প্রিয়ার চোখে জল
পর্বঃ০৭
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
গভীর রাত, প্রিয়া চকিতে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে ঘরের বাহিরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।প্রিয়ার ঘুম খুব পাতলা, রাতের বেলা গাছ থেকে একটা পাতা পড়লেও প্রিয়া বুঝতে পারে।প্রিয়া কান খাড়া করলো,আবার শুনতে পেল কারো পায়ের আওয়াজ। প্রিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুললো, অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রিয়া ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগলো,হঠাৎ করে দেখলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে কেউ আঙুল দিয়েছে।প্রিয়ার শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগলো, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।এত রাতে কে এমন করছে, আগে তো কখনো এমন হয়নি। প্রিয়া চিৎকার দিবে কিনা বুঝতে পারলো না। এবার দরজায় টোকা পড়লো।প্রিয়া সাহস করে হারিকেন জ্বালাললো।ঘর আলো হওয়াতে সাহস একটু বাড়লো।আস্তে আস্তে হেঁটে দরজার সামনে গেল,আবার দরজায় টোকা পড়লো,প্রিয়ার শরীর কেঁপে উঠলো।আস্তে করে বলললো,কে? শাহেদ বাইরে থেকে আস্তে করে বললো আমি। প্রিয়া চমকে উঠলো, এত রাতে শাহেদ ভাই আমার ঘরের সামনে কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।প্রিয়া দরজায় মুখ রেখে আস্তে করে বললো,আপনি এত রাতে আমার ঘরের সামনে কেন এসেছেন,আপনি চলে যান।
-প্রিয়া আমি আপনার সাথে জরুরি একটা কথা বলতে এসেছি, আপনার ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি কথাটা বলেই চলে যাব,কেউ দেখবে ও না কেউ জানবে ও না,প্লিজ দরজাটা খুলুন?
-শাহেদ ভাই আপনি যা বলার সকালে বলবেন, এখন আপনি চলে যান, এত রাতে এখানে আসা ঠিক হয়নি, দয়া করে আপনি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান, আমি চাই না আপনার কারণে আমার বদনাম হোক। প্রিয়া আপনি আমাকে অযথা ভুল বুঝছেন। আমি আপনাকে যে কথা বলতে এসেছি, তা এখনি বলা দরকার, সকালে বলতে পারলে তো আর এখন আসতাম না, আপনি দরজা খুলুন মাত্র দুই মিনিট কথা বলেই আমি চলে যাবো।
প্রিয়া বুঝতে পারলো না কি করবে দরজা খোলা কি তার উচিৎ হবে,নাকি চুপচাপ শুয়ে পড়বে। আবার হঠাৎ করে মামীর কথা মনে পড়লো,শাহেদ ভাই যদি মামীর কাছে বিচার দেয় তাহলে মামী তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেবে।প্রিয়া অনেক ভেবে দরজা খুলে পাশে দাঁড়ালো।শাহেদ ঘরে ঢুকে চকিতে বসলো,প্রিয়া হারিকেন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,শাহেদ বলছে এই ভাঙা ঘরে ভাঙা চকিতে ঘুমাতে আপনার কষ্ট হয় না,তোমার এই কষ্ট দেখে আমারই কষ্ট হচ্ছে।মনে কিছু নিওনা, তুমি করে বললাম, সত্যি কথা বলতে কি তুমি করে বললে আপন আপন মনে হয়।
-শাহেদ ভাই আমার এই ঘরে থাকতে কোন কষ্ট হয় না, আপনি কি বলবেন বলে তাড়াতাড়ি চলে যান।
-প্রিয়া, তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন আমি তো বাঘ নই,তোমার মতই মানুষ, মানুষ কি মানুষের সাথে কথা বলে না?
-বলে,কিন্তু.......
