♥গল্প: শিশির ছোঁয়ার প্রণয় ♥
.
.
উৎসর্গ: চড়ুইয়ের ঝগড়াটে টুনি
.
.
(১.)
পূর্ব গগনে উদিত হয়েছে সকালের স্নিগ্ধ ঊষা । তার মৃদু তেজ দীপ্ততা ক্রমেক্রমে ছড়াচ্ছে অবনী জুড়ে । কৃষ্ণচূড়া গাছের ছোট্টছোট্ট পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে সে আলোর আলোকরশ্মিগুচ্ছ । নিত্যদিনের মতো শিশির এবং তার বন্ধুরা সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে । এরই মাঝে জাহিদ তার গিটারটি শিশিরের হাতে দিলো গান গাওয়ার জন্য । শিশির খুব ভালো সূর তুলতে পারে এই দুই সুতার এই বাদ্যজন্ত্রটিতে । সে তার সমস্ত নিপুণতা দিয়ে টুং টাং টিং সূর তোলার চেষ্টা করছে আর সাথে তার সূরেলা কণ্ঠ মিশ্রিত করে গাইতে লাগলো,
.
'প্রীতি কাঁঠালেরআঠা লাগলে পরে ছাড়েনা....
কি জিনিষ দেখালে দয়াল নজর কেন পড়েনা...'
.
তার গানের মাঝে হঠাৎ নিজ রচিত কলি ঢুকে পড়ায় ছন্দের তালে তাল দেওয়া শ্রোতাগুলোর ভাবনায় ছেদ পড়লো । তারা হাসি আর অবাক মিশ্রিত 'হাবাক' স্টাইলে চেয়ে রইলো শিশিরের দিকে । কিন্তু শিশিরের দৃষ্টি তখন পশ্চিম গেটের পাশে ফুলেরগন্ধ বিলাসেরত একটি মেয়ের দিকে । বন্ধুরা প্রশ্ন উপর প্রশ্ন করতে লাগলো এ ধরণের কান্ড সে কেন ঘটালো তার রহস্যাবৃত করার জন্য । কিন্তু শিশির নিজেই নিজেকে আরও বেশি রহস্যের জালে আটকে ফেলতে লাগলো । শিশিরের বন্ধু নীল তার মাথার কাছে নিজের মাথা রেখে ওর নির্বাক চাহনির দৃষ্টিরেখা দিয়ে তার শেষ প্রান্ত খুঁজতে লাগলো । সে (নীল) যা দেখলো, তা যদি সত্য হয় তাহলে আজ হয়তো কোন এক প্রাণবন্তকর ইতিহাসের যাত্রা পথের দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে ।
.
.
২)
.
চারিদিকে যতদূর চোখ যায় উপরে দৃষ্টিপথে মিলবে শুধু আকাশী রঙ আর সূর্যকে আড়াল করে ব্যস্ত মেঘের বিরামহীন উড়ে চলা । আর তার নিচে সবুজের আল্পনায় গাঁথা গাছের সারী । পাখির কলকাকলিতে মুখর বটবৃক্ষ । একপাশে বয়ে চলা খরস্রোতা নদী । মৃদু ঢেউয়ের খেলা । বক, পানকৌড়ির ঝটপট করে উড়ে চলা । এমনি একটা সুন্দর গ্রামের নাম পুষ্পকলি । সেই গ্রামের-ই ছায়া, মায়ামমতায় বেড়ে উঠেছে একজোড়া প্রণয়ী প্রাণ । দুইজন কিশোর - কিশোরী । তাদের সুন্দর দুটি নাম থাকলেও ছেলেটিকে মেয়েটি চড়ুই বলে ডাকে, আর ছেলেটি মেয়েটিকে টুনটুনি বলে ডাকে ।
.
