প্রিয়ার চোখে জল
.
পর্বঃ ৪৫
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
তুমি জানো না বউমা, কিরণ বড় জেদি ছেলে। একবার যখন বলেছে বিদেশে চলে যাবে, তখন ওকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। এখন আমি কি করবো প্রিয়া? আমার তো দিন প্রায় শেষ। কবে না কবে এই পৃথিবীর বুক ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু তোমার কি হবে? আমি যে নিজের স্বার্থের জন্য তোমার জীবন নষ্ট করে দিলাম।
.
মা আপনি এভাবে বলবেন না। আপনি যদি এভাবে ভেঙে পড়েন, তাহলে আমাকে সান্ত্বনা দেবে কে? আপনার মনোবলই তো আমার শক্তি। আপনি শান্ত হোন। আপনার ছেলে তো এখনই চলে যাচ্ছে না। আর গেলেও কতদূর যাবে? মানুষ আপনজনের কাছ থেকে খুব বেশিদিন দূরে থাকতে পারে না। একাকীত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আবার আপনজনের কাছেই ছুটে আসে। মায়ামমতা আর ভালোবাসা এই তিন শক্তির কাছে পৃথিবীর সব শক্তি হার মেনে যায়। আর আপনি তো মা,জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, শ্রেষ্ঠ উপহার। কিরণ আমার জন্য না হোক, আপনার জন্য অবশ্যই ফিরে আসবে, আসতে তাকেই হবেই। আর আমার জন্য চিন্তা করবেন না মা, আমি তো সব জেনেশুনেই এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছি। আর আমি মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই বাড়ির বউ হয়েই থাকবো। হয়তো আপনার ছেলের কাছে স্ত্রীর মর্যাদা পাবো না, কিন্তু এই বাড়িতে থাকার জায়গা তো পাবো। একজন গরীব আর অসহায় মেয়ের জন্য এরচেয়ে বেশি আর কি পাওয়ার আছে।
.
প্রিয়া মাকে নিয়ে তার রুমে গেল। ওষুধ দিল। মা খেতে চাইলো না,বললো আর ওষুধ খেয়ে কি হবে? এসব দেখার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তবে বউমা, তুমি যাই বলো,আমি তোমার সুখের জন্য যা যা করার দরকার তাই করে যাবো। তা না হলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না। প্রিয়া বললো, মা আপনি যা করার করবেন, এখন ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন। মা প্রিয়ার কথা রাখলো। ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। প্রিয়া কিছুক্ষণ মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মা ঘুমিয়ে পড়লো। প্রিয়া লাইট নিভিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। কিরণের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।
কিরণ মাথায় হাত রেখে শুয়ে আছে। হয়তো অনেক চিন্তা করছে। কিরণকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে প্রিয়ার খুব মায়া লাগলো।
কোন সম্পর্ক না থাক, তবুও তো স্বামী। কিরণ প্রিয়াকে স্ত্রীর মর্যাদা না দিক, ভালো না বাসুক, কিন্তু প্রিয়া তো মনেপ্রাণে কিরণকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছে। আর ভালোবেসেছে। কিরণ যখন ঘুমিয়ে থাকতো, তখন প্রিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিরণের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। আর মনে মনে কত স্বপ্নের জাল বুনেছে। সেই কিরণ প্রিয়াকে ছেড়ে, এই সংসার ছেড়ে দূরে চলে যেতে চাইছে। প্রিয়ার খুব ইচ্ছে করে কিরণের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে, তুমি কোথাও যেতে পারবে না। এদেশেই থাকবে, আমার চোখের সামনে। প্রিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুমের ভেতর ঢুকলো। প্রিয়াকে এভাবে তার রুমে দেখে হয়তো কিরণ রাগও করতে পারে। তবুও প্রিয়া এসেছে। প্রিয়ার পায়ের আওয়াজ শুনে কিরণ চোখ মেলে তাকালো। প্রিয়াকে দেখে উঠে বসলো।
প্রিয়া বললো, খেতে চলুন।
আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না সারাদিন কিছু খেয়েছেন। আর এখনও না খেয়ে শুয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবে। আপনি অযথা মন খারাপ করবেন না,আপনাকে কেউ বাধা দেবে না। আপনি বিদেশ যেতে চান, অবশ্যই যাবেন। মাকে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি মায়ের খেয়াল রাখবো। কিরণ বললো, এই মেয়ে, পৃথিবীর মানুষ গুলো তোমার মত সহজ সরল নয়, এই পৃথিবীটা অনেক কঠিন জায়গা। এখানে ভালো মানুষের জায়গা খুব কম। এত ভালো হলে শুধু কষ্টই পাবে। এই কথা গুলো বলে কিরণ যেন হাঁপিয়ে উঠলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রিয়া কিরণের দিকে তাকালো। কিরণও তাকালো, দু'জন দু'জনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর প্রিয়া বললো, আমার কষ্ট আপনি বুঝতে পেরেছেন, এটাই আপনার কাছ থেকে আমার বড় পাওয়া। আমি তো সেই জন্মের পর থেকেই কষ্ট করছি, আমি কষ্টের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই না। আপনি ভয় পান,তাই তো আমাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বিদেশ চলে যেতে চাইছেন। আপনি যদি বিদেশ গিয়ে শান্তি পান,তাহলে তাই করুন। আমিও চাই আপনি শান্তিতে থাকুন।
.
