরো এলোমেলো করে দিচ্ছিল ,আমি তখন সেদিকে চেয়ে বললাম ,“ আমার নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তরইতো আমি জানিনা ,আপনার প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দিব ?”
কুশল শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল , “ আলো , তুমি কি জানো দুইটা মানুষ কখন কিভাবে একটা সুতায় বাঁধা পড়ে যায় ? সুতার একপাশ থেকে টান পড়লে যে অন্যপাশ থেকেও তা অনুভব করা যায়, সেইটা কি তুমি বুঝো ? ”     

“ এসব বুঝে আমার কোন লাভ নেই । আমি আর কিচ্ছু বুঝতে চাইনা ।”       

“কিন্তু আমি অনেক কিছু জেনে গেছি । ওই যে সুতার টান ! যাকগে , আমার এখানে চলে আসাটা যদিও কোইন্সিডেন্স – কিন্তু তা না হলেও তোমাকে আমার খুজে বের করতেই হত । আচ্ছা আলো, ঋণের বোঝা আর ভালবাসার বোঝা দুইটা কি একই রকম ভারী ?”     

আমি নাক টেনে বললাম , “ জানিনা – আমিতো আপনাকে কোন বোঝা দিয়ে যাইনি । ”

“ আমি ইচ্ছা করেই নিয়েছিলাম । তোমাকে কিছু দিতে এসেছি । তুমি হয়ত জানোনা আমি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি তোমাকে এসব দেবার জন্য ”, এই বলে সে তার ব্যাগ খুলে রোল করা একটা কাগজ আর মাঝারি সাইজের একটা ডায়েরি বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল । কাগজটা খুলে দেখলাম সেখানে আমার একটা স্কেচ আঁকা , বুকের মাঝখানটাতে কেমন যে লাগছিল বোঝানো যাবেনা – তারপরেও কি বিজ্ঞান বলবে , হার্টের কাজ শুধু রক্ত সঞ্চালন করা ?

আমি ছলছল চোখে কুশলের দিকে তাকাতেই সে বলল ,

“ মনুষ্যপ্রজাতির মাঝে তোমার আর আমার মত চিপায় পড়া কিছু স্টুপিড থাকে জানো- তারা ভালবেসে সব হারানোর ভয়ে ভালোবাসার মানুষের কাছে থেকে পালিয়ে বেড়ায় । আমরা অনেক ভীতু , আলো, অনেক ভীতু । আমাদের বড় ভয়টা আমাদের পরিবার- এই ভয়টার মূলেও কিন্তু পরিবারের মানুষগুলোর জন্যে ভালবাসা ।  যদিও আমার বাবা ছাড়া কেউ নেই পৃথিবীতে ,কিন্তু তোমারতো সব আছে । আমাদের ভালবাসাটা নাহয় পূর্ণতা পাবেনা কিন্তু আপনজনদের কষ্ট না দেওয়াটাও পরম ধর্ম ,আলো । সেটা তোমার ধর্মও বলে , আমার ধর্মও বলে ।”

আমি হঠাত করে কেন যেন আবিষ্কার করি আমার দুনিয়াটাই ভেঙ্গে যাচ্ছে , কুশলের আঁকা ছবিটা আর ডায়েরিটাকে আঁকড়ে ধরে আমি ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকি ,
“ তুমি কেন আসছিলা আমার লাইফে ? কেন আসছিলা ?”     
 
“সেইম কোশ্চেনটা তোমাকে করি ? লাভ নেই, আলো ,কোন লাভ নেই ।”  কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল , “  কেন যে আমরা দুঃসাহসী হতে পারিনা , কেন যে পারিনা ! ”   এইটুক বলেই  ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াল । সে চলে গেল , আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ।

সেদিন সারাটা রাত আমি টেবিলে কুশলের আঁকা ছবিটা নিয়ে বসে ছিলাম । ওর ডায়েরিটা খুলে পড়েছিলাম ওর জীবনের প্রত্যেকটা পাতাকে –যে ডায়েরির শেষটুকু শুধুই আমাকে নিয়ে লেখা । কি অদ্ভুত আমরা ! দুইজন দুইজনের জন্যে মরে যাচ্ছি , তারপরেও একসাথে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র সাহস দেখাচ্ছি না ।

ডায়েরির একদম শেষ পাতায় গিয়ে আটকে গেলাম কিছু কথার সাথে , কুশল লিখেছে - “ আলো , নিজেকে একবার চেষ্টা করে দেখবার সুযোগতো দেয়াই যায় ,তাইনা ? নিজেকে দুঃসাহসী হতে না দিয়ে পারছিনা যে ! কাল বিকেলের ট্রেনে ঢাকায় যাচ্ছি – কালকে থেকেই তোমার হাত ধরার সুযোগটা কি দেবে ? জানি এটা পাগলামি  , আর তোমার কাছে অর্থহীন লাগলে শেষপাতাটা  না হয় ছিড়েই ফেলো । ” আমি অন্ননালী বেয়ে উঠে আসা কান্নাটা ঢোঁক গিলে নামিয়ে বন্ধ করে দিলাম ডায়েরিটা ।

সেদিন কতরাতে ঘুমিয়েছি মনে নেই তবে সকালে চোখ মেলে দেখি ঘুম থেকে উঠতেই দশটা বাজিয়ে ফেলেছি । কোনমতে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখি আম্মু থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে – অবশ্য আমার যেকোনো কাজেই আম্মুর মুখ থমথমে হয়ে থাকে । আমি চেয়ার  টেনে বসে ভাবতে লাগলাম কি ব্যাপারে আম্মু আমার উপর রেগে থাকতে পারে । আস্তে ধীরে নাস্তা শেষ করে যখন আমি উঠতে যাব  তখনই আম্মু বলল ,
“ আমার জন্য তোমাদের বাপ -মেয়ের মনে কোন জায়গা নাই , তাইনা ? ”  

আমি ভ্রু কুঁচকে আম্মুর দিকে তাকালাম , “ কি বলতেছো আম্মু ? মানে কি ?”   

