.
বদলে যাওয়া ভালোবাসার স্পর্শে....
.
.
রাত ৮ টা। বসে আছি কাজি অফিসে। পিছনে আমার আর তাসনিয়ার কয়েকজন ভালোবন্ধু আর আমার ভাই রায়হান আর ভাবী। একই মায়ের পেটের ভাই না হলেও প্রচণ্ড আপন। এই মানুষটাই অনেক কিছু করেছে আমার জন্য। তারা আমাদের বিয়েতে সাহায্য করতে এসেছে। আমার পাশের চেয়ারে বসে আছে তাসনিয়া। আমার ভালোবাসার মানুষ। যে আমাকে তার জীবনের বেশি ভালোবেসেছে। আজ এবং এই মুহুর্তে তাকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি। কাজি সাহেব আমাদের দিকে একটি অফিস খাতা বাড়িয়ে দিয়ে সই করতে বললেন। আমরা সই করলাম।
.
দেনমোহর ৭৬৫ টাকা ঠিক হলো তাসনিয়ার কথায়। কারণ আমাদের রিলেশনের বয়স ২ বছর ১ মাস ৪ দিন। ৭৩০ দিন + লীপইয়ার এর জন্য ১ দিন + ১মাস ৪ দিন অর্থাৎ ৭৬৫ দিন। আর প্রতিদিন ১ টাকা করে হলে ৭৬৫ টাকা। সেদিন জানতাম না পরে জেনেছিলাম। সব কিছুতেই তার পাগলামী। তাও আজ হতে আমার পাগলীর রক্ষা করার সব দায়িত্ব আমার। তিন কবুল বলে পাগলীটাকে আপন করে নিলাম।
.
আমি আমার বাড়ি ফিরলাম তাসনিয়াকে নিয়ে। সঙ্গে আমার তিন বন্ধুরা, ভাই ও ভাবী। তাসনিয়ার বন্ধুরা ফিরে গিয়েছে। আমার ভাই ও ভাবী পাশের ফ্লাটে থাকেন। আমরা বাসায় ফিরে আগে সবাই মিলে এশার নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর আমার বন্ধুরা গিয়ে আমাদের বাসর ঘর সাজাতে লাগলো। তাসনিয়া তাদের সাথেই আছে। তাসনিয়া তাদের সাথে ভালো ভাবেই পরিচিত। আমার ভালো লাগছিলো না তাই ছাদে গিয়ে এক পাশে বসে পড়লাম।
.
আমি ফয়সাল আহমেদ। বর্তমানে একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। যদিও এই কথা কেউ এমনকি তাসনিয়াও জানে না। কারণ প্রোমোশন আজকেই হয়েছে। ভেবেছিলাম তাসনিয়াকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এর মধ্যে কতো কিছু হয়ে গেলো। তাকে আর জানানোই হয় নি।
.
মনে পরছে সেই পুরাতন স্মৃতি গুলো। কতোদিন চলে গেছে। কি ছিলাম কি হলাম আবার কি ছিলাম কি হলাম। বুঝতে পারছেন না তো। আসুন তাহলে এই সময়ের মাঝে বলি সেই পুরাতন স্মৃতি গুলো। তাহলেই মনের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন,
.
"আমি ফয়সাল। বাবার একমাত্র ছেলে। মা আমার জন্মের ৩ বছর পর মারা গেছেন। গ্রামের ছেলে। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন এ+ নিয়ে পাশ করে গ্রামের পাশের এক কলেজেই ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বাবার বেশি জমি ছিলো না। তবুও যে টুকু আছে তা নিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়। বাবা এছাড়াও মানুষের জমিতে কাজ করে। আমি মেধাবী ও তার একমাত্র ছেলে ছিলাম বিধায় আমাকে লেখাপড়া করাতে বাবা সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি।
.
