āĻŦুāϧāĻŦাāϰ, ā§§ā§Š āĻĄিāϏেāĻŽ্āĻŦāϰ, ⧍ā§Ļā§§ā§­

3686

দেয়ালের ওপাশে
      #NasirKhan

:::এক:::
প্রতিদিন রাতে খাবার সময় হলেই আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়। খেতে গেলেই দেখব বাটিতে কিছু আলু বেগুনের ভর্তা আর ডাল। মায়ের হাতের রান্না  অমৃতের মত, এই ধারণা আমার বহু আগেই মুছে গেছে। হয়ত প্রতিদিন একই খাবার খেতে খেতে আমার মুখে রুচি মরে গেছে।

অস্বস্তি বেড়ে যায় এই কারণে যে, খেতে বসলেই আমি কিছুক্ষণ  প্লেটে  হাত নাড়াচাড়া  করে 'আজ গ্যাস হয়েছে খেতে পারছি না মা' বলে উঠে যাবো। আর আমাদের দুঃখিনী  মা অপরাধীর মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি তা দেখে কষ্ট পাইনি, এমন ভান করে রুমে চলে আসব।

আজকাল আমাদের বাবার কোন কিছুতে কোন বিকার নেই। তার ছোট ছেলে নয় বছরের লিটু কতদিন ধরে ইলিশ মাছ খেতে চাইছে। আমার মনে হয় না বাবার কানে এই কথাটা একবার হলেও নাড়া দিয়েছে।

রেনুর কথা আলাদা। আমার এই বোনটা যা পায়, তাই লক্ষ্মীর মত খেয়ে উঠে সব থালা বাসন নিয়ে কলতলায় ধুতে বসে।
একদিন দেখি রাতে খেয়ে দেয়ে কলতলায় থালা-বাসন নিয়ে নিরবে ধুতে বসেছে রেনু। আমি ওকে চমকে দেয়ার জন্য চুপিচুপি পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে অবাক হলাম। রেনু ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

আমি অবাক হওয়া গলায় বললাম,
"এই রেনু কাঁদিস কেন? কি হয়েছে? বাবা কিছু বলেছে?"

রেনু আমার উত্তরের ধার দিয়ে গেলো না। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
-"দাদা লুডু খেলবি? যা তোর রুমে যা। আমি চানাচুর-মুড়ি নিয়ে আসছি। আজ কিন্তু বাজীতে খেলব।"

রেনুর বাহির টুকুই আমি বুঝতে পারি। ওর ভেতরের সত্যিকারের রেনুকে আমি বুঝতে পারি না। ওর কষ্টগুলো কোথায় আমি ঠিক ধরতে পারি না।

আজ রাতে খাবার আইটেম আরো ভয়াবহ।
আমি মা'কে জিজ্ঞেস করলাম,
-"কি রেঁধেছো মা?"
মনে হলো মা ইচ্ছা করেই রাগ দেখিয়ে  বলল,
-"বাবু ইচ্ছা হলে খা, না হলে যা এখান থেকে।"
আমি বাটির ঢাকনা উঠিয়ে দেখলাম কাঁচকলা ভর্তা আর ভাত। সাথে আজ ডাল টুকুও নেই।
আমি একটু হেসে বললাম,
-"আজ যে কবির দের বাসা থেকে আমি খেয়ে এসেছি  মা। তোমরা খাও।"

আমি জানি একথায় মা সব বুঝে ফেলে কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। কোন এক বিচিত্র কারণে আমার এই দরিদ্র গলা দিয়ে এসব খাবার নামতে চায় না।
দেখলাম লিটু আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,
-"বড়দা আমিও খাবো না। আমি কলা খাই না।"

আমি বললাম,
-"খা ভাই। মা তোকে মাখিয়ে সুন্দর করে খাইয়ে দেবে। আজ সবগুলো ভাত খেলে একটা চকচকে পাঁচ টাকার নোট দেবো।"

মন খারাপ করে রুমে বসে থাকলাম। খাওয়া নিয়ে একটু বেশিই নাটক করে ফেলি আমি। মনটা এখন খুবই খারাপ লাগছে। ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বলি, "মা, যা আছে তাই দিয়ে দাও ,আমি খাবো।"

রাত দশটার দিকে রেনু আমার রুমে ভাত নিয়ে এলো।
মিটমিট হেসে বলল, "দাদা আজ তোর রাজ খানা। ডিমভাজি ভাত।"

এরই মধ্যে দোকান থেকে ডিম এনে আমার জন্য ভাজা হয়েছে। প্রায়ই এমন হয়। কাজটি করে রেনু। তার দাদা রাতে না খেয়ে থাকবে, এটা মানতে হয়ত তার খুব কষ্ট হয়।

:::দুই:::
বাবার অফিস সকাল নয়টা থেকে।  অথচ আজ প্রায় একমাস হলো বাবা সকালে নাস্তা হওয়ার আগেই অফিসে চলে যায়। তার নাকি কি জরুরী কাজ থাকে। কি এমন বাবার জরুরী কাজ আমরা কেউ বুঝি না। আগে আমার ঘুম ভাঙতো বাবার দাঁত ব্রাশের পর কুলির শব্দে। কি বিশ্রী শব্দ তুলে বাবা কুলি করতো। আশ-পাশের দশ বাড়ি থেকে শোনা যায়, এমন শব্দ।
আমি ঘুম থেকে উঠেই চরম বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় এসে চোখ বন্ধ করে ঘুম ঘুম গলায় বলতাম,
"প্লিজ বাবা এমন জঘন্য করে গার্গল করো না। আমার বমি পায়।"

আমাদের সরল বাবা একথায় সারা বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতো। বাবার হাসিতে শামিল হতো রেনু। কে জানে কি এমন হাসির কথা আমি বলতাম।

