645

অাপন ছোট ভাইকে কান কাটা অবস্থায় দেখলে কেমন লাগবে? কান্না করতে করতে অামার ভাই রাসেল বাড়ি ফিরে এল। কাটা কানে সম্ভবত তুলা জড়ানো।
রাসেল অামার দেড় বছরের ছোট। একদম সহজ সরল ভাইটা অামার। মাস খানেক অাগে অামার সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। অার অাজ কান কাটা নিয়ে ফিরে এল।
.
রাসেলকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, " ভাই অামার, তোর এই অবস্থা হল কিকরে?"
জবাবে রাসেল বলতে শুরু করল..
★
তোমার সাথে রাগ করে হাটতে হাটতে অামি তিন গ্রাম পরে যে শিলমান্দী গ্রাম অাছে ওখানে চলে গিয়েছিলাম।
সারাদিন হাটতে হাটতে ক্ষিধায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। ঐ গ্রামের মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে বললাম অামাকে যেকোন একটা কাজ দিতে। বিনিময়ে শুধু খাইতে দিবে অার থাকতে দিবে। মাতব্বর অামাকে শর্ত দিল।
অামি অাগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম কি শর্ত?
জবাবে বলল,
এক নাম্বার শর্ত,,,,
মাতব্বরের পনেরোটা গরুকে ঘাস কেটে খাওয়াতে হবে।
দুই নাম্বার শর্ত,,,,,
আমাকে তিন অাঙ্গুল সমপরিমান কলাপাতায় খেতে দিবে। এতে অামার পেট ভরলে ভরবে না ভরলে নাই।
তিন নাম্বার শর্ত,,,,,
যদি কখনো আমার ইচ্ছাতে কাজ করবনা বলে ফিরে অাসতে চাই তাহলে অামার কান কেটে রেখে দিবে। অামি রাজী হয়েছিলাম।
ভাই আমি গরুর জন্য সারাদিনে যতই ঘাস কাটি খেড়ে সাবাড় করে ফেলে। তিন আঙ্গুল পরিমান কলাপাতার খাবারে পেট ভরতনা। একমাস পর যখন দেখি না খেতে খেতে মরে যাব তখন আমি বলেছি অামি কাজ করবনা। সেজন্য ভাই অামার কান কেটে রেখে দিছে।
.
★ ★ ★
.
পরেরদিন অামি বাড়ি থেকে বের হলাম। রাসেলকে কথা দিয়ে এসেছি, মাতব্বরের বিচার না করা পর্যন্ত অামি বাড়ি ফিরবনা। অামার সহজ সরল ভাইটাকে এতটা কষ্ট দিয়েছে। এর চেয়ে তিনগুণ শাস্তি অামি মাতব্বরকে দেব।
.
শিলমান্দী গ্রামে গিয়ে মাতব্বরের বাড়ি খুঁজতে অামার দেরী হলনা।
অসহায়ের মত মাতব্বরের কাছে গিয়ে যখন কাজ চাইলাম তখন ছোট ভাইটার মত অামাকেও তিনটা শর্ত দিলেন।
★ পনেরোটা গরুকে ঘাস কেটে দিতে হবে।
★ আমাকে তিন অাঙ্গুল পরিমান কলাপাতায় খেতে হবে।
★ যদি স্বইচ্ছায় কাজ ছেড়ে চলে যেতে যাই তাহলে আমার কানন কেটে রেখে দিবেন।
.
আমি মাতব্বরকে বললাম আমি তিনটি শর্তেই রাজী অাছি তবে অামারো একটি শর্ত অাছে।
মাতব্বর জানতে চাইল অামার একটিমাত্র শর্তের কথা।
অামি বললাম, পঞ্চায়েতের পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে তারপর বলল।
মাতব্বর কিছুক্ষন ভাবলেন। তারপর অামার কথায় রাজী হলেন।
বিকেলে পঞ্চায়েতের পাঁচজন বিচারকের সামনে মাতব্বর অাবারো তার শর্ত তিনটার কথা জানাল। এবার অামার পালা।
অামি পঞ্চায়েতের সামনে বললাম, অামার একটি মাত্র শর্ত হল, " আমি যদি স্বইচ্ছায় কাজ ছাড়ি তাহলে অামার কান কেটে দিবেন কিন্তু মাতব্বর অামার কোন কাজে রাগ হতে পারবেন না। আর আমি যেতে না চাইলেও মাতব্বর নিজে যদি অামাকে তাড়িয়ে দেন তাহলে অামি মাতব্বরের নাক কাটব। "
সবাই হতবাক অামার শর্ত শুনে। অথচ মাতব্বর কোন কিছু না ভেবেই বলে দিলেন তিনিও অামার শর্তে রাজী। হয়তো মাতব্বর অামাকেও অামার ছোট ভাইয়ের মত বোকা ভেবেছিল।
.
