প্রিয়ার চোখে জল
পর্বঃ০৯
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। প্রিয়া ঢাকা শহরের রাস্তায় হাটছে। কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। গ্রামে যখন একজন অপরিচিত মানুষ যায়, তখন সে কোথায় যাবে কার কাছে যাবে এসব জিজ্ঞাসা করা হয়। কিন্তু এই ঢাকা শহরে কেউ কাউকে এসব কথা জিজ্ঞেস করে না। প্রিয়া শুধু হাটছে আর ভাবছে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা পার্কে দেখলো লোকজন বসে আছে। প্রিয়া সেখানে গেল বসার জন্য। একটা বেঞ্চে বসলো। বসার পর একটু ভালো লাগছে, খিদে পেয়েছে। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয়ার টাকা আছে, কিন্তু সে টাকা দিয়ে কি করবে তাও ভেবে পাচ্ছে না। ঢাকা শহরে এত মানুষ, এত গাড়ি,এত দালান কোঠা,এর মাঝে প্রিয়া নিজেকে খুব অসহায় ভাবছে। চারিদিকে তাকালে মনে হয় মানুষের মেলা বসেছে। কোথাও কুঁড়ে ঘর, আবার কোথাও রাজপ্রাসাদ। কেউ রাস্তায় বসে খাচ্ছে, আবার কেউ হোটেলে বসে খাচ্ছে। প্রিয়া ক্ষুধার চেয়ে চিন্তায় বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত থাকার কোন ব্যবস্থা করতে পারছে না। প্রিয়া মাথা নিচু করে বসে রইলো। একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়ালো। প্রিয়া দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া বললো, কে আপনি? লোকটা বললো,আমার নাম রহমত আলী। এই ঢাকা শহরে আমার বসবাস। আমি অনেক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছি অস্থির আর চিন্তিত। মনে হচ্ছে তুমি এই ঢাকা শহরে নতুন এসেছো,তবে আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। না আপনার ধারণাই ঠিক। আমি আজই প্রথম এই শহরে এসেছি। আসলে ভাগ্য আমাকে এখানে এনেছে।
ও বুঝেছি,তুমি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছো।
হ্যাঁ,আমাকে ছোট রেখে বাবা মা মারা গেছে। তারপর থেকে মামার সংসারে বড় হয়েছি।
এই বলে প্রিয়া থেমে গেল। মনে মনে ভাবলো অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষজন আর সামনে এই ভদ্রলোক। তার সাথে কি কথা বলা ঠিক হচ্ছে? কিন্তু এই মুহূর্তে এছাড়া আমার আর করার কি আছে। এতক্ষণ ধরে ঘুরছি, কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এই ভদ্রলোক যখন ইচ্ছে করে আমার কথা জানতে চাইছে, তখন আমার সব কথা তার কাছে বলি। যদি সে আমাকে কোন সাহায্য করে, তাহলে আমার চিন্তা দূর হবে। লোকটা প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, কি ভাবছো? তুমি কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলে। তোমার কোন সমস্যা থাকলে আমার কাছে বলতে পারো। তুমি তো আমার মেয়ের মতই। তোমার সব কথা আমার কাছে বলতে পার, যদি আমার দ্বারা তোমার কোন উপকার হয়। লোকটার এই কথা শুনে প্রিয়া মনে সাহস পেল। ধীরে ধীরে প্রিয়া তার সব কথা লোকটার কাছে বললো।প্রিয়ার সব কথা শুনার পর লোকটা এদিকে ওদিকে তাকালো। তারপর আস্তে করে প্রিয়াকে বললো,তোমার সমস্যার কথা শুনলাম। তুমি কোন চিন্তা করো না, আমি তোমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। তোমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। সত্যি বলছেন! আপনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন? আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব।