অনেকদিন হল বাবার গার্গলে আমার ঘুম ভাঙে না। ইচ্ছা করেই বাবা এখন নিরবে দাঁত ব্রাশ করেন। হয়তো বাবা চায় না তার কারণে কারো এক ফোঁটা কষ্ট হোক। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম বাবার সেই বিশ্রী কুলি করাকে আমি খুব মিস করছি। খুব সূক্ষ্ম  অথচ জোরালো এক হাহাকার চাইছে বাবা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিক। হতে পারে সবচেয়ে অপ্রীতিকর কোন মানুষ বা ঘটনা অনেকদিন চোখের সামনে থাকার পর হঠাৎ বিলীন হয়ে গেলে অসহ্যকর কষ্ট দেওয়া প্রকৃতির ইশারার এক অংশ।

ভাবলাম সকালে আজ বাবার সাথে কিছুক্ষণ  কথা বলব। আজকাল বাবাকে খুবই বিমর্ষ দেখায়। কারো সাথে তেমন কোন কথা বলেন না। মা'ও বাবাকে তেমন পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। আশ-পাশের বাড়ি থেকে যখন প্রতি শুক্রবার পোলাওয়ের গন্ধ বের হয়, তখন বাবা আমাদের আহ্লাদ মেটাতে পারে না বলেই  বাবার প্রতি মায়ের এই উদাসীনতা হয়ত। কিন্তু আমি আমার বাবাকে চিনি। পকেটের শেষ টাকাটা দিয়ে বাবা আমাদের খুশি করার চেস্টা করে। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের সংসারে এমন ভয়ঙ্কর অভাব নেমে এল কেন কে জানে।

বাবাকে পেলাম না সকালে।
যখন ছোট ছিলাম, প্রায়ই বাবার সাথে অফিসে যেতাম। দুপুর হলেই বাবা মোতালেব চাচার রিকশায় আমাকে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিত। এসএসসি পাশের পর আর বাবার অফিসে যাওয়া হয়নি।

ছোটমামা মা'কে নাকি কিছু টাকা দিবে। তাই সকাল সকাল নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম টাকা আনার উদ্দেশ্যে। টাকা শব্দটার প্রতি আমার একই সাথে খুব বিরক্তি, লোভ আর আকর্ষণ। টাকার খুব অভাব আমাদের, এই জন্যই হয়ত।

মা যদি আমাকে বলত, "বাবু যা তো তোর মামার কাছ থেকে খবর নিয়ে আয় তোর নানার অসুখের এখন কি অবস্থা!"

আমি যেতাম না। এক কথায় বলে দিতাম "পারব না"। যেহেতু টাকার কারবার তাই এত আগ্রহে রাজি হয়েছি। মা কে একটু বললেই মা আমাকে সেখান থেকে পাঁচশ  টাকা দিলেও দিতে পারে। টাকার খুবই প্রয়োজন আমার। এত বড় একটা ছেলে যখন দোকানে চা খেতে যায় তখন সন্দেহ নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখে  পাঁচ টাকা আছে তো? চিন্তা করা যায়!

মামাদের বাড়ি আসলেই আমার মন টা খারাপ হয়ে যায়।
সৃষ্টিকর্তার উপর দাবানলের মত রাগ চেপে যায়। কেন মামাদের এত টাকা-পয়সা? কেন মামারা এত বড়লোক?
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি গম্ভীর মুখে। দোতলার বারান্দা থেকে রেখা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
-"এই এই বাবুল ভাই। দাঁড়িয়ে আছেন কেন ওভাবে, ভেতরে আসেন।"

আমি তাকিয়ে খুব ছোট করে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাসের হাসি দিলাম। এত দূর থেকে হাসি দেখতে পাওয়ার কথা না। যদি দেখা যেত, তাহলে নিশ্চই রেখা দেখতে পেত তার ফুপাতো ভাইয়ের হাসিতে এই পাকা বাড়ির প্রতি কতটুকু ঘৃণা।

রেখা দৌড়ে নেমে এলো। কি সুন্দর হয়েছে দেখতে। আমাদের রেনু আর রেখা মাত্র এগারো দিনের ছোট-বড়।

অথচ আমাদের রেনুর চেহারাতে কেমন একটা অসহায় অসুখী অসুখী ভাব। আমি এক নজরে কল্পনা করে নিলাম চকচকে আভিজাত্যের মধ্যে বড় হওয়া আমাদের রেনুর মুখ। কি সুন্দর!

টাকা মানুষকে কত বদলে দিতে পারে।
বললাম,
-"রেখা, মামী কি বাসায়?"

আমার চোখ মুখ উজ্জ্বল করে দিয়েদিয়ে রেখা বলল,
-"নাহ। মা নাই। আপনি আসেন।"

মামীকে আমার একদম পছন্দ না। পাঁচ বছর আগে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। সবাই আমরা একসাথে থাকতাম। সারাদিন উৎসব উৎসব আমেজ থাকতো আমাদের বাড়ি জুড়ে।
বড়মামা একসময় ফরিদপুর চলে গেলো তার সংসার নিয়ে। শুরু হলো ছোটমামীর রুটিন করে তিনবেলা কথা বলা। কতবার বাবাকে শুনতে হয়েছে, "শ্বশুরের জায়গায় থাকা আর ঘরজামাই থাকা একই কথা"।

বাবাকে কোনদিন দেখিনি একথায় ভ্রুক্ষেপ করতে। শুধু বড় আপার একটি ঘটনার কারণে ছোটমামী বাবাকে আলাদা সংসার পাততে বাধ্য করান।

বসার রুমে ঢুকেই দেখি ছোটমামী টেবিলে কাজ করছে। আমি রেখাকে বললাম,
-"মামী বাসায় নেই মিথ্যা বললি কেন?"

রেখা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে ছোটমামীর সামনেই বলে ফেলল,

-"মা কি বাঘ না ভাল্লুক? নাকি আপনি রসগোল্লা যে মা বাসায় থাকলে আপনাকে খেয়ে ফেলবে? মা কে আপনি ভয় পান কেন বলেন তো?"

