প্রিয়ার চোখে জল
.
.
পর্বঃ ৪২
.
.
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
.
রাত সাড়ে দশটা বাজে। কিরণ এখনো বাড়ি ফেরেনি। পুরো বাড়িতে প্রিয়া একা। মা আর রহিমা চলে যাওয়াতে পুরো বাড়ি শূন্য শূন্য লাগছে। প্রিয়া সন্ধ্যার পর থেকে একটু একটু ভয় পাচ্ছে। তাই পুরো বাড়ির আলো জ্বেলে রেখেছে। গেটে দারোয়ান আছে। বিকেলে একবার ছাদে উঠেছিল প্রিয়া। শীতের বিকেল খুব ঠাণ্ডা লাগছিল। তাই বেশিক্ষণ ছাদে থাকতে পারেনি। আজ মনে হচ্ছে প্রিয়ার শীত একটু বেশিই লাগছে। দুপুরে রান্না করার সময় তরকারি কাটতে গিয়ে ডান হাতের আঙুল কেটে অনেক রক্ত পড়েছে। তারপর থেকেই শরীরটা কেমন কেমন লাগছে। ছাদ থেকে নেমে কিছুক্ষণ শুয়ে ছিল, তাও ভালো লাগেনি। সুমির সাথে কথা বলেছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যার পর টিভির সামনে এসেছিল। তাও মন বসেনি। শীলার কাছে ফোন করলে প্রিয়া কোথায় আছে কেমন আছে সবকিছু জানতে চাইবে। প্রিয়া মিথ্যা কথা বলতে পারে না। প্রিয়া কি করে বলবে সে এক অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছে। এই কথা শুনলে শীলা আর মামা অনেক চিন্তা করবে। তাদের মন আবার ভেঙে পড়বে। কিন্তু প্রিয়া তা চায় না। তারা যে সান্ত্বনা নিয়ে আছে, তাই নিয়ে থাক। প্রিয়ার কষ্ট একাই বয়ে বেড়াক। কাটা হাতের আঙুলটা অনেক ব্যথা করছে। সামান্য ফুলেও গেছে।হয়তো ব্যথার ওষুধ খেলে একটু ভালো লাগতো। প্রিয়া গায়ে চাদর পেঁচিয়ে রেখেছে। তবুও শীত করছে। প্রিয়া ভাবলো,কিছুক্ষণ লেপ নিয়ে শুয়ে থাকলে হয়তো ঠাণ্ডা কিছুটা কমবে। প্রিয়া রুমের দিকে যাবে, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।
প্রিয়া দরজা খুলে দিল।
কিরণ এসে ঘরে ঢুকলো।
প্রিয়া রান্নাঘরে ঢুকলো খাবার গরম করার জন্য। গরম করা খাবার টেবিলে রাখলো।
কিরণ হাত-মুখ মুছতে মুছতে এসে ড্রাইনিংটেবিলে বসলো।
প্রিয়া দাঁড়িয়ে রইলো। প্রিয়ার যেন আজ দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।
কিরণ খাবার খেতে লাগলো আর মনে মনে ভাবলো, প্রিয়া তো মনে হয় এখনো না খেয়ে আছে। কিরণ প্রিয়াকে বললো,আপনি খেয়েছেন?
প্রিয়া বললো,না,আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
কিরণ বললো,রাতেরবেলা না খেয়ে থাকা ঠিক নয়, সামান্য কিছু খেয়ে নিন।
কিরণের এই কথাগুলো প্রিয়ার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত মনে হল। প্রিয়া আর না বলতে পারলো না,একটা চেয়ার টেনে বসলো। প্লেটে খাবার নিল,কিন্তু হাত এত ব্যথা করছে, হাত দিয়ে তো খেতে পারবে না। তাই ছোট একটা চামচ নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রিয়া তো কখনো চামচ দিয়ে ভাত খায়নি, তাই হাত থেকে ভাত পড়ে গেল। কিরণ মনে মনে ভাবলো, এই মেয়ে কি বা হাত দিয়ে খায় নাকি?