এই বয়সে ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা না থাকলেও তাদের একে অপরের জন্য রয়েছে অনন্য হৃদয়ঙ্গমতা । দুটি দেহ হলেও যেন একটাই প্রাণ । একজন ব্যথা পেলে অন্যজন কষ্ট পায় আবার একজন কাঁদলে অন্যজনের চোখ থেকে বাঁধ ভাঙ্গা অশ্রু ঝরে পড়ে । একজন হাসলে অন্যজনের হৃদয়ে অনুভূত হয় স্বর্গীয় সুখ । তারা সারাক্ষণ মিষ্টি ঝগড়া করতে পছন্দ করে । টুনির একটু পরপর চড়ুইয়ের সাথে ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয়না । মেয়েরা এমনিতেই ঝগড়াটে স্বভাবের কিন্তু ভালোবেসা মিশ্রিত ঝগড়াতে টুনির জুড়ি মেলা ভার । প্রথমে ঝগড়া করে একে অপরের সাথে সাময়িকী আড়ি দিবে । তারপর যে কোন একজন অন্যজনকে রাগাবে । এরপর মারামারি করে একজন অপরজনকে ভ্যাঙ্গানি দিয়ে হাসাহাসি করে আবার এক হয়ে যাবে ।
.
তারা হলো সেই পুষ্পকলি গ্রামের সবার নয়নের মণি এবং তাদের পরিবার দুটি এলাকাজুড়ে বেশ প্রভাবশালী ও বটে । একজন হলো ঐ এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে আর অন্যজন হলো একই এলাকার স্থানীয় ব্রাঞ্চের ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের মেয়ে । তারা সারাদিন একসাথে পড়ে, খেলে, স্কুলে যায় । হাতে হাত রেখে নদীর তীরে ঘুরে বেড়াই । তাদের দুই পরিবারের মাঝেও রয়েছে জানা-শুনা, আসা-যাওয়া, আর অন্যরকম হৃদতা ।
.
৩)
.
'ঐ শিশির, কাহিনী কী বলতো? তুই কী কাউকে দেখছিস?' জাহিদ বললো ।
শিশির ও কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
_ 'থাম আগে দেখতে দে মেয়েটাকে । ওয়াও অপরূপ সৌন্দর্য্য! এ যেন মাত্রই আসমান থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেছে । দোস্ত, মানুষ এত মায়াবী হতে পারে? মনে হয় কোন অপ্সরী! আমি কি বাস্তবে আছি নাকি স্বপ্নে? একটুখানি চিমটি প্লিজ! ধুর শালা এত জোরে কেউ কাউকে চিমটি দেই নাকি?'
ওর কথা শুনে সবাই মুখ হা করে হাবাক + আশ্চর্য 'হাবাকাশ্চর্য' ভাব নিয়ে ওর তাকিয়ে রইলো । তা দেখে শিশির বলল ঐ তোরা এমন হা করে থাকলে তো মশা-মাছি, হাতি-ঘোড়া, ব্যাঙ-টিকটিকি সব তোদের মুখের ভিতর ঢুকে পড়বে, বন্ধ কর আগে । তাড়াখেয়ে সবাই একটু লজ্জা পেয়েছে । কিন্তু লজ্জাটে ভাব কাটিয়ে অহনা বললো, 'তুই কিনা মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস । ঐ তুই শিশির না?'
তা শুনে ভ্রুুকুঞ্চিত করে শিশির বললো, 'তো কি হয়ছে? আমি কি মানুষ না? পারিনা তাকাতে?'
না, ঠিক তা নয়....
শিশিরের কথায় ওরা ভাবনার অতলে ডুবে গেলো । ভাবতে লাগলো ওর ব্যাকগ্রাউন্ড.....
.