সেদিন টাকা পেলাম না। মামী আমাকে টেবিলে খাবার দিয়ে বলল,
-"আজ তো তোমার মামা বাসায় নেই। কাল একবার এসো বিকেলে। পারলে রেনু আর লিটুকেও নিয়ে এসো। রেখা কে কাল দেখতে আসবে।"

আমি একবার শুধু রেখার দিকে তাকালাম। রেখা কতবড় হয়ে গেছে এই প্রথম লক্ষ করলাম।

:::তিন:::
দুপুরের একটু পরপর বড়রাস্তার মোড় দিয়ে ফিরছিলাম। এইদিকে তেমন আসা হয় না আমার। বাবার অফিসও এদিকেই।  ভাবলাম বাবার সাথে দেখা করেই যাই।

বাবার অফিসে  আমার জন্য এতবড় একটা ভয়ঙ্কর  খবর অপেক্ষা করছিলো, আমি ভাবতেও পারিনি।  অফিসে গিয়ে বাবাকে পেলাম না। বাবা কোথায়- এই প্রশ্নে সবাই আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালো। যেন আমি খুবই অবাক করার মত একটা প্রশ্ন করেছি।

আমাকে ঘিরে যখন লোক জমা হচ্ছে আর আমি যখন অবাক হওয়ার চরমে পৌঁছেছি, তখন ক্যাশ সেকশনের আরেকজন ইদ্রীশ চাচা এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন।

কোন ইতস্তত না করে বললেন,
-"বাবু, তোমার বাবার দু'মাস হলো চাকরি  নেই একথা  জানায়নি তোমাদের?"

এমনিতে দুপুরের প্রচণ্ড গরমে আমার গা ঘামছিলো। খরটাতে আমার গা একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। আমি প্রচণ্ড অনিচ্ছা আর অস্বস্তি নিয়ে লক্ষ করলাম আমার  চোখে অজস্র জলের ধাক্কা।

বাবা নাকি অফিসের ক্যাশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা মেরে দিয়েছে। 
কী আশ্চর্য  আমার বাবা এমন  কাজ করতেই পারে না। রাস্তার ভিক্ষুককে খুশি করার জন্য যে বাবা নিজের ঈদের জামা কিনতে চায় না, সে বাবা কখনও  এই ধরনের কাজ করতে পারে না।

ইদ্রীশ  চাচা জানালেন বাবা নাকি কোন একটা অফিসে খুবই নিম্নমানের একটা পার্ট টাইম কাজ নিয়েছে।
কষ্টে আমার গা কাঁপতে লাগলো। আহারে। আমার সরল বাবা টা হয়তো এই প্রখর রৌদ্রে মুখে সীমাহীন চিন্তার ছাপ ফেলে কোন ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটছে একটা কাজের আশায়। কটা টাকা কামানোর আশায়।

বাবা কি সকালে কিছু খেয়েছে? দুপুরেও কি বাবা এখন কিছু খায়?
আমার মনে হলো কান্না বুঝি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে। ইদ্রীশ চাচা কি মনে হতে পকেট থেকে দু'হাজার টাকা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "কাঁদে না বাবা। খারাপ কিছু হয়নি। টাকাটা রাখো। তোমার বাবার পাওনা ছিলো।"

:::চার:::
মানুষের জীবন দু'রকম  অনুভূতিতে  ভরপুর থাকে।
আনন্দের অনুভূতি  আর কষ্টময় মুহূর্ত। আমাদের সংসারে আনন্দময় কোন অনুভূতি গত পাঁচ বছরে হয়েছে বলে মনে হয় না আমার। জীবন এত জঘন্য হয় তা আমাদের পরিবার দেখলেই বোঝা যায়। বেঁচে থাকার জন্য আমার যেটুকু সান্ত্বনা তা হলো- বাবার সরলতা, মা আর রেনুর অজস্র ভালোবাসা।

আর লিটুর অসম্ভব  সুন্দর একটি স্বপ্নময় মুখ।

রেনু সম্ভবত  আমাদের এই অস্বচ্ছলতায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে। কিন্তু ও কাওকেই বলে না কিছুই। খুব মুখচোরা আমাদের রেনু।

কিন্তু একদিন আমার কাছে রেনু ধরা খেয়ে গেলো।
আমি এক শুক্রবার রেনুর টেবিলের নিচ থেকে একটা ডায়রি উদ্ধার করলাম।
আমাদের চুপচাপ এই বোনটা আমাদের পরিবারের খঁটিনাটি দুঃখ-কষ্ট, ছোট আনন্দ সব লিখে রেখেছে।

ডায়রির উপরে ক্যাপশন  লিখেছে, "আমাদের দুঃখী  পরিবার"।

আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে পড়তে শুরু করলাম..

২৩ জুন, ২০১২
আজ খুবই খারাপ লেগেছে আমার। পাশের বাসার ধনী বাবার মেয়ে মোহনার সাথে লিটু সারাদিন খেলে। আজ  পাশের কমিউনিটি  সেন্টারে মোহনাদের দাওয়াত ছিলো। মোহনা সকাল থেকেই লিটুর কাছে দামী দামী খবারের গল্প করেছে।  শেষমেশ মোহনা তার মাকে রাজি করিয়ে সন্ধ্যায় লিটুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আমার মা লিটুর সব থেকে ভালো জামাটা পরিয়ে ওদের সাথে পাঠালো। পরে শুনলাম লিটুকে নাকি কমিউনিটি  সেন্টারে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ওর নাকি দাওয়াত নেই।
লিটুর মন খারাপের পরিমান চিন্তা করে মোহনার মার কাছে গেলাম। মোহনার মা বলল লিটুই নাকি ভিতরে ঢুকতে চায়নি।
আমার ভাবতে অবাক লাগে এখনও কি পৃথিবীতে  এমন মানুষ আছে যে এতটুকুন ছেলের মায়াবী মুখ দেখেও ফিরিয়ে দিতে পারে? বাইরে লিটু, আর ভেতর থেকে আসা দামী খাবেরর গন্ধ; ওই অবস্থায় লিটুর কেমন লাগছিলো?
রাতে দাদা বাসায় এসে মায়ের সাথে খুব রাগারাগি  করলো। মা নাকি অভদ্র হয়ে গেছে। অভাব নাকি মানুষকে অভদ্র, নির্লজ্জ করে দেয়। লিটু ঘুমিয়ে ছিলো। দাদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি স্পষ্ট লক্ষ করলাম দাদার চোখ ভেজা। আমার এত খারাপ লাগলো। দাদা কথা দিলো কাল আমাদের দামী কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াবে। টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
আমি পৃথিবীতে সবচে বেশি ভালোবাসি আমার এই দাদা কে। কিন্তু এই কথা কেউ জানে না।