এই বলে প্রিয়া নিজের রুমে চলে এলো। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছে না। বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে। কিরণ বারান্দায় গিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর অনেক কিছু ভাবছে। কিন্তু কোন কুলকিনারা পাচ্ছে না। কিরণ যদি ইচ্ছা করলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। প্রিয়াকে নিয়ে সুখে থাকতে পারে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কে যেন বাধা দেয় দেয়, কে দেয় কিরণ তা জানে না। হয়তো সব কিছু জেনেও কিরণ তা উপেক্ষা করে চলেছে। কিরণ আর বেশি কিছু ভাবতে পারছে না।চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে রইলো। মানুষ অন্ধকারের মাঝে বসে অনেক কিছু ভুলে থাকতে চায়, কিন্তু তা কি পারে? প্রিয়া অনেকক্ষণ কাঁদলো। প্রিয়া বুঝতে পারলো কিরণ তার জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু প্রিয়া পালাবে কোথায়? তার তো পালাবার কোন জায়গা নেই। কিরণ প্রিয়াকে ভালোবাসা দেয়নি। কিন্তু প্রিয়ার চোখের সামনে তো প্রিয়া কিরণকে দিনরাত দেখতে পেত, সেটাই ছিল প্রিয়ার সান্ত্বনা। কিরণ বিদেশ চলে গেলে তো প্রিয়া তাকে দেখতেও পাবে না। যতবারই এই কথা ভাবছে, ততবারই প্রিয়ার বুক কেঁপে উঠছে। ইচ্ছে করছে কিরণকে জোর করে আটকে রাখতে। কিন্তু সেই অধিকার তো কিরণ প্রিয়াকে দেয়নি। হঠাৎ করে রুবেলের কথা প্রিয়ার মনে হল। রুবেল তো কিরণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওনাকে বললে হয়তো কিছু একটা করবে।
.
প্রিয়া চোখের পানি মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে রুবেলের কাছে ফোন করলো। রুবেল ফোন ধরলো।
প্রিয়া তাকে সব কথা বললো ফোনে।
রুবেল বললো, ভাবী আপনি কোন চিন্তা করবেন না,আমি দেখছি কি করা যায়। প্রিয়া ফোন রেখে বসে রইলো। প্রিয়া জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেছে, কিন্তু আজকের এই কষ্ট সহ্য করা কঠিন। ভাবতেই যেন কেমন লাগছে। শূন্যতা প্রিয়ার চারপাশের ঘিরে ধরেছে। স্বামী নামটা ছাড়া যার সাথে কোন সম্পর্ক নেই, তার জন্য এত মায়া, এটাই তো ভালোবাসা। প্রিয়া শুয়ে পড়লো। রাতের অন্ধকারে চারিদিক নীরব হয়ে গেছে। হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রুবেলের কথা শুনে প্রিয়া কিছুটা ভরসা পেয়েছে,তাই প্রিয়াও ঘুমাবার চেষ্টা করলো।
.
.
প্রিয়ার চোখে জল
.
