------------------------অবুঝ ভালবাসা-------------------------
-------------------৫ম পর্ব-----------------
গান শেষ হওয়ার পর একটু সময় দুজনেই নীরব থাকে। তারপর অভি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-তুমি এত ভালো বাজতে পারো! তাছাড়া গান গাওয়ার গলাও বেশ ভালো। কি আর বলবো, আসলে..... আসলে আমার খুব লজ্জা করছে।
-প্রশংসা করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু লজ্জা পাচ্ছ কেন?
-আসলে আমি তো জানতাম না তুমি এত ভালো বাজাতে পারো। জানলে গতকাল তোমার সামনে ভুলভাল বাজানোর দুঃসাহস দেখাতাম না। কি সব বাজিয়েছি সেটা ভেবেই লজ্জা লাগছে।
-আরে না, এইসব কি বলছো। তোমার গিটার বাজানো দারুণ ছিল। আমি ছোট বেলা থেকেই বাজানো শিখেও তোমার মতো বাজাতে পারি না। তুমি নিজে থেকে এত ভালো সুর তোল যা প্রশংসার যোগ্য।
-আমি আর কি এমন বাজাই। আমার থেকে রাহুলের গিটার বাজানো অনেক বেশি ভালো হয়। সে গান ও করে দারুণ।
রাহুলের কথা তোলাতে অনামিকা বিরক্ত হয়। সে মনে মনে বলে-- "কি বুঝাতে চাই আর কি বুঝে! স্বপ্নে আমি কত সহজেই মনের কথা বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন কিছুই বলতে পারছি না। আসলে এটাই হচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে পার্থক্য। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে অভিও আমাকে ভালবাসে। কিন্তু তখন রাহুল কেন অন্য কথা বলেছিল?
-তোমার কি এখানে এসে ভালো লাগছে?
-যার মনের মধ্যে দুঃখ বাসা বেঁধে থাকে, হাজার সুন্দর কিছুও তার কাছে দেখতে ভালো লাগে না।
কথাটি বলতে গিয়ে হঠাৎ অভির চোখ ভিজে ওঠে। কোনোভাবে সে কান্না আটকে রাখে।
-কিসের এত দুঃখ তোমার? আমাকে কি বলা যায় না?
-প্রত্যেক মানুষের এমন কিছু কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। আমার এই দুঃখটাও সেইরকম, যা আমি কাউকে বলতে পারিনা। আমার এমন কিছু নেই যা রাহুলের সাথে শেয়ার করি না। কিন্তু এটা পারছি না। আমার কি মনে হয় জানো? তোমারও এরকম কোনো কথা আছে যা কাউকে বলতে পারছ না।
অনামিকা কিছু না ভেবেই ততক্ষণিকভাবে বলে দেয়,
-আমার এমন কোনো দুঃখ নেই।
-তাহলে তো ভালোই, তুমি এই যন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচে গেলে।
-তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? সত্য কথা বলবে কিন্তু।
অভি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। এখন যদি অনামিকা জানতে চায়, সে তাকে ভালবাসে কিনা! তখন সে কি উত্তর দিবে? মিথ্যে বলবে অনামিকাকে?
-আগে বলো কি প্রশ্ন?-শুনেছি যাদের মনে অনেক দুঃখ কষ্ট থাকে। তারা মদ, সিগারেট এইসব নেশা করে দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করে। তুমিও কি এইসব খাও নাকি?
