অনিন্দ্য এডেন
মেঘলা তাসনিম
১- শেষের শুরু -
অরূপ আর আমার গল্পটা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল আমার মনে নেই। দিন তারিখের হিসেবে আমি বড্ড বেখেয়ালি। আমার শুধু মনে আছে এক জোড়া ধূসর চোখ, একটা হাল্কা সবুজ টিশার্ট আর কলাভবন এর রাস্তায় সেই প্রথম ডাক! পুচকি!
আমার কিশোর বেলার ভালবাসা , সেই ধূসর চোখের ছেলে টা খুব অদ্ভুত ছিল । আমাদের সম্পর্কের চেয়েও অদ্ভুত । আমরা দুই শহরে থাকতাম .. পায়রা যুগের প্রেমের মত অনেকদিন বাদে কথা হত আমাদের ! আমি প্রচন্ড তৃষ্ণায় একফোটা জলের মত চাইতাম সেইসব রাত গুলো । তখনো আমার নিজের একটা ঘর হয়নি । তাই লুকিয়ে ফোনে কথা বলার জন্য সারারাত বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতাম । অথচ আমরা কেবল নিরবতা টুকু ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম কয়েকশত রাত ! উষ্ণতা গুলো আমরা জমা রেখেছিলাম সময়ের খাতায়। বছর শেষে সেগুলো অনিশ্চিত হিসাব নামে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল ! সঞ্জীবদার কথা মনে আছে ? ছেলেটাও সঞ্জীবদার মত প্রায়ই হারিয়ে যেত । আমার তখন ভয়ংকর রকম কষ্ট হত । মনে হত আমার হৃৎপিন্ড টা কেউ খুব বাজে ভাবে ছিড়ে নিয়ে গেছে । আমি ধূসর চোখের ছেলেটাকে খুব ভালবেসে ছিলাম ।
এরপর আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি । এমনকি আমার স্বামীকেও না ! আমার কেবলই মনে হত সেই ছেলেটা হয়ত আমাকে এখনো ভালবাসে ! শেষবার যখন আমাদের কথা হয়েছিল তখন শুনেছিলাম সে একটা মেয়েকে ভালবেসে । চিরকাল অভিমানী আর ভয়ংকর ইগোবাজ আমি সমস্ত আত্মসম্মান ভুলে গিয়ে সেদিন জিগ্যেস করেছিলাম , " তুমি আমাকে আর ভালবাসো না কেনো ? ঐ মেয়েটা কি খুব সুন্দর দেখতে ? যাকে একদিন খুব ভালবেসে মায়াবতী বলেছিলে তার চেয়েও বেশী মায়া বুঝি ঐ মেয়েটার চোখে আছে ?? " ও খুব হেসেছিল সেদিন । আর আমি মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করছিলাম প্রতিটা মুহুর্তে !
সেদিনের পর থেকে আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি ! হয়ত ভালবাসার অর্থই বুঝিনি কখনো ! আমার কাছে ভালবাসা মানে এখনো অরূপ এর সেই ধূসর চোখ , অনেকদিন পর ফিরে এসে দুহাতে আলতো করে ছুঁয়ে বলা - পুঁচকি , চোখের জলে নাকি বঙ্গোপসাগরের পানি বিপদ সীমার উপরে প্রবাহিত করে ফেলেছো ? তাই ফিরে এলাম ! এবার চলো কাকড়া চাষ করি ! এইটুকু একবাটি কাকড়া একশো টাকায় কিনে খেতে হয়েছে বর্ডারে !
প্রায় সাড়ে আট বছর হয়ে গেছে , আমার এখনো মনে হয় অরূপ একদিন হুট করে ফিরে এসে বলবে " পুচকি , কাকড়ার ব্যবসাটা প্রায় দাড় করিয়ে ফেলেছি , তোমার চোখের জলে ভাটা পড়েছে তাই ফিরে এলাম ! তুমি এখন আর কাদোঁ না কেনো ? তুমি জানোনা তোমার ভেজা চোখে আমি দেখি আমার অনিন্দ্য এডেন ! "
মাঝে একদিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে। আমি চাকরী নিয়ে চট্টগ্রামের বদলী হবার কিছুদিন আগে। আমি ওকে ফেরাতে চাইনি। কিংবা ও আমাকে। আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম দুজন দুজনকে ! একই সাথে!