তুমি আমার সাথে চল। প্রিয়া বুকভরা আশা নিয়ে লোকটার পেছন পেছন হাটতে লাগলো। এতক্ষণ এর ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। হতাশা দূর হয়ে গেছে, প্রিয়া আশ্রয় পেয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় খুশি প্রিয়ার জন্য কি হতে পারে! অনেকক্ষণ পর লোকটা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। লোকটা প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে গেটের ভেতর ঢুকলো। প্রিয়াও ঢুকলো। অনেক সুন্দর বাড়ি। প্রিয়া চারদিকে তাকাতে লাগলো। লোকটা বললো,তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে আসি। এই বলে লোকটা ভেতরে চলে গেল। প্রিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এদিক ওদিক তাকালো।অনেকগুলো ফুলের গাছ আর এক কোণায় একটা পানির কল। প্রিয়া সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি। অনেক্ষণ ধরে পিপাসা লেগেছিল। কিন্তু চিন্তায় পানিও খেতে ইচ্ছে করেনি। এখন প্রিয়ার মন শান্ত, তাই কলের সামনে গিয়ে পানি খেলো। পানি খাওয়ার পর প্রিয়ার খুব ভালো লাগলো। প্রিয়া হাটতে হাটতে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালো। দরজার ভেতর থেকে দুজন মানুষের কথা শুনতে পেল। বললাম তো স্যার মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দরি, তাই টাকা একটু বেশিই দিতে হবে। স্যার আপনাকে কত মেয়ে এনে দিলাম। তবে এই মেয়ে সবার চেয়ে আলাদা। আর এই মেয়েকে দিয়ে আমার চেয়ে আপনিই বেশি লাভবান হবেন, বুঝছেন স্যার?
হ্যা, বুঝতে পেরেছি, তুমি যেমন নাছোড়বান্দা , না বলার উপায় আছে আমার। মেয়েটা কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?
জ্বী স্যার ভেতরে নিয়ে আসবো?
দাঁড়াও আগে তোমার পাওনা বুঝিয়ে দিই। তারপর ওকে ভেতরে নিয়ে এসো।
দুজনের কথা শুনে প্রিয়া থমকে গেল,মাথা ঘুরতে লাগলো, চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলো। প্রিয়া দৌড়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন বুড়ো লোক এসে সামনে দাঁড়ালো। প্রিয়া ভয় পেয়ে গেল। লোকটা বললো, তুমি কে মা? প্রিয়া বললো,একজন লোক চাকরি দেবে বলে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। লোকটা বললো,উনি এখন কোথায়? প্রিয়া বললো, ভেতরে। লোকটা চারিদিকে তাকিয়ে বললো, ওরা চাকরির নামে অসহায় মেয়েদের সর্বনাশ করে।মা তুমি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও। প্রিয়া গেট থেকে বেরিয়ে সোজা হাটতে লাগলো। এত তাড়াতাড়ি হাটছে মনে হচ্ছে পাগলা কুকুর তাকে তাড়া করেছে, ধরতে পারলেই বিষদাঁত বসিয়ে দেবে তার পায়ে।
শীলা পড়ার টেবিলে বসে আছে আর প্রিয়ার কথা ভাবছে। প্রিয়া আপু এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, থাকার কোন ব্যবস্থা করতে পেরেছে কি না, কিছু খেয়েছে কি না! আর ভাবতে পারছি না। আপুকে চলে যেতে বলে কি ঠিক করলাম? না ভুল করলাম। শীলা মাথা নিচু করে বসে রইলো। মামী এসে শীলাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ধমক দিল। শীলা উঠে দাঁড়ালো। মামী বললো,পড়ার টেবিলে বইসা কার কথা ভাবতাছোস, ওই পোড়াকপালির কতা! আমার সংসার থেকা পলাইয়া গেছে, কিন্তু সুখের চেহারা কোনদিনও দেখবো না। সুখ ওর কপালে নাই। শীলা বললো, দোহাই লাগে মা এভাবে বলো না। মামী বললো, তোর বাপ পুকুরঘাটে বইয়া ভাগ্নির লাইগা শোক পালন করতাছে। আর তুই এহেনে বইয়া চোখের পানি ফালাইতাছোস,খবরদার আমার সামনে এসব ঢং করবি না! শীলা চেয়ারে বসে পড়লো। শাহেদ এল ব্যাগ হাতে। মামী অবাক হয়ে বললো, কিরে শাহেদ তুই ব্যাগ লইয়া কই যাইতাছোস? শাহেদ বললো, খালাম্মা আমি চলে যাচ্ছি। চইলা যাবি মানে! কই যাবি,তুই না কইলি বিদেশ আর যাবি না। বিয়া কইরা এই দেশেই থাকবি। তাহলে এহন আবার মত পাল্টাইলি ক্যান?