প্রশ্নটা শুনে নীরবে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অভি। শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
-এইসব ব্যর্থ চেষ্টা করার কোনো মানেই হয় না। আমি মনে করি একমাত্র মৃত্যু ছাড়া এইসব নেশাটেশা এই দুঃখ ভুলাতে পারবে না। তাছাড়া আমি এই দুঃখ ভুলতে চাইও না। চাপা কষ্টটা মনের এক কোণে রেখে দিতে চাই। এই দুঃখ থেকেই আমি সুখ খুঁজে নিতে চাই।
-তুমি সবসময় অদ্ভুত রকমের কথাবার্তা বলো।
-হাঁ আমি সবসময় অদ্ভুত রকমের কথাই বলি। বলতে আমার ভালোই লাগে। (কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলে) আই লাভ ইউ অনামিকা। তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমি ভালবেসে ফেলেছি।
হঠাৎ অভির মুখে ভালবাসার কথা শুনে আনন্দে অনামিকার চোখে পানি চলে আসে। এইবার আর সে তার আবেগ লুকিয়ে রাখে না।তার মনের কথাগুলি সেও এবার বলে দেয়।
-আমিও তোমাকে ভালবাসি অভি। ঠিক কখন থেকে,আর কেনই বা ভালবেসেছি বলতে পারবো না। শুধু এটুকুই বলতে পারি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
অভি মনে মনে যেটা ভাবছিল সেটাই হল! সে বুঝতে পারছে অনামিকাও তাকে ভালবাসে। কিন্তু বিষয়টাকে মজা করার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হঠাৎ করেই হেসে ফেলে।
-আরে বাহ! তুমি দেখছি আমার থেকেও ভালো অদ্ভুত কথা বলতে পারো? আসলে সব মানুষই মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কথা বলে থাকে। আমি একটু বেশিই বলে থাকি এই হল পার্থক্য। তবে তোমাকে এইরকম অদ্ভুত টাইপের কথা বলা উচিৎ হয়নি, আমাকে ক্ষমা করে দিও।
একটু আগে অনামিকার চোখে যে জল ছিল সেটা ছিল পরম আনন্দের। কিন্তু এখন অভির কথাটি শুনে তার আনন্দ অশ্রু মুহূর্তে নীলচে কষ্টে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-এইসবের মানে কি অভি?
-মানে, শুধু তোমাকে বুঝানোর জন্য যে আমরা সবাই মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব কথা বলি। যদিও ভালবাসা নিয়ে এইভাবে মজা করা উচিৎ হয়নি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
-তুমি তো কোনো ভুল করোনি। তুমি যেমন আমায় বলেছ, তেমনি আমিও তোমাকে বলেছি। তাহলে আমাকেও যে ক্ষমা চাইতে হয়!
কথাটি বলে অনামিকা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অভি বুঝতে পারে অনামিকা খুব কষ্ট পেয়ে গেছে। কিন্তু কি আর করার আছে তার? সে নিজেও অনামিকাকে অনেক ভালবাসে। তবে সেটা মনে মনে, কোনোদিন প্রকাশ করবে না। কারণ রাহুল তার হ্নদয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। তাকে কষ্ট দিয়ে সে কিছু করতে পারবে না। রাহুলকে হাসি মুখে দেখার জন্য তার যা যা করার দরকার সে সব করতে পারবে।
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর অভি বলে,
-এইবার এখান থেকে যাওয়া উচিৎ। অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছি।
-তুমি যাও, আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।
অনামিকা অভির দিকে না তাকিয়েই কথা বলছে।
-তুমি তাহলে আমার উপর রেগে আছো! তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করে না দাও তাহলে নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হবে।
-চলো।
-ধন্যবাদ।অভি ও অনামিকা পাহাড় থেকে নেমে আসলো। রাহুল ও আফরোজা চৌধুরী এতক্ষণ নানান গল্প করছিলেন। রাহুলের সাথে গল্প করতে তার ভালোই লাগে। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে ছেলেটা। তিনি ভাবেন, এইরকম একটা ছেলের সাথে যদি অনামিকার বিয়ে দেয়া যেত! অনামিকা ফিরে এসেছে দেখে তিনি বলেন,
- কেমন লাগলো পাহাড়ে ছড়ে?