২- অরূপ কথন –
চারুকলার রাস্তাটা পার হবার সময় এক গুচ্ছ সবুজে চোখ আটকে গেল ! কলা পাতা রংএর কাঁচের চুড়ি ! নিনিতার খুব প্রিয় ছিল । অদ্ভুত একটা চুড়ি থিউরী ছিল মেয়েটার । ওর বাক্সপেটরায় হয়ত চুড়ি রাখার আর যায়গা নেই তবুও দেখা হলেই চুড়ি কিনে দেবার বায়না করত । সেটা আবার শর্তসাপেক্ষে নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিতে হত । শর্ত হল একটা চুড়িও ভাঙা যাবেনা । ভাগ্যমন্দ হলে অশ্রূ কন্যা কেঁদে চোখ ভাসাতেন । আমি একদিন বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম তুমি চুড়ি আমাকে পরিয়ে দিতে বলো কেন ? আর ভেঙে গেলেই বা কাঁদো কেন? অভিমানী ছলছল চোখে বলেছিল - " তুমি যখন আমাকে চুড়ি পরাও তোমার সমস্ত সত্বা একটাই প্রার্থনা করে যাতে চুড়ি ভেঙে না যায় , কারণ তুমি আমার চোখের জল সহ্য করতে পারোনা ! যেদিন আমার চোখের জল তোমাকে আর ছুঁয়ে যাবেনা সেদিন বেখেয়ালে সবগুলো চুড়ি ভেঙ্গে যাবে দেখো! সেদিনের পর থেকে আমি আর চুড়ি পরব না "
এসব ছেলেমানুষী দিন গুলি ভাবতে ভাবতে কখন চুড়ি কিনে গন্তব্যে পৌছে গেছি টের পাই নি । হালকা আলোর ছোট্ট রেস্তরাটার একদম শেষের দিকে বসে আছি আমি আর নিনিতা ! অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে । আমিই নিরবতা ভাঙলাম ।
- কবে যাচ্ছো নিনিতা ?
: পঁচিশে ডিসেম্বর ।
- ফিরবে না আর ?
: অতীতে ফেরা যায় না অরূপ!
- এখনও ভালবাসো ?
: তোমার মনে আছে অরূপ তুমি যেদিন আমায় বলেছিলে তুমি আর আমাকে ভালবাসতে পারছো না , তখন আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ! মনে হচ্ছিল ভালবাসা একটা অন্তহীন কান্নার নদী যা পার হয়ে আমি কোনদিন তোমাকে ছুঁতে পারব না । আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল পৃথিবীর শুদ্ধতম চোখদুটো কেন আমার সাথে মিথ্যে বলছে ? এক পৃথিবী ভালবাসা বুকে বেড়ে ওঠা ছেলেটা কেন আমাকে আর ভালবাসতে পারবেনা ?! অনেক দিন পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম ভালবাসা টা আসলে ঈশ্বরের মত । যখন তুমি বিশ্বাস করবে ঈশ্বর আছেন , তখন একটা অদ্ভুত আত্মার বন্ধন সৃষ্টি হবে তোমার আর ঈশ্বরের মাঝে । তুমি সবটুকু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে এই বিশ্বাস টুকু ! কিন্তু যখন তোমার মনে হবে ঈশ্বর বলে কিছু নেই , তখন তোমার তাঁকে ঘিরে সমস্ত আরাধনা অর্থহীন মনে হবে । ভালবাসাটাও ঠিক তেমন । তোমাকে শুধু বিশ্বাস করতে হবে এর অস্তিত্ব আছে । তুমি সেই বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলেছো অরূপ! আমি ভীষণ ভিরু মানুষ , বিশ্বাসে বেঁচে আছি !
বিষণ্ণ চোখের মেয়েটা চলে যাচ্ছে ! আমার খুব ইচ্ছে করছে শহর জুড়ে ভয়ংকর একটা ঝড় তুলে ওকে আটকে রাখি ! নিনিতা কোনদিন জানবে না বুক পকেটে এক ডজন সবুজ ভালবাসা নিয়ে কেউ একজন ওর ফেরার অপেক্ষায় ছিল ! আট বছর আগের অতীতে ফেরার অপেক্ষায়. ..... নিনিতা ফেরে নি ! আমি ওকে ফেরাতে চাইনি। কিংবা ও আমাকে। আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম দুজন দুজনকে ! একই সাথে!