ডিসেম্বর ১২, ২০১২.
আজ ছোটমামী কি মনে হতে আমাকে দামী একটা শাড়ি পাঠালো। আমি এত আনন্দিত কোনদিন হয়েছি কি না জানি না। মা'ও খুব খুশি। মা তার ট্রাংক খুলে জমানো টাকা থেকে আমাকে কিছু টাকা দিলো ম্যাচ করে ব্লাউজ, পেটিকোট বানানোর জন্য। রাতে শাড়িটা পড়লাম। বাবা মুগ্ধ হয়ে বলল, "আমাদের রেনু মা কে এত সুন্দর লাগছে। টাকা জমিয়ে আমি তোকে এর থেকে সুন্দর শাড়ি কিনে দেব।" খুশিতে আমার চোখ ভিজে আসলো। এই প্রথমবারের মত মনে হলো পৃথিবীতে আমাদের থেকে সুখি কেও আছে কি?

ডিসেম্বর ১৪, ২০১২.
ছোটমামীর দেয়া শাড়িটা পাশের বাসার মিনু আপা দেখতে এলো। আমি মহা আনন্দে ট্রাংক থেকে শাড়ি এনে বিছানায় মেলে ধরলাম।
মিনু আপাও খুব অবাক হলো এটা নাকি খুব দামী শাড়ী। কিছুক্ষণের  মধ্যে মিনু আপা আবিষ্কার করলো শাড়ীর পাড়ের দিকে দু'তিন জায়গায় ফুটো। কি আশ্চর্য আমরা কেউ এটা আগে লক্ষ    করিনি।
মিনু আপা আমাকে মন খারাপ করে দিয়ে বললেন,
-"শাড়ীতে সমস্যা  ছিলো বলেই নাকি মামী আমাকে এটা দিয়েছে। এমন সমস্যাওয়ালা দামী শাড়ী নাকি ঢাকার ফার্মগেট,গাউছিয়া এলাকায় ফুটপাতে দু'তিনশো টাকায় পাওয়া যায়।
রাতে বিশ্রী একটা অবসাদ নিয়ে আমি আজ ঘুমুতে যাচ্ছি।

...রেনুর মত বোন পেয়ে আমি খুব গর্বিত। আমার ধারণা রেনু এইটুকুন বয়সেই খুব মহান হয়ে গেছে। দারিদ্র্য  আসলেই  কাওকে কাওকে মহান করে দেয়।

:::পাঁচ:::
বাবার চাকরি না থাকার খবর টা আমি বাসায় বললাম না।  এমনকি বাবাকেও এ নিয়ে কিছু বললাম না। বাবা চাইছিলেন না এই চিন্তা করার মত খবরটি আমরা যেন না জানি। কারণ এতে করে সবার মন অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে যাবে। বাবা একা একাই এটা হজম করে ব্যাপারটি চেপে যেতে চেয়েছেন। আহা কত কষ্টই না বাবা মনে মনে  সহ্য করেছেন।

রাতে খাবার পর আমি বাবাকে ডেকে আমার রুমে নিয়ে এলাম। বাবা কিছু আঁচ করতে পারলেন কি না কে জানে, অকারণে হঠাৎ বাবার কথা বলা বেড়ে গেলো।
"হ্যাঁ রে বাবু তোর মাস্টার্স শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?"
"বাবু, রেনুর জন্য যে ছেলেটা দেখেছিলাম, ওই যে গার্মেন্টেসে চাকরি করে ওর সাথে বিয়ে দিলে কেমন হয়। ভাবছি রেনুটাকে ধুমধাম করে বিয়ে দেবো।"

বাবার ভাবখানা এমন যেন ব্যাংকে বাবা গাদা খানেক টাকা জমা করে রেখেছেন। যখন ইচ্ছা ছো মেরে এনে খরচ করা যাবে।
আমি বাবাকে বললাম,
-"শোনো বাবা আমি  একটা কোচিং এ দু শিফটে পড়ানোর কাজ নিয়েছি। মাস শেষে খুব খারাপ টাকা পাওয়া যাবে না। আমি চাই তুমি তোমার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাসায় রেস্ট নাও। মা'কে রাজি করানোর দায়িত্ব  আমার।"

বাবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। বাবা আমার বিছানায় বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে শীতল  গলায় বললো-
-"তোর মাকে কিছু বলিস না বাবু। তোর মা খুব বোকা।  এতে অনেক কষ্ট পাবে। তুই আমার অফিসে কবে গিয়েছিলি?"

আমার ঠিক কি কারণে জানি না গহীন এক কষ্টে বুক ভারী হয়ে এলো। অসহায়, সরলভাবে বসে থাকা আমার বাবার  ঘাড়ে হাত রেখে বললাম,
-"তুমি পৃথিবীর সেরা বাবাদের একজন তুমি জানো? তোমার মত বাবা পেলে প্রতিরাতে এখন থেকে আমি কাঁচকলা সিদ্ধ ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে পারবো।"

আমার হঠাৎ আবেগ দেখে বাবা আমার দিকে পৃথিবীর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।

:::ছয়:::
আমার ধারণা অত্যন্ত ভুল ছিলো। আমি ভেবেছিলাম সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমাদের জন্য শুধু কষ্টই লিখে রেখেছেন।
তার বিপরীত প্রমাণ আমরা খুব শীঘ্রই পরপর দু'বার পেয়ে গেলাম।

