গল্প-"পুতুল কন্যা"
(Polok Hossain)
.
Part -11
.
উপমা প্রবন্ধর সামনে এসে দাঁড়ালো।প্রবন্ধর পাশে এসে জিজ্ঞাসু চোখে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ প্রবন্ধ বোঝে।
-কিছু বলবে!
উপমা নিচে তাকিয়ে বলল-
-কি খাইতে মন চায়!মা জিগাইসে!
-তোমার হাতে বানানো চা।
-আর... কি!
-তোমার হাতের দুই কাপ চা বানিয়ে আনো আগে, এরপর বলছি।
-দুই কাপ?
-হুম।এক কাপ আমার, আরেক কাপ তোমার।কেনো? তুমি চা খাও না!
উপমা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।সে খায়।
-নিয়ে আসো।আমারা দুইজন চা খেতে খেতে গল্প করবো।আমার সাথে গল্প করবে তো!
-হুম।
-চা তোমার হাতে বানাবে কিন্তু।তোমার হাতে বানানো চায়ের খুশবু অনেকদিন হয় নেই না।
উপমা আগের মতো করে প্রবন্ধর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দৌড়ে চলে গেল।
যাওয়ার সময় শুধু হাতের চুড়িগুলোর ছনছন আওয়াজ শোনা গেছে। ওকে এখন থেকে নুপুর পরিয়ে রাখতে হবে।তখন শুধু চুড়িই নয় নুপুরের আওয়াজও শোনা যাবে।
.
উপমা ব্যস্ত হয়ে রসুই ঘরে গেল চা বানাতে।মনের উত্তেজনায় কোনটা ফেলে কোনটা আগে করবে বুঝে পাচ্ছে না।একটু পর পর বলছে-মা..পাতিল কই,চিনি কই,চা পাতা কই।সবকিছুতে তড়িঘড়ি করছে।
.
প্রবন্ধ বিছানা থেকে উঠে পরলো।কাল এই গ্রামকে ছেড়ে ব্যস্ত জীবনে চলে যেতে হবে।
এর মাঝেই যতোটুকু সময় ছিল সেই সময়টায় সে অজানা অপ্সরী উপমাকে চিনেছে।মেয়েটার লজ্জাবতী চেহারার নিচে লুকিয়ে আছে হাজারও রুপ।এই রুপ হাসতে জানে,কথা বলতে জানে,জানে অনেক জাদু।এই কয়টা দিনে উপমাকে পুরোপুরিভাবে চেনা হলো কি না তাও এক রহস্য।হয়তো এই রহস্য আরও উদঘাটন করার আছে।তবে কাল বাড়ি গিয়ে সর্বপ্রথম কাজ হবে উপমাকে স্কুলে ভর্তি করানো।কে বলে বিবাহিত জীবনে শিক্ষা লাভ করা হাস্যকর!! প্রবন্ধ নিজে মেয়েটিকে পড়াবে।মেয়েটি শিক্ষিত হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে,ও নিজেকে চিনবে,নিজের মনের সকলভাবনাগুলো নিজে নিজেই আয়ত্তে আনতে পারবে।মেয়েটির কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর অর্থ হলো মেয়েটিকে বুঝতে দেওয়া যে প্রবন্ধ ওর কোনো প্রতিদন্দী নয়।কোনো পিশাচ পুরুষও নয় যে নিজ চাহিদা মেটাতে মেয়েটিকে ঘায়েল করবে।
উপমার হয়তো মন গলেছে,ভয় কেটেছে।উপমাও হয়তো জেনেছে এই পুরুষ তার জীবনের বিশেষ এক অংশ।যার সাথে সে তার জীবন কাটাচ্ছে।বয়স ওর কাচা।কাচা বয়সে প্রেম হয়,অনুভূতি হয়।কিন্তু এই বয়সটা এখনও অনেক কিছুই জানে না,সংসার করতে জানে কিন্তু মূল্য সে বোঝতে শেখে না।আর তা শেখার বয়স হয় ধীরে
ধীরে।বয়স গড়িয়ে যখন হয় আঠারো কিংবা উনিশে।এখন সময় ওর শিক্ষার ঘাটতি পূরণ করা,ওর ছোট ছোট আবদারে মিশে যাওয়া,ওকে নিজের মতো করে বুকে জড়িয়ে নেওয়া,ওর পাশে বন্ধুর মতো করে চলা,ওর চোখে চোখ রেখে দুষ্টুমির ছলে ওর মন কেড়ে নেওয়া, ওর বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেমানুষি করা,হাত বুলিয়ে ওর ছায়াকে স্পর্শ করা।মেয়েটির সাথে এখন মনের মিল হওয়াটাই হলো আবশ্যক।
.