তারপর বলেই ফেললো, আপনি কি বা হাত দিয়ে খান?
এই কথা শুনে প্রিয়া কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। মাথা নিচু করে বললো,জ্বী না,দুপুরে তরকারি কাটতে গিয়ে ডান হাতের আঙুল কেটে ফেলেছি। তাই ডান হাত দিয়ে খেতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
কিরণ দেখলো, প্রিয়ার বা হাত দিয়ে খেতেও কষ্ট হচ্ছে। এসব দেখে কেন জানি প্রিয়ার জন্য কিরণের অনেক মায়া লাগলো।
কিরণ উঠে গিয়ে প্রিয়ার পাশের চেয়ারে বসলো। প্রিয়া অবাক হয়ে গেল। কিরণ তার নিজের হাতে খাবার নিয়ে প্রিয়ার মুখের সামনে ধরলো। প্রিয়া তাকিয়েই রইলো। কিরণ বললো,খেয়ে নিন।
প্রিয়া মাথা নিচু করে খাবার খেল। কিরণও খেয়ে উঠে চলে গেল। কিরণ চলে যাবার পর প্রিয়া আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে ভাবলো, আর কিছু না হোক, স্বামীর এতটুকু সহানুভূতি পেয়েছি, তাতেই আমার জীবন ধন্য। প্রিয়া আর বসে থাকতে পারছে না। উঠে নিজের রুমের দিকে গেল।
যাওয়ার সময় দেখলো কিরণ বারান্দায় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। প্রিয়ার মনে হল কিরণ কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।
কোন কারণে কি ওর মন খারাপ?
প্রিয়া প্রায়ই দূর থেকে কিরণের দিকে তাকিয়ে থাকে। যতই দেখে, যেন দেখার শেষ হয় না। হয়তো এটাই কিরণের প্রতি প্রিয়ার নীরব ভালোবাসা। প্রিয়া জানে না সেই ভালোবাসা কখনো স্বীকৃতি পাবে কিনা। তবুও ভালোবাসা তো ভালোবাসাই।
.
.
.
.
মধ্যরাতে কিরণের ঘুম ভেঙে গেল। কারো চাপাকান্নার আওয়াজ শোনা গেল। কিরণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। কোথা থেকে এই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে? মনে হল প্রিয়ার রুম থেকে।
কিরণ উঠে বসলো।
হ্যাঁ,এই আওয়াজ প্রিয়ার রুম থেকেই আসছে।
কিরণ উঠে প্রিয়ার রুমে গেল।
প্রিয়া জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। আর জ্বরে কাতরাচ্ছে। প্রিয়ার পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে।
কিরণ দুই তিনবার প্রিয়াকে ডাকলো, কিন্তু প্রিয়া চোখ মেলে তাকালো না।
কিরণ প্রিয়ার মাথায় হাত রাখলো। এত জ্বর যে কিরণ সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল। ঘুম থেকে উঠে এসে প্রিয়ার এই অবস্থা দেখে কিরণের মাথা খারাপ হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপলো। এত জ্বর!
ঘড়ি দেখলো রাত পৌনে দুইটা। কিরণ বুঝতে পারলো না এত রাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, না কি করবে।
আর এতজ্বর যে, প্রিয়া বেহুঁশের মত পড়ে আছে। কিরণ ভাবলো এই মেয়েকে নিয়ে এখন কি করি? মা থাকলে তো আর আমাকে চিন্তা করতে হতো না। এক কাজ করি, মাথায় জলপট্টি দেই। তারপর দেখা যাক কি হয়।
.
.