শুক্রবার ঠিক সন্ধ্যায় আমাদের বাসার দরজায় কড়া নারার শব্দে আবছা আলোয় দরজা খুলে আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে পরিপাটি করে শাড়ি পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুব চেনা চেহারা।
আমার মনে আছে, ঠিক দুমিনিট আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। দু'মিনিট পর আমি প্রায় অস্পষ্টভাবে  বললাম,
-"তুই মিতা আপা না?"
একথায় আমাকে ধমক দিয়ে মেয়েটি বলল,
-"একটা চড় খাবি ফাজিল। মিতা না তো কি আপা? পাঁচ বছরে মিতা নিশ্চই সীতা হয়ে যায় না।"

আমি প্রায় এক চিৎকার দিয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে জমিয়ে ফেললাম।
মা হতভম্ব হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে বসে গেলো। আপার চোখে পানি অথচ হাসছে আর বারবার বলছে কি কাণ্ড!  কি কাণ্ড !
আমাদের রেনু শুধু একবার  আপার হাত ধরে "আপা তুই খুব খারাপ। তোর সাথে আমার কোন কথা নেই আল্লাহর কসম" বলেই দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।

লিটু বারান্দায় ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে। শুধু বাবা চুপচাপ।  বাবা খুবই স্বাভাবিকভাবে শান্তগলায় আপাকে বলল,
-"মিতা ঘরে যা। হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নে।"

আমি "রাখো তোমার খাওয়া" বলে আপাকে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে আমার রুমে নিয়ে আসলাম।
রেনু থাকতে পারলো  না। দরজা খুলে চলে আসলো আমার রুমে। আমি বললাম,
-"রেনু আল্লাহর কসম বললে কথা বলতে হয় না। তুই যা ঘরে  গিয়ে দরজা আঁটকে কান্না কর।"

আপা হাসতে  হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি। হাসার একফাঁকে বলে দিলো, "তোরা এত আনন্দে আছিস আমাকে জানাসনি কেন?"

পাঁচ বছর আগের ঘটনা। তখন আমরা মামাদের সাথে থাকি। মামীর কিছু গা জ্বালানো কথা বাদে আমরা খুব আনন্দেই ছিলাম।
আমাদের পাড়ায় সুনামগঞ্জ  থেকে একটি  ছেলে আসলো। নাম রতন। আমাদের ধারণা শুধু মেয়েদের চোখই অসাধারণ পাগল করা হয়। এই রতন সাহেব আমাদের সেই ভুল ভাঙিয়ে দিলো। এত সুন্দর মায়াবী চোখ নিয়ে জন্মেছেন উনি।

রতনভাই ভাড়া নিলো ছোটমামীদের রান্নাঘরের বাকি অংশের একটি রুম। খুবই শান্ত কিন্তু আমুদে ছেলে । একা একা রান্না করে খেতো। আমাদের বাসায় ভালো কিছু রান্না হলেই রেনু আর মিতা আপা মিলে তাকে দিতে যেতো। একটা কথাও বলত না । হাসি মুখে খাবার রেখে বাটিটা কলতলায় নিয়ে ধুয়ে আপার হাতে ফেরত দিতো।

আপা তো একদিন বলেই ফেললো,
-"আপনি তো দেখি বেশ অভদ্র। একটা ধন্যবাদও দেন না।"
আপাকে নাকি সে বলেছে "এই পৃথিবীতে ধন্যবাদের কোন দাম নেই। ভালোবেসেছেন, খাবার
দিয়েছেন। প্রতিদান হিসেবে কোন একদিন ডাবল) ল ভালোবাসা ফেরত পাবেন। কথাপ্পপ্পপ্পল দিচ্ছি।"প

তখন আমাদের রেনু ক্লাস এইটে পড়ে। একদিন সন্ধ্যায় রেনু  গরুর মাংশের বাটি ফেরত এনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "রতন ভাই হিন্দু। গরুর মাংস হিন্দুরা খায় না। রতন ভাই ফেরত দিয়েছে। এখন কি হবে আপা?"

মহাবাংলাদেশ অশুদ্ধ হচ্ছে এমন ভাব করে রেনু কথাগুলো বলল। আমরা সবাই হেসেই খুন।

মিতা আপা রতনদার জন্য অজস্র ভালোবাসা জমা রেখেছিলো। কারণে অকারণে সারাক্ষণ রতনদার কথা বলত। একদিন রাতে খাবার সময় মিতা আপা বলল,
-"রতনদা খুব নোংরা।  গায়ে এত বিশ্রী ঘামের গন্ধ।  ইয়াক!"

মা অবাক হয়ে বললো, "তুই কি ওর কাছে যাস নাকি?  গন্ধ, নোংরা জানিস কিভাবে? তোর মামী কিন্তু আমাকে খুব খারাপ ভাষায় কিছু কথা বলেছে। তুই আর রতনের ওখানে যাবি না।"

আপা অবাক হয়ে বলল, "আমি ওনার ঘরে যেতে যাবো কেন। আমার ঠেকা কিসের?"

অথচ পরদিন সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের সবাইকে অবাক আর হতভম্ব করে সেই ইয়াকওয়ালা  ঘামের গন্ধের রতনদার সাথে আমাদের আপা কোথায় যেন চলে গেছে।
রেনুর খাতায় লিখে গেছে ছোট একটা চিঠি।

মা,
রতন দা কে আমি কেন জানি ভুলতে পারব না।
ওনার রুমে যাওয়া বন্ধ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
আমি তোমাদের খুব বোকা মেয়ে, তাই পালিয়ে যাচ্ছি।
তোমরা একদম কষ্ট পাবে না পায়ে ধরি। মামী গালাগালি করলে মামীর মুখে খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দিও। পারবে না? হি হি হি।

-মিতা খাতুন।

মা, বাবা, মামা-মামীর লজ্জা, রাগ, ক্ষোভ কষ্ট এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে আপার তেমন কোন খোঁজ খবর কেউ নিলো না। ত্যাজ্যপুত্র করা যায়। কিন্তু কিভাবে ত্যাজ্যকন্যা করতে হয় তা বাবা জানেন না। তারপরও কেউ বাবার কাছে আপার কথা জানতে চাইলে বাবা বলত, "খোঁজ জানি না। ত্যাজ্য করে দিয়েছি।"

