"প্রিয়ার চোখে জল"
৩য় পর্ব
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
জ্বরের কারণে প্রিয়ার শরীলটা দুর্বল। আজও প্রিয়ার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। প্রিয়া শুয়ে আছে, চোখ বুজে বাইরে অনেক লোকজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রিয়া ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু মামীর গলার আওয়াজ শুনতেই প্রিয়া লাফ দিয়ে উঠলো। মনে হয় সকাল সাতটার মত বাজে। প্রিয়া আজ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে, সে উঠে দাঁড়ালো।ভয়ে বুকটা কাঁপছে, মামী আজ আর তাকে সারাদিন খাবার খাবার দিবে না। এরকম অনেকবার করেছে, প্রিয়া দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ভয়ে ভয়ে মামীর দিকে তাকালো।মামী বললো, এই নবাবের বেটি, আমি কি তোর চাকর যে তোরে ডাইকা তুলন লাগবো, কতক্ষন ধইরা ডাকতাছি। তাড়াতাড়ি নাস্তা তৈরি কর, আমার বইনের পোলা আইছে বিদেশ থেকা, দেখতাছোস না, কত মানুষ আইছে তারে দেখতে। আমার বইনের পোলা এতদিন পর বিদেশ থেকা আইছে, আর তোর মামার কামের চাপও বাড়ছে, আইজ তোরে বাজারে যাওন লাগবো, প্রিয়া চমকে বললো,মামী আমি বাজারে যাব। মামী রেগে বললো,কেনো বাজারে গেলে কি তোর মান সম্মান সব শেষ অইয়া যাইবো? প্রিয়া মাথা নিচু করে বললো,ঠিক আছে মামী আমি বাজারে যাবো। মামী বললো, বড় দেইহা একটা রুই মাছ আনবি। শাহেদের রুই মাছের মাথা খুব পছন্দের। এই বলে মামী ঘরে চলে গেল। প্রিয়া রান্না ঘরে ঢুকলো,ঘুম চোখ নিয়েই চুলার সামনে বসলো, হাত মুখ ধোয়ার সময় ও পেল না। চেয়ারে শাহেদ বসে আছে,তাকে প্রিয়া দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু লোকজনের ভিড়ে দেখতে পেল না। গ্রামের লোকজনের মন খুব সহজ সরল, তারা ছোটখাট ব্যাপারগুলোকে অনেক বড় করে দেখে। বিদেশ থেকে আনা প্রত্যেকটা জিনিস তারা খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে। কিছুক্ষন পর শাহেদ উঠে দাঁড়ালো। সবার মাঝখানে সে নিজেকে রাজা মনে করছে। তার পরনে ভারী কোট, পায়ের জুতা হাটু পর্যন্ত, চোখে কালো চশমা। লোকটাকে দেখে আজব মনে হল, প্রিয়া মনে মনে হাসলো। এতক্ষণ শীলাকে চোখে পড়লো,শীলা নতুন কাপর পড়েছে,সেজেছে।প্রিয়া ভাবলো শীলা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। শীলা হাসি মুখে এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়ালো। বললো,আপু দেখ তো আমাকে আজ কেমন লাগছে? প্রিয়া বললো, খুব সুন্দর লাগছে তোকে, কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিস বুঝি? শীলা বললো, আমি আবার কোথায় বেড়াতে যাবো। প্রিয়া বললো,তাহলে নতুন কাপড় পড়েছিস কেন? শীলা বললো,শাহেদ ভাই এসেছে তো তাই মা বলেছে নতুন কাপড় পরতে। মামী ভেতর থেকে শীলাকে ডাকলো,শীলা চলে গেল, শাহেদ ঘরে চলে গেছে তাই লোকজনও কমে গেছে। প্রিয়া তাড়াতাড়ি নাস্তা তৈরি করতে লাগলো,আজ আবার বাজারে যেতে হবে,প্রিয়া কখনো বাজারে যায়নি, আজ কিভাবে যাবে তাই ভাবছে।