★ ★
সকালে মাতব্বর আমার হাতে ধারাল কাঁচি তুলে দিলেন। আজ থেকেই অামার কাজ শুরু। আমি মাঠে গিয়ে দুই অাঁটি বড় বড় ঘাস কেটে অানলাম। এনে এক মুঠো করে পনেরোটা ভাগ করে প্রতি মুঠো ঘাস একেক গরুর সামনে দূরত্ব রেখে বেঁধে দিলাম। গরু চাইলেও নিমিষেই ঘাস শেষ করতে পারবেনা। একটু একটু করে টেনে টেনে খেতে হবে।
মাতব্বর আমাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে দেখে রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার, ঘাস না কেটে বাড়ি ফিরে এলে কেন?
--- অামিতো ঘাস কেটে গরুরে খেতে দিয়েই এসেছি।
--- এত তারাতারি ঘাস কাটা শেষ হল কিকরে?
--- গিয়ে দেখে অাসুন।
--- তুমিও অামার সাথে এসো।
দুজনেই গরুর কাছে গেলাম। ক্ষুধার্ত গরু অাপ্রাণ চেষ্টা করে একটু একটু করে ঘাস টেনে খাচ্ছে।
মাতব্বর রাগ দেখিয়ে বলতেছেন, "এই অল্প কিছু ঘাসে গরুর পেট ভরবে? "
--- মাতব্বর সাহেব, অাপনি বলেছেন পনেরোটা গরুর ঘাস কেটে দিতে হবে। আমি কেটে দিয়েছি। গরুর পেট ভরবে কিনা সেটাতো অামি জানিনা। মাতব্বর সাব, অাপনি অামার কাজে রাগ করেছেন? অামাকে তাড়িয়ে দিবেন?
--- না, অামি একটুও রাগ করিনি।
মনে মনে মুচকি হাসলাম। নাক কাটার ভয়ে অামার কাজ তার অপছন্দ হয়নি।
.
★ ★
.
ঘরের ফ্লোরে অামাকে খেতে দিবে। তিন অাঙ্গুল পরিমান কলাপাতা নীচে রেখে মাতব্বর চামচ দিয়ে অল্প অল্প ভাত দিচ্ছেন।
কিছুক্ষন পর দেখা গেল তিন অাঙ্গুল কলাপাতার সীমানা ছেড়ে ভাত ফ্লোরে অবস্থান করতেছে। মাতব্বর বলতেছে,
--- ভাত ফ্লোরে পড়তেছেতো।
--- অামি ফ্লোর থেকে তুলে খেতে পারব। আপনি কলাপাতায় ভাত দিতে থাকুন। কোথায় যায় সেটা অাপনার দেখার বিষয়না।
মাতব্বরের ততক্ষনে জানা হয়ে গেছে যে তিনি কার পাল্লায় পড়েছেন।
★ ★
.
ঈদ উপলক্ষে মাতব্বরের শশুড়বাড়ি থেকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। মাতব্বরের বউ বাচ্চা অাগেই চলে গিয়েছে। আমি মাতব্বরের সাথে মিষ্টির হাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছি। হাটার সময় মাতব্বর বলতেছে,
--- শ্রাবইন্না, দেখ কি সুন্দর একটা বগা।
--- ধুর এটা বক।
--- আরে এটাকে বগা বলে।
--- না বক বলে।
--- আচ্ছা যদি মানুষ এটাকে বগা বলে তাহলে আজই তোর কান কেটে ছেড়ে দেব।
--- আর যদি বক বলে তাহলে আপনাকে জুতা দিয়ে মারব।
--- আচ্ছা ঠিক অাছে। ঐযে সামনের দুজনকে ডেকে অান।
পথের দুজনকে ডেকে অানলাম। জানতে চাইলাম,
--- ভাই ঐযে দেখা যায় সাদা যে, এটা বক না?
--- হ্যাঁ বকইতো।
মাতব্বর মাথা নীচু করে রাখলেন। আমিও দেরী না করে জুতা খুলে মাতব্বরকে এক ঘা মেরে দিলাম।
--- শ্রাবইন্না তুই এটা কি করলি?
--- রাগ করেছেন। অামাকে তাড়িয়ে দিবেন?
না, তাড়াতাড়ি হাট। তুই অামার সাথে কথা বলবিনা।
★ ★
.