৩- নিনিতউপাখ্যান -
চট্টগ্রামে বদলী হবার পর আমি মন দিয়ে সংসারী হবার চেষ্টায় ছিলাম। আমার ধূসর অতীত আরো ধূসর হয়ে যাচ্ছিল কাজের চাপ আর স্বামীব্রত পালনে... রিশাদ জানত অরূপের কথা। ওর কোন অভিযোগ ছিল না আমার অতীত নিয়ে। আমি চাইতাম রিশাদ হিংসা করুক অরূপকে ! আমাকে হারানোর ভয় করুক! কিন্তু আমাদের সম্পর্ক্যটা "খেয়েছো, কি করছো " এটুকুতেই আটকে গিয়েছিল এক সময় । আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম আমরা একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছি একে অন্যকে জানার আগ্রহ... সবটুকু জানা হয়ে গেলে আসলে আর থাকেনা কিছুই জানার..
এসব আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম! পড়ুয়া মেয়েরা জানে। তারা এও জানে মানুষ একটা ১০০ পৃষ্ঠার থ্রিলার বইয়ের চেয়েও কম রোমাঞ্চকর হয় পুরো জীবন জুড়ে! খুব পরিচিত কিছু অধ্যায়, আমি তুমিতে শুরু... আমরা অথবা আমি অথবা কেবল তুমিতে শেষ! তবুও আমি কারো জীবনের সবচেয়ে কঠিন ধাঁধাটা হতে চেয়েছিলাম, মাথায় গেথে রবে সারাক্ষণ অথচ কিছুতেই খুঁজে পাবে না যার শেষ... কেউ প্রতিটা জন্মে কেবল আমাকেই জানতে চাইবে এমন নাবালিকা স্বপ্ন আমি বহুদিন লালন করেছি কিশোরীর প্রথম প্রেমের মায়ায়..! পরিচিত এই নির্লিপ্ত অধ্যায় কে আমি ভয় পাই সে জন্যে নয়, আমি রিশাদের অন্য আলোয় নিজেকে জানার আগ্রহ কে হিংসে করি তেমনটাও না! আমি শুধু মেলাতে চেয়েছিলাম এই যে মানুষ রোজ রোজ এত ভালবাসাবাসি বলে, এত বছর পরেও মুগ্ধতায় আছি বলে - সে কি কেবলই আয়নায় চোখ না মেলাতে পারার ভয়ে? নাকি কেবলই অভ্যাস কিংবা যাক না দিন যাচ্ছে যেমন এই ভাবনায় ? আমি মেলাতে পারি না... কিংবা আমার ইচ্ছেকৃত রাত নামে দুপুরের তপ্ততায়ও। আমি অন্ধকার গুণি! অভ্যাসে...অনিচ্ছায়....বিষণ্ণ হেরে যাওয়া দিনগুলিতে... নির্লিপ্ততায়..চেনা মুখে.... নিঃশ্বাসের চেয়ে কাছাকাছি থাকা দুটি অচেনা পাহাড়ে... আমি অন্ধকার গুনি অভিনব অভিনয়ে..
৪ - রিশাদ কথন -
"জানো , অরূপ যখনি আমার সাথে দেখা করতে আসত, ফুল নিয়ে আসত। কখনো বেলি, কখনো কাঠগোলাপ কিংবা রজনীগন্ধার মালা। একবার আমার ভার্সিটি তে একটা প্রোগ্রাম ছিল। সেই প্রথম ভার্সিটি তে শাড়ি পড়া আমার। আম্মুর কালো রঙের একটা শাড়ি আনাড়িপনায় জড়িয়ে এদিকওদিক ঘুরছি এমন সময় দেখি ঘুমকাতুরে মানব সেই ভোর বেলায় আমার উঠোনে হাজির! উস্কোখুশকো চুল, চোখ লাল হয়ে আছে! সারা রাত ট্রেনে ঘুমায়নি বোধ হয়!
আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলেছিল - " শুনলাম এই শহরের সব ফুল নাকি আজ মই নিয়ে মিছিলে নেমেছে, তোমার খোপায় উঠবে বলে! এই দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না! তাই চলে এলাম! পুচকী, বেলী পাইনি, আজ গোলাপে চলবে? "
সেই দিনটা আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই! আমরা বেশ ভাল ছিলাম জানো! কিন্তু কেন যে এমন করলো...!”