খালাম্মা আমি শহরে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে ব্যবসা করবো, তারপর দেখা যাক কি হয়।
কিন্তু আমি তো তোর লাইগা মাইয়া ও ঠিক করছি। ভাবছি তোর লগে বিয়া দিমু, আর এহন তুই চইলা যাইতাছোস?
খালাম্মা আমি অনেক বছর বিদেশ ছিলাম, তাই আমার পছন্দটা একটু অন্যরকম। আমি গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবো না। শহরে গিয়ে দেখে শুনে একজন সুন্দরি মেয়ে বিয়ে করবো। আসি খালাম্মা আমার জন্য দোয়া করবেন। এই বলে শাহেদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শীলা মনে মনে খুশি হল। মামী অবাক হয়ে শাহেদের চলে যাওয়া দেখলো। তারপর রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শীলা আবার প্রিয়ার কথা ভাবতে লাগলো।
প্রিয়ার চোখে জল
পর্বঃ১০
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশ শুয়ে আছে। সুমি এসে বললো,কি ব্যাপার, তুমি এই সন্ধ্যায় শুয়ে আছো কেন? আকাশ বললো, শুয়ে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছিলাম, আর তুমি এসে আমার স্বপ্নটা বেঙে দিলে। সুমি বললো, কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলে? আকাশ বললো, যাকে আমি ভালোবাসি, যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আমি ভালোবাসি। সে আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। সুমি বললো থাক আর ঢং করতে হবে না। এবার উঠ, হাত মুখ ধুয়ে নাও। তোমাকে বলেছিলাম আজ একটু রিতার বাড়ি যাবো, অথচ তুমি সারাটা বিকেল শুয়ে কাটিয়ে দিলে। তোমরা সারাদিন ঘুরতে পারো, আর ঘরের বউ যদি কোথাও যেতে চায়,তাহলেই যত আপত্তি। আকাশ উঠে বসলো। সুমির হাত ধরে বললো, রাগ করো না, চলো এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। সুমি বললো, থাক আর আদর করতে হবে না, যথেষ্ট হয়েছে। এবার উঠে ফ্রেস হয়ে নাও,সন্ধ্যার পর না সফিক সাহেবের সাথে তোমার দেখা করার কথা? আকাশ মাথায় হাত দিয়ে বললো, সেই কথা তো আমি ভুলেই গেছি। আসলে তুমি না থাকলে আমার কিছুই হতো না। শুধু তুমি আমার পাশে আছো বলে আজ আমি এতো বড় ব্যবসায়ী।সুমি বললো, থাক আমার আর সুনাম করতে হবে না। আমি যাই চা নিয়ে আসি। আকাশ বললো,নীলা কোথায়? সুমি বললো, ছাদে ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। আকাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,ওর সব কথা তো ওই ফুল গাছের সাথে। এত অর্থ থাকতেও আমার বোনটার জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। মানুষ বলে টাকা দিয়ে নাকি সব হয়। টাকাই সব সুখের মূল, কথাটা ঠিক নয়। জীবনের সব সমস্যার সমাধান টাকা দিয়ে হয় না। আমরা টাকা দিয়ে ভাগ্যকে বদলাতে চাই। তখন ভাগ্য মানুষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, টাকার চেয়ে আমি বড়, আমাকে মনে প্রাণে স্বীকার কর,তখন দেখবে কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আর চোখের পানি ফেলতে হবে না। এই বলে আকাশ বাথরুমে চলে গেল। সুমি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কারণ সুমি জানে আকাশ এখন কাঁদবে।