মাতব্বরের শশুড় বাড়ি পৌছে আমি মাতব্বরের শাশুড়ীকে আস্তে করে বললাম, " ঈদ উপলক্ষে সবার বাড়িতে গোস্ত থাকে। আপনার মেয়ের জামাইতো পথে অামাকে বলেছে ওনার নাকি শোল মাছ দিয়ে মাসকেলাইর ডাল খেতে ইচ্ছে করছে"
রাতের খাবারেই ডাল তৈরী। মাতব্বরসাব মনটা দিয়া খাইছে।
.
ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি মেহমান। আমাকে অার মাতব্বরকে এক রুমে থাকতে দিয়েছে। মধ্য রাতে মাতব্বর অামাকে ডেকে তুলল,
--- এই শ্রাবণ, আমারতো মনে হয় পাতলা পায়খানা শুরু হইছে। বাইরে যে অন্ধকার, অামার ভয় করতেছে। তুই একটু সাথে অায়না।
--- মাতব্বর সাবগো, আমার অারো বেশী ভয়। আমার চাচাত ভাইরে ভূতে মারছিল।
মাতব্বর আরো ভয় পেয়ে বলল, এখন তাহলে কি করব?
আমি পাশের মাটির কলসটি দেখিয়ে দিয়ে বললাম এটাতে কাজ সেরে ফেলেন।
মাতব্বর প্রায় সারারাত কলসেই বসা ছিল।
.
★ ★
ভোর সকালে মাতব্বরকে ডেকে তুললাম।
---রাতে কলসে কি করছেন মনে নাই? মানুষ সজাগ হওয়ার অাগে নদীতে ফেলে দিয়ে অাসেন। নয়তো লজ্জায় টিকতে পারবেন?
মাতব্বর কলস মাথায় নদীর দিকে রওনা দিল। আর অামি বাইরে বের হয়ে চিৎকার দিলাম। " কে কোথায় অাছেন, মাতব্বরকে বাঁচান"
সবাই বেরিয়ে এল, " কি হইছে মাতব্বরের?"
---অাপনার মেয়ের জামাইরে নাকি অাসার পর থেকে ভাল সমাদর করেননি। এজন্য কলস নিয়ে নদীতে যাচ্ছে মরার জন্য।
সবাই দৌড় দিল। মাতব্বরও দৌড়ে মাতব্বরের শশুড় বাড়ির মানুষও দৌড়ে। মাতব্বর সবাইকে অাসতে দেখে আরো জোরে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে গেছে। আর মাটির কলস ভেঙ্গে গুপ্তধন বাইরে বের হয়ে গেছে। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা।
সেদিনই মাতব্বর অামাকে অার বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি চলে এল।
পথে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "রাগ করেছেন? তাড়িয়ে দিবেন?"
এবার না বলতেও খুব কষ্ট হল। তবুও বলল রাগ করেনি।
★ ★
.
মাতব্বরের মেয়ে ফাইভে পড়ে। এবারের পরীক্ষায় ফেল করেছে। মাতব্বরতো রেগে অাগুন।
রেগে গিয়ে বলতেছে,
--- সারাবছর পড়ার পরও ফেল করলি কেন? থাপ্পড় দেয়া দরকার তোরে। এই শ্রাবইন্যা ওরে থাপ্রাইয়া দাঁত ফেলে দে।
বলার সাথে সাথে থাপ্পড় দুটা দিয়ে ফেলেছি। মাতব্বর গিয়ে অামার হাত ধরে ফেলেছে,
--- শ্রাবইন্যা কি করোস তুই?
--- যা বলছেন তাই।
--- এবার কিন্তু সত্যিই রাগ করেছি।
--- তাড়িয়ে দিবেন?
কিছুক্ষন ভেবে বলতেছে, হ্যাঁ তাড়িয়ে দেব। তোর অত্যাচারের চেয়ে অামার নাক কাটা ভাল।
.
★ ★
.
মাতব্বর ধারাল কাঁচি দিয়ে অামার ভাইয়ের কান কেটেছিল। অামি ভোতা একটা কাঁচি নিয়েছি মাতব্বরের নাক কাটার জন্য।
সহজে অার নাক কাটেনা। অামিও নাক না কেটে বাড়ি ফিরবনা। অাধা ঘন্টা কষ্ট দিয়া নাক কেটে অামি বাড়ি ফিরলাম। ভাইটাকে দেখিয়ে বললাম, দেখ ভাই মাতব্বরের বিচার করে অাসছি। ভাইটি এবার দুঃখ ভুলে হাসি দিল।
.
.
লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,,
,,,,,,,,Mohammad Omar Faruq(শ্রাবণ)