নিনিতা যখন কথা গুলো বলছিল তখন ওর চোখে মুখে অদ্ভুত একটা সারল্য দেখতে পাচ্ছিলাম আমি! একটা ছোট্ট বাচ্চার মত মায়া মায়া চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল! ঠোটের কোণের ছোট্ট তিলটা নাচিয়ে বলছিল ওর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কথা। আমি এই নিনিতাকে আগে কখনো দেখিনি! ৬ বছরের সংসারে আমি কখনো জানতেই চাইনি নিনিতা কি ফুল ভালবাসে! বা আদৌ ওর কোন ভাললাগা আছে কিনা! আমার বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যথা হচ্ছিল! এটা কি নিনিতা কে পেয়েও হারানোর কষ্টে নাকি যা আমার কোনদিন ছিল না তা আরো একবার হারিয়ে ফেলার ভয়ে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না! শুধু অনেক কষ্ট হচ্ছিল! অনেক!
৫- টুকরো নিনিতজীবন- দ্বিতীয় মৃত্যুর পরেও -
রিশাদ পর্নগ্রাফীতে আসক্ত ছিল । এটা আমি জানতে পারি বিয়ের অনেক দিন পর। হয়ত বিষয়টা ছেলেদের জন্য খুব অস্বাভাবিক কিছু নয় ,কিন্তু আমি বিষয় টা সহজ ভাবে নিতে পারতাম না ! আমার কেমন বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি হত অন্য কারো ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহুর্ত দিনের পর পর দিন দেখে অমানুষিক সুখ খোঁজার বিষয়টায় ! এক সময় মনে হত হয়ত আমার উদাসীনতাই রিশাদকে এ পথে ঠেলে দিয়েছে ।
আমি রিশাদের কাছাকাছি থাকতে শুরু করলাম , চাকরীটাও ছেড়ে দিলাম এক সময় । একেকটা বিষণ্ণ দিন শেষে আমি অপেক্ষায় থাকতাম রিশাদের ভালোবাসায় পরাজিত হবার! আমি অনেকদিন... অনেকটা দিন রিশাদের জিনিস পত্র ছুঁয়ে ওর স্পর্শ পেতে চাইতাম! কারও সত্যিকারের স্পর্শ কি তার চেয়েও জীবন্ত? আমার ওর শরীরের গন্ধটা পেতে ইচ্ছে করত। কেউ বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে গাল ঘষে দিলে কেমন লাগে খুব জানতে ইচ্ছা করত ! এত গুলো বছরেও রিশাদ কখনো আমার শরীরে ডুবে যেতে চায়নি! খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাই না? একজন মাতালও রাতে বউ এর নেশা খোঁজে , রিশাদ খুঁজত না! এই ভয়ঙ্কর লজ্জার অথচ সত্যি কথা গুলো আমি কাউকে বলতে পারতাম না। একটা অযাচিত নির্লজ্জ তৃষ্ণা বুকে জিইয়ে রেখে আমার শুধু একজন কে অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হত !
তাকে আমি দোষ দেই না! রিশাদের অমন আগুন চোখে পোড়ে না এমন দেহ গড়ে নি বিধাতা! তবু মাঝে মাঝে তাকে ভীষন অভিশাপ দিতে ইচ্ছে কর্ত । খুব চাইতাম তারও খুব কাছের কেউ নিঃশ্বাসের কাছাকাছি থেকেও নির্লিপ্ত একটা পাহাড় হয়ে যাক। যার অস্তিত্ব ছুঁয়ে অনুভব করা যায় কিন্তু আলোড়িত করা যায় না। বিছানার পাশেই থাকুক নির্লিপ্ত পাহাড়টা। আর তার ওপাশে নদী। ভীষণ তৃষ্ণার্ত তার কঠিন কোন অসুখ হোক! জল ছুঁলেই মরন। কিংবা সে আজীবন ২৫ বছরের একলা তরুণী হয়ে যাক... মাঝে মাঝে আমার নিজেকে ভীষন অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করত । আমার একটাবার সেই মেয়েটি হতে ইচ্ছা করত ! কিংবা ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করত যা ছিল শুধু আমার! সেই মেয়েটি দূরের কেউ ছিল না… সে ছিল আমার সবচেয়ে আপন আর প্রিয় বন্ধু দ্বিতীয়া ! হ্যাঁ, আমি বেঁচে ছিলাম আমার দ্বিতীয় মৃত্যুর পরেও !