তারপরই আমরা আলাদা হয়ে সংসার পাতলাম। কারণ মামী ছোটমামাকে বলে দিয়েছে, আমরা তাদের সাথে থাকলে তিনি মামার সাথে সংসার করবে না।

::সাত::
মানুষের মৃত্যুর শোক প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর পর যেমন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, ঠিক তেমনই ধীরে ধীরে আমরা মিতা আপাকে প্রায় ভুলেই গেছিলাম। শুধু মাঝে মাঝে বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে এবং প্রতি ঈদে আপার জন্য মায়ের কান্না আর বছরে আপার পাঠানো দু'একটি চিঠি ছাড়া তেমন কোন হৈচৈ আপাকে নিয়ে হত না।
আমরা জেনেছিলাম আপা রতন দা'কে নিয়ে সিলেট আছে। এবং সুখেই আছে।

মাঝরাত পর্যন্ত আপার সাথে গল্প করলাম। আপা বেশ সুখে আছে শুনেই বোঝা গেলো।
আপা এসেছে সেই কখন, অথচ এতক্ষণ কিছু না বলে  মাঝরাতে আপা বলল তার নাকি তিন বছর বয়সী এক মেয়ে আছে।
কী আশ্চর্য আমাদের মিতা আপার মেয়ে। আমি আর রেনু প্রায় একসাথে বললাম , "ওকে নিয়ে আসিস নি কেন?"
আপা বলল, "তোরা যদি বাসায় উঠতে না দিতি তাহলে আমি ওকে নিয়ে কোথায় যেতাম? তাই একা এসে প্রথমে ট্রায়াল দিলাম।"

ঘুমুতে যাওয়ার ঠিক আগে আগে আপা আমাকে চমকে দিয়ে একটা কথা বলল।
-"বাবু একটা  কথা বলি। আমার গা ছুঁয়ে বল মাকে আগেই কিছু বলবি   না। তাহলে বাবা অপমানিত হবে।"
-"ধুর কাওকে বলব না। কাহিনী কি বলতো?"

আপা কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-"বাবা কিন্তু আমাকে প্রায়ই দেখতে যেতো। বাবার সাথে আমার যোগাযোগ ঠিক ছিলো। বাবাই তো চিঠি লিখে আমাকে আসতে বলল কিছু টাকা নিয়ে।"

আমার এত আনন্দ আর গর্ব হলো বাবাকে নিয়ে। বাবাকে আমি ধরতে পারিনি, এজন্য নিজেকে অনেক বোকা লাগলো।
মনে হলো এই যে আমি, মা,বাবা, রেনু, আপা, মামী, রেখাসহ সব মানুষই হচ্ছে একেকটা নিরেট পাথরের দেয়াল। যে দেয়ালের একপাশ আমরা শুধু দেখতে পাই। প্রতিটি দেয়ালের ওপাশে অবধারিতভাবে আরেকপাশ থাকে। যা শত চেস্টা করেও আমরা দেখতে পাই না। আবার খুব সহজেই দেখে ফেলি। দেয়ালের ওপাশে কি হয় না হয়, তা কি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে? আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়। মা, বাবা, রেনু, আপা সহ অনেকের মনের দেয়ালের ওপাশে কি কষ্ট, কি বেদনা অথবা কি সুখ আনন্দ মিশে আছে তা দেখার এত সাধ আমার।

::আট::
ঁঁক
বাবা বাসা থেকে আজও না খেয়েই বের হতে যাচ্ছে, ঠিক তখন ইদ্রীশ চাচা এলো আমাদের বাসায়।
বাবা বুঝে ফেললেন অফিস নিয়ে কোন কথা বলবে নিশ্চয়ই। তাই বাবাকে দেখে মনে হলো একরকম অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন তিনি।
আমিও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি। কি বলতে এসেছেন চাচা। অনেকক্ষণ থাকলেন তিনি, কিন্তু অফিস সংক্রান্ত কোন কথাই বললেন না।
যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে অতি সাধারণ ভাবে বাবাকে বললেন,
-"ভাই ক্যাশের পঁচিশ হাজার টাকার খোঁজ পাওয়া গেছে। বড় স্যার খুবই ব্যথিত। আজ আপনাকে ফিরে যেতে বলেছে। খুব করে বলেছে আমি যেন আপনাকে নিয়েই অফিসে যাই। আপনি আবার রাগ করে না বলবেন না দয়া করে।"

দেখলাম বাবার চোখ লাল হয়ে এসেছে। এইতো এখনি জল জমা হবে। যখন বাবাকে চোর বলা হয়েছিলো, তখন বাবার চোখ এমন হয়নি আমি নিশ্চিত। এখন হচ্ছে। হওয়ার কারণ আছে।

মা, রেনু, আপা ইদ্রীশ চাচার কথা কিছুই বুঝলো না। বাবা ইদ্রীশ চাচার সাথে কোনরকম কথার প্যাঁচে না গিয়ে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার পুরোনো অফিসে চলে গেলেন।

মা বারবার আমাকে বলল, "ঘটনা কি? ঘটনা বুঝলাম না।" আমি শীতল গলায় মহাপুরুষদের মত বললাম,
-"সব ঘটনা সবাইকে জানতে হয় না। না জানলে কোন ক্ষতিও হয় না। প্রকৃতির খেলা তাকে নিজ মনে খেলতে দিতে হয়।"

হয়ত মা ভাবলো আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো মা।

ছোটমামা যে টাকাটা দিতে চেয়েছিলো সেটা নিয়ে মা আর বেশি কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু আমি ছাড়বার পাত্র হব কেন? মায়ের ভাগের সব জমিই তো জালিয়াতি করে মামা দখল করছে। এই যে তাদের প্রাসাদের মত বাড়ি, এখানেও তো আছে মায়ের টাকা। মায়ের অধিকার লুট করা টাকা।