অনামিকার মন ভালো নেই। তাই ছোট করেই উত্তর দিলো।
-ভালো।
-সেটা বুঝাই যাচ্ছে। এতক্ষণ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বসে থাকলি!
-আম্মু আমি হোটেলে ফিরতে চাচ্ছি।
এইবার আফরোজা চৌধুরী লক্ষ্য করলেন অনামিকা স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে না। কথা বলায় মনে হয় গলাটা হালকা কেঁপে উঠলো।
-কি হয়েছে অনামিকা! তুই এইভাবে কথা বলছিস কেন। তোর কি কিছু হয়েছে?
-না মানে... আম্মু... এই একটু মাথা ঘুরছে।
-করবেই তো! তখনি মানা করেছিলাম এত উঁচু পাহাড়ে ওঠার কোনো দরকার নেই। কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমার কথার কোনো দাম দিলি? এত উঁচু পাহাড় দেখলেই তো মাথা চক্কর মারে।
তারপর অভি - রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-তোমরাও কি হোটেলে ফিরবে এখন?
রাহুল কিছু বলার আগেই অভি বলে,
-আমরা এখন যাবো না আন্টি। আশপাশটা আরেকটু ঘুরে দেখবো। আপনারা বরং চলে যান। পরে দেখা হবে।
অভি ভাবলো সে অনামিকার সামনে থাকলে হয়তো অনামিকা নিজেকে স্বাভাবিক করতে কষ্ট হবে। তাই অনামিকার সামনে না থাকাটাই ভালো হবে।
-ঠিক আছে। হোটেলে ফিরলে দেখা হবে।
কথাটি বলে ওরা চলে যায়। ওরা যাওয়ার পর রাহুল বলে,
-এটা তুই কি করলি? এখানে থেকে আর কি করবো? একসাথে ফিরলেই তো ভালো হত। তুই জানিস না আমার সারাক্ষণ অনামিকাকে দেখতে ইচ্ছে করে। ওর কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে হয়।
-তাহলে তুই এখনো তাকে মনের কথাটি জানাচ্ছিস না কেন?
-আমার ভয় করে। কারণ আমি জানিনা অনামিকা অন্য কাউকে ভালবাসে কিনা। যদি ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড থেকে থাকে আর আমি প্রপোজ করি তবে সে আর আমাদের সাথে ঘুরতে রাজি হবে না।
-তারপরও তোর উচিৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মনের কথাগুলো জানিয়ে দেয়া।
-কিন্তু কেন? -কারণ... ধর অনামিকা কাউকে ভালবাসে না। কিন্তু এখানের কোনো ছেলেকে দেখে ওর ভালো লেগে গেলো তখন কি হবে?
-এখানে আবার কার প্রেমে পড়বে! পড়লে তোর প্রেমে পড়বে। তোর মতো ছেলে রাঙ্গামাটিতে আছে নাকি?
-কি বললি?
-কিরে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আরে ইয়ার মজা করেছি।
কথাটি বলে হেসে ফেলে রাহুল। অভির বুক থেকে মনে হল কয়েক মণের একটা পাথর সরে গেলো। তারপর রাহুল আবার বলে,
-এইবার বল এখানে আর কি করবি?
-আমরা যে পাহাড়ে ঘুরতে এসেছি সেটার স্মৃতি ধরে রাখতে হলে ছবি তোলে রাখতে হবে না? তাছাড়া ফ্রেন্ডরাও জিজ্ঞেস করবে কোথায় কোথায় গিয়েছি, কি কি দেখেছি। তখন এইসব ছবি দেখাতে পারবো।
-তাইতো! কিন্তু ছবিতো ওরা থাকতেও তোলা যেত। ওদেরও ছবি তোলে নিতাম।
-থাক, যে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে সেটা নিয়ে আর আফসোস করতে হবে না। এখন অন্য আরেকটা সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে। চল ঐদিকটায় একটু ঘুরে আসি।
অনামিকা ও আফরোজা চৌধুরী গাড়িতে এসে ড্রাইভারকে হোটেলে নিয়ে যেতে বললেন। আফরোজা চৌধুরী ড্রাইভারকে বললেন,
-ড্রাইভার! রাস্তায় কোনো ফার্মেসী চোখে পড়লে গাড়ি থামিও।
-আচ্ছা ম্যাডাম।
অনামিকা বলে,
-ফার্মেসীতে গিয়ে কি করবে আম্মু?