-প্রিয়া এত দুর্বল মন নিয়ে পৃথিবীতে বসবাস করা যায় না। তুমি মোটামুটি শিক্ষিত একজন মেয়ে,দেখতেও সুন্দরী তুমি এখানে পড়ে আছো কেন, তুমি ইচ্ছে করলে তোমার জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে পারো,তুমি সারাদিন এত কাজ করো যে তোমার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,বিশ্বাস করো তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।
-মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট থাকবেই আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি,ছেলেরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারে,কিন্তু মেয়েরা পারে না আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে,আমার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এবার আপনি যান।
-প্রিয়া আমি তোমাকে আমার সাথে ঢাকায় নিয়ে যাবো।প্রথম দেখার পর থেকেই তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
-ছিঃ ছিঃ শাহেদ ভাই আপনি এসব কি বলছেন,মামী শুনলে আমাকে মেরেই ফেলবে,আমি আপনার সাথে আর কোন কথা বলবো না আপনি চলে যান এখান থেকে,তা না হলে মামাকে ডাকবো।
-প্রিয়া তুমি আমাকে বুঝার চেষ্টা করো,আমি জানি না যে খালাম্মা এই বিয়েতে মত দেবেন কিনা।
-মামী এই বিয়েতে কখনো মত দিবেন না,কারণ মামী শীলার জন্য আপনাকে পছন্দ করেছে।
-কিন্তু আমি তো শীলাকে পছন্দ করি না, আমার ভালো লেগেছে তোমাকে, আর আমার একবার যাকে ভালো লাগে তাকে আমি.....
-ও তার মানে এর আগেও আপনি অনেক মেয়েকে পছন্দ করেছেন, আর ভালোবাসার অভিনয় করেছেন।
-প্রিয়া তুমি খুব বুদ্ধিমান মেয়ে,আর বুদ্ধিমান মানুষ আমার অনেক পছন্দের,আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি প্রিয়া, তুমি আর অমত করো না,তুমি আমি....
-থাক শাহেদ ভাই,আর একটা কথা বললে আমি সত্যি সত্যি সবাইকে ডাকবো।এই বলে প্রিয়া ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো,শাহেদ এসে সামনে দাঁড়ালো।প্রিয়া ভয় পেয়ে গেলো। হারিকেনের আলোয় শাহেদের মুখটা ভয়ংকর মনে হল।শাহেদ হাসলো, প্রিয়ার যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল,পা দুটো অবশ হয়ে গেল।প্রিয়া চিৎকার ও দিতে পারছে না,মনে হয় গলার স্বর আটকে গেছে। শাহেদ দরজা বন্ধ করতে চাইলো,আর সেই মুহূর্তে শীলা এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো।শীলাকে দেখে শাহেদ ভয় পেয়ে গেল।প্রিয়া শীলার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। শীলা শাহেদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
-শীলা এই সময়ে তুই এখানে?
-কেন শাহেদ ভাই, আমি আসাতে আপনার অসুবিধা হয়ে গেল,তাই না?
-শীলা তুই কিন্তু আমাকে অপমান করছিস।
-খবরদার ওই নোংরা মুখে আমার নামও উচ্চারণ করবেন না। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে না গেলে আমার পায়ের জুতা আপনার গালে উঠবে। শীলার এই কথা শুনে শাহেদ মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।প্রিয়া শীলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।শীলা প্রিয়াকে শান্ত হতে বললো,আপু এই বাড়িতে তোমার এই চোখের পানির কোন দাম নেই।এই কথা জানাজানি হলে সব দোষ তোমার উপর পড়বে, কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না।
-আমি এখন কি করবো শীলা,আমার যে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।আমার জীবনে কখনো এমন ভয়ংকর রাত আসবে আমি তা ভাবতেও পারিনি,আজ তুই সময় মত না এলে আমার সর্বনাশ হয়ে যেত। আমার জীবনের তো কোন মূল্য নেই,আর এই ঘটনার পর তো আমার বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করছে না।
-আপু মরার জন্য যদি সাহস হয় তবে সেই সাহস দিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর,তুমি চলে যাও এখান থেকে দূরে অনেক দূরে।
-আমি কোথায় যাবো কার কাছে যাবো তোরা ছাড়া আমার আর আপন বলতে কে আছে।
-আপু মানুষ সারাজীবন আপন নিয়ে থাকে না,তুমি ঢাকায় চলে যাও শুনেছি সেখানে অনেক মেয়েরা চাকরি করে খায়,সম্মান নিয়ে জীবনযাপন করে।এই বাড়িতে তুমি সারাদিন পরিশ্রম করো,তবুও পেট ভরে খাবার আর পরনে ভালো শাড়ি পাওনা। তোমার সারাদিনের পরিশ্রমের কোন মূল্য নেই এখানে।তোমার কোন দাম নেই এই বাড়িতে। লক্ষ লক্ষ মেয়েরা পরিশ্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে তুমি কেন পারবে না। এবার তোমাকে পারতেই হবে, তোমাকে শক্ত হতে হবে। এই পৃথিবী শক্তের ভক্ত আর নরমের জম।
-শীলা তোর মনে হয় আমি পারবো?
