নস্টালজিক মন
লেখা: মিশু মনি
.
২০৮০ সাল।
দেখতে দেখতে জীবনের অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেছে! একাশি বছর বেচেছি! অনেক দীর্ঘ সময় জীবনকে দেখলাম!
পৃথিবী আর আগের মত নেই।সবকিছু এত দ্রুত বদলে গেছে যে মাঝেমাঝে মনে হয় আমি স্বপ্নের রাজ্যে আছি! সবকিছুই অতিমাত্রায় আধুনিক।
বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়না।সারাদিন ঘরে শুয়ে শুয়ে বই পড়া আর কল্পনায় তন্ময়ের সাথে কথা বলেই সময় গুলো পার করি।
বড় ছেলেটা ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে,ছোট ছেলেটা ডাক্তার।ছেলেমেয়েদের ভালো ভাবে মানুষ করতে পেরেছি ভাবলেই মনে শান্তি পাই।তন্ময়ের খুব ইচ্ছে ছিল তার একজন ছেলে সিভিল সার্ভিসে জয়েন করবে।ছেলেরা তার ইচ্ছে পুরন করেছে।মেয়েটা নিউরোলজিস্ট হতে চলেছে।জীবনে যা চেয়েছি তার সব ই তো পেয়েছি! কিন্তু তবুও কিসের যেন শুন্যতা! কিসের যেন হাহাকার!
আমি জানি এটা কিসের হাহাকার।তন্ময়ের শুন্যতা,যা প্রতি মুহুর্তে তীব্রভাবে দহন করে আমাকে। ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হোক,সেটা তো অবশ্যই চেয়েছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল সারাজীবন তন্ময়ের পাশে থাকা।বুক ফেটে কান্না আসে ভাবলে,চাইতাম যেন আমিই আগে মারা যাই।কিন্তু সেটা হলোনা।প্রকৃতি আগে তন্ময় কেই নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে।আজ এত সম্মান, যশ,প্রতিপত্তি,সুনাম,ছেলেমেয়ে, ঐশ্বর্য সবকিছুর মাঝেও শুন্যতা ঘিরে রাখে আমাকে।জীবনে একজন কেই সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছি,সে হচ্ছে তন্ময়।
তন্ময়ের ভাবনায় সারাক্ষণ তন্ময় হয়ে থাকি।ওর মৃত্যুতে যে আমার ও অর্ধেক মৃত্যু হয়ে গেছে।কিভাবে নিশ্বাস চলছে জানিনা।
বই খোলা রেখে একমনে ভাবছি তন্ময়ের কথা।
নাতি নাতনী রা এসে হৈ চৈ শুরু করে দিলো।
এক নাতি বলল,দাদি তোমার এত মন খারাপ হয়ে থাকে কেন সবসময়? দাদু নেই তো কি হয়েছে? আমাদের মাঝে কি দাদুকে খুজে পাওনা?
নাতির কথায় হেসে বললাম,হুম দাদুভাই।এখন তো তোরাই আমার সব।
- দাদি তুমি এসি বন্ধ রাখছ কেন? গরম লাগছে তো।
- এসি,ফ্যানের হাওয়া আজকাল সহ্য হয়না রে দাদু।ভালো লাগে না।
নাতনী লিরা বলল,দাদি গল্প শুনতে আসলাম।
- কি গল্প শুনবি আপুমনি?
- তোমার আর দাদুর ভালবাসার গল্প বলো প্লিজ।
সবাই জোরাজোরি করছে দেখে বলতে শুরু করলাম, ভালবাসা কাকে বলে সেটা তন্ময় ই শিখিয়েছে আমায়।প্রতি মুহুর্ত পাশে থাকত।আমার খেয়াল রাখত,নিজের হাতে খাইয়ে দিতো। আমার কাপড় কেচে দিতো। বলত,তুমি কাপড় কাচলে তোমার সুন্দর হাত গুলা লাল হয়ে যায়।আমার কষ্ট হয়।নখ গুলা ক্ষয়ে যায়।তোমায় কাচতে হবেনা।তন্ময় কোনো কাজের লোক রাখতে চাইত না।নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি পছন্দ করত।
ছোট নাতি অবাক হয়ে বলল,দাদি তোমরা কিভাবে কাপড় কাচতে? কাপড় তো মেশিনে কাচতে হয়।তাহলে হাত লাল হবে কেন?