তবে সেই কান্নার শব্দও কেউ শুনবে না, আর আকাশের চোখের পানিও কেউ দেখবে না। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সুখ হচ্ছে মানুষের মনের সুখ, সেই সুখ আকাশের মনে নেই। তার একমাত্র বোনের অসহায় মুখটা দেখলে তার কষ্ট আরো বেশি বেড়ে যায়। আকাশ হাত মুখ-ধুয়ে বেরিয়ে এল।চোখ কিছুটা লাল। সুমি আকাশের সামনে এসে দাঁড়ালো। আকাশ, আমরা তো আমাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি, তারপরও নিজেকে এভাবে কষ্ট দাও কেন? সুমি, নীলার মুখের দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। ওর না বলা কথা গুলো ওর চোখের ভাষায় ফুটে উঠে। এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি আছে বল! যদি সুন্দর একটা মনের মতো ছেলের সাথে নীলার বিয়ে হত,তাহলে হয়তো ওর দুঃখ কিছুটা কমতো। কিন্তু এই পর্যন্ত যে কয়জন ছেলে ওকে দেখতে এসেছে, তারা সবাই ওর চেয়ে আমার সম্পত্তিকে পছন্দ করেছে। আর যেখানে স্বার্থের পরিমাণ বেশি সেখানে ভালোবাসার পরিমাণ কম থাকে।
তুমি মন খারাপ করো না,দেখো একদিন নীলার জীবনে এমন একজন আসবে যে শুধু নীলাকেই ভালোবাসবে, তখন নীলার আর কোন দুঃখ থাকবে না।
সুমি, এখন যেমন খাঁটি জিনিস পাওয়া মুশকিল, ঠিক তেমনি ভালো মানুষ পাওয়াও মুশকিল। বাবা -মা মারা যাবার পর ওকে আমি লালন -পালন করেছি। তাই ওর জন্য আমার কষ্টটাও বেশি। জানি না নীলার ভাগ্যে কি আছে। আমি যাই সফিক সাহেবের সাথে দেখা করে আসি। এই বলে আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সুমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এলো। প্রিয়া এতটুকু সময়ের মধ্যে ঢাকার অনেক রুপ দেখেছে। প্রিয়া ভাবছে এর চেয়ে মামীর অত্যাচার সহ্য করা অনেক ভালো ছিল। ঢাকা শহরের এত মানুষের মাঝে আমার নিজের জন্য জায়গা খুঁজে নেয়া অনেক কঠিন। কত ধরণের মানুষ দেখলাম। একজন মেয়ে বলে নিয়ে গেলো বিক্রি করার জন্য, আরেক জন বোন ডেকে নিয়ে গেল খারাপ জায়গায়। সেখান থেকেও প্রিয়া পালিয়ে এসেছে। দিনের আলোয় প্রিয়া নিজেকে রক্ষা করছে। কিন্তু এই রাতের আঁধারে প্রিয়া কি করবে? কত বাড়িতে গেছে প্রিয়া, কেউ বলছে যুবতী মেয়ে ঘরে রাখবো না। কেউ বলেছে চুরির মতলবে বাড়িতে ঢোকার ফন্দি। অনেক বাড়ির কর্তা আবার কূ-নজরে তাকিয়েছে। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না কেন? মানুষের মন থেকে কি মানবতা হারিয়ে গেছে? প্রিয়া ভাবছে আর হাটছে। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলো দু'জন ছেলে তার পিছু নিয়েছে। প্রিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। পিছু তাকাচ্ছে আর জোরে জোরে হাটছে। সামনে একটা বাড়ির গেট খোলা দেখে প্রিয়া ঢুকে পড়লো। ছেলে দুটো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেল। প্রিয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো, তারপর গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় একজন বয়স্ক লোক গেটের ভেতর ঢুকলো। প্রিয়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, এই মেয়ে কে তুমি?