-আপু পারতে তোমাকে হবেই, তা না হলে শাহেদ ভাইয়ের মত লোকেরা তোমাকে ছোবল মারতে চাইবে। একবার চেষ্টা করে দেখ না আপু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারো কিনা।
-শীলা তুই শুধু আমার কথা ভাবছিস, তোর কথা ভাব, শাহেদ খুব খারাপ ছেলে ও অনেক মেয়েকে ধোঁকা দিয়েছে, তুই ওকে বিয়ে করলে তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
-আপু তোমার কি মনে হয় শাহেদ ভাই এর নোংরা চেহারাটা দেখার পর আমি তাকে বিয়ে করবো। কোনদিনও না,প্রয়োজনে মায়ের সাথে ঝগড়া করবো তবুও এই বিয়ে করবো না।তুমি ভেবো না আপু, মা আমার সাথে বেশি জোর করবে না,আমি তার নিজের মেয়ে তো আমার মতামতের দাম তাকে দিতেই হবে।
-কিন্তু শীলা আমি তোদের ছেড়ে কিভাবে থাকবো, দুঃখ কষ্ট এক জিনিস আর মায়া আরেক জিনিস।
-আপু যত কষ্টই হোক তোমাকে একা থাকতেই হবে মায়া মমতা ত্যাগ করতে হবে।মানুষ এই পৃথিবীতে আসেও একা যায়ও একা। তোমাকে একাই পথ চলতে হবে আমি জানি তুমি জয়ী হবে। এই পৃথিবীটা এই বাড়ির মত ছোট নয়,আর এই পৃথিবীর মানুষগুলোও আমার মায়ের মত নয় এই পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে।
প্রিয়ার চোখে জল
পর্বঃ০৮
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
-শীলা আমি কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
-আপু তোমাকে আর ভাবতে হবে না। ভেবে এই পর্যন্ত কিছু করতে পারোনি, আর পারবে ও না, আমি যা বলছি তোমাকে তাই করতে হবে। আজ আমার কথা তোমাকে রাখতেই হবে, আর আজ যদি তুমি না পার তাহলে এই জীবনেও কিছু করতে পারবে না। এভাবে ধূকে ধূকে তোমাকে মরতে হবে, আর তোমার কষ্ট দেখার চাইতে আমার মরে যাওয়া ভালো হবে।
-শীলা আর কখনো এমন অলক্ষুণে কথা বলবি না। ঠিক আছে তুই যা বলবি আমি তাই করবো, এই পোড়া জীবনটার শেষ কোথায় আমিও দেখবো।
-এইতো আমার আপুর মত কথা, তুমি দাঁড়াও আমি আসছি। এই বলে শীলা চলে গেল। প্রিয়া বসে পড়লো, প্রিয়া কি আজ সত্যি সত্যি এই বাড়ি ছেড়ে যাবে,এই বাড়ির বাইরের জগতের ব্যাপারে প্রিয়ার কোন ধারণা নেই।ঢাকা শহরের অনেক গল্প শুনেছে কিন্তু কখনো যায়নি, কখনো দেখেনি সেখানে গিয়ে, প্রিয়া কিভাবে তার আশ্রয় খুঁজে নেবে। পরিচিত কেউ থাকতো তবুও কিছুটা ভরসা পেত। এক কষ্টের জীবন ছেড়ে আরেক অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াতে যাচ্ছে। প্রিয়া উঠে দাঁড়ালো, চোখের পানি মুছলো বাইরের দিকে তাকালো। হয়তো একটু পর ফজরের আযান পড়বে। শাহেদকে যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সে ঘরের দরজা বন্ধ। প্রিয়া একটা ব্যাগে নিজের কাপড় ভড়লো শীলা এলো কিছু টাকা প্রিয়ার হাতে দিয়ে বললো,এই টাকাগুলো রাখো এই টাকা আমি টিফিন থেকে বাঁচিয়েছি, পথে তোমার কাজে লাগবে। আপু আমি সব সময় দোয়া করবো যাতে তুমি ভালো থাকো।প্রিয়া বললো,তুইও নিজের দিকে খেয়াল রাখিস কিন্তু মামাকে সামলাবি কিভাবে,মামা তো আমি চলে গেছি শুনে কাঁদবে। শীলা বললো,আপু বাবাকে যা বলার আমি বলবো তুমি আমাদের নিয়ে মোটেও চিন্তা করবে না,তুমি এখন শুধু নিজের কথা চিন্তা করবে। জানি না আপু তোমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে আমি ঠিক করছি না ভুল করছি।প্রিয়া বললো,তুই অত চিন্তা করিস না,আর নিজেকে কখনো দোষী ভাববি না আমিও চাই আমার এই জীবনটাকে একটু বদলাতে আর তার চেয়ে বড় কথা,আমি ভাগ্যকে বিশ্বাস করি। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে,তার জন্য আমি কখনো তোকে দোষ দেব না। আমি যেখানেই থাকি আর যেমনই থাকি তোকে চিঠি লিখে জানাবো।