পর্বঃ ৪৬
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
সকালবেলা প্রিয়া নাস্তা তৈরি করছে। রহিমা ঘরের কাজ করছে। মা মন খারাপ করে সোফায় বসে আছে। কিরণ এসে মায়ের পাশে বসলো। মায়ের হাতটা ধরলো। মা হাত সরিয়ে নিল।
কিরণ বললো, তুমি যদি মা হয়ে আমাকে না বুঝ, তাহলে কে বুঝবে, বল?
মা বললো,মা তো সারাজীবন শুধু সন্তানের সুখ এর কথাই ভাবে। কিন্তু মায়ের সুখের কথা ভাবা কি সন্তানের উচিৎ নয়? সেই ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত তোর কত আশা, কত সুখ আমি পূরণ করেছি, আর তুই আমার একটা আশা পূরণ করতে পারলি না।
.
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।
রহিমা দরজা খুলে দিল।
প্রিয়া রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। ভাবলো রুবেল এসেছে। কিন্তু না সুন্দর একটা মেয়ে এসে ঘরে ঢুকলো।
মেয়েটাকে দেখে মা উঠে এল।মেয়েটাকে বললো, কে তুমি?
মেয়েটা বললো,আমার নাম জয়া। কিরণের বন্ধু।
এই কথা শুনে কিরণ সোফা থেকে উঠে এসে মেয়েটার সামনে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে বললো,আমি আপনার বন্ধু?
হ্যাঁ, তুমিই তো আমার বন্ধু। এতে আশ্চর্য হবার কি আছে। বন্ধুকে বন্ধু বলে স্বীকার করলে দোষের কি আছে? আর তুমি আমাকে আপনে করে বলছো কেন? তুমি শব্দটাই ভালো লাগে।
মা আর প্রিয়া অবাক হয়ে দু'জন দু'জনের দিকে তাকালো।
কিরণ অবাক হবে, না রাগ হবে, বুঝতে পারছে না। এই মেয়েকে জীবনে প্রথম দেখলাম, আর এই মেয়ে বন্ধু বলছে, তুমি করে বলছে। পাগল নাকি?
কিরণ একটু রেগে বললো,শুনুন মিস জয়া, আপনি হয়তো ভুল করে এই বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। দয়া করে বাইরে গিয়ে আসল ঠিকানা খুঁজে নেন।
কিরণ, তুমি আমাকে না চেনার ভান করছো কেন? ও বুঝতে পেরেছি, আমি তোমাকে না বলে এখানে এসেছি বলে তুমি মনে মনে রাগ করছো। আর সবার সামনে আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছো? চল আমরা বাইরে যাই, যেখানে বসে আমরা প্রতিদিন কথা বলি।
এই মেয়ে আপনি কি পাগল নাকি, কি আবোল তাবোল বলছেন? আমি আপনার বন্ধু হতে যাবো কোন দুঃখে? আপনাকে তো এর আগে আমি কখনো দেখিনি। আমাকে আর বিরক্ত না করে চলে যান এখান থেকে।
কিরণ, তুমি এত নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলে আমার সাথে! আমার এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে!
এই কথা শুনে কিরণ চুপ হয়ে গেল। রহিমা, প্রিয়া, মা সবাই কিরণের দিকে তাকিয়ে আছে। যে কিরণ মেয়েদের নাম শুনতে পারে না, সেই কিরণের মেয়ে বন্ধু এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।
কিরণ বুঝতে পারলো সবাই তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এই মুহূর্তে কিরণ বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিরণ কি করবে, কি বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না।
মা এসে, মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এই মেয়ে আমার ছেলের সাথে তোমার কতদিনের সম্পর্ক?
প্রায় পাঁচ বছর। খালাম্মা কিরণ হয়তো আপনাদের লজ্জায় বলেনি। আমরা দু'জন দু'জনকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। আমাদের বিয়ের কথাও পাকা হয়ে গেছে। তবে কিরণ কেন জানি এই দেশে বিয়ে করতে চাচ্ছে না, তাই আমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। সেখানেই আমাদের বিয়ে হবে। তাই তো বিদেশ যাওয়ার আগে আমি আমার শ্বশুর বাড়িটা একবার দেখতে এলাম। আপনি তো আমার হবু শাশুড়ি। আপনিই বলেন, কাজটা আমি ঠিক করিনি?