শিশির কলেজ লাইফ থেকেই সবার থেকে অন্যরকম । অসম্ভব মেধাবী, কিউট, আলাপি, এক কথায় যে কোন মেয়েকে আকর্ষিত করতে কোন গুন-ই তার মাঝে কমতি নেই । এজন্য সব মেয়েই তার পিছনে ছুটে । ছুটে বললে ভুল হবে কলেজ পেরিয়ে এখন ভার্সিটিতেও ওর বেশ নামডাক হয়েছে । কিন্তু সব কিছুর মধ্যে ওর একটা খারাপ পরিচয় হয়েছে 'নেশাখোর' নামে । গ্রাম থেকে শহরে আসার পর খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে এই একটা বদ অভ্যাস ওর মাঝে জায়গা করে নিয়েছে । শিশিরের কিছু ভাল বন্ধু ও আছে এখন যাদের সাথে আছে তারা । তারা অসংখ্য বার চেষ্টা করেছে ওকে এই অভ্যাস ত্যাগ করাতে কিন্তু পারেনি । এটুকুবাদে চেনা জানা সবার আস্থা এবং ভালোবাসার অন্যতম নাম শিশির । যে কারও বিপদে সবার আগে ও ই ছুটে যায় ।
.
তো তার এই বিশেষ বৈশিষ্ট গুলির কারণে অনেক মেয়েরা তার পিছনে ছুটলেও সে কখনও কাউকে পাত্তা দেয় না । এমনকি যাদের পিছনে বড় ভাইয়েরাও লাইন মারার চেষ্টা করে তাদের ও শিশির একবাক্যে রিজেক্ট করেছে । এমন অসংখ্য রেকর্ডস যার ব্যাক পকেটে থাকে এবং টপ থেকে টপারর্সরা যেখানে ধোপে টিকলোনা সেখানে কোথাকার কোন মেয়েকে দেখে ক্রাশ নামক অপুষ্টিকর অখাদ্য খেয়ে বসে আছে । এটা ওর পরিচিতজনদের কাছে রীতিমত অষ্টম আশ্চর্য দেখার অভিজ্ঞতা বলা যায় ।
.
তাদের ভাবনায় ছেদ পড়লো শিশিরের ডাকে -
'ঐ হাদারামের দল, তোদের আবার কী হলো?'
ওর ডাক শুনে সবাক লাফ দিয়ে উঠলো । সবাই চমকে গেছে কিন্তু সেদিকে ওর খেয়াল নেই । ও বর্ণনা করতে লাগলো মেয়েটার রূপের কথা । সবাই তো মেয়েটাকে দেখে সেইরকম ধাক্কা খেলো । বোরকা পরা, তাও আবার কালো কুচকুচে রঙ্গের তাতে কোনো স্টাইলের বালাই নেই । শুধু মাত্র চোখ দুটি ছাড়া আর কিছুই দেখি যাচ্ছে না, অথচ শিশির এমন ভাবে বলছে যেন সে বিশ্বসুন্দরী মেয়ে । শিশিরের বান্ধবীদের মধ্যে নিরুপমা শিশিরকে ভীষণ পছন্দ করে । তাই ও রীতিমত সেইরকম জ্বলা-জ্বলছে । তাই তো মুখটা ৯০ ডিগ্রি বাকা করে বললো,
.
'দেখনা গাধার কাজ, আশেপাশে এতো সুন্দরী আর স্মার্ট মেয়ে থাকতে ও শেষ পর্যন্ত কি না একটা আনস্মার্ট জঙ্গি'র প্রেমে পড়লো!'
এই বলে সবাই হোহো করে একপর্ব হেসে নিলো । তাই দেখে শিশির বললো,
'আশেপাশে যেগুলো আছ সেগুলো সব মাকাল ফল । কতক আবার এমন দশা যেন.... জানিস তো ছিলে রাখা, মাছির স্পর্শ পাওয়া কলার যেমন দাম নেই, তেমনি এই নির্লজ্জ আলগা গুলোও আমার চোখে মূল্যহীন । ইউ হ্যাভ টু জানতে হবে এদেরকে শোপিস হিসেবে মানায়, শিশিরের লাইফ পার্টনার হিসেবে নয় ।'
.