সন্ধ্যার পর  গেলাম মামাদের বাসায়। বাড়ি ভর্তি লোকজন। বসার ঘরে মোটামোটা কয়েকট মহিলা, যারা আনাড়ি ভঙ্গিতে পান চিবিয়ে ঠোঁট লাল করছে।

রেখা আমাকে দেখেই ছুটে এলো। আমার আসার উদ্দেশ্য রেখা বুঝে ফেলেছিলো হয়ত। বেণী দুলিয়ে সরাসরি বলে ফেললো,
-"নিশ্চয়ই টাকা নিতে এসেছেন?"
-"হ্যাঁ। তোর কোন সমস্যা?"
-"না সমস্যা না। ফকিরের মত এমন হাত পাততে আসেন কেন বলেন তো বাবুল ভাই।"

-"কারণ আমরা ফকির তাই। রেখা এরা কারা? তোদের বাড়িটাকে এতিমখানা অথবা আয়েশখানার মত লাগছে।"
-"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বাবুল ভাই। এরা বরপক্ষের লোকজন। বিয়ের আগেই বেড়াচ্ছে আমাদের বাড়ি। আগামী পনেরো তারিখ আমাদের বাড়িতেই দু'পক্ষের সবার উপস্থিতিতে বিয়ে হবে। দোতলায় কনেপক্ষ। আর নিচতলায় বরপক্ষ। আমার বরের বাড়ি আবার সীতাকুন্ডু। মা চায় না এতদূর থেকে বিয়ে আসুক। কী অদ্ভূত বিয়ে বুঝতে পারছেন?"
-"না বুঝতে পারছি না। তোর বিয়ে আর আমরা কিছুই জানলাম না? আমার মা কি তোদের কিছু হয় না?"
-"এত অস্থির হচ্ছেন কেন? ঠিক সময়েই দাওয়াত পেতেন। আমার বরের সাথে দেখা করবেন? ভদ্রলোক এখন আমাদের বাড়িতেই আছেন। আসুন।"

বরের সাথে রেখা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এইভাবে- "এই হচ্ছে  আমার ফুপাতো ভাই বাবুল। খুব গর্ধব। টাকা নিতে এসেছে।"

আমি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। রেখা এমন উন্মাদের মত কথা বলছে কেন?
রেখার বর হাতজোড় করে বলল, "প্লিজ কিছু মনে করবেন না ওর কথায়। সকাল থেকেই ও উল্টাপাল্টা বলছে। আপনাদের কথা রেখার মুখে অনেক শুনেছি।"
রেখার বর কে আমার বেশ পছন্দ হলো। বেশ সাদামাটা অসম্ভব ভদ্র একটা ছেলে।

টাকা পেলাম। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। বাসা থেকে বের হব ঠিক তখন রেখা হামলে পড়লো।
-"বাবুল ভাই কথা আছে ছাদে চলুন একটু।"
-"এখানেই বল।"

রেখা আমাকে জোড় করে ছাদে ডেকে এনে বাংলা ছবির নায়িকাদের মত বলল,
-"আপনাকে আমার ভালো লাগে বাবুল ভাই।"
-"তোকেও আমার ভালো  লাগে।"

রেখা আর কোন কথা  বলল না।
আমাকে হুট করে চমকে দিয়ে অস্বস্তি নিয়ে ছাদের অন্ধকারে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি ওকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, "এই কথা বলতে ছাদে ডাকতে  হয়। তোর উদ্দেশ্য কি বলতো? আমাকে চুমু খেতে চাস? আয় চুমু দে।"

রেখা মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।
হঠাৎ রেখার এমন আচরণ আমাকে খুব অবাক করলো। কিছু সময়ের জন্য মনে হলো পৃথিবীতে আমার জন্মই হয়েছে বুঝি অবাক হবার জন্য।

:::নয়:::
রেখার বিয়েতে আপা থাকলো না। আপা চলে গেলো তার দুদিন আগেই। এবার গিয়ে আপা মেয়ে আর রতনদা কে নিয়ে আসবে।
সব ঠিকঠাক মতই চলছিলো।

রেখার বিয়ের দিন খুব সকালে বাবা বাদে আমরা চারজন মামাদের বাসায় চলে এলাম। খরচের চূড়ান্ত করছেন আমার ছোটমামা। আমরা টাকার অভাবে লিটুকে ইলিশ মাছ খাওয়াতে পারি না। আর এখানে রেখার বিয়ের জুতাই কেনা হয়েছে চার হাজার টাকা দিয়ে।

আমাদের রেনু সারাক্ষণ রেখার সাথে শপিঙের জিনিস দেখতে থাকলো। যেটাই দেখে, চোখ যতদূর সম্ভব কপালে তুলে  রেনু বলে, "এ আল্লা এটা এত সুন্দর? কিহ্? বারো হাজার টাকা?"
রেনুর উচ্ছ্বাস দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যায় এমন অবস্থা। খুব ইচ্ছা হয় রেনুকে অনেক দামী দামী কিছু কিনে দেয়ার। সৃষ্টিকর্তা সে ক্ষমতা সবাইকে দেয় না। তিনি তার সৃষ্টির একাংশকে সাধ দিয়েছেন, সাধ্য দেননি। তাদের একমাত্র চোখ কপালে তুলে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন।

আমি রেনুকে ডেকে একফাঁকে বললাম, "এমন  ছোটলোকের মত করছিস কেন? আমার খারাপ লাগছে রেনু।"

আমাদের রেনু খুব অভিমানী। খুব অল্পতেই ওর অভিমান অনেক। একবার বাবা আমাদের সবাইকে বাজারে নিয়ে গেলেন। সবাইকে আলাদা আলাদা ভাবে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের প্রিয় খাবার কি? আমরা সবাই সবকিছু খেলাম। শুধু রেনু খেলো না কিছুই। বলল ওর পেট ব্যথা করছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

বাসায় এসে প্রায় দু'ঘন্টা চুপচাপ কাঁদলো রেনু।
বাবার অপরাধ, বাবা দোকানীর সামনে রেনুকে জিজ্ঞেস করেনি যে ওর প্রিয় খাবার কোনটা। ও এতে লজ্জা পেয়েছে। এমন পাগলী মেয়ে ছিলো রেনু।