আমি হেসে জবাব দিলাম, আমাদের সময় হাত দিয়েই কাপড় কাচতাম আমরা।তখন মাত্র ছোট ছোট ওয়াশিং মেশিন তৈরি হয়েছিল।কিন্তু আমরা কিনি নি।তন্ময় কাজ করতেই বেশি পছন্দ করত।
লিরা অবাক হয়ে বলল,হাত দিয়ে রান্না করে খেতে?
- হ্যা।আমাদের সময় রান্নার জন্য যন্ত্র ছিল না।এখন তো যন্ত্রকে নির্দেশ করলেই খাবার তৈরি হয়ে আসে।কিন্তু নিজ হাতের রান্নার অনেক স্বাদ! এখন তো বাসায় চুলা ই নেই, রান্না করা টাও আজকাল ভুলেই গেছি।
বড় নাতি বলল,দাদি, দাদুভাই আর তুমি তো প্রেম করে বিয়ে করেছ।তোমাদের সেই রঙিন দিংগুলি কেমন ছিল?
আমি হেসে বললাম,খুব সুন্দর! আমরা একসাথে জোসনায় হাটতে বের হতাম।তন্ময় সারাক্ষণ কল,এসএমএস দিয়ে পাগল করে দিতো। ও আমি ছাড়া আর অন্য মেয়ের দিকে তাকাত ও না।
- ইস,যদি তখন জন্ম নিতাম! অন্তত প্রেমের স্বাদ উপলদ্ধি করতে পারতাম। আমরা তো প্রেম টাকে ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছি।ভালবাসা কি জানতাম ই না।তুমিই তোমার ছেলেদের মানুষ করতে পেরেছ বলে তারা আমাদের শিখিয়েছে ভালবাসা কি? নয়ত আমরা তো বুঝতাম ই না।কিন্তু দাদি, এখন তো ভালবাসার মত কোনো মেয়ে নাই।সব একেক টা রোবট,নেই কোনো আবেগ,নেই কোনো মমতা।শুধু আছে প্রতিযোগিতা,কে কত টা ফ্যাশনেবল হতে পারে!
আমি উত্তরে শুধু হাসলাম।এখন তো এটা ই হবে।জেনারেশন বদলাবে,এটা স্বাভাবিক।
নাতি নাতনিরা যেমন দল বেধে এসেছিল, তেমন দল বেধে চলে গেল।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি,আজকাল এদের সাথে ইংলিশে কথা চালাতে হয়।বাংলায় ওরা সহজে মত বিনিময় করতে পারেনা।সব কটা ই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ভেবেছিলাম নাতিদের শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে অনুপ্রাণিত করবো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠে না।তন্ময়ের চিন্তাতেই সারাক্ষণ বিভোর হয়ে থাকি,আর ভাবি কবে মৃত্যু হবে।
.
জানালা খুলে দিলাম।বাইরে যানবাহন চলছে কিন্তু খুব বেশি শব্দ নেই।এই দিক টা ভালো হয়েছে,আগে থাকা যেত না শব্দ দুষনের কারনে।এখন শব্দ নেই বললেই চলে।
রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না।সকলেই বাসায় বন্দি,মোবাইল,কম্পিউটার নিয়েই ব্যস্ত।স্কুলে বই নিয়ে যেতে হয়না।প্রবীণ দের সংগ্রহ ছাড়া কারও বাসায় তেমন বই দেখা যায় না।সবাই ল্যাপটপে পড়াশুনা করে।বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। কেউ আর পার্কে ঘুরতে যায় না।ঘরে ঘরে 3D মূভি।
.
কিছুক্ষণ কুরআন তিলোয়াত করে বিছানায় এসে শুয়ে পরলাম। আজ তন্ময়কে বডড বেশি মনে পড়ছে, মনে পড়ছে অতীতের কথা! অনেক বন্ধু ছিল আমার,সবাই মিলে কত মজা করতাম!
ফেসবুকে গল্প লিখলেই অসখ্য লাইক কমেন্টে মন ভরে যেত।তন্ময় আমাকে সেলিব্রেটি বলে ক্ষেপাত।কিন্তু কখনো বোরিং হয়ে গেলে তন্ময় কে বলতাম,একটা থিওরি মাথায় এসেছে কিন্তু লিখতে আলসেমি লাগছে।
তন্ময় জোর করেই থিওরি টা জেনে নিয়ে নিজেই আমার আইডি থেকে লিখে দিতো।
হঠাত ই মনে পড়ে গেল ফেসবুকের কথা! প্রায় বিশ বছর ধরে ফেসবুকে লগইন করিনা।আজ একবার ঢুকলে কেমন হয়?