শিশিরের কথা শুনে মেয়ে গুলোর মুখে মাছি ঢোকার মত অবস্থা । একটাও আর চোখ তুলে তাকাচ্ছেনা । আর নিরুপমা তো রেগে আগুন ।
শিশির ওদের দিকে তাকিয়ে রহস্যআবৃত একটা হাসি হাসলো যার অর্থ কেবল সেই জানে ।
.
৪)
.
স্কুলে চড়ুই আর টুনিকে সবাই বর বউ বলে খেপায় । চড়ুই একটু লজ্জা পেলেও দুষ্টু টুনিটা তখন ওর দিকে চোখ বড়বড় করে হয়ে তাকিয়ে থাকে । তা দেখে চড়ুই আরও বেশি লজ্জা পায় চোখ তুলে তাকায়না পর্যন্ত । সবাই জানে ওরা একজন অন্যজনের প্রাণ ।
.
একদিন একটা মেয়ে পিছন থেকে এসে চড়ুইকে জোর করে কিস করে দৌড়ে পালিয়ে যায় । চড়ুই তখন হতভম্ব হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বারবার আশেপাশে তাকাতে লাগলো যে, এই অঘটন টুনি দেখে ফেলেছে কি না । কিন্তু সামনে তাকাতেই দেখলো ঐ মেয়েটা নোংরা কাদাজলে পড়ে আছে আর তাকে ধুমধাম করে কীল, ঘুসি, থাপ্পর মারতে লাগলো টুনি । তা দেখে ভয়ে শিশির বললো
'এই টুনি শোন, এভাবে মারলে তো ও মরে যাবে! প্লিজ, এবার ছেড়েদে ।'
তা শুনে টুনি বললো, - 'মরলে মরুক, তোর কী তাতে? ওর কত্ত বড় সাহস আমার চড়ুইকে জোর করে কিস করেছে । আমি তাই এসব করিনা, লজ্জা পাই বলে! ছিঃ!' তারপর মুখে হাত দিয়ে কি জানি ভেবে আবার বললো
'কী বললি চড়ুই? ও মরে যাবে তাই না? গুড আইডিয়া, দাঁড়া, ওকে আজ আমি মেরেই ফেলব! আমার জানের গালে কিস করার মজা এবার ও হাড়েহাড়ে টের পাবে, নির্লজ্জ, অসভ্য মেয়ে ।'
এই বলে ও একটা বদনা হাতে নিয়ে ছুটে আসতে লাগলো তাকে আরো মাইর দিবে বলে আর ওদিকে মেয়েটা কাঁদামাখা অবস্থায় আজও দৌড় তো কালও দৌড় । পিছন থেকে টুনি বলছে,
'আাদিইইইব্বা... থাম বলছি! বেশি মারব না । নাকে দুইটা কিল মারব, মুখে একটু খামছি দিব আর এই বদনা দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা বাড়ি দিয়েই তোকে ছেড়ে দিব । থাআআআআম, ভয় পাসনে আর কামড় দিবনা !!' আদিবা তো ভোঁ-দৌড় দিছে আর ভয়ে একবারও পিছু ফিরে তাকাচ্ছেনা । চড়ুই তা করে হাসতে হাসতে জ্ঞ্যান হারানোর উপক্রম..
.
টুনি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো । সাথে সাথে চড়ুই ওর কাছে দৌড়ে এলো । এসে দেখলো ও গাল ফুলিয়ে বসে আছে । চড়ুই কাছে আসতেই বললো, - 'এখানে কেন এসেছিস? যা আদিবার কাছে যা । ওকে চুমু খা । আমার কাছে এসেছিস কেন?' টুনির গাল ফুলিয়ে থাকা দেখে চড়ুই আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা তাই আবারো খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো । তা দেখে টুনি ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে ধুমধাম করে কিল মারতে লাগল আর বলতে লাগলো
-'তুই একটুও ভালোনা, একদম পঁচা । তোর সাথে আজ থেকে আড়ি । আর কথা বলবনা । দূর হ'
-আরে! আমি আবার কী করলাম?