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।উপমা আসছে নিশ্চয়ই।হাতে ট্রে আর এর উপর দুটি চায়ের কাপ।প্রবন্ধর সামনে আসলেই মুখের কোনে হাসি জমিয়ে রাখাটা এখন ওর নিয়মের আওতায় পরে গেছে।
উপমা ট্রে টা রেখলো।কাপের তলায় পরে থাকা চিনিগুলো চামচ দ্বারা মিশ্রিত করে নিচ্ছে।কিন্তু ওর মন অন:মনষ্ক হয়ে আছে।চোখের পাতা এদিক ওদিক করে পলক ফেলে যাচ্ছে।প্রবন্ধ ওর সামনে এসে বসলো।লক্ষী মেয়েটা প্রবন্ধর কাছে থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে।ওর মিষ্টি সুর মেলে উত্তর পাঠ করতেও ঠোটের আগায় বাক্যের শব্দ জমিয়ে রেখেছে।
প্রবন্ধ বলল-
-তুমি বানিয়েছ তো!
-জী।
-তুমি কিন্তু আমাকে এখনো বলো নি যে তুমি আর কি কি বানাতে জানো!
যদিও প্রবন্ধর জানা আছে যে মেয়েটিকে এইখান থেকেই রান্না বিষয়ক ডিগ্রী অর্জন করিয়েই শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হয়েছে।তবে কিছু কথা অজানার মতো হয়ে জানার ইচ্ছায় জিজ্ঞাসা করলে এতে ভালোবাসা বাড়ে।
উপমা বলল-
-আমি সব রানতে জানি।আমি একাই না,আমার ছোট দুই বইনেও সব রানতে জানে।
প্রবন্ধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল-
-তুমি আমার বোন তানহা মানহাকেও শিখিয়ে দিও।ওরা রান্না শিখতে আগ্রহী কিন্তু ওদেরকে কেউ রান্না শেখাতে আগ্রহী নয়।আর তা জানো কেন!!ওদের পড়াশোনার বিঘ্ন ঘটবে বলে ওদেরকে শেখাতে চায় না।তুমি শিখেছিলে কিভাবে! তা বললে না!
-মা কাকীরা যখন রানতে বসতো তখন আমরা তাদের সাথে বইসা বইসা দেখতাম,মাঝে মাঝে নিজেরাও চেষ্টা করতাম।এইভাবেই শিখসি।
-একটা কথা বলবো উপমা..
-বলেন..
-কাল যে তুমি আমার সাথে এইখান থেকে চলে যাচ্ছো তোমার কী মন খারাপ লাগছে?
উপমা মাথা ঝুকিয়ে বলল-
-একটু একটু।
-তবে তুমি বললে এইখানে থেকে যেতে পারো।দুই দিন পর এসে না হয় আমি তোমায় নিয়ে যাবো।মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটা আমি ম্যানেজ করে নিবো।
উপমা বলল-
-না।তা কি কইরা হয়!আমি আপনের সাতেই যামু।, কিন্তু প্রবন্ধ বলল অন্য কথা।
-আচ্ছা. .উপমা ,সত্যি করে বলো তো!তুমি কি এখনো আমাকে ভয় পাও!!
হঠাৎ এই কথা শুনে উপমা মুখে আচল চেপে হেসে ফেলল।আর মাথা নাড়ালো।তার ভয়ের সংকোচ কেটেছে।
প্রবন্ধও কিছুটা হেসে নিলো।কথা বলতে বলতে কাপের অর্ধেকটা চা এখনো কাপেই পরে আছে। উপমা খেয়াল করে বলল-
-চা ঠান্ডা হইয়া যাইবো।চা-টা খাইয়া নেন।
প্রবন্ধ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলল-
-তোমাদের গ্রামটা সত্যি-ই খুব সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে।এই পরিবেশে আমার আসা হয় না।নতুন করে এসে চিনতে পেরে খারাপ লাগছে না।
-মা বলসে,আমাগো গেরাম আগে অনেক সুন্দর আর বড় সিলো কিন্তু নদীভাঙনের পরে গেরাম আরও ছোট হইয়া গেসে।
-তাই বুঝি..!
-জী।এই গেরাম নিয়া লোকে আরও অনেক কিসু কয়।
-কি বলে?
-অনেক আগে এই গেরামে নাকি জ্বীনেরা থাকতো।এক মনিষী আইসা সেই জ্বীনদের নিজে কব্জা কইরা ফেলসিলো।এরপর জ্বীনরা নাকি অভিশাপ দিসিলো।আর সেই জ্বীনেদের অভিশাপে এই গেরামের সবাই অভাবে থাকে।এই গেরামে কারো উন্নতি হয় না।তুফান, ঝড়,নদীভাঙনে আজ এই দশা।
প্রবন্ধ হাসতে হাসতে বলল-
-লোকের মুখে শোনা গল্প কখনো সত্যি হয় না।তুমি একজনের কাছে গিয়ে ঘটনা যাচাইবাছাই করে দেখো।সবাই বলবে যে তারা দেখে নি শুধু শুনেছে।এর আগেও যারা এইখানে বসবাস করতো তারাও হয়তো একই কথা বলে গেছে সবাইকে।আসলে কেউ কিছুই দেখে নি।শুধু লোকের মুখেই এই পর্যন্ত শুনে এসেছে।আর যে বলেছিলে সে বানিয়ে গুজব ছড়িয়েছে।যার কাহিনী এই গ্রামের সবাই সত্যিভেবে বিশ্বাস করে যাচ্ছে।সাইন্স এইসব ভূত প্রেত মানে না,সব হচ্ছে মানসিক ব্যাপার।ভূতের কথা চিন্তায় আসলে ভয় লাগে আর চিন্তা না করলে কিছুই না।
উপমা শুনে গেলো।হয়তো বুঝেনি কিছুই।প্রবন্ধ বলল-
-থাক..ওসব কথা।এখন তোমার কথা বলো!তোমার কথা শুনতে চাই।
উপমা অবুঝের মতো করে বলল-
-আমার কি কথা শুনতে চান!