মা রেগে কিরণের দিকে তাকালো।
এতগুলো মিথ্যা কথা এই মেয়ের মুখ থেকে শোনার পর কিরণ যেন বোকা হয়ে গেল। কিরণ বুঝতে পারছে না এই মেয়েকে চড় মারবে, নাকি ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দেবে।
প্রিয়া পাথরের মত দাঁড়িয়ে সব শুনছে আর দেখছে।
কিরণ বললো, এতক্ষণ আপনার মিথ্যা কথা অনেক সহ্য করেছি। আর নয়,আপনি যদি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে না যান, তাহলে....
তাহলে কি করবে তুমি? আমিও এতক্ষণ তোমার নীরবতা অনেক সহ্য করেছি। আর নয়, এত বছর ধরে প্রেম করছো, আর এখন বলছো আমাকে চেন না! আসলে তুমি একটা কাপুরুষ, তাই তো কাউকে না জানিয়ে আমাকে নিয়ে বিদেশ চলে যেতে চেয়েছিলে।
জয়া তার হাত ব্যাগ থেকে কিরণের ছবি বের করে মায়ের হাতে দিল।
তারপর বললো, এই ছবিটাও কি মিথ্যা? আপনার ছেলে ওর ছবি আমাকে দিয়ে বলেছে, যখনই আমার কথা মনে পড়বে, তখনই আমার ছবিটা দেখবে।
প্রিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সেখান থেকে চলে গেল।
মা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জয়াকে বললো, যে মেয়েটি চলে গেল,ওর নাম প্রিয়া। কিরণের বিবাহিত স্ত্রী।
জয়া বললো,কিরণ, তুমি আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলে! তুমি বিয়ে করছো, আর আমাকে জানাওনি তুমি? মিথ্যাবাদী, প্রতারক, আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করবো না। এই বলে জয়া চলে গেল।
.
মা রেগে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। রহিমা রান্নাঘরে চলে গেল।
কিরণ কি করবে বুঝতে পারলো না। মায়ের পাশে গিয়ে বসে পড়লো।
মা কিরণের কাছ থেকে দূরে সরে বসলো।
কিরণ মাকে বললো,তুমি মা হয়ে যদি অবিশ্বাস করো,তাহলে আমাকে আর বিশ্বাস করবে কে? আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলছি না মা, ওই মেয়েকে আমি সত্যি সত্যি চিনি না। ওই মেয়ে যা বলে গেছে, সব মিথ্যা কথা মা। আমি নিজেও জানি না, ওই মেয়ে কেন এখানে এলো,আর আমার এত বড় ক্ষতি করে গেল। আমার ছবি কিভাবে ওর কাছে গেছে তাও আমি জানি না।
.
.
প্রিয়ার চোখে জল
.
পর্বঃ ৪৭
.
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
.
.
চুপ কর কিরণ, তোর মনে যদি এই আশাই ছিল,তাহলে আগে বলতি। প্রিয়ার জীবনটা আর নষ্ট করতাম না। এই মিথ্যা নাটকের কি দরকার ছিল? মেয়েদের সাথে প্রেম করে বেড়াস, আর বলিস মেয়েদের তুই ঘৃণা করিস! ভালোবেসেছিস ভালো কথা, আমাকে বলতি, না হয় বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসতি।
বিশ্বাস করো মা,ওই মেয়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই,ভালোবাসা তো দূরের কথা।
আর কত মিথ্যা কথা বলবি তুই? ওই মেয়ের সাথে যদি তোর কোন সম্পর্ক না থাকে,তাহলে ওই মেয়ে এই বাড়ি চিনলো কি করে? তোর ছবি কি ওই মেয়ের কাছে হেঁটে হেঁটে গেছে? তুই কাল এসে বললি, এদেশে থাকবি না। তোর দম বন্ধ হয়ে আসছে, কানাডা চলে যাবি। তুই কানাডা যাবি, সেই কথা ওই মেয়ে জানলো কি করে, বল কি করে জানলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন? তুইও শুনে রাখ, আমি প্রিয়ার জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেবো না। আমি ওকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেব। আর এই বাড়ি ওর নামে লিখে দেব। এই বলে মা উঠে চলে গেল।
.