ভাবামাত্রই মোবাইল টা নিয়ে ফেসবুকে লগইন করলাম। পাসওয়ার্ড টা ভুলার কথা নয়,কারন সেটা তন্ময়ের নামে দেয়া।
লগইন করতেই ভেসে উঠল, Mishu, after long time you activated your account!
অসংখ্য নোটিফিকেশন দেখে মাথা ঘুরা শুরু হয়ে গেল।এইসব আর দেখবো না।ইনবক্সে ঢুকেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না।সেই কত বছর আগের মেসেজ! আমার বন্ধু,আত্মীয় শুভাকাঙ্ক্ষী দের কত আবেগময় মেসেজ!
তন্ময়ের সাথে কনভারসেশন টা দেখে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল।কত স্মৃতি মিশে আছে এই মেসেজ গুলোতে! আর চোখ মেলে থাকতে পারছি না।চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে!
.
মোবাইল এক পাশে রেখে দিলাম। জানিনা আজ সবার কথা এত মনে পড়ছে কেন!
একদিন আব্বু আম্মুকে নিয়ে রাঙামাটি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে! আচ্ছা আব্বুর আত্মা কি আমাকে দেখতে আসে? আম্মুর আত্মা কি আমাকে এক পলক দেখতে আসে? তন্ময় তো আমার ধ্যানে এসে উপস্থিত হয়।কিন্তু মা বাবা? ওরা কি কখনো দেখতে আসে আমায়?
খুব মনে পড়ছে আজ সবাইকে! কবরে কি অবস্থায় আছো আব্বু আম্মু? তোমাদের কি খুব কষ্ট হয়? জানো আব্বু,আমার ও খুব ইচ্ছে করে তোমাদের মত চলে যেতে।কিন্তু জানিনা আরও কতদিন এভাবে স্মৃতি আকরে ধরে আমার নিশ্বাস চলতে থাকবে! যে পৃথিবী তে আব্বু আম্মু নেই,তন্ময় নেই,সে পৃথিবীতে থেকে আমি কি করবো?
খুব কষ্ট হচ্ছে।ছেলেরা ভালো আছে অনেক, ওরাও ওদের বাবার মত স্ত্রীর খেয়াল রাখে অনেক। এই বৃদ্ধা মায়ের ও খেয়াল রাখে কিন্তু তারা সময় পায়না আমার কাছে আসার।আমার কোলে মাথা রেখে মা বলে ডাকার সময় তাদের হয়না।সবাই খুব ব্যস্ত!
তবুও সুস্থ আছি,কিন্তু শান্তি পাইনা কিছুতেই।খুব মনে পড়ে সবাইকে।
.
দুদিন পর বিবাহ বার্ষিকী আমাদের। প্রতিবছর তন্ময় বর সাজত আর বছরে এই একটিবার আমাকে নতুন করে কবুল বলে হত।দুজনে নিজের হাতে ফুল দিয়ে ঘর সাজাতাম। সেই তন্ময় তো আর নেই,কেউ আর খুব সকালে ডেকে তুলে বলবে না,কলিজা চলো শিউলি কুড়াতে যাই।
এইদিনে আমি ও তন্ময় শিউলি কুড়াতে কুড়াতে ছেলেবেলায় ফিরে যেতাম।তন্ময় নতুন একটা করে শাড়ি আর হাত ভর্তি চুরি উপহার দিতো আমাকে।
আজ সেই তন্ময় নেই! আমি বেচে আছি কেন?
আব্বু আম্মু কেও খুব মনে পড়ে। আমার বিবাহ বার্ষিকীতে আব্বু আমাকে নিজের হাতে রান্না করে দিতো, আম্মু সুযোগ পেত না।তন্ময়ের মত আব্বু ও আমাকে খুব ভালবাসত।আব্বুর মুখ থেকে পান বের করে নিয়ে খেতাম।
আরও কত স্মৃতি!
.
মসজিদে আযান হচ্ছে।নামাজ পড়ার জন্য উঠে পড়লাম। নামাজে বসে বাবা মা ও আমার বরের জন্য দুয়া করলাম। দুচোখে অশ্রুর বন্যা বইছে।আজ স্মৃতিগুলো খুব কাদাচ্ছে আমায়! মানুষের মন ভীষণ নস্টালজিক!
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