- কিচ্ছু করিস নাই?
- কই না তো । আচ্ছা কেউ আমার গায়ে হাত রাখলেও তুই তাকে মারবি?
- হ্যাঁ মারব । মেরেই ফেলব তাকে ।
- কেন? আমি তোর কি হই?
- জানিনা এত কিছু । মারতে ইচ্ছা করবে তাই মারব । তোর কি তাতে?
- মারবিই তো, তুই একটা গুন্ডি, ডাকাতনী, আর....
- কি বললি? দাড়া...
কথা শেষ করার আগেই টুনি ওকে দৌড়ানি দিতে শুরু করলো, ব্যাস আবার স্টার্ট হয়ে গেলো ঝগড়া ।
.
৫)
.
প্রথম দিনের পরে শিশির মেয়েটিকে অনুসরণ করতে থাকে । কিন্তু কখনও কাউকে ডিস্টার্ব করার অভিজ্ঞতা না থাকায় কিভাবে এগোনো যায় বুঝতে পারছে না । আবার বন্ধুদের হেল্প নিয়ে ও কিছু করতে পছন্দ করেনা । তাই পড়লো মহা বিপাকে । তাছাড়া ওর বন্ধুরা বলেছে যে, 'দোস্ত মেয়েটার চোখ দুটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না । এখনকার যুগে কেউ এমন করে ক্ষ্যাত হয়ে থাকে নাকি? দেখবি সে হয়ত তার কুৎসিৎতাকে ঢাকতে এমন বেশ ধারণ করেছে ।' কিন্তু শিশিরের একটাই কথা, প্রেম যদি করি তাহলে তার সাথেই করব । তবুও তো ঐ আলগা গুলোর সাথে নয় ।
.
শিশির প্রথমদিন তার পিছু পিছু হাটছে । মেয়েটার দু বার তার দিকে তাকালেও কিছু বললোনা । মেয়েটা যখন থামছে ও তখন অন্যদিকে তাকাচ্ছে । এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরে মেয়েটা একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলো । আর শিশির সেখানে পাগলের মত ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো ।
এভাবে পরপর তিনদিন চলে যাওয়ার পর একদিন মেয়েটা ওকে ডাকলো । শিশির ভয়ে ভয়ে একপা দু'পা করে এগিয়ে গেল তার কাছে । তখন মেয়েটা বললো,
- কী ব্যাপার! প্রতিদিন দেখি আপনি আমাকে অনুসরণ করেন । কাহিনী কী?
- ক ক কই নান নাতো..
- থামুন! মিথ্যা বললে নাক ফাটিয়ে দিব । মেয়ে বলে ভিতু ভাববেন না । ঠিক ঠাক বলুন ।
- জি না; মাম মানে হ্যাঁ এখন তো দিনকাল খারাপ যেকেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করতে পারে তাই বলতে পারেন সিকিউরিটির জন্য ।
এটুকু বলে ও হাবুর মত একগাল হাসি দিলো । তা দেখে মেয়েটাও হাসলো কি না বোঝা গেলনা । কিন্তু রূঢ় গলায় বললো,
- কিন্তু আপনার কী মনে হচ্ছেনা যে আপনি নিজেই আমাকে ডিস্টার্ব করছেন?
- কই না তো! একটুও মনে হচ্ছে না । আ আমিতো আপনাকে প পছন্দ করি । পছন্দের মানুষকে কি কেউ বিরক্ত করে বলুন?
