প্রিয়ার চোখে জল
১ম পর্ব
লেখকঃ সাইদা ইসলাম বকুল
ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম আলো এসে প্রিয়ার মুখে পড়ল। প্রিয়া ওপাশে ফিরে শোয়ার সময় অনুভব করলো গায়ে প্রচন্ড ব্যথা। চোখ খোলার চেষ্টা করলো। মাথাও ব্যথা করছে। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।গায়ে জ্বর উঠেছে, আস্তে আস্তে উঠে বসলো। কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না। পায়ের কাছে রাখা ছেঁড়া কাঁথাটা গায়ে পেচিয়ে বসে রইলো। মানুষ যখন অসুস্থ থাকে, তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। তবে কাছে আপনজন থাকলে অসহায়বোধ কিছুটা কম লাগে।
প্রিয়ার বাবা মা মারা গেছে ওকে ছোট রেখে, সেই থেকে প্রিয়া মামার সংসারে বড় হয়েছে। প্রিয়ার বাবার সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল, তা দিয়ে মামা প্রিয়াকে মেট্রিক পাশ করিয়েছে। তার জন্য মামীর মুখে রাতদিন গালমন্দ শুনতে হয় মামাকে। মামা এই বাড়ির ঘর জামাই। মামা অবশ্য এই বাড়িতে থাকতে চায়নি, কিন্তু মামা সামান্য বেতনের চাকরি করে। সেই টাকা দিয়ে থাকা খাওয়া কষ্ট হয়ে যাবে, তাই এই বাড়িতে পড়ে আছে। মামার অসহায় মুখটা দেখলে প্রিয়ার খুব কষ্ট হয়। মামার ইচ্ছা করে প্রিয়াকে বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা দিতে, কিন্তু তার স্ত্রীর জন্য পারে না। কারণ মামী চাই না প্রিয়াকে কেউ আদর করুক। প্রিয়াকে মামী কাজের মেয়ের মতো রাখে, তাতেই প্রিয়া খুশি। কারণ প্রিয়ার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
প্রিয়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, কাঁচা মাটিতে পাড়া দিতেই প্রিয়ার শরীর কেঁপে উঠলো। ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে, কিন্তু ইচ্ছে করলেও প্রিয়া আর আরাম করতে পারবে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের সব কাজ প্রিয়াকেই করতে হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। উঠানের মাটি যেনো আরো বেশি ঠান্ডা মনে হচ্ছে। প্রিয়া অনেক কষ্টে উঠান ঝাড়ু দিয়ে নাস্তা তৈরী করতে বসলো। গ্রামের বাড়ি, ছোট ছোট ছেলে -মেয়েরা ঘুম থেকে উঠেই দৌড়াতে লাগলো। মাটির চুলার ধোঁয়া এসে প্রিয়ার চুখে লাগলো চোখ লাল হয়ে গেল। প্রিয়া চোখ মুছে রুটি বানাতে লাগলো। মামী এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়ালো। মামীকে দেখলেই ভয়ে প্রিয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়,মামী রেগে বললো এতো বেলা অইলো, এহনো নাস্তা তৈরি অয় নাই। আইজ কি না খাওয়াইয়া রাখবি? প্রিয়া বললো, মামী গায়ে অনেক জ্বর ছিলো,তাই উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আপনি ঘরে গিয়ে বসুন। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