-যা ইচ্ছে তা-ই বলো..তোমার যেকোনো কথা-ই মুগ্ধ হয়ে শুনতে ইচ্ছে হয় উপমা।
উপমা মুচকি হেসে বলল-
-আপনে প্রশ্ন করেন, আমি উত্তর দেই।
-প্রশ্ন আর উত্তরের মাঝে ব্যবধান রেখো না।তুমি প্রশ্ন-উত্তরের মাঝে বাধ ভেঙে অনর্গল কথা বলে যাও।
উপমা লজ্জা পাচ্ছে।প্রবন্ধর চোখে চোখ তুলে তাকাতেও কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে ওর।
ঠোট দুটো কাপাতে কাপাতে বলল-
-আপনার নামটা উচ্চারণ করি!
প্রবন্ধ হো হো করে হেসে দিলো।খুব মজা করে কথা বলতে জানে উপমা।প্রবন্ধ বলল-
-হুম।করো।এইবার ভুল যেন না হয়!
উপমা বলল-
-পরবন্ধ।
প্রবন্ধ হেসে হেসে বলল-
-একটু ভুল করেছো।প্রথম অক্ষরটা 'প্রো' হবে।
উপমা দিধাদন্দ করে বলল-
-প্রবন্ধ।
প্রবন্ধ হাসতে হাসতে বলল-
-এইতো।তোমার উচ্চারণের উন্নতি হয়েছে।
উপমাও মুখে আচল চেপে হেসে ফেলল।
.
.
রাতের ঘুটঘুটে আধার ও নীরবতায় চারিদিক ছেয়ে আছে।ইতোমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছে যে এই দুইদিনে যারা শহর থেকে মেহমান বেশে এই গ্রামে প্রবেশ করেছিল কাল সকালে তারা চলে যাবে।আবার কবেই বা দেখা হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।
উপমা সবার সাথে দেখা করে আগের থেকেই বিদায় চেয়ে নিচ্ছে কেননা সকালে সবাই ব্যস্ত থাকলে তখন আর কারো সাথে বিদায় নেবার জন্য দুই একটা কথা বলে নেওয়ার সময় থাকবে না।ঠিক ওইদিনের মতোই আত্মীয় প্রতিবেশীরা সবাই এলো উপমার কাছে।শোক আনন্দ সব মনের মাঝে মিলে একাকার হয়ে আছে উপমার।
.
উপমার পিছু পিছু তোড়া আর পিউলি পরে রইলো।তোড়া একটু একটু পর পর বলে ওঠে -
-যাইয়ো না আপা..দুলাভাই চইলা যাক,তুমি যাইয়ো না।
উপমা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-
-পাগলী..এইডা কয় না।
-তাইলে আবার কবে আসবা আপা!
-আসমু..তোগোরে কি ভুইলা থাকতে পারমু পাগল!
পিউলি বলে-
-আপা..আরও কিসু দিন থাইকা যাও না...
-না রে।আমার যাইতো হইবো পিউলি।তোরাও বেড়াইয়া আশিস।
মাও কাঁদে।উপমা যেন টের না পায় তাই মুখ লুকিয়ে কাঁদে।মেয়ে তার অবুঝ।মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে তার মনও কাঁদে।মেয়েটাকে তো তার এক দিন না এক দিন শ্বশুর বাড়ি পাঠাতেই হবে।আর যদি আসে কোনো বড় ঘরের সম্বন্ধ তাহলে তো কোনো কথাই নেই।মেয়ের সুখ ভেবেই কম বয়সে মেয়েটাকে এই বিয়েটা দিয়েছিল।
.
উপমা ঘরের এক কোনে বসে চাপা কান্না কাঁদছে।কাল সবাইকে ছেড়ে আবারও শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে।প্রবন্ধও জানে উপমা ধীর স্বরে কেঁদে যাচ্ছে।কিন্তু কষ্টটা সে প্রবন্ধকে বুঝতে দিচ্ছে না।প্রবন্ধও নীরব হয়ে আছে।হয়তো কান্না করলেই মনের চাপা কষ্টগুলো ঝড়ে পরবে।চোখে পানি গড়িয়ে ওর ফুলের মতো গাল বেয়ে নিচে ঝড়ঝড় করে পরছে।প্রবন্ধ উপমার সামনে গিয়ে নিজের বাহুতে উপমাকে জড়িয়ে নিলো। বাধা আর লজ্জার সিঁড়িকে পিছু ফেলে প্রবন্ধর বুকে মুখ গুজে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো উপমা।
চলবে...
#পলক_হোসেন
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