কিরণ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। এ কোন পাপের শাস্তি আমি পেলাম! যে অন্যায় আমি করিনি, তার সাজা আমি কেন পাচ্ছি! কে ওই মেয়ে, ওর সাথে আমার কীসের শত্রুতা ছিল যে, ও আমার এত বড় ক্ষতি করে গেল। এত কিছুর পর কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। এই অপবাদের চেয়ে খুনের আসামী হওয়া অনেক ভালো ছিল। ওই মেয়ে কেন আমাকে এত বড় অপবাদের বোঝা মাথায় দিয়ে চলে গেল। কিরণ আর বেশি কিছু ভাবতে পারছে না। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে। সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইলো।
.
.
প্রিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। মা এসে পাশে বসলো। মাথায় হাত রাখলো। প্রিয়া মাথা তুলে তাকালো। মায়ের চোখে পানি,প্রিয়ার চোখেও পানি। আজ যেন দু'জনের কষ্টই সমান। মা প্রিয়াকে বললো, বউমা তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মত ভাষাও আমার জানা নেই। আমি সত্যি জানতাম না যে কিরণ কাউকে ভালোবাসে। যদি জানতাম, তাহলে তোমাকে আমি এই বাড়ির বউ করে নিয়ে আসতাম না। আর তোমাকে এই কষ্টও দিতাম না। প্রিয়া মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে বললো, আপনি শুধু আমার শাশুড়ি নন,আমার মা। মায়ের আদর ভালোবাসা আমি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। তাই আমার অনুরোধ, নিজেকে কখনো অপরাধী মনে করবেন না। আমি তো আগেও বলেছি, আমি ভাগ্যকে বিশ্বাস করি। কি এমন ক্ষতি হবে, যদি স্বামীর আদর ভালোবাসা না পেলাম। আপনার আদর ভালোবাসা পেলেই আমার সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে। মা প্রিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তা হতে দেব না। আর আমি বেঁচে থাকতেই তোমার সুখের ব্যবস্থা করে দেব।এটা আমার ওয়াদা। প্রিয়া মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে লাগলো। কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়, কিন্তু প্রিয়ার মনের কষ্ট কি দূর হবে?
.
.
.
কিরণের মন খুব খারাপ। এই ঘটনা যতই ভাবছে, ততই কষ্ট বাড়ছে। কে ওই মেয়ে, কেন আমার সাথে এমন আচরণ করে গেল? আমি তো ওই মেয়ের কোন ক্ষতি করিনি। ও যদি আমাকে এই অপবাদ না দিয়ে দশ লক্ষ টাকা চাইতো, তাও আমি হাসিমুখে দিয়ে দিতাম। টাকার কষ্ট সহ্য হত, কিন্তু এই অপবাদের কষ্ট যে সহ্য হচ্ছে না। ছিঃছিঃ,সবাই আমাকে নিয়ে কিনা কি ভাবছে। প্রিয়া হয়তো ভুল বুঝছে। আমাকে নিয়ে বাজে বাজে কথা ভাবছে। প্রিয়া ভাবলে ভাবুক, কিন্তু মা, উফ! আর ভাবতে পারছি না। কাল সারাদিন চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিদেশে চলে যাবো। কষ্ট থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। আর এখন তার চেয়েও বড় কষ্ট আমার উপর ভর করেছে। মানুষের জীবনের একেক সময় একেকভাবে যায়, তবে আজকের দিনটা সবার জন্যই খুব কষ্টের। কিরণ সারাদিন তার রুমে ছিল। ঠিকমত খায়নি। মাকে খেতে বলেছে, মা সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আজ অনেক শীত পড়েছে, তাই প্রিয়া মায়ের গায়ে দু'টো কম্বল দিয়ে দিল। মা প্রিয়ার দিকে অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে রইলো। সেই চাহনির মাঝে কতটা কষ্ট তা প্রিয়া বুঝতে পারে। প্রিয়া মায়ের পাশে বসলো, মা আপনি অতটা ভেঙে পড়বেন না। আমি জানি না কি হবে,তবে কেন যেন আমার মন বলছে, আপনার ছেলের কোন দোষ নেই। আমি এত দিনে আপনার ছেলেকে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হয় না আপনার ছেলে অন্তত আপনাকে মিথ্যা কথা বলবে। আপনার ছেলে আপনাকে অনেক ভালোবাসে, আপনার জন্যই তো আমাকে স্বীকৃতি না দিক তবু বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা তো দিয়েছে। আমার মনে হয় না আপনার ছেলের সব দোষ। হয়তো কোথাও কোন ভুল হয়েছে। এমনও তো হতে পারে মেয়েটা আপনার ছেলেকে কোন কারণে দোষারোপ করতে চাইছে। মা একটু হেসে বললো,তোমার মনে এত বল কোথা থেকে আসে? তুমি কিভাবে সবকিছু এত সহজভাবে ভাবতে পারো?