কিরণ প্রিয়ার পাশে বসে জলপট্টি দিতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ পর পর জ্বর মাপতে লাগলো।
প্রিয়া চোখ বুজে আছে। তবুও মনে হচ্ছে চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঘুমের ঘোরে মা মা বলে ডাকছে।
কিরণ ভয় পেয়ে গেল। এই শীতের মধ্যেও কপালে ঘাম জমে উঠেছে।
কিরণ দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে কম্বল নিয়ে এসে প্রিয়ার গায়ে দিয়ে দিল। আবার জলপট্টি দিতে লাগলো। রাত চারটার দিকে প্রিয়ার জ্বর কিছুটা কমলো।
কিরণ কিছুটা স্বস্তি পেল। এতক্ষণ কিরণ এতটা ভয় পেয়েছিল, আর এতটা চিন্তায় ছিল যে, শরীর খুব দুর্বল লাগছে। অনেক সময় মানুষ যখন বেশি চিন্তা করে তখন শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
কিরণ কি আজ সত্যিই প্রিয়ার জন্য অনেক চিন্তা করেছে? কিন্তু কেন করেছে? সে তো প্রিয়াকে ভালোবাসে না, তাহলে প্রিয়ার অসুস্থতা দেখে এত অস্থির হয়ে পড়েছে কেন? প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে এত মায়া লাগছিল কেন? কিরণ কিছুক্ষণ প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যেতে লাগলো। আবার ভাবলো প্রিয়াকে এই অবস্থায় একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। কিরণ প্রিয়ার পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। আবারও প্রিয়ার কপালে হাত রাখলো, জ্বর কিছুটা কম। কিরণের এত ঘুম পেল যে আর বসে থাকতে পারলো না।
কিরণ প্রিয়ার পাশেই শুয়ে পড়লো, তারপর ঘুমিয়ে পড়লো।
.
প্রিয়ার চোখে জল
.
পর্বঃ ৪৩
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো এসে কিরণের মুখে পড়লো। কিরণ আস্তে আস্তে চোখ খুললো। কিরণ একা, প্রিয়া নেই। কিরণ উঠে বসলো। রুম থেকে বেরিয়ে এলো। প্রিয়া তার রুমে নেই। কিরণ রান্নাঘরের দিকে গেল। প্রিয়া নাস্তা তৈরী করছে। কিরণ প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো প্রিয়াকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় রান্নাঘরে দেখে কিরণ খুব রেগে গেল।
তোমাকে এই শরীর নিয়ে রান্নাঘরে আসতে কে বলেছে? মা যদি এসে দেখে এই অবস্থা, তাহলে বলবে আমি তোমার প্রতি খেয়াল রাখিনি। কাল রাতে তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আর এখন এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছো কাজ করতে!
হঠাৎ করে কিরণের চোখ গেল প্রিয়ার কাটা আঙুলের দিকে। আঙুল ফুলে গেছে। কিরণ ভাবলো হয়তো এই আঙুল কাটার ব্যথায় জ্বর এসেছে। এবার প্রিয়ার উপর আরো রেগে গিয়ে বললো, এভাবে আঙুল কেটেছে, রক্তও নিশ্চয় অনেক পড়েছে! নিজে কিছু করতে পারবে না তো, আমাকে ফোন করতে।
জানো, রাতে তোমার জ্বর দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই কথা গুলো বলে কিরণ চলে গেল। প্রিয়ার কাছে কিরণের এই রাগ মধুর মত মনে হল। প্রিয়া আজ খুব খুশি। সেই খুশির কাছে এই অসুস্থতা তুচ্ছ মনে হল। রাতে কিরণ প্রিয়ার সেবা করেছে, আবার চিন্তাও করেছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!