“মানে বুঝনাই ? মানে না বুঝলে আমাকে কষ্ট দিয়ে এইসব কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি ? তুমি কি ভাবছ আমি কুশলের কথা জানিনা ? ”  

আমি বুঝলাম ,এখন কোন অজুহাত দিয়ে  অস্বীকার করে আসলে কোন লাভ নেই – শুধু বললাম ,

“ জেনেছই যখন তখন আর আমাকে জিজ্ঞেস করে কি হবে ? ” 

“ ছেলেটা খ্রিস্টান তুমি আগে থেকেই জানতে না ?”  

“না” ,একটু থেমে আবার বললাম ,“ জানলেও কি এই ক্ষতি আটকাতে পারতাম ! তবে ভয় কইরোনা আম্মু । আমার লাইফে তুমি কুশলকে দেখবানা কখনো , কিন্তু তবু ওকে নিয়ে আমার ফিলিংসটাকে প্লিজ অসম্মান কইরোনা  আম্মু ,প্লিজ না ।”  

আম্মু দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল , “ অসম্মান তো তুমিই করছো  , করছো না ?”  
আমি বুঝতে পারলাম না , “আমি ?”  
“ হ্যা তুমি – তোমার ধারনা তোমার আম্মু এত খারাপ যে মেয়ের কোন অনুভূতি বুঝবেনা ?”

আমি কিছু বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে আছি – আম্মু কি তামাশা করছে আমার সাথে ? হঠাত আম্মু কুশলের ডায়েরিটা আমার হাতের কাছে রেখে বলল , “ এসব ডায়েরি মানুষজনের চোখের সামনে রাখবা আর মানুষজন কিছু জানবেনা ? তাছাড়া তোমার বাবাও আমাকে সব বলেছে । এখন হা করে না থেকে গোছগাছ কর যাও , বিকালের ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছ তুমি । আর সামনের মাসে আমি আর তোমার বাবাও আসছি । ”  
আমাকে হা করে থাকতে দেখে আম্মু আবার বলল , “ ভালবাসায় আবার ধর্ম কি ? সারাজীবন ধর্ম মেনে চলেছি ,ধর্ম কাউকে অন্ধ করেনা সেটা জেনে রাখিস !”  

আমি চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম , কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম ,“ আই এম সরি আম্মু । আমি তোমাকে সত্যিই এতদিন বুঝিনাই ।”   

আমাদের আবেগের মাঝে আমার বেরসিক বাবা হঠাত করেই ডায়েনিং রুমের দরজা থেকে মাথা বের করে বলল , “ এতবছরে আমিই বুঝিনাই । তুই আর কি বুঝবি ?”

৫ .
ট্রেইনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ব্যাগ বোচকা নিয়ে – আসার সময় আম্মু ট্রেনে খাওয়ার জন্য বাসায় বানানো অনেক খাবার দিয়ে দিয়েছে , যখন শুনেছে কুশলের মা নেই , তখন ওর জন্যে আরো বেশি করে  দিয়ে দিয়েছে । কিন্তু এই ছেলে এত দেরি কেন করছে ? একা একা এতকিছু নিয়ে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায় ?

হঠাত আমার কেন যেন মনে হল , ও কি সত্যিই আসবে ? ও যদি ভেবেই রাখে যে আমি আসব না ? আমি ভয় পাওয়া মুখে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি । ট্রেন ছাড়তে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি , স্টেশনে বারবার এনাউন্স করা হচ্ছে যে কিছুক্ষনের মাঝে গাড়ি ছাড়বে – আমার গলায় কান্না জমে আসছে   , কুশল কি তাহলে আসবেনা ?

ট্রেনের চাকা গড়ানো যখন শুরু হয়ে গেল  ,আমি আমার ঝাপসা চোখকে আর আটকাতে পারলাম না  -কুশল তুমি কেন আসলে না ?

---------------------------------------------------------------------

“ এত বিখাউজ কেন তুমি ?” দাঁত মুখ যতটা সম্ভব খিচিয়ে আছে আলো । কিন্তু কুশল হেসেই যাচ্ছে । আলো কুশলের শার্টের কলার খামচে ধরে বলল ,  “ হাসি পাচ্ছে ? হাসি পাচ্ছে তোমার ? আমি কত ভয় পাইছি জানো তুমি ?”
“কি করব ম্যাডাম! আমার জীবনে শোনা সবচাইতে মর্মান্তিক গালি ছিল এইটা ! ”
আলো কলার টানতে টানতেই বলল , “ আরো গালি শুনা তো বাকিই আছে তোমার । যা কাদাইছো আমাকে । ভালবেসে কোন লাভ আছে কষ্ট ছাড়া ?”

কুশল আলতো করে আলোর হাতটা ধরে বলে , “কোন লাভ নাই ?”
আলো মাথা নাড়ায় ,“না ।”

“ ঠিক আছে , আমরা না হয় দুজন মিলে ভালোবাসার ক্ষতিগুলোই গুনে রাখব , কি বল ?”

আলো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে কুশলের চোখের দিকে । এই ছেলের চোখের আঁধারে বিলীন হতে তার এত শখ কেন কে জানে?

āĻ•োāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāχ:

āĻāĻ•āϟি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āϟ āĻ•āϰুāύ