রিশাদের সাথে আমার ডিভোর্সের কারণ টা খুব সাধারণ ছিল । এক ফাগুন ফাগুন বিকেলে রিশাদ আমার গাল দুটো ছুঁয়ে খুব শান্ত স্বরে বলেছিল – “নিনিত , আমি মনে হয় তোমাকে আর ভালবাসতে পারছিনা। তুমি চাইলে এই সম্পর্ক্যটা ছিন্ন করতে পারো ।“ আমার সমস্ত শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল , আমি রিশাদকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিলাম অনেক ক্ষ্ণ । এর পর আর কোনদিন আমার সাথে রিশাদের দেখা হয় নি । আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম । একই সাথে!
৫- অপেক্ষা – প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশ্যে !-
আমি চাকরীটায় আবার জয়েন করেছিলাম । বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে তবুও সবাই রিশাদের কথা জিজ্ঞেস করত । খুব দুঃখী দুঃখী ভাব চেহারায় ফুটিয়ে জানতে চাইত “মেয়েঘটিত কোন ব্যপার নয়ত ? “ আমার অসহ্য যন্ত্রণা হত ! বিচ্ছিরি একটা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি সারাক্ষণ ঘিরে থাকত । আমার ঐ মানুষগুলোকে কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা জোঁক মনে হত , যারা আমাকে মানসিক ডিভোর্সের যন্ত্রণা দিতেন সহস্রবার !
শুধু সঞ্জীবদা আলাদা ছিলেন । আমাকে কখনো হয়ত একগাদা বেলুন দিয়ে বলতেন নিনিত দেখিতো কে জেতে বেলুন ফোলানোতে … কিংবা কখনো ফুচকার দোকানে নিয়ে গিয়ে বলতেন মামা আজ জন্মের ঝাল দাও । তারপর শুরু হত আমাদের বাজি ধরে ফুচকা খাওয়া । ঝালের তীব্রতায় সঞ্জীবদার চোখমুখ লাল হয়ে যেত , তার চোখ জলে ভরে যেত অথচ তিনি বাচ্চাদের মত হেসে বলতেন - আজ কিন্তু তেমন একটা ঝাল হয়নি বুঝলি ?
আমার সঞ্জীবদার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করত! আচ্ছা কারো ভেজা চোখে কি আসলেও এডেন দেখা যায় ? অরূপের সেই অনিন্দ্য এডেন ? আমি শুধু একজোড়া ধূসর চোখ খুঁজতাম । অরুপ কিংবা রিশাদ কারো চেহারাই আমি স্পষ্ট মনে করতে পারতাম না। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হত । আমি এক টুকরো সবুজ খুঁজতে হারিয়ে যেতাম শহরের শেষ প্রান্তে ।
সেই সব বিকেল গুলোতে সঞ্জীবদা আমাকে প্রায়ই একটা কবিতা শোনাতেন… আরণ্যক বসুর।
“পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু'জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক'রে দুচোখ ভ'রে থাকবো চেয়ে...
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?
………………………………
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে……. পরের জন্মে...
মনে থাকবে?”
আমি শুধু নিঃশব্দে বলতাম মনে থাকবে ………!
ডায়রিতে এই পর্যন্তই লেখা ছিল । এক সময়ের বিতর্কের মঞ্চ কাঁপানো তুখোড় মেধাবী নিনিতা আপু আজ আমার সামনে শিশুদের মত পুতুল নিয়ে খেলা করছে । তাকে কখনো এই অবস্থায় দেখবো কল্পনা করিনি । আমি জানি না ডায়রীর এই লেখা গুলো সত্যি কিনা । শুনেছি হিংসে করার মত সুখি একটা জীবন ছিল তার আর রিশাদ ভাইয়ার । অথচ আজ তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জীবন যাপন করছেন এই একতলার ছোট্ট ঘরটায় ! পুরো ঘরে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছবি ! যার প্রায় সব গুলোতেই আপুর মুখটা কলম দিয়ে কেটে নষ্ট করে ফেলা ! একসময় নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা মানুষটা কেন নিজেকে এত ঘৃণা করতে শুরু করেছিল কে জানে!
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