প্রিয়া টেবিলে নাস্তা দিল।
কিরণ হাত-মুখ ধুয়ে এসে প্রিয়াকে বললো, চল ডাক্তারের কাছে যাবে।
প্রিয়া বললো,আমার তো জ্বর সেরে গেছে। এখন আর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। আপনি নাস্তা খেয়ে অফিসে যান।
কিরণ বললো, আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। নিজের দিকে খেয়াল দাও।
প্রিয়া বললো, আমি সেই ছোট কাল থেকেই রোগের সাথে যুদ্ধ করে আসছি। যখন অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতাম, তখন মামা চুপিচুপি আমাকে ওষুধ এনে দিত। আর এখন তো মাত্র সামান্য জ্বর, এমনিতেই সেরে যাবে। কিরণ বললো,অতীত শুধু মানুষকে কষ্টই দেয়, যা ঘটে গেছে তা ভেবে লাভ কি? অতীত ভেবে বর্তমানকে অস্বীকার করা ঠিক নয়। চল ডাক্তারের কাছে যাই। এই বলে কিরণ দরজা খুলে বাইরে গেল। প্রিয়া বললো, কিরণ স্বামী হিসেবে খারাপ হোক, কিন্তু মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। রাত থেকে আমার জন্য অনেক করেছে। এখন আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কিরণ গাড়ির দরজা খুলে দিল।
প্রিয়া গাড়ির ভেতর বসলো।
কিরণ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
দারোয়ান গেট খুলে দিল।
কিরণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অনেক দিন পর প্রিয়া বাড়ির বাইরে এসেছে, তাই মনটা ভালো লাগছে। গাড়ি চলছে, প্রিয়া এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে আর মানুষজন দেখছে।
.
.
.
.
বেলা এগারোটার দিকে মা আর রহিমা এলো। দারোয়ান গেট খুলে দিল। ড্রাইভার গাড়ি ভেতরে আনলো। মা আর রহিমা গাড়ি থেকে নেমে এলো। রহিমার মা কিছুটা সুস্থ্য, তাই মা তাকে কিছু টাকা দিয়ে চলে এসেছে। একদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে মায়ের মনটা ভালো হয়ে গেছে। আরেকদিন বেড়াতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু প্রিয়া বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাবে, তাই চলে এসেছে। কিরণ যদি প্রিয়াকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিত, হাসিখুশি থাকতো, তাহলে মায়ের আর চিন্তা করতে হতো না। মা ঘরে ঢুকবে, এমন সময় দারোয়ান বললো, কিরণ ভাই ভাবীকে নিয়ে বাইরে গেছে। দারোয়ানের এই কথা শুনে মা চিন্তিত হয়ে পড়লো। ড্রইংরুমে গিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো। কিরণের মোবাইলে ফোন দিল। কিন্তু কিরণ ফোন ধরলো না। মা আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লো।
রহিমা মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,খালাম্মা আপনি অত চিন্তা কইরেন না হয়তো কোন কামে বাইরে গেছে, দেখবেন কিছুক্ষণ পরই ফিরা আইবো।
মা ভাবলো, কিরণ প্রিয়াকে কোথায় নিয়ে গেল। আমি জানি ও কখনো প্রিয়াকে বেড়ানোর জন্য বাইরে নিয়ে যায়নি, কোন বন্ধুর বাসায়ও যাবে না। তাহলে কি ও প্রিয়াকে সুমির বাসায় রেখে যাওয়ার জন্য নিয়ে গেছে? মা আর ভাবতে পারছে না। আসলে মানুষ যা ভাবে,তা অনেক সময় ঠিক হয় না, আবার মানুষ যা কল্পনা করে, বাস্তবে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মা এই মুহূর্তে কোন কিছুই সঠিক করে ভাবতে পারছে না। তাই সুমির কাছে ফোন করার জন্য গেলো। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। রহিমা দরজা খুলে দিল। প্রিয়া আর কিরণ ভেতরে এল। কিরণকে দেখে মা ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো। কিরে তুই প্রিয়াকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?? কিরণ বললো, মা, তুমি কখন এলে?
মা বললো,একটু আগে এসেছি। ওর মায়ের অবস্থা একটু ভালো, তাই চলে এসেছি। এবার বল তুই প্রিয়াকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?
