প্রেম পিয়াসী
আমি পিয়াসী।সেই ছোট বেলা থেকেই একটু শান্ত স্বভাবের।যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেয়ার চমৎকার অভিজ্ঞতা আছে।এই যেমন সেদিন,আমার ৬ বছরের চাচাত ভাইটি দুষ্টুমির ছলে আমার বই নিয়ে দৌড় দেয়।বই টা নষ্ট করে ফেলে এই ভয়ে আমি তার পিছু নেই।সে এক রকম অসতর্ক ভাবে গিয়ে পুকুরে পড়ে যায়।ভাইকে বাঁচাতে আমিও ঝাপিয়ে পড়ি।পানি থেকে তুলে আনি তাকে।তার কোনো রকম সমস্যা হয়নি।চাচী জান ছুটে এল।ভাইটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, পিয়াসি আপু আমাকে ফেলে দিয়েছে পানিতে।তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল চাচী। খবর পেয়ে চাচা ও এল।চাচী চাচাকে দেখেই উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল আর বলল -
-এই জন্যই তোমাকে বলেছিলাম,এই মেয়ে কালসাপ হয়ে আমার সংসার টাকে শেষ করে দেবে।মা,বাপ নেই তো কি হয়েছে? বিয়ে দিয়ে দাও।পরের ঘরে চলে যাক।
-কি বলছ এসব,পিয়াসীই তো রাজন কে বাচালো।
-হ্যাঁ, তা তো করবেই।ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে,আবার কেউ দেখে ফেলার ভয়ে তুলে এনে ফেরেস্তাও সেজেছে।এমন সর্বনাশী মেয়ে আমার এই জন্মে দেখিনি কভু।জন্মের পর মাকে খেয়েছে।২ বছর পর বাপ কে খেয়েছে।এরপর খেতে এসেছে আমাকে।
-আহা।চুপ কর।একটা ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসলে বিয়ে দিয়ে দেবো।যেমন তেমন ঘরে তো আর দিতে পারিনা।
-তোমার এই কালো ভাতিজি টাকে কে বিয়ে করবে শুনি?
-নিশ্চই আল্লাহ ওর জন্যও ভালো কিছু লিখে রেখেছেন।
-যে সর্বনাশী আমার ছেলেকে মারতে চাইল,আর তুমি কিনা তার ভালো চাইছো?
-আহা!ঝগড়া করোনাতো।রাজনের যে কিছু হয়নি এটাই বেশি।
সেদিন চাচাজান চাচীকে এক মুহূর্তের জন্য চুপ করিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী প্রতিটা মুহূর্তে যে কত কথা শুনতে হয়েছে আমার।রাজন কে আমি খুব স্নেহ করি।
.
চাচা সেই ছোট বেলা থেকে আমাকে লালন পালন করে আসছেন।লেখাপড়া শিখিয়েছেন।হ্যাঁ,আমি এখন একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।চাচার সংসারে চাচা-চাচী,রাজন,আমি আর আবিদ ভাই।আবিদ ভাই চাচার বড় ছেলে।পড়াশুনা শেষ করে ঢাকা একটা কম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করছে।চাচা-চাচী এখন তাঁর জন্য একটা ভালো পাত্রী খুঁজতে উঠেপড়ে লেগেছে।যখন কোথাও মেয়ে দেখে, চাচা বাড়ি এসে মেয়েটার প্রশংসা করেন,আমি তখন এক রাশ অভিমানে আড়ালে অশ্রু লুকাই।অভিমান টা আমার নিজের সাথেই।গায়ের রং যদি কালো না হতো তবে হয়তো আমার শূন্য আকাশে একটি ঘুড়ি উড়ে বেড়াত।
.
প্রেম নাকি এক মরণ ব্যাধি।আমি প্রথম এই মরণ ব্যাধিতে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন, যেদিন আবিদ ভাই আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে আমাকে বলেছিল,
-পিয়াসী, কান্না করছিস কেন?এই পৃথিবীতে কি তুই ই একমাত্র মেয়ে যার গায়ের রং কালো।কালো মেয়েদের মাঝে কি সৌন্দর্য থাকেনা?তুই কি জানিস,তোর চোখ গুলো খুব সুন্দর।ঠিক গরুর চোখের মত।আমার মতে সবচেয়ে সুন্দর চোখের অধিকারী হচ্ছে গরু।হরিণের চোখ আমার একেবারেই ভালো লাগেনা।কেমন কুচকানো দেখতে।
আমার খুব হাসি পেয়েছিল আবিদ ভাইর কথা শুনে।সেই প্রথম ভালো লাগা।আমার মতো পিয়াসীদের কখনো ভালো লাগতে নেই কাউকে।তারপরও অনেক ভালোলাগা কাজ করতো তাঁর জন্য।কিন্তু আবিদ ভাই কখনোই আমাকে সে রকম চোখে দেখেনি। চাচাতো বোন হিসেবে আমাকে শান্তনা দিতো মাত্র।
.