এইচএসসি তেও গোল্ডেন এ+ পেয়ে পাশ করলাম গ্রামের পাশের কলেজ থেকে। এখন টেনশনে পরে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়তে গেলে শহর এ যেতে হবে। আর সেখানে টিকে থাকতে হলে অনেক টাকা পয়সা লাগবে। এতো টাকা কোথায় পাবেন বাবা। কিন্তু তিনি একপ্রকার জোর করে হাতে তার জমানো টাকা পয়সা তুলে দিয়ে বাবা বললেন,
.
-- ডরাইস না বাজান। আমি আছি না। আমি বাইচ্চা থাকতে তোর টিয়্যার চিন্তা ক্যা। দরকার হইলে আরো খাটমু। মাসে মাসে টিয়্যা পাঠামু। তাও তুই লিহাপড়া ছাড়িস না বাজান। আমাগো কতোশখ তোরে মাইনষের মতো মানুষ করুম। শিক্ষিত করুম। আমাগো আশা নষ্ট করিস না বাজান। তোর মা উপর থাইক্কা দেখতাছে। তোর মায়েরও আশা আছিলো। নিজে চাকরী করবি। আমাগো মতোন খাটুন লাগতো না তোর।
-- আমি তোমাদের আশা পুর্ণ করবো।
-- এই ল তোর মোবাইল। আমার লগে যোগাযোগ রাহিস। আর মাঝে মাঝে আইসা আমারে দেইক্ষা যাইস।
-- আচ্ছা বাবা। ভালো থেকো।
-- হ যা বাজান।
.
সেদিন আবেগে সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। বাবাকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ছেলেদের কাঁদতে হয় না। তবুও কেনো যেন একটু পর পর পানি বেড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। সারারাস্তা এমন মন খারাপ করেই গেলো।
.
শহরে গিয়ে প্রথম একটা ছাত্রাবাস খুঁজতে লাগলাম। সারাদিনে না পেয়ে এক মেসের সামনের এক জায়গায় বসে পড়েছিলাম। সারাদিন ম্যাস খুজে খুজে ক্লান্ত আমি। ভালো ছাত্রাবাসের ভাড়া বেশি হচ্ছে। কিন্তু আমি চাচ্ছি যাই হোক একটু কম ভাড়ার ছাত্রাবাসের রুম। কারণ আমার অত টাকা খরচ করা যাবে না। কারণ সামনে আরো দিন পরে আছে। টাকা লাগবে। ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে। তাছাড়া এই ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার জন্যও তো চাই টাকা। এখন খালি টাকা আর টাকা দরকার। অথচ কম ভাড়ায় কোনো ছাত্রাবাস পাচ্ছি না।
.
হটাৎ এক লোক আসলো। আমার চেয়ে ২-৩ বছরের বড় হবে। জিজ্ঞাসা করলো,
-- এখানে কি করছো? দেখে মনে হচ্ছে গ্রাম থেকে এসেছো!
-- হ্যা গ্রাম থেকে এসেছি। গরীব ঘরের সন্তান। টাকা পয়সা বাঁচিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু অল্প ভাড়ায় কোনো ছাত্রাবাস পাচ্ছি না। সেগুলোর বেশি ভাড়া বেশি। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের আর্থিক অবস্থাও বেশি ভালো না।
.
এই বলে তাকে আমি সব খুলে বললাম। তাকে ভালো মানুষ মনে হয়েছিল তাই। তিনি শুনে আপসোস করলেন। বললেন,
.
-- এমন মেধাবী ছেলে এভাবে তলে চাপা পড়বে তা তো হবে না। এককাজ কর। আমি তোকে একটা ছাত্রাবাসে রুম ঠিক করে দিবো। তুই সেখানে থাকবি। আচ্ছা।
-- আপনাকে ধন্যবাদ ভাই। আমার অনেক প্রয়োজন একটা থাকার জায়গার।
-- আমার নাম রায়হান। আজ হতে আমি তোর ভাই। আর আমাকে তুমি করে বলবি। আর আমি তুই করে বলবো। কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে বলবি।
.