শীলা বললো, আপু এখন আর কেউ চিঠি লেখে না ফোনে কথা বলে। এই বলে কাগজে একটা মোবাইল নাম্বার লিখে দিল,আপু এটা আমার বান্ধবীর নাম্বার। এই নাম্বারে ফোন করলে আমার সাথে কথা বলতে পারবে। আর দেরি করো না একটু পর আযান দিয়ে দিবে, আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই তোমাকে গ্রাম ছাড়তে হবে।এর আগে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঢাকার গাড়িতে উঠবে প্রিয়া।শীলাকে বুকে জড়িয়ে নিল,তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে মামার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়ালো।ঘরের ভেতর সামান্য আলোয় হারিকেন জ্বলছে সেই আলোয় মামা আর মামীকে দেখতে পেল।খাটের উপর দু'জন দুই ভুবনের বাসিন্দা, প্রিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো আর মনে মনে বললো, মামা আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার প্রিয়া আজ জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, তোমাকে আর শীলাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু কি করবো মামা,যা কখনো ভাবিনি তাই আজ করতে যাচ্ছি।নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমাকে যে যেতেই হবে মামা,জানি না আমার ভাগ্যে কি আছে, তুমি আমার জন্য দোয়া কর, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মামা। প্রিয়া মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। শীলা প্রিয়ার হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো, দূরের মসজিদ থেকে আযানের সুর ভেসে এল প্রিয়া শেষবারের মত শীলাকে বুকে টেনে নিল। তারপর শীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা বুকে চেপে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। চারপাশে অন্ধকার, আশেপাশের কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রিয়া ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিছুদিন আগে ধান কাটা হয়েছে।ধান গাছের গোড়া গুলো শক্ত হয়ে গেছে। সেগুলোর উপর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে,তবুও এই পথ দিয়েই যেতে হবে। সোজা পথ দিয়ে গেলে যদি কেউ দেখে,তাই ক্ষেতের উপর দিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ প্রিয়ার ভয় ভয় লাগছিল। এখন কিছুটা সাহস নিয়ে হাঁটছে, সময় মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দেয়,আর কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়ালে মানুষের মনও কঠিন হয়ে যায়। এক বাড়ির পুকুর ঘাটে এক লোক অযু করতে বসলো । প্রিয়া মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেল। প্রিয়া হাঁটছে আর চারদিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ করে মনে হলো চারদিক থেকে কেউ তাকে ধরতে আসছে, থমকে দাঁড়ালো। চারপাশে থাকালো নাহ্ কেউ নেই। এটা প্রিয়ার মনের ভাবনা। দূরে কোথাও মোরগ ডেকে উঠলো। প্রিয়া আরো জোরে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ করে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেল। প্রিয়া থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হচ্ছে। প্রিয়া স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। খালি পায়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিছু দূর থেকে গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়া পেছনে ফিরে তাকালো। মামী আর শাহেদের দৃষ্টি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। আকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়াতে চারপাশের সব কিছু দেখা যাচ্ছে।