-মেডিসিন নিবো
-কার জন্য?
-তোমার জন্য।
-মেডিসিন লাগবে না আম্মু।
-লাগবে না মানে! গতকাল বলেছিলে মাথা ব্যথা করছে। আবার আজকেও করছে। ব্যাপারটা যদি তোর আব্বু জানে কি হবে জানিস?
-জানি। কিন্তু আব্বুকে জানাবে কেন? তুমি আব্বুকে কিছু বলবে না। এমনিতে একা আছে, এই কথা শুনলে বিরাট টেনশন শুরু করে দিবে। তাছাড়া আমার এমন আহামরি কিছু হয়নি। সামান্য একটু ব্যথা এমন কিছু নয়। হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি হোটেলে চলো।
(চলবে).....................
------------------------অবুঝ ভালবাসা-------------------------
-------------------৬ষ্ট পর্ব-----------------
আজ সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যার পর অভি ও রাহুল হোটেলে ফিরে আসে। হোটেলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পা দুটিকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছে। বেচারা পা দুটো! সারাদিন তাদের বয়ে বেরিয়েছে। তারওতো একটু বিরতি দরকার। বিছানায় শুয়ে মোবাইল হাতে নিতেই অভির মনে হল তার আপুর সাথে একটু কথা বলে নেয়া দরকার।
-হ্যালো আপু, কেমন আছিস?
-ভালো, তোরা কেমন আছিস?
-আমাদের ভালো-মন্দ জেনে তুই কি করবি? একবারও নিজে ফোন করে জানতে চাইলি না। আসলে বিয়ের পর তুই আমাদের ভুলে গেছিস।
-একদম নাটক করবি। এক থাপ্পড় দিবো। তোদের কে আমি ভুলে যাবো এটা কোনো কথা বললি?
-এইরকমই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় ঐ হাঁদারামটার সাথে সারাদিন ফোনে কথা বলিস,তাই আমাদের কথা মনে থাকে না।
-ঐ বান্দর, হাঁদারাম কাকে বলেছিস?
-কাকে আবার, তোর ওগো'কে। আমার একমাত্র দুলাভাইটাকে।
-এই দাঁড়া, তোকে আমি একবার কাছে পেয়ে নেই। তারপর বুঝবি মজা। তুই ওকে হাঁদারাম বললি কেন?
-বলবো না? এতদিনে তোকে তার কাছে (আমেরিকা) নিয়ে যেতে পারলো না।
-আমেরিকা নিয়ে যাওয়া কি মুখের কথা? আমেরিকা তো আর রাঙ্গামাটি না যে চাইলেই নিয়ে যাবে। ও চেষ্টা করছে হয়ে যাবে। তাছাড়া তুই আমাকে দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস কেন?