সারাদিন পর সন্ধ্যায় কেলেঙ্কারী হয়ে যায়, ঠিক এমন একটা খবর আসলো। বর নাকি রেখাকে বিয়ে করতে চাইছে না। তার নাকি আমাদের রেনুকে খুব পছন্দ হয়েছে। গল্প-উপন্যাসে এমন হয় শুনেছি। বাস্তবে এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ঘটনা কতখানি সত্যি আমি জানি না।

ছোটমামী একফাঁকে আমাকে আর মাকে রান্না ঘরে ডেকে এনে মাকে বললেন, "আপা পায়ে ধরি রেনুকে নিয়ে আপনারা চলে যান। আপনারা এখানে থাকলে সব শেষ।"

লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়া অবস্থা। আমরা যখন সবার কাছ থেকে 'রাত হয়ে যাচ্ছে' এই দোহাই দিয়ে বিদায় নিচ্ছি তখন ছোটমামী আমাদের পুরোপুরি উদ্বিগ্ন  করে দিয়ে বললেন রেখার সোনার পাঁচভরির হারটা পাওয়া যাচ্ছে না।

কি হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। মামা এসে মা'কে ধমক দিয়ে বলল,
"তোমাদের এখন যেতে হবে না। কাল সকালে যেও।"

রাত বারোটার দিকে সোনার হার উদ্ধার হলো।
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চমক উপহার দিয়ে সবার সামনে ছোটমামী রেনুর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে হারটি বের করে আনলো।
লজ্জায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

রেনু আর মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম,
-"রেনু তুই হার চুরি করেছিলি?"
রেনু অসহায়ের মত বলল,
-"হ্যাঁ। এমন একটা হারের খুব শখ ছিলো আমার।"

আমি রেনুর কথা বিশ্বাস করলাম না। জানি রেনু কষ্টের মাত্রা ছাড়িয়ে মিথ্যা বলছে। রেনুর মানসিক কষ্টের কথা চিন্তা করে আমার মরে যেতে ইচ্ছা হলো। কি লাভ পৃথিবীতে থেকে। এই পৃথিবীর সকল কষ্ট কি আমাদের জন্যই  বরাদ্দ?

রেখার বিয়ে হয়ে গেলো। আমরা আসলে  এখানে উপযুক্ত ছিলাম না। আমাদের এখানে আসা বিরাট ভুল হয়েছে বুঝতে পারলাম। সবকিছু সবার জন্য না এটা অনেক আগেই বুঝেছিলাম যদিও।

রাতে আমরা রেনুকে খুঁজে পেলাম না। কোথাও না। অভিমান করে কোথায় লুকিয়ে আছে তা রেনুই ভালো জানে। আমি এত ক্লান্ত ছিলাম যে রেনুকে নিয়ে একটুও চিন্তা করতে ইচ্ছা করলো না। নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে ও বাড়িতে চলে গেছে। এই সাহস ওর আছে।

:::দশ:::
রেনুকে আমরা খুঁজে পেলাম পরদিন সকালে। সূর্য ওঠার আগে। রেখাদের বাড়ির পেছনে জংলা পুকুরটার পাড়ে একটা কাঁঠাল বাগান আছে।
সেখানে মায়ের দেয়া নীল রঙের সিল্কের শাড়িটা গলায় পেঁচিয়ে কাঁঠাল গাছের একটা ডালে ঝুলে আছে  আমাদের রেনু। প্রানহীন আমার ছোটবোন।

রেনু মারা যাওয়ার নয়দিনের মাথায় হার চুরির রহস্য ধরা পড়লো। কে রেনুর ব্যাগে হার রেখেছিলো আমরা জেনে গেলাম।

মানুষের মানসিকতার উপর আমার গভীর এক ঘৃণা তৈরি হয়ে গেলো। বিধাতা যদি সবাইকে এমন এক অদৃশ্য হাতুরী দিয়ে পাঠাতো পৃথিবীতে, যে হাতুরী দিয়ে ভাঙা যাবে সবার মনের দেয়াল। তাহলে দেয়াল ভেঙে দেখতে পেতাম কার ভেতর কি খেলা চলছে।
দেখতে পেতাম রেনুর কষ্ট।
তাহলে বুঝে ফেলতাম রেনুর মৃত্যুর  সিদ্ধান্ত। সেই রাতে হয়ত রেনুকে  বুঝতে পেরে বলতে পারতাম আড়ালে ডেকে,
"বোকা মেয়ে, কিভাবে ফাঁসের গিট দিতে হয় চিন্তা করছিস এ নিয়ে? তোকে মরতে হবে না। আমি আছি না? আমি না পৃথিবীর সেরা দাদা? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?"

রেনুর না থাকা আমাদের সংসারকে একদম ভেঙে দিলো। সবাই গম্ভীর হয়ে গেলো বাড়ির। মনে হলো না আমরা রেনুকে কখনও ভুলতে পারবো।

মুখে আমার এখন আরো বেশি রুচি নেই। কিছু খেতে ইচ্ছা করে না রেনুকে ছাড়া। রাতে মা ডিম ভেজে আমার ঘরে ভাত নিয়ে আসে। রাজ্যের কষ্ট মায়ের মুখে। আমি তাকাতে পারি না। মাকে বলি,
"মা আমার খেতে ইচ্ছা করে না। রেনুকে খুব মনে পড়ে।"

কোন কোন রাতে আমি সহ্য করতে না পেরে মেয়েদের মত বিলাপ করে কেঁদে ফেলি।
ইচ্ছা করে মরে যেতে। বেঁচে থাকায় কোন সুখ খুঁজে পাই না।
মাঝে মাঝেই মাঝ রাতে ভাবি, ছেলেরাও কি গলায় নীল সিল্কের শাড়ী পেঁচিয়ে কাঁঠাল গাছে ঝুলে পড়তে পারে? ♦♦

āĻ•োāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāχ:

āĻāĻ•āϟি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āϟ āĻ•āϰুāύ