জীবনে এই প্রথম প্রিয়া নিজেকে স্বাধীন মনে করছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন তার পায়ের শিকল কেটে দিয়েছে। সে আজ মুক্ত,মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। ভোরের মিষ্টি বাতাসে পাখিগুলো মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রিয়া জীবনে অনেক ভোর দেখেছে, কিন্তু আজকের ভোরটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। প্রিয়া প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলো খুলতে শুরু করেছে। প্রিয়া রাস্তার পাশে দাঁড়ালো পরপর কয়েকটা বাস এলো। কিন্তু ঢাকার গাড়ি নয়। প্রিয়া চিন্তিত মনে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগলো, যদি কেউ দেখে। কিন্তু পরিচিত কাউকে চোখে পড়লো না। প্রিয়া শাড়ির আচল দিয়ে মুখ ঢাকলো। দূর থেকে একটা গাড়ি আসতে লাগলো। একটু কাছে আসতেই ঢাকা লেখা দেখতে পেল। গাড়ি এসে থামলো। প্রিয়া তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। গাড়ি ছেড়ে দিল।ঊনিশ বছরের জীবন পেছনে ফেলে প্রিয়া এগিয়ে চলছে সামনের দিকে, ভবিষ্যৎ কি জানা নেই।
মামীর ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটার দিকে। রান্নাঘরে প্রিয়াকে না দেখে ঘরে গেল। প্রিয়া সেখানেও নেই, মামী চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো। মামা,শাহেদ,শীলা দৌড়ে এল।মামা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,কি হয়েছে তুমি এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন,প্রিয়া কোথায়? মামী বললো, তোমার আদরের ভাগ্নি বাড়ি থেকা পলাইছে।তার ঘরে কাপড়-চোপড়ও নাই।এই আছিলো পোড়া কপালির মনে,হায় হায় আমার টেকা পয়সা তো নিয়া যায় নাই? আগে আমার আলমারি দেইহা লই।মামী দৌড়ে ঘরে গেল।শীলা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মামা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।শাহেদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দু'পা পেছনে গেল। মামী এসে মামার দিকে তাকিয়ে বললো,কানতাছো ক্যান? আপদ বিদায় অইছে,ভাগ্য বালা আমার কিছু নিয়া যায় নাই। আমার মনে অয় তোমার ভাগ্নি কারো হাত ধইরা রাইতের অন্ধকারে পলাইছে। মামা বললো,দোহাই লাগে এভাবে বলো না।আমার প্রিয়া খারাপ মেয়ে নয়। ওকে এভাবে কলঙ্ক দিওনা।আমি জানি প্রিয়ার কোন ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না ও অন্য কোন কারণে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি ওকে কোথায় খুঁজবো!মামা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।মামী হাসলো।শীলা বললো,মা তুমি হাসছো,হাসো মা প্রাণ খুলে হাসো। তোমার আপদ বিদায় হয়েছে,সাথে সাথে এই সংসারের কাজের মহিলাও বিদায় হয়েছে। মানুষ যদি একটা পশুও লালন-পালন করে,তবুও তার জন্য কিছুটা মায়া লাগে।অথচ একটা মেয়ে এতটা বছর তোমার কাছে থাকলো, তোমার সংসারের সব কাজ-কর্ম করলো।তার জন্য তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। মামী বললো,ওর লাইগা আমার কোন কষ্টও নাই,আর আফসোসও নাই।শীলা বললো,মা হয়েও তুমি সন্তানের মর্ম বুঝলে না। নিজের সন্তানকে বুকে টেনে নাও, আর পরের সন্তানকে দূরে ঠেলে দাও। এটা তো মায়ের ধর্ম নয়। মামী বললো, থাক তোরে আর উপদেশ দেওন লাগবো না।তোর থেকা আমি কম বুঝি না। এই বলে মামী চলে গেল। শাহেদ এসে শীলার সামনে দাঁড়ালো। শীলা কঠিন দৃষ্টিতে শাহেদ এর দিকে তাকালো। শাহেদ বললো শীলা, প্রিয়া হয়তো ওর কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে। তুই তো সবার বাড়ি চিনিস, চল খুঁযে দেখে আসি।
শাহেদ ভাই প্রিয়া আপু যেখানে ইচ্ছে যাক,কুষ্ট করে আপনাকে খুঁজতে হবে না।
যে মেয়েকে তুই বড় বোনের মত দেখিস, সেই মেয়ে নিখোঁজ, অথচ তুই নিশ্চিন্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস!