- এইত সত্য কথা বলে ফেলেছেন । যান ভাগেন, আপনার মতো ছেলের সাথে আমি রিলেশন করবনা ।
শিশির আবার কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মেয়েটা তার গন্তব্য পথে হাটা শুরুকরেছে । আর শিশির তার চলা পথের দিকে একবার তাকিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, আমি কেমন ছেলে? আমার সাথে রিলেশন করবেনা কিন্তু কেন? কিসের অনুপস্থিত আমার মধ্যে? এসব উত্তর বিহীন প্রশ্ন আওড়াইতে আউড়াতে গন্তব্য পথে হাটতে লাগলো ।
.
৬)
.
প্রতিদিন প্রত্যুষের মত বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বকুল ফুল কুড়িয়ে পুকুরপাড়ে সিঁড়ির উপর পা দুলিয়ে বসে মালা গাঁথছে টুনি । পাঁচটি বকুল ফুল আর তার মাঝে একটি করে শিউলি ফুল দিয়ে চমৎকার করে মালা বানাচ্ছে সে । আর তা দক্ষিণ দিকের ঐ শিমুলগাছের ওপাশ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে চড়ুই ।
নিত্যকার মত আজও তা নজর এড়ালোনা টুনির ।
তাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে নিজ হাতের নিপুণতায় মালা বানিয়ে পরিয়ে দিলো তাকে । তারপর গালে হাত দিয়ে বললো বাহ্ তোকে তো অনেক সুন্দর লাগছে রে চড়ুই! বোকা বোকা চেহারা নিয়ে শিশির একগাল হেসে তার পকেট থেকে একজোড়া পায়েল বের করে তা পরিয়ে দিলো টুনির আলতা রাঙা ছোট্ট পায়ে । টুনি তো আনন্দে কেঁদেই ফেললো বোকা চড়ুইয়ের এই কান্ড দেখে । সে বিস্মিত চাহনিতে জানতে চাইলো এই মালা সে কোথায় পেয়েছে । তখন চড়ুই লজ্জা অবনত দৃষ্টিতে বললো সে তার বড় আপুর থেকে চুরি করে এনেছে । টুনি কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলোনা তবুও বললো,
- চড়ুই, তুই এটা কেন করলি? যদি তোর আপু তোকে বকে? তখন চড়ুই বললো
- বকবে কেন? আপু আমাকে অনেক ভালোবাসে ।
- তাহলে তুই এটা আমাকে কেন দিলি?
- কারণ আমি তোকে....
- কী?
- কিছুনা ।
- ঐ ফাজিল বল আগে ।
- বলবনা ।
- বল বলছি । চড়ুই টুনির বিনুনি ধরে জোরে একটা টান দিয়ে দিলো দৌড় আর টুনি ও ওর পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো না বলা কথাটি শোনার জন্য......
.
৭)
.
পরদিন আবার সেই একই জায়গা একই সময় পাশাপাশি বসে আছে দুজন । উত্তরা বাতাসে উড়ছে শিশিরের কুন্তল । মাঝে মাঝে সেদিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে ছোঁয়া । ও হ্যাঁ বলা হয় নি মেয়েটির নাম ছোঁয়া । ছোঁয়া শিশিরকে বললো
.
- হ্যাঁ, এবার বলুন কি বলতে চান?
- দেখুন আপনি হয়ত আমাকে ফালতু ছেলে ভাবতে পারেন । আমি কিন্তু তা নই । জীবনে অসংখ্য মেয়েকে আমি রিজেক্ট করেছি আসলে এসব প্রেম ভালোবাসা আমার পছন্দ না তবুও আ আমি আপনাকে প পছন্দ করি... আর ভালোবাসতে চাই । ছোঁয়া কতক্ষণ চুপকরে থাকলো তারপর বললো
- আমি আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি আপনি বেশ ভালো ছেলে । কিন্তু জানেন তো, কোন নেশাখোর ছেলের সাথে তো কোনো ভাবেই আমি সারাজীবন থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা ।
- তাহলে এখন উপায়?