-তোর দেশে থেকে লাভ কি! দেশে থাকা স্বত্বেও তুই আমাদের বাসায় আসছিস না। দেখ আমি রাঙ্গামাটি এসেছি ঘুরতে। আম্মু এমনিতেও চিন্তায় আছে। একা থাকলে চিন্তাটা বেড়ে যায়। কোথায় তুই গিয়ে কয়েকদিন আম্মুর কাছে থেকে আসবি তা না তুই আছিস শ্বশুর বাড়ি নিয়ে। আরে বাবা আমাদের বাসায় গেলে তো তোরই অনেক লাভ হবে। সারাদিন ঐ হাঁদারাম.... ওহ সরি, দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারবি।
-ওর তো কোনো কাজ নেই যে আমার সাথে সারাদিন কথা বলবে।
-তারমানে দুলাভাই তোকে ফোন করেনা? তাহলে তো সে তোকে একদম ভালবাসে না। নিশ্চয় ঐ দেশে তার গার্লফ্রেন্ড আছে।
-ঐ একদম কথার প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করবি না। সবসময় এত বেশি বুঝা ভালো না। আমি কি একবারও বলেছি ফোন করে না? কাজ না থাকলেই ফোন করে।
হালকা বিরতি নিয়ে আবার বলে,
-আর শুনেন অভি সাহেব, মা-বাবার জন্য ভালবাসা শুধু আপনার আছে,আমাদের নেই? আম্মুকে নিয়ে আমারো চিন্তা হচ্ছে। আমার শাশুড়ি বাড়ি ছিলেন না। আজকে এসেছেন। না হলে আপনাকে বলে দিতে হত না, আমি নিজ্ব থেকেই চলে যেতাম। কালকে সকালেই আম্মুর কাছে চলে যাবো।
তার আপুর কথা শুনে হেসে ফেলে অভি।
-আচ্ছা তাহলে এখন রাখছি।
-রাখবি মানে! এখনো তো রাহুলের সাথে কথাই হয়নি।
-এহহহ... আমি ফোন করেছি এখন আসছে আজাইরা আহ্লাদ দেখাতে। নিজে ফোন করে কথা বলতে পারিস না?
-থাপ্পড় খাবি একটা। কথা না বাড়িয়ে রাহুলকে দে।
-ঠিক আছে নে কথা বল।
অভি মোবাইলটা রাহুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-নে রাহুল আপু কথা বলবে।
রাহুল মোবাইল নিয়ে কথা বলা শুরু করে।
-আপু কেমন আছো?-ভালো, তুই কেমন আছিস?
-ভালো আছি। দুলাভাই কি করেন? ভালো আছেন উনি?
-হাঁ। কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ত আছে। দেশ থেকে ফিরেছে তো। তারপর কেমন লাগছে রাঙ্গামাটি?
-অ-সা-ধা-র-ণ... খুবই ভালো লাগছে।
তখন অভি পাশ থেকে বলে ওঠে,
-ভালো লাগবেই তো, এখানে এসেই প্রেমে পড়েছিস।।
-কি বলল অভি? ভালোভাবে বুঝতে পারিনি।
-কিছুনা আপু, আমি ফিরে এসে সবকিছু খুলে বলবো। এখন রাখি।
এই বলেই রাহুল ফোন রেখে দেয়। আর আফসোস করে বলে,
-তুই খুব ভাগ্যবান অভি। অর্পিতা আপুর মতো একটা বোন পেয়েছিস। তুই যখন অর্পিতা আপুর সাথে কথা বলিস তখন তোকে আমার খুব হিংসে হয়।
-মন খারাপ কেন করছিস? আমার আপু কি তোর আপু নয়? তাছাড়া আপু কিন্তু আমার থেকেও তোকে বেশি ভালবাসে।
-বাসবেই তো। তুই দুলাভাইকে যখন যা মনে হয় তাই বলিস। পৃথিবীতে কয়টা স্ত্রী আছে যার সামনে তার স্বামীকে কেউ কিছু বললে সে চুপ করে থাকতে পারবে।
-আপুকে ক্ষেপানোর জন্য এইসব বলি। আর আপু সেটা ভালোমতোই জানে। তবুও রেগে যায়।
কিছুক্ষণ পর অভি বলে,
-রাহুল আমি বাইরে থেকে আসছি। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। রিচার্জ করতে হবে। তোর লাগবে নাকি?