হ্যাঁ আছি,কারণ আমি জানি প্রিয়া আপু কোথায় গেছে।ঠিকানা বলতে পারবো না,তবে এই বাড়ি থেকে দূরে বহুদূরে চলে গেছে আপু।
তার মানে তুই ওকে চলে যেতে সাহায্য করেছিস?
হ্যাঁ,বাঘের খাঁচায় তো আর মানুষ থাকতে পারে না।খাঁচা বেঙে পাখি উড়ে গেছে।আর কেউ খু্ঁজে পাবে না, আর তাকে ধরতেও পারবে না,আপনিও না।
তুই সব জেনেশুনে এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলি? আমি খালাম্মাকে এক্ষুণি বলছি।
দাঁড়ান শাহেদ ভাই,এত লাফালাফি করবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হবে।রাতের কথা ভুলে গেছেন? আমি কিন্তু ভুলিনি, এত কিছুর পরও আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আপনার লজ্জা লাগছে না?
শীলা, তুই কিন্তু আমাকে অপমান করছিস।
আপনার কি অপমান বোধ আছে শাহেদ ভাই?খারাপ মানুষের না অপমানবোধ থাকে,না লজ্জা থাকে। যদি লজ্জাই থাকতো, তাহলে আপনার চেহারটা আমাকে আর দেখাতেন না। প্রিয়া আপু শুধু আপনার জন্য এই বাড়ি ছেড়ে গেছে। যে মেয়ে এত বছর এত কষ্ট করেও এই বাড়ির বাইরে যায়নি, সেই মেয়ে কেন একরাতে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে পালাবে? সে কথা আমি যদি এখন সবাইকে বলি,তাহলে আপনার কি অবস্থা হবে জানেন? আমার কথা কেউ অবিশ্বাস করবে না।এমন কি আপনার খালাম্মাও না।কারণ সে আমার মা,আমার কথা কখনো অবিশ্বাস করবে না। আপনি খারাপ হতে পারেন, আমি না।আমি আপনাকে কারও কাছে ছোট করতে চাই না। আমি চাই আপনি এই বাড়ি ছেড়ে আজই চলে যাবেন। আর কখনো আপনার ওই অপরাধী চেহারাটা আমাদের দেখাতে আসবেন না। শাহেদ মাথা নিচু করে চলে গেল।শীলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।মনে মনে বললো,আপু তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি যে বড় একা হয়ে গেলাম। তোমার শূন্যতা আমি কোন কিছু দিয়ে পূরণ করতে পারবো না। জানি না তোমার জীবনের দুঃখ কষ্ট শেষ হবে কি না। হে আল্লাহ,আমার আপুকে সব রকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করো। আপু ঢাকা শহরে কখনো যায়নি,আর ওখানে কাউকে চেনে না। জানি না কোন আশ্রয় খুঁজে পাবে কি না। শীলা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