রায়হান ভাই আমাকে একটা রুম ঠিক করে দিলো। সত্যিই অনেক ভালো ছিলো ভাইটা। ছাত্রাবাসে ভাড়া নিতো না। ভাইয়া টাকা দিতে মানা করে দিয়েছেন। তারাও কেন যেন সব মেনে নেয়। কোনো রুপ দ্বিরুক্তি করতো না। কারণ টা জেনেছিলাম ২ বছর পর।
.
যাই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। নিয়মিত ক্লাস শুরু করি। কিন্তু গরীব ছিলাম বিধায় এক দুই ড্রেস পরে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস করে সোজা বাড়ি চলে আসতাম। একা একা নিজের থাকতাম। কোনো বন্ধু ছিলো না। বন্ধু ছিলো একমাত্র আমার বড় ভাই। তার সাথে প্রায় সন্ধ্যায় আড্ডা দিই। কিন্তু তার জীবনের কিছু জানি আমি। ভায়ের মা নেই। বাবা আছেন তবে তার দ্বিতীয় সংসার নিয়ে। ভায়ের কোনো খবরই রাখেন না। সেই থেকে ভাই নিজেই উপার্জন করে। কিন্তু কি কাজ করে বলে নি। তাছাড়া আমার মতো এক অপরিচিত ছেলের জন্য যা করছেন তিনি মহৎ ছাড়া আর কি হবেন। তার সহযোগীতা আর বাবার পাঠানো টাকা দিয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করি আমি।
.
ঠিক তৃতীয় বর্ষ থেকে দুঃখের যাত্রা শুরু হয়। আমার বাবার কোনো এক মারাত্মক অসুখ ছিলো যেটা আমাকে জানান নি। বরং টাকা উপার্জন করতে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে। অথচ সামনের দিনের কথা আমার কথা ভাবলোই না। ভাবোলনা তিনি চলে গেলে আমি একা একা কি করবো। খবর যেদিন পেলাম তার আগের দিনই তার দাফন কাফন শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বাবার উপর প্রচণ্ড অভিমান হয় আমার। তবুও কাঁদতে কাঁদতে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
.
গিয়ে শুধু তার কবরের দেখা পেয়েছি আমি। আবার এদিকে আমাদের যেটুকু জমিজমা ছিলো সব হাতিয়ে নিয়েছেন আমার চাচা গুলো। আমাকে পুরো পথে বসিয়ে ছেড়েছে। জমি আছে বলতে শুধু বাবার কবর এর জমি টুকু। প্রচুর প্রচুর অভিমানী হলাম আমি। সেদিনই গ্রাম হতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম।
.
এরপর টাকার সঙ্কট শুরু হয়েছিলো। টাকার প্রচণ্ড অভাব বুঝেছি তো ছোট থেকেই। এখন আরো বুঝছি। বেঁচে থাকি পুরো দায়। সেদিন হতেই বাবার উপর অভিমান আর টাকার সঙ্কট এ বাবাকে দেয়া কথা ভুলে গেলাম। কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনো কাজ পেলাম না। পড়ালেখার দিকেও আর নজর দিই নি। কিন্তু ভাইয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলো মনযোগ আনার জন্য।
.
শেষ পর্যন্ত রায়হান ভায়ের কাছে হাত পাতলাম। রায়হান ভাই কি কাজ করতো জেনেছিলাম বাবার মৃত্যুর কিছু দিন আগে। তখন প্রচণ্ড ঘৃণা হয়েছিলো মনে। তবুও একপ্রকার ভক্তি ছিলো তার উপর। মানুষটা অনেক করেছিলো আমার জন্য। তবে আজ বুঝতে পারছি টাকার জন্য মানুষ কি না কি করতে পারে।
.