কিরণ বললো,ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। কাল দুপুরে নাকি তরকারি কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে গিয়েছিল, আর সেই ব্যথায় রাতে জ্বর এসেছে। তাই এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে বলিনি অযথা চিন্তা করতে, তাই।মা খুশি হয়ে বললো, যাক আমার ছেলে তাহলে আমার দুঃখ বুঝতে শুরু করেছে। আমি আজ খুব খুশি। বাবা, এতক্ষণ অযথা চিন্তা করেছিলাম। আমার ছেলে যখন তার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে, তখন আমার আর চিন্তা কীসের!
কিরণ বললো,মা আমি কোন দায়িত্ব পালন করিনি। তোমার অবর্তমানে আমার যা করা উচিৎ ছিল, আমি তাই করেছি। তুমি এসে পড়েছো, আমার দায়িত্ব শেষ। আমি এবার অফিসে যাচ্ছি। এই বলে কিরণ চলে গেল।
মা প্রিয়ার কপালে হাত রাখলো। সামান্য জ্বর আছে, তবে ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, খেলেই জ্বর আর ব্যথা সেরে যাবে।
মা প্রিয়াকে নিয়ে সোফায় বসলো। একদিনের জ্বরে প্রিয়া খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবুও হাসিমুখে মায়ের কাছে কিরণ তার যে সেবা যত্ন করেছে, সব কথা বললো।
শুনে তো মা আরো খুশি হল।
মা বললো,প্রিয়া তোমার জন্য আমার ছেলের আজ এই পরিবর্তন। আজ আমি কতোটা খুশি তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। কিরণ আমার ছেলে, আমি ওর মন বুঝতে পারি। তুমি দেখে নিও বউমা, কিরণ তোমাকে ভালোবাসবেই। তোমার মাঝেই ও সুখ খুঁজে নিবে। তোমার ধৈর্য আর ভালোবাসার কাছে ওকে হার মানতেই হবে।
.
এমন সময় সুমির ফোন এলো। মা খুশিমনে সুমিকে সব কথা বললো। শুনে তো সুমি মহাখুশি। কারণ সুমির প্রতিটি প্রহর কাটে প্রিয়ার কথা ভেবে। তাই সুমি তাড়াতাড়ি খালার সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিল। কারণ এত বড় খুশির খবর আকাশকে বলবে। তাই মায়ের খুশি দেখে প্রিয়া কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। সত্যিই কি কিরণ প্রিয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? এটা কি কিরণের মানবতা, না ভালোবাসা, তা বুঝতে হয়তো আরো কিছুদিন সময় অপেক্ষা করতে হবে।
.
.
চলবে,,,,,,,,,,,
প্রিয়ার চোখে জল
.
.
পর্বঃ ৪৪
.
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
কিরণ অফিসে গেল না। আসলে কিরণের আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন ইচ্ছে করছে না,তা কিরণও জানে না। বারবার প্রিয়ার কথা মনে পড়ছে। কাল রাত থেকে শুরু করে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রিয়া কিরণের কাছাকাছি ছিল। কিরণ তা শত চেষ্টা করেও ভুলতে পারছে না। বারবার প্রিয়ার অসহায় মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিরণের খুব অশান্তি লাগছে। মাথার ভেতরটা কেমন করছে। গাড়ি নিয়ে শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। কোথায় যাবে,কি করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। রুবেলের কথা আজ এই মুহূর্তে খুব বেশি মনে পড়ছে। এই মুহূর্তে রুবেল কিরণের পাশে থাকলে এতটা খারাপ লাগতো না। সামান্য ভুলের জন্য রুবেলের মত প্রিয় বন্ধু আজ কিরণের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কিরণ মনে মনে নিজের দোষ স্বীকার করেছে। রুবেলকে এই কথা বলা তার ঠিক হয়নি। শুধু রুবেলকে কেন,কাউকেই এই ধরণের কথা বলা ঠিক নয়। রুবেলের