.
প্রিয়া বললো,মা সহজভাবে ভাবলে কষ্ট কম হয়। আর এখনো তো পুরো সত্যি জানা যায়নি। ওই মেয়ের কথাই যে সব সত্যি, আর আপনার ছেলের সব কথা মিথ্যা, এমন ভাবারও তো কোন কারণ নেই। আপনার ছেলের কথাও তো সত্য হতে পারে, তাই না মা?
মা বললো,তোমার কথাই যাতে সত্য হয় মা।
প্রিয়া লাইট নিভিয়ে চলে এল।বাইরে আসার পর মনে হল মাকে যে সান্ত্বনা দিলাম, তা যদি সত্যি হয়, যদি কিরণ নির্দোষ হয়? প্রিয়া কিরণের রুমের সামনে গেল। কিরণের জন্য প্রিয়ার খুব মায়া লাগছে। আজ সারাদিন মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে। ঠিকমত খাওয়া -দাওয়াও করেনি। ভাবলো এক গ্লাস গরম দুধ এনে দেবে। এই শীতের রাতে গরম দুধ খেলে ভালো লাগবে। প্রিয়া রান্নাঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে গরম করে গ্লাসে ঢাললো। তারপর কিরণের রুমের সামনে এলো। পর্দা ফাঁক করে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। কিরণ তার রুমে নেই। প্রিয়া ভেতরে ঢুকলো। বারান্দা দেখলো, কিরণ কোথাও নেই। প্রিয়া ঘড়ি দেখলো রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। প্রিয়া বাইরে এলো। কিরণের গাড়ি গ্যারেজে, গেট বন্ধ। দারোয়ান তার রুমে। প্রিয়া তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর চলে এলো। কারণ বাইরে প্রচণ্ড শীত। প্রিয়া চিন্তিত হয়ে পড়লো, কিরণ কোথায় গেলো? গাড়ি তো নিয়ে যায়নি। প্রিয়া যতটুকু জানে, কিরণ তার গাড়ি ছাড়া একা বাইরে কোথাও যাবে না। আজ সারাদিন মন খারাপ করে বসে ছিল। প্রিয়া জানে , মা কিরণের সাথে কথা বলেনি। তাই কিরণের মন আরো বেশি খারাপ। কোথাও রাগ করে চলে যায়নি তো? একথা ভাবতেই প্রিয়ার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। কিরণের জন্য হঠাৎ করে মনটা কেঁদে উঠলো। এত রাতে কোথায় চলে গেল? প্রিয়া কি মায়ের কাছে যাবে, নাকি কি করবে, বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে মনে হল ছাদে দেখা হয়নি। কিন্তু এই কনকনে শীতের মধ্যে কেউ ছাদে উঠবে নাকি? প্রিয়া মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ছাদের উপর গেল। কিরণ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এই শীতের মধ্যে এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? ছাদে আসতেই প্রিয়ার শরীর শীতে কেঁপে উঠলো। আর কিরণের গায়ে শুধু শার্ট। প্রিয়া এবার কিরণের কষ্টটা পুরোপুরি বুঝতে পারলো। মানুষের বুকের ভেতর অনেক যন্ত্রণা না থাকলে কেউ এই শীতের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। প্রিয়া কিরণের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিরণের বিষণ্ণ মুখটা দেখে প্রিয়ার অনেক মায়া লাগলো। প্রিয়া বললো, এই শীতের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঘরে চলুন, তা না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। কিরণ বললো, আমার ঠাণ্ডা লাগলে তোমার কি, তুমি কেন এই শীতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে আছো? চলে যাও এখান থেকে, আমি একা থাকতে চাই।
আপনি না গেলে আমিও আপনার সাথে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।
কেন অযথা জিদ করছো, চলে যাও এখান থেকে।
আপনি কি ভাবেন জিদ শুধু আপনার একাই আছে, আর কারো নেই?
কথাগুলো বলে প্রিয়া কিরণের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই চাহনিতে অনেক রাগ, অনেক অনুরাগ, অনেক অভিযোগ, অনেক অভিমান।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