জ্বী মানে, কিছু বাজে ছেলে আমার পিছু নিয়েছিল,তাই ভয়ে এই বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।
দেখে তো ভদ্র মেয়ে মনে হয়। তা এত রাতে বাড়ির বাইরে বের হয়েছো কেন?
রাতেরবেলা সুন্দরি যুবতী মেয়ে রাস্তায় হাটবে, আর ছেলেরা পিছু নেবে না!
যার ঘর নেই, তাকে তো রাস্তায়ই থাকতে হয়। ইচ্ছে করে কি কেউ এত রাতে একা রাস্তায় থাকে!
থাকে,তোমার মত মেয়েরা থাকে। তোমাদের মতো এক শ্রেণীর মেয়ের কাছে ঘরের চেয়ে রাস্তাই বেশি পছন্দের।
আপনি এসব কি বলছেন!
কেন,সত্যি কথা শুনতে কি খারাপ লাগছে? তোমাদের মত মেয়েরা ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করে সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করে। আর কিছু বেওয়ারিশ শিশু জন্ম দিয়ে রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেয়। তারা কুকুর বেড়ালের মত রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়।
আপনি আজ পর্যন্ত কোন বেওয়ারিশ সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, তাদের আদর করেছেন?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ ওদের কাছে যেতেও তো ঘৃণা লাগে। মানুষের বাচ্চাকে কুকুর বেড়ালের সাথে তুলনা করলেন, তারা বেওয়ারিশ বলে তাদের ধরতেও ঘৃণা লাগে, তাহলে কুকুর বেড়ালকে এত আদর করেন কেন? তারাও তো রাস্তাঘাটেই জন্ম নেয়। যারা মানুষের চেয়ে পশুকে দাম দেয় বেশি, তারা এই সমাজের কাছে কতটুকু দায়বদ্ধ, বেওয়ারিশ সন্তানের জন্য দায়ী একজন খারাপ নারী, একজন খারাপ মা, সব দোষ যদি শুধু নারীরই হয়,তাহলে যে আপনাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। একজন নারী শুধু গর্ভধারণ করে,কিন্তু জন্মদাতা তো কোন না কোন পুরুষ মানুষ। মানলাম আমার মতো মেয়েরা ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করে। কিন্তু যে মেয়েরা পাগল,সে তো এই জগৎ -সংসারের ভালোমন্দ কিছু বুঝে না। রাস্তাঘাটে শুয়ে থাকে, যে যা দেয় তাই খায়। তার ইজ্জত কে নষ্ট করলো, সে কেন গর্ভবতী হলো? সেই পাগল মায়ের সন্তান যখন এই দুনিয়ার বুকে আসবে, তখন কে তাকে বুকে টেনে নেবে? কেউ না, আপনারা শুধু একজনের দিকে আঙুল তুলতে পারেন। আর কিছুই পারেন না। একটা পাখির বাসা কখনো অন্য পাখি ভাঙে না, কিন্তু একজন মানুষ অন্য মানুষের ঘরও ভাঙে, আবার মনও ভাঙে। অবহেলা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কাউকে যদি ভালোবাসতে না পারেন, তবে তাকে কখনো অবহেলা করবেন না, কারণ সেই অধিকার আপনার নেই। এই কথা বলে প্রিয়া গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
যে স্বপ্ন নিয়ে প্রিয়া এই ঢাকা শহরে এসেছিল। এই ঢাকা আসলে সে রকম নয়। এখানে মানুষকে অনেক কষ্টে টিকে থাকতে হয়। আর এখানে টিকে থাকার জন্য ভালো মানুষ খারাপ হয়ে যায়। সত্যবাদী লোক মিথ্যা বলে। দিনের বেলার অশান্ত ঢাকা রাতের বেলা এত শান্ত হয়ে গেছে, দেখে প্রিয়ার ভয় আরো বেড়ে গেছে। দূরে একটা দোকান খোলা আছে, রাস্তায় মানুষজন খুবই কম। প্রিয়ার সব আশা ভরসা এই রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। সামনে অন্ধকার, দু'চোখে অন্ধকার। প্রিয়া আর