আজ প্রচন্ড রোদ পড়েছে, বাড়িতে থাকলে এতটা গরম বোঝা যায় না। যা বাইরে এসে প্রিয়া অনুভব করছে, রোদের আলোয় ধান ক্ষেতগুলো ঝলমল করছে। দুই তিনটা গরু ঘাস খাচ্ছে। প্রিয়া ঘামছে কিন্তু সে তার ঘাম মুছতে পারবে না,তার দুই হাতে বাজারের ব্যাগ। ইচ্ছে করছে একটু জিরিয়ে নিতে, কিন্তু মামীর রাগী মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, প্রিয়া দ্রুত হাঁটতে লাগলো। সামনে একটা বড় বট গাছ, দুজন যুবক সেই গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে, প্রিয়াকে দেখে ছেলে দু'টো ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, প্রিয়া মনে মনে ভয় পাচ্ছে, পেছন ফিরে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। কিন্তু অন্য রাস্তা দিয়ে গেলে বাড়ী যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্রিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। প্রিয়া যতই সামনে এগুচ্ছে তার অস্থিরতা ততই বাড়ছে। গ্রামের রাস্তায় এমনিতেই লোকজন কম থাকে, প্রিয়া আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না,তবে মামীর কথা মনে পড়তেই জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো। প্রিয়া ছেলে দু'টোর সামনে দিয়ে চলে গেলো, পেছন ফেরে তাকালো না, কিছু দূর যাবার পর পেছনে ফিরে তাকালো। কেউ নেই,প্রিয়ার মনে হল তার বুক থেকে একটা পাথর সরে গেল। দূর থেকে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, প্রিয়া একটু শান্ত হল। হঠাৎ করে পেছন থেকে কে যেন প্রিয়াকে ডাকলো। প্রিয়া থমকে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো।তারপর ভয়ে পেছনে না তাকিয়ে জোরে হাঁটতে লাগলো। আবার ডাক শুনতে পেয়ে মনে হল মেয়ে মানুষের গলার আওয়াজ। প্রিয়া পেছন ফিরে তাকাতেই মেয়েটি বললো,তোকে আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছি, আর তুই দৌড়ে পালাচ্ছিস। আমার গলার আওয়াজ ও তুই ভুলে গেছিস? দাঁড়া তোকে একটু দেখি। প্রিয়া বললো,তোর গলার আওয়াজ ভুলবো কেন। মেয়েটি বললো, আমি তোর বান্ধবী তোর অবস্থা বুঝতে পারি, খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে তোকে দেখতে কিন্তু কোন উপায় নেই, তোর মামীর মত এত খারাপ মহিলা আমি আর দেখিনি।
-থাক আশা, মামীর কথা বাদ দে তোর কথা বল, তোর সাথে দেখা হয়না, কথা হয় না, তবুও শীলার কাছে তোর খবর আমি সব সময় জানতে চাই, আর তোর সব কথা আমি জানি, এবার বল বিয়ে কবে হচ্ছে?
-প্রিয়া, আমার বিয়ে হচ্ছে না ভেঙে গেছে।
-ভেঙে গেছে মানে, ছেলে পক্ষ তোকে পছন্দ করেনি?
-আমাকে পছন্দ করেছে,কিন্তু আমার বাবাকে করেনি
-আশা তোর কথার মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আমার বাবা গরীব বলে, যৌতুক এর টাকা দিতে পারবে না বলে, এই বিয়ে হবে না।
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আমাদের দুই ভাই বোনকে বাবা অনেক কষ্টে বি.এ. পাশ করিয়েছে,তুই তো জানিস আমার বাবা মুর্খ মানুষ তবুও আমাদের শিক্ষিত করে তুলছে যাতে আমরা সব জায়গায় গিয়ে মাথা উচু করে চলতে পারি। কেউ যাতে আমাদের ঠকাতে না পারে।
প্রিয়ার চোখে জল
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
৪র্থ পর্ব
ছেলে পক্ষ আমাকে পছন্দ করলো, আমার শিক্ষাকে পছন্দ করলো, তবে ওরা যৌতুক হিসেবে যা দাবি করেছে তা আমার বাবার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়,আর আমিও চাই না যৌতুক দিয়ে কারো ঘরে যেতে।
-আশা তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?