রায়হান ভাই এক গুণ্ডা গ্যাং এর সদস্য ছিলো। ঢাকার খুব বড় গ্যাং ছিলো। এমন কোনো কাজ নাই যে গ্যাং করতো। তবুও আমি যেন কেমন হয়ে গেছিলাম। শোক, অভিমান, দুঃখ আমাকে কোথায় নিয়ে গেছিলো। এই আমি কিনা যে মেধাবী ছাত্র। বাবাকে দেয়া কথা ভুলে গেলাম। রায়হান ভাই আমাকে বাধা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তবুও আমি এক মাত্র রাগের বশে জেদ ধরে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে ভাইয়া আমাকে বলেছিলো যে দলে ঢুকতে দিবে। তবে আমাকে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে হবে। আমি লেখাপড়া করতে রাজি হলাম না। তবুও পরে রাজি হয়ে গেলাম।
.
ভাইয়া গ্যাং এর এক দলে কাজ করতো। সেই দলের নেতার প্রিয় পাত্র ছিলো ভাইয়া। এই দল টাও কুখ্যাত ছিলো। আমাকে ভাইয়া ঢুকিয়ে দিলো। আমাকে কাজ করতে ইচ্ছা হলে করি। প্রথম প্রথম কিছুই পারতাম না। হয়তো বিবেকে বাধতো। সেজন্য হয়তো কোনো খারাপ কাজ করতে পারতাম না। আসতে আসতে আরো খারাপ হতে থাকলাম। রাগ বাড়তে লাগলো। ভালো কি যেন ভুলেই যেতে লাগলাম। বাবার উপদেশ গুলোও ভুলে যেতাম। এমন খারাপ হতে থাকলাম যে আমার দলের প্রধানের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। প্রায় ভালো ভাবেই চলতাম। মাথায় খালি একটা কথাই আছে আসে। মুক্তি মুক্তি মুক্তি। কোনো অভাব নাই, কোনো টাকার টেনশন নাই। এটাই তো চাওয়া। সব বুদ্ধি জ্ঞান যেন লোপ পেয়ে গেছিলো।
.
আগে কলেজে যারা আমাকে পাত্তা দিতো না তারা এখন আমার ভয়ে কাপে। ভাবে আমার কথা না মানলে না জানি তাদের ক্ষতি করে দিই। ভাইয়ার জন্য যেতে হতো। অমানুষ হয়ে গেলেও ভাইয়াকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতাম।
.
আমার প্রতিদিনের কাজ ভার্সিটি গেটে বসে এসে ওকে বিরক্ত করা। বিশেষ করে মেয়েদের প্রচণ্ড বিরক্ত করতাম। আমার সঙ্গে ৩ জন ফ্রেন্ড থাকতো। এইভাবে ৩য় বর্ষ শেষ করলাম। চতুর্থ বর্ষে উঠলাম। পড়া শোনা করার ক্ষমতা কেন জানি আমার ভেতরে থেকে গিয়েছে। যার জন্য এখনো টিকে আছি ভার্সিটিতে। নবীন বরণে আমি কোনো বারই যাই না। এবার কি মনে করে যেন গেলাম।
.
গেটে বন্ধুরা আর আমি বসে বসে মেয়েদের বিরক্ত করছিলাম। এমন সময় হলুদ 'থ্রি পিছ' পড়া এক মেয়ে আমার সামনে দিয়ে ভার্সিটি গেটের দিক যাচ্ছে। আমি হা করে চেয়ে আছি। এই প্রথম আমি আমার পাষাণ বিবেক হীন এ হৃদয়ে কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম। পরেছিলাম মেয়েটার মায়ায়। হলুদ ড্রেসে অপূর্ব সুন্দর লাগছিলো তাকে। কিন্তু সেই সৌন্দর্যে না পড়েছিলাম তার চোখের মায়ায়। অপূর্ব সুন্দর সেই চোখ। টানা টানা, চোখের ভেতরে যেন শান্ত দিঘি। চোখের দিকে তাকালে যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। আমার মুখি হয়েই আসছিলো। ঠিক কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারবো না। মেয়েটার চোখে প্রচুর মায়া আছে। ঠিক সেই মায়ার দিঘি যখন চোখের আড়ালে চলে গেলো তখন নিজের চারপাশ টের পেলাম। বন্ধুদের ওকে নিয়ে বাজে বলতে মানা করে দিলাম।
.