মামী বললো, খবরদার আমার সামনে কহনো তোর অসুখের কথা কবি না। এই বাড়িতে থাকতে অইলে কাম কইরা ভাত খাওন লাগবো, শরীর সুস্থ না অসুস্থ তা আমি দেখুম না। আমি চাই কাম। চিৎকার শুনে মামা আর শীলা দৌড়ে এলো। মামা বললো, কি হয়েছে রাহেলা? মামী বললো, এতো বেলা অইছে এহনো নবাবজাদীর নাস্তা তৈরি অয় নাই,কয় কাইল রাইতে বলে জ্বর অইছে, তাই উঠতে আইজ দেরি অইছে, ওরে তুমি সাবধান কইরা দেও, কহনো যাতে ওর অসুখের কতা আমার সামনে না কয়। মামা বললো, রাহেলা তুমিও তো একটি মেয়ের মা,নিজের মেয়েকে এতো আদর করো,এতো ভালোবাসো, আর এই অসহায় মেয়েটার সাথে একটু ভালোভাবে কথাও বলতে পার না তাই বলে। মামী বললো,ভাগ্নির লাইগা যদি এতোই দরদ লাগে, তাইলে আলাদা বাড়ি ভাড়া কইরা রাখলেই পারো। মামা বললো, যদি আমার সেই সামর্থ থাকতো তাহলে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতাম, তবুও তো এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো।প্রিয়া এসে মামার সামনে দাঁড়ালো। বললো,মামা আমার এখানে কোন কষ্ট হচ্ছে না, আর সংসারের কাজ তো সবাইকে করতে হয়। আমিও করি। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। মামী রেগে চলে গেল। প্রিয়া দাঁড়িয়ে রইলো। শীলা এসে প্রিয়ার কপালে হাত রেখে বললো, আপু তোমার তো অনেক জ্বর, তুমি গিয়ে শুয়ে থাক, আজ সব কাজ আমি করবো। প্রিয়া শীলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো,তারপর একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে বললো, শীলা তুই পড়তে বস, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। শীলা মাথা নিচু করে চলে গেলো।এই শীলাই প্রিয়ার একমাত্র সঙী, বয়স তেরো চৌদ্দ হবে, বয়স কম হলেও প্রিয়ার সুখ-দুঃখ সবই বুঝে। শীলা আর মামা আছে বলেই প্রিয়া সব দুঃখ ভুলে থাকতে পারে। প্রিয়া তাড়াতাড়ি নাস্তা তৈরি করতে লাগলো।
প্রিয়ার চোখে জল
২য় পর্ব
সাইদা ইসলাম বকুল
মামা ছাতা হাতে বেরিয়ে যেতে লাগলো, শীলা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,বাবা তুমি নাস্তা না খেয়েই অফিসে চলে যাচ্ছো? আমার ক্ষিদে নেই মা, তুই নাস্তা খেয়ে স্কুলে চলে যাস। বাবা,মায়ের সাথে রাগ করে নাস্তা না খেয়ে চলে যাচ্ছো? বাবা বললেন, মারে আমি সামান্য একজন পিয়ন, তোর মায়ের বাড়িতে থাকি আমার কি রাগ করা শোভা পায়। প্রিয়া যেমন এই বাড়িতে আশ্রিতা আমিও তো তেমন । বিয়ের আগে যতটুকু রাগ ছিল, বিয়ের পর তাও শেষ হয়ে গেছে।
-বাবা তুমি কাঁদলে আমিও কাঁদবো,
-ও কিছু না মা, যে মানুষের কোন মূল্য নেই সেই মানুষের চোখের পানিরও কোন দাম নেই। এই বলে মামা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শিলা মন খারাপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। প্রিয়া এলো নাস্তা নিয়ে শীলার সামনে দিয়ে বলল, নাস্তা খেয়ে নে, মামা কোথায়? শীলা বললো,বাবা অফিসে চলে গেছে। বাবা আজ আমার সামনে কাঁদলো,আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপু, তোমার কষ্ট দেখে বাবাও কষ্ট পায়, আমিও কষ্ট পাই। তুমি তো একজন মানুষ, রক্ত মাংসে গড়া, তোমার কি রাগ ঘৃণা অভিমান বলতে কিছু নেই, এত কষ্ট এত অপমান সহ্য করে কেন এই বাড়িতে পড়ে থাক। প্রিয়া বললো,কোথায় যাবো, কার কাছে যাব, এই দুনিয়ায় তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল? শীলা,মামী আমাকে ভালো না বাসুক,তুই আর মামা তো আমাকে ভালোবাসিস তোদের দুজনের ভালোবাসার কাছে একজনের অবহেলা কিছুই না। তুই আর কখনো