হাটতে পারছে না। একটু পানি ছাড়া সারাদিন কিছুই খায়নি। পা'দুটো অবশ হয়ে আসছে। প্রিয়া রাস্তার মাঝখানে বসে পড়লো। আর হাটার মত কিংবা কিছু ভাবার মত শক্তি প্রিয়ার নেই। এই ঢাকায়ও কোন থাকার ব্যবস্থা করতে পারলাম না। আর মামীর কাছেও ফিরে যেতে পারবো না। আমার এই জীবনের কোন মূল্য নেই। আমি মরে গিয়ে এই মূল্যহীন জীবনের অবসান ঘটাবো। দূর থেকে একটা গাড়ি আসছে। কিন্তু প্রিয়া উঠে দাঁড়াতে পারছে না। গাড়ি প্রিয়ার সামনে এসে থামলো। আকাশ রেগে গাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রিয়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। পুরো শরীর কাঁপছে। আকাশ বললো,এই মেয়ে এই রাতের অন্ধকারে রাস্তার মাঝখানে বসে আছো কেন? মরার সাধ জেগেছে নাকি? কি হলো,কথা বলছো না কেন? প্রিয়া বললো, মরতে পারলে তো ভালই হতো, তাহলে আর এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা দেখতে হতো না। আকাশ বললো,দেখে তো মনে হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো। প্রিয়া তার সব কথা আকাশের কাছে বললো। সব শুনে আকাশ কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল।একা একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে রাস্তায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবছে। তারপর প্রিয়াকে বললো,তোমার সব কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। আজ তুমি ঢাকায় প্রথম এসেছো। অনেক কিছু দেখেছো। কিন্তু রাতের ব্যাপার আলাদা। তুমি ইচ্ছে করলেও নিজেকে রক্ষা করে চলতে পারবে না। আমাকে যদি তোমার বিশ্বাস হয়, তাহলে আমার সাথে আমার বাড়ি চল।রাতটুকু থেকে না হয় সকালে চলে যেও। বাড়িতে আমার স্ত্রী আর ছোট বোন আছে, সেখানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। যে জন্য গ্রাম ছেড়ে এই শহরে এসেছো, রাতেরবেলা তুমি রাস্তায় একা থাকলে তারচেয়েও খারাপ ঘটনা তোমার সাথে ঘটবে। আমি একজন মানুষ হয়ে তোমাকে এই অবস্থায় একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। প্রিয়া বললো, আমি যাব আপনার সাথে। আকাশ গাড়ির দরজা খুলে দিল। প্রিয়া বসলো, আকাশ গাড়ি চালাতে লাগলো। প্রিয়া ভাবছে, আমি কি ঠিক করলাম, না ভুল করলাম? কিন্তু এছাড়া আমার আর করার কি বা আছে! এই রাতের অন্ধকারে আমি কোথায় থাকতাম, কি করতাম।লোকটার কথা শুনে ভালই মনে হল। যাক ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। শীলা হয়তো আমার জন্য অনেক চিন্তা করছে,আর মামা তো চোখের পানি ফেলছে। বাবা-মাকে হারিয়ে যতটুকু আদর ভালোবাসা পেয়েছি,তা শুধু মামার খাছ থেকেই। ভাগ্য আমাকে আজ সেই মামার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে। প্রিয়া গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসলো। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে ভর করেছে, ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু প্রিয়া ঘুমকে দূরে রাখতে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। ঘর বাড়ি আর দোকান পাট, খালি কোন জায়গা চোখে পড়লো না।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