বন্ধুরা তো অবাক। এই আমি যে কিনা কাউকে ছেড়ে কথা বলি না সেই আমি কিনা আজ চুপ। তাও আবার একজন মেয়ের সামনে। তাদের মধ্যে অদ্র বলে উঠলো,
.
-- দোস্ত চরম মাল ছিলো। তুই কিছু বললি না যে। (অদ্র)
-- দোস্ত কিছু মনে করিস না। সুন্দর হোক কিন্তু এই মেয়ের চোখে যা মায়া আমি অন্তত একে বিরক্ত করতে পারবো নারে। তোরাও বিরক্ত করিস না।
.
তুহিন মধ্যে থেকে বলে উঠলো,
.
-- তুই প্রেমে পড়েছিস বলে মনে হচ্ছে। (তুহিন)
-- হয়তো আবার হয়তো না। আমার চোখের সামনে থেকে অই মায়া দূর করতে পারছি না। এক কাজ করবি মেয়েটার সব জেনে আমায় জানাবি। আমি বাড়ি যাচ্ছি ভালো লাগছে না। (আমি)
-- দোস্ত তুই পুরাই ফেঁসে গেছিস। চিন্তা করিস না আমরা আছি তো। (তুহিন)
.
আর অপু বরাবরি চুপ। তবে আমার ধরণা ছিলো অই করতে পারবে সব ভালো ভাবে। হলোও তাই। পরের দিন অপু এসেই আমাকে বলল,
.
-- দোস্ত মেয়েটা অনার্স প্রথম বর্ষের। নতুন মাল।
-- চুপ মাল মাল করবি না তো। আর আমার মনে হয়েছিলো প্রথম বর্ষই। আগে দেখিনি তো।
-- কেন রে মাল বললে লাগে বুঝি। যাই হোক। মেয়েটা অই এলাকায় থাকে আগে থাকে। নাম তাসনিয়া। মেয়েটার বাবা আর সৎ মা আছে।
-- ধন্যবাদ দোস্ত। আর হ্যা দেখবি ওকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
-- আচ্ছা।
.
কয়েকদিন মেয়েটার পিছনে ঘুরতে থাকলাম। আমার জন্য কোনো ছেলে তাসনিয়াকে বিরক্ত করতে সাহস করতো না। ২ মাস চলে গেলো। তাসনিয়ার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো বিরক্ত হয় না। আমার থেকে পালিয়ে বেড়ায় না। বরং আমার পাশ দিয়ে ভালো ভাবে যায়। আমার মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো আর সময় দিই না গ্যাং এ। নিজের খেয়াল রাখি। আর মদ কোনো কালে খেতাম না। তাই আমার বন্ধুতাও খেতো না। খালি সিগারেটেই বিশেষ ছিলাম।
.
প্রায় ৬ মাস পর, আমি তাসনিয়াকে প্রপোজ করি। কয়েকটা লাইন কাব্য লিখেছিলাম। আগে আমি কবিতা লেখতে পারতাম। এখনো সেই ছন্দ আমার মাঝে আছে। সত্যি মায়া প্রেম এগুলো কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে আসে বলা মুশকিল। প্রপোজ কাব্যা ছিলো,
.
প্রিয়তমা পড়েছিলাম তোমার প্রেমে,
যেদিন দেখেছিলাম তোমার অই মায়া ভরা দিঘি,
আজ আমি এসেছি তোমার
ভালোবাসার অনুরোধ নিতে,
দিবে কি সেই সুযোগ আমায়,
কথা দিলাম তোমার হাত ছাড়বো না আজীবন।
.
তাসনিয়া বরং আমার গালে একটা চর মেরেছিলো। আর বলেছিলো,
.