-না, আমার মোবাইলে যথেষ্ট ব্যালেন্স আছে।
-তাহলে আমারটায় রিচার্জ করে আসি।
অভি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
অনামিকা মানুষিক ভাবে বিপর্যস্ত। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। দুপুরে খেতেও পারেনি ঠিকমতো। এক টানা লাম্বা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যায় উঠেছে। যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল তার মস্তিষ্ক ছিল বিশ্রামে। ঘুম ভাঙ্গতেই সেই ভাবনাগুলো আবারো তার মাথায় ভর করে। সে ভেবে পায় না আজকে তার সাথে এটা কি হল? আজ যে ঘটনা ঘটলো এটা কোনোদিন ভুলার নয়। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় বলে শুনেছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ অন্যভাবে মিলেছে। সবকিছু ঠিক ছিল। দৃশ্যপট, মানুষ, এমনকি স্বপ্নের সংলাপ! সেটা মিলে গেছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এটা ছিল অভির অদ্ভুত ধরণের পাগলামি। নাকি অন্যকিছু?
আচ্ছা ঘটনা এমন নয়তো, আমার মনের কথা জানার জন্য অভির এই অদ্ভুত পাগলামি! যদি এইরকম কিছু হবে তবে তো সে জেনেই গেছে আমিও তাকে ভালবাসি। তাহলে আর প্রব্লেম কোথায়? আমার তো মনে হচ্ছে সেও আমাকে ভালবাসে। কিন্তু তার মনের কথাটি বলছেনা কেন? সমস্যাটা কোথায় ওর? উফ! আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
কথাগুলো ভাবতে গিয়ে মস্তিষ্ককে বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে তাই মাথা ব্যথা করছে। অনামিকা কপালের দুপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। আফরোজা চৌধুরী লক্ষ্য করে বললেন,
-কি হয়েছে অনামিকা! মাথা ব্যথা কি আবার শুরু হয়েছে?
-না আম্মু।
-তাহলে এমন করছিস কেন?
-দিনের বেলা এতটা ঘুমানো উচিৎ হয়নি। এখন মাথা ঝিমঝিম করছে। আম্মু আমি একটু হোটেলের বাগান থেকে হেঁটে আসি?
-ঠিক আছে যা।
অনামিকা রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
-অভি।
অনামিকার ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় অভি। অনামিকা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসেই বলে,
-কোথায় যাচ্ছ?
-এইতো সামনে,মোবাইলে রিচার্জ করাতে হবে।
-চলো আমিও যাবো। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম এখন মাথা ঝিমঝিম করছে। একসাথে বসে কফি খাওয়া যাবে।
দুজন বসে বসে কফি খাচ্ছে। কারো মুখেই যেন কোনো কথা নেই। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে অনামিকা বলে,
-অভি।
-হু।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-করো।
-রাহুল যে বলেছিল এখানে আসার পর তুমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছ, সেই মেয়েটি কি আমাদের মতো পর্যটক নাকি রাঙ্গামাটির মেয়ে?অভি বুঝতে পারলো এই বিষয়ে অনামিকা খুব বেশিই সিরিয়াস। হয়তো সারাক্ষণ এই বিষয়েই চিন্তাভাবনা করছে। তাই যাই উত্তর দেয় না কেন ভেবেচিন্তে দিতে হবে। এইজন্য এমন প্রশ্ন শুনেও সে অনামিকার দিকে তাকালো না। স্বাভাবিক থেকেই প্রথমে কফিতে একটা চুমুক দেয়। তারপর শান্ত ভাঙ্গিতে বলল,
-দেখে তো মনে হয়েছিল আমাদের মতোই ঘুরতে এসেছিল।
-এরপর কি আর একবারও তার সাথে দেখা হয়নি?
-নাহ, আর কখনো হবেও না। আমার মনে হচ্ছে ঐদিনই মেয়েটি চলে গেছে এখান থেকে।
-ওহ!
অনামিকাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অভির উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে আবার বলে,
-তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। জানো আমাদের সাথে একটা ছেলে পড়তো। তাকে সবাই ডাকত "বোকা দেবদাস"।
নামটা শুনে হেসে ফেলে অভি।
-বোকা দেবদাস! এ আবার কেমন নাম?
-নাম শুনে হেসো না। ওর কাহিনী অনেকটা তোমার মতোই।
-আমার মতো মানে!
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অভি।
-বেচারা তোমার মতো ঘুরতে গিয়ে প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটির সাথেই ঘুরে বেরিয়েছিল অথচ একটাবার মুখ ফোঁটে বলতে পারেনি ভালবাসার কথাটি। তার এই বোকামির জন্যই মেয়েটিকে হারালো। ভালবাসার কথাটি বলে দিলে মেয়েটিও হয়তো রাজি হয়ে যেতো। এখন আবার বোকাটি অপেক্ষা করে আবার কোথাও মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যাবে। এইজন্য সবাই তাকে বোকা দেবদাস নামে ডাকে।
অভি অনামিকার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো এই নামের কোনো চরিত্র সত্যিই আছে নাকি পুরোটাই সে বানিয়ে বলেছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। আসলে একটা মেয়েকে বুঝার চেয়ে নিউটনের সূত্র বুঝা অনেক সোজা।
অভিকে চুপ করে থাকতে দেখে অনামিকা আবার বলল,
-কি হল? তুমি কি এখনি নিজের ভবিষ্যৎ দেখা শুরু করলে?
-নাহ। তাছাড়া আমার ভবিষ্যৎ এমন হবে কেন? রেজাল্ট বের হলেই ইংল্যান্ড চলে যাবো ভাইয়ার কাছে। আর সেখানে কোনো বাংলাদেশি সুন্দরি ভালো লেগে গেলে তাকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে যাবো। তখন কি আর এই এক মুহূর্তের প্রেমের কথা মনে থাকবে নাকি!
-ওহ আচ্ছা, সবকিছু দেখছি পরিকল্পনা করেই রেখেছ।
-এই রাখলাম আর কি!
অভি হাসার চেষ্টা করলো। তার হাসিটা বোকাদের মতো দেখালো। অনামিকা ভাবছে অভিকে সরাসরি ভালবাসার কথাটি বলে দিবে। যেহেতু অভি সেই মেয়েটিকে আর খোঁজে পায়নি।
-অভি!
-হু।
-তোমাকে কিছু বলার ছিল।
-আমাকে! কি বলবে?
অভির মনে আতঙ্ক। এখন কি বলতে চায় অনামিকা? তার জন্য রক্ষাকর্তা হয়ে আসে রাহুলের ফোন।
-এক মিনিট! রাহুল ফোন করেছে, কথা বলে নেই।
তারপর অভি ফোনে কথা বলা শুরু করে দেয়।
-কিরে অভি! বাইরে গিয়ে কি হারিয়ে গেলি নাকি?
-আরে না, এইতো আসছি।
-আমি শিওর তুই কোথায় বসে ঐ মেয়েটির কথা চিন্তা করছিস।
-হাঁ ঠিকই ধরেছিস। মেয়েটিকে হয়তো আমি কোনো দিন পাবো না। কিন্তু এটা সত্য যে ওর জায়গায় আর আমি কাউকে বসাতে পারবো না। এখন কেউ যদি আমায় কোনো দিন ভালবাসে তবে সেটা হবে তার বোকামি। আমার কিছুই করার থাকবে না।
-হয়েছে আর এত উদাস উদাস কথা বলতে হবে না আমার দেবদাস বন্ধু। সময় এলে সবকিছু দেখা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি রুমে চলে আয়। আর শুন, আসার সময় কোকাকোলা নিয়ে আশিস।আচ্ছা আসছি।
মোবাইল রেখেই অভি বলে,
-ওর নাকি রুমে একাকা ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি যেতে বলল।
-ঠিক আছে চলো যাই।
তারা ওঠে দাঁড়ায়। অভি একটা ১লিটার কোকাকোলার বোতল কিনে নেয়। তারপর হোটেলের পথে পা বাড়ায়। হোটেলে পৌঁছে বিদায় দেয়ার সময় অভি বলে,
-ওহ হাঁ, তুমি না কি বলবে বলেছিলে?
-এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। পরে কখনো বলবো।
-আচ্ছা তোমার ইচ্ছে। গুডনাইট।
-গুডনাইট।
বাইরে থেকে আসার পর অনামিকা চুপচাপ শুয়ে আছে। তার মাথার মধ্যে নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। অভির বলা কথাগুলোর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছে-- অভি কখনো সেই মেয়ের জায়গায় কাউকে বসাতে পারবে না। এই কথাটি আমাকে শুনিয়ে বলার মানে কি? তবে কি অভি সব বুঝে এখন ইশারায় আমাকে সরে যেতে বলছে? তবে কি অভি চায় তাকে নিয়ে কোনো রঙ্গিন স্বপ্ন না দেখি? হাঁ,অভির ইশারা ঐরকমই। তবে না হয় ওর ইচ্ছেই পূরণ হউক। আমি ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাবো। এখান থেকে আমাকে চলে যেতেই হবে। যত বেশি ওর কাছে থাকবো তত বেশি ওর প্রেমে পড়বো। তত বেশি কষ্টের পরিমাণ বাড়বে।
-আম্মু।
-বল।
-এখানে এসেছিলাম অবসর সময়টা ঘুরাঘুরি করে আনন্দে কাটাতে। কিন্তু এখন আর এখানে একদম ভালো লাগছে না। আব্বুকে খুব মিস করছি।
-তুই কি চলে যেতে চাচ্ছিস?
-তুমিও যদি চাও চলে যাবে তবে চলে যেতাম।
-আমার চাওয়া না চাওয়ায় কি হবে! তোর ইচ্ছেয় এখানে আসা হয়েছে। এখন যাওয়াও হবে তোর ইচ্ছেতেই।
-তাহলে কালকেই চলে যাই?
-কালকেই!!
-হাঁ কালকে। কেন কোনো সমস্যা?
-না কোনো সমস্যা না। মানে এখানে এসে এখনো কিছুই কেনাকাটা করা হল না। তোর বাবা যে এতগুলা টাকা সাথে দিলো সেগুলো খরচ না করেই চলে যাবি? তারচে বরং কাল কেনাকাটা করি,পরেরদিন চলে যাবো।
-আচ্ছা।
রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে রাহুল অভির সাথে কথা বলছিল। কি করে অনামিকাকে সে মনের কথা বলবে সেটা নিয়েই আলোচনা।
-দেখ অভি, আমাকে দিয়ে প্রপোজ করা হবে না। আমি কোনো ভাবেই অনামিকাকে বলতে পারবো না। তুই আমার হয়ে তাকে বলে দে প্লিজ।
-আমি বললে অনামিকা রেগে যাবে।
-রাগবে কেন?
-কারণ এখনকার মেয়েরা সরাসরি ছেলের মুখ থেকে ভালবাসার কথাটি শুনতে চায়। চিঠি লিখে বা অন্য কাউকে দিয়ে বলানো পছন্দ করে না। এই কথাটি আমার না, তুই নিজেই এইসব কথা বলতি।
-আরে তখনতো আর প্রেমে পড়িনি।
এই সব বিষয়ে কথা বলতে বলতে রাহুল ঘুমিয়ে পড়ে। তখন অভি ব্যাগ থেকে তার সেই ডায়রি বের করে যেটা রাঙ্গামাটির জন্য কেনা হয়েছিল। তারপর আজকের দিনের সব ঘটনা মনে করতে থাকে আর ডায়রিতে লেখা শুরু করে..........
(চলবে)......................
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