-প্রিয়া,গরীবের কষ্ট হচ্ছে ঘাসের উপর জমে থাকা এক ফোঁটা শিশির বিন্দু। এই আছে এই নেই।
-থাক আশা, মন খারাপ করিস না, দেশে তো আর ছেলের অভাব নেই।
-দেশে ছেলের অভাব নেই, কিন্তু যৌতুকের অভাব আছে,সেই অভাবে কত মেয়ের স্বপ্ন বেঙেছে! তার খবর কে রাখে। টাকার কাছে ভালোবাসা হার মেনে যায়।
-আশা মনটাকে শক্ত কর, এত তাড়াতাড়ি বেঙে পড়লে কি চলবে, নারী শুধু নারীই রয়ে গেল, মানুষ হলো না। প্রিয়া, আমি তোর এই ধারণা পাল্টে দেব, আমি আমার বাবার পরিশ্রম বৃথা যেতে দেব না। আমি আমার শিক্ষা দিয়ে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো, আমার বাবা মার মুখে হাসি ফোটাবো, আর যদি কখনো কেউ আমাকে সম্মান দিয়ে তার ঘরে তুলে নিতে চাই, সেদিন হাসি মুখে বিয়ের মালা গলায় পড়বো।
-আমি দোয়া করি তোর মনের আশা পূরণ হোক।
-আমার জন্যই শুধু দোয়া করবি নিজের জন্য কিছু ভাববি না। এভাবে কি তোর জীবন যাবে? তোর মামীর সংসারে যদি সারা জীবনও পরিশ্রম করিস তবুও নাম পাবি না,এখনো সময় আছে নিজের জন্য ভাব।
-তোর মত অত সাহস তো আমার নেই, তাই নিজের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, আর কখনো পারবো কিনা জানি না। যাইরে আশা বাড়িতে মেহমান এসেছে, তাড়াতাড়ি না গেলে আমাকে বকবে। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না,ভালে থাকিস। এই বলে প্রিয়া তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো আশা ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলো -বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের কত ঘটনা ঘটে কত পুরুষ সাজা পায়। কিন্তু পুরুষের চেয়ে বেশি নির্যাতন নারীই নারীকে করে। একটা সংসারে স্বামীর চেয়ে বেশি অত্যাচার করে শাশুড়ী ননদ, এক নারী আরেক নারীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে। নারীই যদি নারীর দুঃখ না বোঝে তাহলে পুরুষ বুঝবে কি করে। আশা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তার বিশ্বাস চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে প্রতিটি পা ফেলছে,সফল সে হবেই।
মামী আজ খুব খুশি শাহেদ আসাতে।সকাল থেকেই মামীর মেজাজ ভালো প্রিয়ার সাথে আজ বেশি খারাপ আচরণ করেনি। শাহেদ খাটের উপর বসে ভাত খাচ্ছে। শীলা পাশে দাঁড়িয়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। মামী রুই মাছের মাথাটা শাহেদের প্লেটে তুলে দিল,প্রিয়া আজ সকালে সময় পায়নি তাই এই ভর দুপুরে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। শাহেদ ভাত খাচ্ছে আর ছোট্ট জানালা দিয়ে প্রিয়াকে আড়চোখে দেখছে। মামী খাবার তুলে দিতে চাইলো,শাহেদ হাত ধরে বললো খালাম্মা আর খেতে পারবো না পেট ভরে গেছে।মামী বললো,তুই কি আবার বিদেশ চইলা যাবি, নাকি এই দেশেই থাকবি। শাহেদ বললো,খালাম্মা ভাবছি দেশেই থেকে যাবো বিদেশ আর ভালো লাগে না,টাকা তো কম কামাই করলাম না। এত টাকা কে খাবে। মামী বললো, হ ঠিকেই কইছোস, তোর তো আর আপন ভাই বোন নাই। আহারে আমার বইনডা অল্প বয়সে মইরা গেল,ওর কতা মনে অইলে বুকটা আমার ফাইটা যায়। আর তোর কথাও মনে অইলে বুকটা আমার ফাইটা যায়। আর তোর বাপ বছর না ঘুরতেই আবার বিয়া করলো, হেই ঘরে দুই পোলা। কয়েকদিন আগে আইছিলো আমার কাছে তোর ঠিকানা জানতে চায়। আমি সোজা না কইরা দিছি, তুই কহনো তোর বাপের লগে দেহা করতে যাবি না।হের সংসার লইয়া হেয় থাকুক, তুই এহন তোর চিন্তা কর। বিয়া কইরা নিজের সংসার নিজে সাজাইয়া ল।বিয়ের কথা শুনে শাহেদ একটু লজ্জা পেল, শীলা হেসে ফেললো, মামী রেগে শীলার দিকে তাকালো, শীলা চলে গেল। মামী বললো,তুই বস, আমি তোর লাইগা এক গ্লাস দুধ নিয়া আহি। মামী চলে গেল,শাহেদ প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।হঠাৎ করে প্রিয়ার চোখ শাহেদ এর দিকে গেল, শাহেদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। প্রিয়া কেন এভাবে চলে এলো, শাহেদ জানে না, শুধু জানে তার বুকটা কাঁপছে।
সন্ধ্যার পর শীলা পড়তে বসেছে, কিন্তু তার পড়ায় মন বসছে না। হঠাৎ হঠাৎ মনটা অস্থির হয়ে পড়ছে। শীলার মা চাচ্ছে শাহেদ এর সাথে শীলার বিয়ে হোক। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। শীলা তো পড়া লেখা শিখে ডাক্তার হতে চাই, তার বাবার মুখে হাসি ফোটাতে চায়। তবে শীলা জানে তার মায়ের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এই বয়সে বিয়ের কথা ভাবতেও তো অবাক লাগে। তার মায়ের ইচ্ছের কাছে বাবার স্বপ্নের কোন মূল্য নেই। মা জোর করে বললে শীলাও না করতে পারবে না। এমন অনেক সংসার আছে যেখানে বাবা মায়ের রাগের কারণে সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের অনেক স্বপ্ন ধুলার সাথে মিশে যায়। শীলার অবস্থাও হয়তো তাই হবে। শীলা টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