-- আপনি আমার যোগ্যই না। আপনি একটা গুন্ডা মাস্তান। নামাজ কালাম তো পড়েনই না। আর মেয়েদের পিছে লাইন মারতে লজ্জা করে না। নিজের মুখও তো সংযত রাখতে পারেন না। সে কিনা প্রেম করতে আসে।
-- .......(আমি নির্বাক। এই পাষাণ হৃদয় ও কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিলো তার একেকটা কথায়)
-- কি হলো আপনার কথা কোথায় হাড়িয়ে গেলো। খুবই তো বাজে বলতেন। কান সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া যায়। আমি আপনাকে সেই সুযোগ দিবো। যেই দিনে ভালো ছেলে হবেন। নামাজ কালাম পড়বেন, গুন্ডামি ছেড়ে দিবেন। যেই দিন খারাপ কাজ ছাড়তে পাড়বেন সেদিন আমার সামনে আসবেন। এর আগে যেন না দেখি।
.
এই বলে সে হন হন করে হেটে চলে গেলো। আর আমি ভাঙ্গা নয়নে তার দিকে চেয়ে রইলাম। বুকের ভিতর যেন ভেঙে চুরে যাচ্ছে। কোনো মতে বাড়ি ফিরে সুয়ে পড়লাম। অনেক মাস পরে সেদিন মন খুলে কেঁদেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে আমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু সে তো দেখতেই পেলাম। ভাবতে ভাবতে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
.
উঠলাম পরের দিন সকালে। উঠে ভাবতে লাগলাম যত দিন ভালো না হবো ততদিন আর তার সামনে যাবী না। ভালো হয়ে যাবো। তার ভালোবাসা পাবার জন্য সব করতে পারবো।
.
২ দিন পরে ঠিক করলাম নামাজ পরার চেষ্টা করবো। সেইদিন নামাজ পড়েছিলাম। আগেও পড়তাম। কিন্তু মধ্যে কেনো জানি ওলট পালট হয়ে গেলাম। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেছেন কিনা এটা ভেবে এখনোও কাঁদি। নামাজ শুরু সেদিন থেকে আবার। সে দিন আবার বুঝালাম নামাজ মানেই শান্তি। নামাজ পড়ার পর এতো শান্তি পেয়েছিলাম যা ১ বছরে পাই নি।
.
আমার ৩ বন্ধুকেও আমার সাথে নিয়ে নামাজ পড়ানো শুরু করলাম। তারাও কিছু দিন নামাজ পড়ার পরই বুঝতে পারলো নামাজে প্রকৃয় শান্তি রয়েছে। কিছু দিন পরেই আমরা ৪ বন্ধু গ্যাং ছেড়ে দিই। কারণ আমি দল প্রধানের প্রিয় ছিলাম। বরং আমাকে বলেছে যাতে আমি সুখি হই। তাসনিয়া কিছু দিন পরেই ফিরে এসে ছিলো। আমাকে পথ দেখিয়েছিলো। ইসলামী পথ অনুসরণ করতে বলেছিলো। ৩ মাস লেগেছিলো নিজেকে পুরো পরিবর্তন করতে। তাসনিয়া অনেক সাহায্য করেছিলো আমায়।
.
তারপর তাসনিয়ার কাছে ফিরেছিলাম। কারণ আমার পরিবর্তন তার জন্য সম্ভব হয়েছে। তার জন্যই আজ এই পথে ফিরেছি। আমার সঠিক পথ তো সে নিজেই দেখিয়েছে। পরের দিন প্রথম ভার্সিটি গেলাম। তার সাথে দেখা করে এক সাইডে বসলাম। তাকে আমার জীবনের ঘটনা বলতে চাইছিলাম। তাসনিয়াই বলে উঠলো,
.
-- অবশেষে তুমি এখন ভালো ছেলে হতে পারলে।
-- হুম সবই তোমার জন্য। আমার জীবনের ঘটনা জানো না তুমি। আমার বা............