- একটাই উপায় আছে আর তা হলো নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে । আর হ্যাঁ আমি আপনার সাথে প্রেম করতে পারবোনা । যদি নিজেকে পরিবর্তিত করতে পারেন তবে আমার বাবার কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিবেন । উনিই বিচার করবেন আমাকে আপনার হাতে তুলে দিবেন কি না? যদি না দেন তবে আই হ্যাভ নাথিং টু ডু...
এই কথা শুনে শিশির ছোঁয়াকে তার কথা মত নিজেকে পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনকার মতো চলে এলো সেখান থেকে.....
.
৮)
.
চড়ুই এবং টুনির মাঝে হঠাৎ করেই তৈরী হলো আকাশ-পাতালের দূরত্ব । সরকারী চাকরীজীবী হওয়ার সুবাদে টুনির পরিবার যশোর থেকে ৫৮০ কিমিঃ পথ দূরে চট্টগ্রামে ট্রান্সফার হয়ে গেলো । সাথে সাথে দুটি অবুঝ হৃদয়ের অপ্রকাশিত কথা গুলিও আটকা পড়ে গেলো অচেনা আলো আধাঁরীতে ঘেরা কোনো অন্যজগতে, স্বচ্ছ আয়নার অন্তরালে । চড়ুই আর বলতে পারলোনা না বলা সেই কথা গুলো কিন্তু দৃঢ় অপেক্ষাই রইলো ছোঁয়ার ফিরে আসার । চলে যাবার কথা শুনে দু'জনেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, পাড়াশুদ্ধ মানুষকে কাঁদিয়ে টুনি চলে এলো তার নতুন ঠিকানাই ।
আসার আগে চড়ুইকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো সে তাকে ভুলবেনা কখনও আর চড়ুই ও বলছিলো সেও সারাজীবন তাকে মনে রাখবে ।
চড়ুই তার কানে কানে বললো
'চড়ুই টুনির মধ্যে এই দূরত্ব একদিন যখন আমরা বড় হব তখন শিশির ছোঁয়া রূপে শেষ হবে'
.
৯)
.
দিনের আলো অস্তমিত হয় সায়াহ্ণের আধাঁরে আবারো রাতকে গ্রাস করে দিনের আলো । এভাবেই সময়ের পরিক্রমাই নিজেকে ছোঁয়ার মন মতো করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে শিশির । তারই ধারাবাহিকতায় প্রণয়ের সুতাই নিজেদের বেঁধে নিয়েছে তারা । আজ বাসর রাত । রাতের স্নিগ্ধতা আলাদাভাবে তাদের দুজনের মনে খুশির জোয়ার এনে দিয়েছে । এই আনন্দ একে অপরের প্রাপ্তির সাথে অন্যজনকে বোকা বানানোর ও । আনন্দের ছলাৎ ছলাৎ ঊর্মিমালা আছড়ে পড়ছে তাদের হৃদয় তটিনীর তীরে । তাইতো আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছোঁয়া বললো
- বোকা চড়ুই, তুই সত্যিই সারাজীবন বোকাই থেকে গেলি । আজও যে তোকে বোকা বানিয়ে তোর গলায় মালা হয়ে ঝুলে পড়েছি তা তুই বুঝতে পারলি না ।
শিশির এক চিমটে হাসির রেখা এঁকে জানতে চাইলো
- তাই বুঝি! বোকাতো তুমি নিজেই হয়েছো পাগলী ।
তা টুনি আমাকে কেমন করে বোকা বানালো তা যদি একটু বলতে...
.
- তার আগে বল আমি কেমন করে তোর মতো গাধার কাছে বোকা হয়ে গেলাম?