কথাই ঠিক, সব মেয়ে আমার সেই প্রেমিকার মত ছলনাময়ী নয়। প্রিয়ার মত ভালো মেয়ে আছে বলেই এখনো মানুষ ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে, সংসার করে। কিরণ একটা পার্কের সামনে গাড়ি দাঁড় করলো। গাড়ি থেকে নেমে পার্কের ভেতর গেল। গাছের নীচে একটা বেঞ্চে বসলো। চারদিকে অনেক গাছপালা। শান্ত পরিবেশ। এখানে বসার পর কিরণের একটু ভালো লাগলো। একটু দূরে ছোট ছোট ছেলে - মেয়ে বসে খেলছে। পরনে ময়লা কাপড়। আশেপাশে ওদের মায়ের মত কাউকে দেখতে পেল না। হয়তো ওদের বাবা আছে কিংবা নেই। পাশ দিয়ে কয়েকটা ছেলে -মায়ে হাত ধরে হেঁটে গেল। মেয়েদের পরনে স্কুল পোশাক। হয়তো অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আর ছেলেদের দেখে বোঝা গেল না ওরা ছাত্র, না অন্য কিছু। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কি? ডিশ আর মোবাইলে এই দেশের স্বংস্কৃতি আর সামাজিকতার রুপ পালটে দিয়েছে। যে বয়সে ছেলে-মেয়েরা মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করবে, সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে, এই দেশকে নিয়ে ভাববে, এই দেশের মানুষকে নিয়ে ভাববে, ছোট ভাই-বোনদের কথা ভাববে। আর সেই বয়সে ছেলে -মেয়েরা প্রেম করে বেড়াচ্ছে। অল্প বয়সে প্রেম ব্যর্থ হয়ে পড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। নিজের প্রতি খেয়াল দিচ্ছে না, আর পরিবারের কথাও ভাবছে না। আগে টিফিনের টাকা জমিয়ে ছেলেমেয়েরা বই কিনতো।আর এখন সেই টাকা খরচ হয় মোবাইলের পেছনে। ঘন্টার পর ঘণ্টা কথা বলে সময় নষ্ট করছে। অর্থ অপচয় করছে, আর নানা কারণে আস্তে আস্তে তাদের সুন্দর মনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের সাথেও ভালো ব্যবহার করে না। এই যদি হয় নতুন প্রজন্মের মনমানসিকতা, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কি, আর এই দেশের ভবিষ্যৎ কি? কারণ আজকের প্রজন্ম আগামীতে এই দেশের হাল ধরবে। কিরণ মাঝে মাঝে এসব নিয়ে অনেক ভাবে। দুঃখ হয় তখন, যখন দেখে ছেলে-মেয়েরা স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধু -বান্ধবের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত আর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু তার জন্য কি শুধু ছেলে মেয়েরাই দায়ী? তা কিন্তু নয়, বাবা-মা-ও দায়ী। সন্তান ভুল পথে পা বাড়াবার আগেই বাবা-মায়ের সতর্ক থাকা উচিৎ। বাবা -মা যদি তাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখেন, তাহলে তারা কখনো অনিশ্চিত পথে পা বাড়াবে না। বাবা-মায়ের সতর্ক দৃষ্টিই পারে তাদের সন্তানদের সুন্দর জীবনের দিকে নিয়ে আসতে। কিরণ অন্যকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের কষ্ট ভুলেই গেছে। অনেকক্ষণ নীরব বসে থাকাতে মনটা শান্ত হয়েছে। তবে প্রিয়ার কথা মন থেকে সরাতে পারছে না। কিরণ বুঝতে পারছে, সে ধীরে ধীরে প্রিয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুর্বলতা আর ভালোবাসা তো এক নয়। কিরণ উঠে দাঁড়ালো। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে বিদেশ চলে যাবে। সবার কাছ থেকে দূরে, সবার চোখের আড়ালে চলে যাবে সে। কিরণ বুঝতে পেরেছে, প্রিয়া খুব ভালো মেয়ে,তাই সে প্রিয়াকে কষ্ট দিতে চায় না। স্বর্ণের মধ্যে খাদ থাকলে মানুষ তো মেনে নেয়, কিন্তু ভালোবাসার মধ্যে খাদ থাকলে মানুষ শুধু দুঃখই পায়। কিরণ এখনো মন থেকে সেই ছলনাময়ীকে ভুলতে পারেনি। যদি প্রিয়াকে ভালোবাসতে গিয়ে পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারে,সেই জন্য কিরণ প্রিয়ার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। হঠাৎ করে কিরণের মনটা খুব উদাস হয়ে গেল। মনে হচ্ছে জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে সবাই থাকতে,সব কিছু থাকতেও কেন এই শূন্যতা, কেন এই হাহাকার। পায়ে হেঁটে কিরণ গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। কিরণ এখন বাড়ি যাবে, তার মাকে বিদেশ যাওয়ার কথা বলবে। হয়তো মা রাজী হবে না। কান্নাকাটি করবে,তবুও কিরণকে যেতে হবেই।
.
.
.
.
রাত আটটার দিকে কিরণ বাড়ি ফিরে এলো। মা ড্রইংরুমে বসে আছে। রহিমা মায়ের পা টিপে দিচ্ছে, আর প্রিয়া রান্নাঘরে। কিরণ এসে মায়ের পাশে বসলো, মা বুঝতে পারলো, কিরণের মনটা অনেক খারাপ। তাই মা জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে বাবা,মনটা এত খারাপ কেন?
মা আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
মা, আমি বিদেশ চলে যাবো। এই বাংলাদেশে আর থাকবো না।এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে মা,তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিদেশে চলে যাবো।
কিরণ তুই এসব কি বলছিস বাবা!
আমি যা বলছি মা, ভেবে চিন্তেই বলছি। মা গো আমি হাঁপিয়ে উঠেছি, না তোমাদের হতে পারছি, না নিজের হতে পারছি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কানাডা চলে যাবো। আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমাকে যেতে দাও মা,আর যদি কখনো আমার মন শান্ত হয়, তখন আবার তোমাদের মাঝেই ফিরে আসবো।
.
.
প্রিয়া রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সব শুনলো। প্রিয়ার চোখ ভারী হয়ে আসছে। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবুও স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
কিরণ মায়ের কাছ থেকে উঠে এল। প্রিয়ার দিকে একবার তাকালো, তারপর নিজের রুমে চলে গেল। মা কাঁদতে লাগলো। প্রিয়া এসে মায়ের পাশে বসলো। কিরণের এই কথা শুনে প্রিয়ারও খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এত জোরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে, যাতে চারপাশের লোকজন আপনজন সবাই শুনতে পায়। আর সেই কান্নার আওয়াজ শুনে যাতে সবাই বুঝতে পারে যে,প্রিয়ার ভেতর কত বড় কষ্ট। কিন্তু না,প্রিয়া তার কষ্ট আজ পর্যন্ত কাউকে বুঝতে দেয়নি, আর বুঝতে দেবেও না। প্রিয়ার জীবনে আজ পর্যন্ত এমন কেউ আসেনি কিংবা এমন কেউ নেই, যার সাথে প্রিয়া রাগ করতে পারবে, অভিমান করতে পারবে। প্রিয়া সবসময় নিজের উপর নিজেই রাগ করেছে। আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, মন খারাপ করিস না প্রিয়া, তুই তো সব জেনেশুনেই এই সংসারে বউ হয়ে এসেছিস। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। হয়তো তোর ভাগ্যে সুখই নেই।এভাবে চলতে চলতেই হয়তো একদিন জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। প্রিয়া নিজের মনকে শক্ত করে, মাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো। মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, মা আপনি কাঁদবেন না।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