-- বলতে হবে না। আমি সব জানি। যাই হোক। কালকে বাবার কবর জিয়ারত করবে গিয়ে। আবার কবিতা লিখা শুরু করবে।
-- তুমি জানলে কিভাবে এসব। একমাত্র আমি আর আমার ডায়রি জানে। ১ মিনিট ডায়রি তোমার কাছে না। এই জন্যই তো খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
-- হ্যা ঠিক ধরেছো। তোমার বন্ধু এটা দিয়েছেন আমাকে। আর তুমি আমার ব্যাপারে জানো আশা করি।
-- হ্যা।
-- আমি তোমার ব্যাপার জানতাম। কষ্ট দিয়েছিলাম যাতে সঠিক পথে চলে আসো। কিন্তু পরে ভাবলাম আমিও সাহায্য করি তোমাকে।
-- ও।
-- ওকে কবিতা লেখা শুরু করবে আর কালকে বাবার কবর জিয়ারত করবে।
-- আচ্ছা।
-- আর আমাকে কিছু বললে না যে।
-- কি আর বলবো একটা কবিতা বলছি,
.
তোমার অই মায়া ভরা দিঘির,
চোখে চোখ রেখে,
আমি কাটাতে চাই বাকি জীবন,
তুমি হবে সে জীবনের জীবনসঙ্গি।
.
তাসনিয়া তার মায়া ভরা চোখ আমার দিকে এনে বলে হ্যা হবো। আমাদের ভালোবাসার নতুন করে পথ চলা শুরু সেখান থেকে। কয়েক মাস পর আমি অনার্স কম্পলিট করলাম ভায়ের সহযোগীতায়। আর পড়াশোনা করতে ইচ্ছা হলো না। চাকরি খুঁজতে শুরু করে দিলাম। আবারো সমস্যা মুখে পড়েছিলাম। অবশ্য একাটা ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্ক কর্মকর্তার চাকরি পেয়েছিলাম। মাস খানেক কাজ করে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলাম। যত্ন সহকারে কাজ করতাম। সব কাজ সময় মতো করেছিলাম। ম্যানেজারের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। এই কাজের জন্য কিছু দূরে এসে থাকতে হচ্ছে। ফলে তাসনিয়ার সাথে রোজ দেখা হয় না। আমার বন্ধু গুলোও আমার সাথেই থেকে কাজ করে।
.
আমাদের ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ট্রান্সফার হয়। আগের ম্যানেজার আমাকে প্রমোশন দিয়ে দেন। ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এই অল্প বয়সে। আমি সব কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করি। তাছাড়া সততার সঙ্গে কাজ করি। এর ফল তো আল্লাহ দিবেনই। খুব খুশি লাগছিলো। কতো কষ্টে চাকরী টা পেয়েছিলাম। এখন প্রোমোশন পেয়েছি। ঝামেলা চলছিলো। যাক এবার মুক্তি। কিছু টাকা বেশি বেতন পাবো। তাসনিয়াকে বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নাই। আজ প্রমোশন লেটার নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সন্ধ্যে ৬ টায় তাসনিয়া কল করে জরুরী দেখা করতে বলল। কি আর করার। বাড়ি না ফিরে তাসনিয়ার সাথে দেখা করতে চললাম।
.
তাসনিয়া আমকে দেখার সাথে সাথে বলল,
.
-- ফয়সাল জলদি রিকশা ঠিক করো।
-- এই সন্ধ্যায় আবার কোথায় যাবে।
-- কোথাও না। তুমি রিকশা ডাকো।
-- আচ্ছা।
.
আমি একটা রিকশা ডাকলাম। সে উঠে বলল,
.
-- মামা কাজি অফিস চলেন। আর তোমাকে কি উঠতে বলে দিতে হবে।
.
আমি উঠে বললাম,
.
-- কাজি অফিস কেন। কারো কি বিয়ে।
-- আগে চলো তারপর।
.