- না, আগে তুই বল ।
- বলেছি না বলতে? আগে বল... (রাগী মুডে)
- না, লেডিস ফাস্ট। তুই আগে বল.. ছোঁয়া একটু থেমে সময় নিয়ে বললো
- আমি সেই ছোট্ট বেলাই তোকে ছেড়ে অনেক দূরে চলেগেছিলাম কিন্তু বিশ্বাস কর আজ এত বছরে ও হৃদয়ের কুঁঠিরে আমার চড়ুইপাখিটাকে ছাড়া অন্যকাউকে বসাতে পারিনি । তারপর যখন এখানে এসেছিলাম তখন তোর আপু সব শুনে বললো যে আমার ভাইটিকে তোমার সাথে একসুতায় বেঁধে দিতে পারি কিন্তু শর্ত আছে । ও আজে বাজে নেশা করে । আর তুমি যদি ওকে সে পথ থেকে ওকে ফিরিয়ে আনতে পার তবেই তা সম্ভব । তাই আমি তোকে ইমপ্রেস করতেই তোর কলেজে যেতাম । আর তুই পড়েগেলি আমার ফাঁদে হাহাহা...
এবার তুই বল আমি কেমন করে বোকা হলাম?
শিশির, ছোঁয়ার কথা শুনে টাস্কি খেয়ে গেলো । তাই বেশ অবাক হয়েই বলল
- তাই? কিন্তু... তুমি এ বাড়িতে আসলে তোমাকে জীবন সাথী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা আমি আপুকে প্রথমে বলি । তখন আপু তো আমাকে বললো যে ঠিক আছে কিন্তু শর্ত আছে, যে ভাবেই হোক মেয়েটাকে নতুন করে তোর প্রেমে ফেলতেই হবে । যদি পারিস তো বুঝব যে শিশির আসলেই কিছু করতে পারে এবং তখন তার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিয়ে দেবার দায়িত্ব আমার । আর বলেছিল যে তোমার মাথাতে নাকি সামান্য প্রব আছে কখন কি বলে বসো তা জানো না । তাই উল্টো পাল্টা কিছু বললে যেন কিছু মনে না করি । তাই তুমি নেশাকরার কথা বলাতেও আমি কিছু বলিনি । আমি জীবনে কখনও নেশার দ্রব্য স্পর্শ ও করিনি...
.
দুজন দুজনার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলো । তখন ছোঁয়া বললো তাইত বলি যে শুনেছিলাম চড়ুইটা কখনও কোন মেয়েদের পাত্তা দেইনা কিন্তু সেই উনিই কিনা আমার পিছু ছুটলো? আমি যেখানে চিন্তিত ছিলাম যে মেয়ে হয়ে তোমাকে কিভাবে প্রস্তাব দিব!
কিন্তু আপু এমনটা কেন করলেন?
'জানিনা,তবে হয়ত ছোট বেলাই চুরি করে তোকে ওর পায়েলটা দিয়ে দিয়েছিলাম তার প্রতিশোধ নিছে' শিশির বললো । এই বলে ওরা দুজনেই হাসতে লাগলো ।
শিশির বললো
বাদ দে ওসব যা হবার ভালোই হয়েছে । আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত । এসব কথায় তা নষ্ট করবোনা ।
- তো কি করবি?
- জানিস না বুঝি?
- না
- বল না
- অনেক কিছু
- যেমন?
- তোর মাথা
- আজ থেকে তুই বলবি না । তুমি বলবি, ঠিক আছে?
- পারবনা
- কেন?
- লজ্জা লাগে
- আরে আমার লজ্জাশীল গো । চড়ুইপাখি আসো তোমার লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিই ।
- খবরদার আমাকে ছুঁবিনা টুনি । এই বলে শিশির বেড থেকে নেমে যাচ্ছিলো তখন ছোঁয়া ওকে টানদিয়ে বুকে নিয়ে নিলো আর রচনা করতে চললো এক অন্যরকম ইতিহাস...।
.
.
লেখক: Dh Shishir (মুকুট বিহীন রাজকুমারজকুমার)
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