আমি যেন কালো নামের একটা অভিশাপে বন্দি হয়ে গেছি।কিছুদিন পর চাচা,চাচী মেয়ে দেখতে গেল এবং পছন্দও হলো।মেয়ে খুবই সুন্দরী, রুপবতী,গুনবতী।চাচীর মুখে প্রশংসার শেষ ছিলনা।দিনক্ষণ দেখে বিয়ে ও ঠিক হলো।আবিদ ভাই মা বাবার পছন্দ মতই বিয়ে করবে বলেছে। সময় যত ঘনিয়ে আসছিল,আমার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ততই কষ্ট হচ্ছিলো।তারপরও সবার সামনে খুশি থাকার মিথ্যে অভিনয়টা যেন প্রতিনিয়ত এই কালো দেহের মনটাকেও বিষিয়ে কালো করে তুলছিল।
.
আগামীকাল আবিদ ভাই এর বিয়ে।আমি ছোট্ট একটা ডায়েরী হাতে নিয়েছি।লিখতে বসেছি না বলা কিছু কথা।যা সারাজীবন এই ডায়েরীর পাতায়ই থেকে যাবে। অব্যক্ত কথাগুলো কাউকে বলা হবে না। রাত টা যে আমার কত কষ্টে কাটল তা বুঝানোর মত ভাষা নেই আমার।
.
বর পক্ষ চলে গিয়েছে বিয়ের গাড়িতে।বাড়িতে আমি আর চাচীজান শুধু।যথাসময়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো।বউ নিয়ে বাড়ি আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো তাদের।চাচী বউ নিয়ে ব্যাস্ত।আবিদ ভাই এর বউ এর নাম রাদিফা।আমি রাদিফা কে যখন প্রথম দেখলাম, নিজেকে হাজার বার অভিশাপ দিলাম।যেন আমার রং টা নিয়ে আর কোনো পিয়াসী না জন্মে।বউকে বাসর ঘরে দেয়ার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম,তোমার বুকে ফাটল ধরেনা কেন?আমি তোমার মাঝে যাবো।ধরণির বুকে আর কাজ নেই আমার।আমাকে আমার মা বাবার কাছে নিয়ে যাও, আমায় উঠিয়ে নাও।আকাশ টাও আমার কথা শুনতে পায়নি।
.
যাইহোক নতুন বউ যেদিন প্রথম নাস্তা বানিয়ে ছিল,আবিদ ভাই সেদিন বউ কে বলেছিল,তুমি পিয়াসির কাছ থেকে রান্না শিখে নিও।সেদিন সে আমার উপর ঈর্ষান্বিত হয়েছিল,তা সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম।
.
পরবর্তী দিন গুলো ছিল আমার জন্য আরও বেদনাদায়ক। বছর ঘুরতেই রাদিফার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান।দুর্ভাগ্য, বাবুটা ১০ দিন বয়সেই মারা যায়।চাচীজান এই অপবাদ টাও আমার ঘারেই চাপিয়ে দেয়।আমি নাকি তাদের সংসারের কাল হয়ে দাড়িয়েছি।ঘুমন্ত বাবুটিকে নাকি আমি মেরে ফেলেছি।চাচীজান আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। চাচাজানও কিছু বলতে পারেননি তখন।আবিদ ভাই বাধা দিলে চাচী শুনেন নি।আবিদ ভাই,চাচীকে না জানিয়ে কলেজ হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।কয়েক টা টিউশনি যোগার করে পড়া লেখার খরচ চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করি।এ দিকে আবিদ ভাইও প্রায় সময় টাকা পাঠাতো।বারণ করতাম,শুনত না।বলত,চাচাতো ভাই হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে।
.
এর মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েক টা বছর। আমি অনার্স শেষ করে প্রাইমারি স্কুলের জব করি তখন।একদিন, জানতে পারি,ঢাকা যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্ট এ আবিদ, রাদিফা দুজনকেই মারাত্নক অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি করা হয়।আবিদ কে দেখার জন্য ছুটে গেলাম হসপিটালে।শুনতে পেলাম রাদিফার জন্য o- রক্ত লাগবে।আমারও রক্তের গ্রুপ o-।তাই দেরি না করে রাজি হয়ে গেলাম।রাদিফার অনেক রক্তের দরকার ছিল।জানিনা বাকি রক্ত কিভাবে ম্যানেজ করা হয়।
.
তারপর আমি আবিদ কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি।চাচাজান যা বলল আমি তাতে নির্বাক হয়ে গেলাম।এক্সিডেন্টের মাধ্যমে আবিদ পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।যেখানে শুয়ে আছে আমার মা-বাবা। আমি যেন সব হারিয়ে ফেললাম।শেষবার তাকে দেখলাম আমি।জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল,বলতে ইচ্ছা করছিল,আমাকে নিয়ে গেলে না কেন।এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি যে একমাত্র তোমাকেই ভালবাসি।এতটা ভালবাসি যে, চাইলেও কেউ কখনো আমার চেয়ে বেশি তোমাকে ভালবাসতে পারবেনা।কিন্তু তোমার সুখের কথা চিন্তা করে কখনো বলতেই পারিনি।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে একটি বার উঠো, দেখো আমাকে।
-----সমাপ্ত------
✍ আবির হোসেন(কালো মানুষ)
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