কাজি অফিস গেলাম। দেখলাম তাসনিয়ার কিছু বন্ধু আমার তিন বন্ধু আর রায়হান ভাই আর ভাবী। আমি অবাক। এরা সবাই, এখানে কার বিয়ে কিছু বুঝতে পারছি না। ও হ্যা বলা হয়নি। আমার চাকরী পাবার পর রায়হান ভাইও অই কাজ ছেড়ে নতুন করে নিজের ব্যবসা শুরু করে। ভালোই চলছে ব্যাবসা। ভাইয়া আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকে। বিয়ে করেছে ৬ মাস হলো।
.
তাসনিয়াকে বললাম,
.
-- ব্যাপার কি এরা সবাই এখানে।
-- হ্যা আজ আমাদের বিয়ে। বাড়িতে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করেছিলো। এক বুড়া লোকের সাথে। আজ রাতেই বিয়ে দিয়ে দিত। তাই পালিয়ে এসেছি। আর এদের ফোন করে আসতে বলেছি।
.
আপনাদের বলা হয় নি। তাসনিয়ার বাবা মারা গেছেন এক মাস আগে। তার পরেই শুরু হয় সৎ মায়ের অত্যাচার। বাবা থাকার কারণে কিছু বলতে পারেন নি তিনি। এখন পাত্র খুজছিলেন। টাকা ওয়ালা। আমি প্রস্তাব নিয়ে গেছিলাম বিয়ের। বাট রাজি হন নি। কারণ টাকা নাই আমার নাই বেশি সম্পত্তি। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ সেটা সমস্যা ছিলো না। স্বার্থবাদী মহিলা তিনি। আমি তাসনিয়া আশ্বাস দিয়েছিলাম বুঝাবো। বাট এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু হবে কল্পণা করি নি। তাই কোনো বিলম্ব করলাম না। তাছাড়া উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তো হয়েই যাচ্ছি। তাই রাজি হয়ে গেলাম।"
.
তারপরের ঘটানা তো জানেনই। এমন সময় বন্ধুরা আমাকে এসে ছাদ থেকে নামিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। আমাকে শান্তনা দিয়ে ফাজলামি করে চলে গেলো। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম তাসনিয়া বসে আছে। আমি তার পাশে বসে বললাম,
.
-- চলো আমাদের সামনের দিন যেন এমন ভালোবাসা ময় হয় তার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া চাই।
-- আচ্ছা চলো। (মুচকি হাসি দিয়ে)
.
জায়নামাজ ছিলাম। আমি সামনে তাসনিয়া একটু পিছনে। আমরা দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া চাইলাম। তারপর জায়নামাজ গুছিয়ে আমি বিছানায় বসে পড়লাম। তাসনিয়া এসে বলল,
.
-- কি মহাশয়, নিজে নিজে তো ছাদে গিয়ে চাঁদের আলোয় বসে ছিলেন। আমাকে নিলেন না।
-- চলো যাই (হাসি দিয়ে)
.
আমি আর তাসনিয়া ছাদে গিয়া বসলাম। আমার পাশে তাসনিয়া বসে আছে। আমি তাকে বললাম,
.
-- আজ কি হাতটা ধরা যাবে। আগে তো ধরতে দাও নি।
.
সে কিছু না বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার কাঁধে মাথা দিলো। আমি তার হাতে প্রোমোশন লেটার টা ধরিয়ে দিলাম। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি তাকে খুলতে ইশারা করলাম। সে খুলে পত্র দেখে ছলছল চোখে আবার ভরে রাখলো। আবার আমার কাঁধে মাথা রাখলো।
.
সে চাঁদ দেখছে। আর আমি দেখছি তার সেই মায়া ভরা দিঘি। যেই দিঘি থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। যেই চোখ দেখে পার করে দিতে পারি এই জীবন। কিন্তু পার করে দিলে তো হবে না। এই পাগলীর পাগলামো রক্ষা করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হবে আজীবন। ঠিক যেমন ভালোবাসায় আমাকে আবার সত্যের পথে ফিরিয়ে এনেছে। চলুক আমাদের প্রতিটা পথ প্রতিটা অলিগলি ভালোবাসাময়।
............................(সমাপ্ত)...............................
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