এসব নিয়ে ভাববি না। তুই শুধু মনযোগ দিয়ে পড়া লেখা করবি, তুই মামার একমাত্র ভরসা, একমাত্র স্বপ্ন। তুই ডাক্তার হবি, মামার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে, মামার মুখে হাসি ফোটাতে হবে। শীলা বললো, আপু তোমার কষ্ট আর বাবার অসহায় মুখটা দেখলে আমার সব কিছু কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যায়। প্রিয়া বললো, শীলা তুই যেদিন ডাক্তার হবি, সেদিন মামার দুঃখ আর আমার কষ্ট সব দূর হয়ে যাবে। শীলা বললো, আপু আমি তোমার আশা আর বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো। আমি ডাক্তার হয়ে গরীব আর অসহায় মানুষের সেবা করবো,বিনা চিকিৎসায় গরীব মায়েদের মরতে দেব না। যাতে কোন সন্তান তার বাবা মাকে হারিয়ে এতিম না হয়, আর তোমার মত অন্যের বাড়িতে থেকে কষ্ট সহ্য না করে।
মামা বারান্দায় অন্ধকারে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। গ্রামের নিস্তদ্ধ পরিবেশ, জোনাকি পোকা আশে পাশে ঘুরছে। মামা হাত দিয়ে পোকা ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু একটা পোকাও ধরতে পারছে না। প্রিয়া এসে মামার পাশে দাঁড়ালো। মামা বললো, দেখলি প্রিয়া, আমি সামান্য একটা জোনাকি পোকাও ধরতে পারি না, আসলে আমি কিছুই পারি না, তুই আমার কাছে থাকিস, অথচ তুই অসুস্থ থাকলে তোর সেবা দিতে পারি না, তুই কাঁদলে তোর চোখের পানি মুছে দিতে পারি না, তুই ক্ষুধার্ত থাকলে তোর মুখে খাবার তুলে দিতে পারি না, তোর বাবা -মায়ের সাথে যদি তোর মৃত্যু হতো, তাহলেই মনে হয় ভালো হতো। আমি এই সংসারের কর্তা হয়েও তোর মতই আশ্রিতা।ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ঘর বাড়ি সব হারিয়ে এই বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে আছি। নদীর ভাঙনে জায়গা জমির সাথে সাথে আমার কপালও ভেঙেছে। সংসার সন্তান থাকতেও আমি বড় অসহায়। প্রিয়া বললো,মামা নিজেকে এতোটা দুর্বল আর অসহায় ভাববেন না। শীলা আপনার পাশে আছে আর সব সময় থাকবে এটাই তো আপনার বড় সান্ত্বনা। আমি সব দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারি না, আমার কসম দিলাম মামা, আএ কখনো আপনি কাঁদবেন না। আপনার চোখের পানি শীলার চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো। আমাদের দুজনের জন্য আপনার মনকে শান্ত রাখতেই হবে মামা। মামা বললো,তোদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তো বেঁচে আছি আমি। প্রিয়া বললো,এই অন্ধকারের মধ্যে আর বসে থাকতে হবে না। রাত অনেক হয়েছে এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন। মামা বললো, মারে ঘর হল মানুষের শান্তির জায়গা। সারাদিন পরিশ্রম করে মানুষ ঘরে ফিরে আসে বউ বাচ্চা নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। স্ত্রীর সাথে মানুষ তার সুখ দুঃখের কথা বলে। আর আমি ঘরে থেকেও মনে হয় গাছের নিচে। মাথার উপর খোলা আকাশ আমার চারপাশে কেউ নেই। মামা যতটা না বয়সে বুড়ো হয়েছে তারচেয়ে বেশি চিন্তায় বুড়ো হয়ে গেছে। মামাকে দেখলে প্রিয়ার খুব কষ্ট হয়। নিয়তির কাছে মানুষ বড় অসহায়।
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