বহু বছর আগের কথা, ব্যতিব্যস্ত কাজ করছি আবুধাবী সেন্ট্রাল হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের অফিসে - ল্যাবের ভেতর ব্যতিব্যস্ত আমার টেকনিশিয়ান টেকনোলজিস্টের দল। ফোন বাজল, ওধারে মহিলা-
"বলছি !"... "একজনের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর পেয়েছি. আমাকে একটু হেল্প করতে হবে"। "বলুন!" "আমি গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে এখানে ছেলের সংসারে এসেছি, আগামী সপ্তাহে ফিরে যাব। এক পেশেন্টকে দেখতে চাই”। “চলে আসুন ভিজিটিং আওয়ারে, কোনো অসুবিধে নেই"। "না, ভিজিটিং আওয়ারে না। আমি আসতে চাই যখন বাইরের কেউ থাকবে না।"
একটু ধাক্কা খেলাম, বললাম : – "কোন পেশেন্ট"?
নাম শুনে চুপ হয়ে গেলাম। পেশেন্ট ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গভীর কমা'তে লাইফ সাপোর্টে আছেন। আমার ল্যাবের রিপোর্ট বলছে জীবনের আর কোনো আশা নেই, ডাক্তারেরাও জবাব দিয়ে দিয়েছে। এখানে তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা আছে - এখন শুধু অপেক্ষা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে উনাকে চলে যেতে দেবার। বললাম:-
"উনি তো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, ওখানে অনেক রেস্ট্রিকশন !!"
মিনতিভরা কণ্ঠে তিনি বললেন – "দেখুন, উনাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য আমি অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়েছি। অফিস ছুটি দিচ্ছিল না, রিজাইন করে এসেছি। প্লিজ, প্লি--জ একটা ব্যবস্থা করে দিন!!”
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল -"চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন?" “কি করব – ছুটি দিচ্ছিল না। আমার এত বছরের চাকরী !”
মনে হল জীবনের এমন এক দাবী এসেছে যাকে উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। বললাম-
“যখন বাইরের কেউ থাকবে না......তাহলে তো মাঝরাতে আসতে হয় …." "তাই আসব – যখন বলবেন আসব”। "রাত দু'টোয় আসুন - আমি ইমার্জেন্সির গেটে থাকব।” "আচ্ছা। আমি সবুজ শাড়ী পরে আসব, চিনতে পারবেন।"
রাত দু'টোয় তিনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন, সবুজ শাড়ী পরা। আইসিইউ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাসিমুখে ছুটে এল হেড নার্স সুমাইয়া, বলল -“কি ব্যাপার বিগ ব্রাদার, এত রাতে"? বললাম পেশেন্ট দেখতে এসেছি। সুমাইয়া মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গেল।
নাকেমুখে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে লাগানো নানা রকম পাইপ আর টিউব, ধীরে বইছে নি:শ্বাস। চোখদুটো আগের মতই বন্ধ। সরু টিউবের ভেতর দিয়ে হাতের সুঁচে শরীরে ঢুকছে টিপিএন ফ্লুইড, টোটাল প্যারেন্টারেল নিউট্রিশন। আস্তে তিনি বসলেন বেডের পাশে চেয়ারে। পেশেন্টের হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন-
"টোনা! আমি তোমার টুনি!! মনে আছে ছোটবেলার কথা?”
মাথায় বাজ পড়ল আমার। বিস্ফোরিত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। এ শরীর এতদিন বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি শত আহ্বানে তার বন্ধু বান্ধবের, স্ত্রীর এমনকি সন্তানদেরও। সেটা এখনো পড়ে আছে একই রকম নিষ্প্রাণ। ওই শরীর, ওই মন, ওই আত্মা কি আর কখনো কারো ডাকে সাড়া দেবে? তিনি ফিসফিস করে বললেন-
“তোমার অসুখের কথা শুনে ঢাকা থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি!"
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট। ওটা মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা নাকি জীবন্ত শরীরে মৃত আত্মা বলা কঠিন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই নিথর দেহের কোন অতলান্ত গভীরে নড়তে শুরু করেছে রহস্যময় বিশাল কি যেন। মহিলা গভীর মমতায় ফিসফিস করে বললেন -
"আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ। আমি জানি আমার কথা না শুনে তুমি পারবে না”।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি. আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট।
“সেই সবুজ শাড়ীটা তুলে রেখেছিলাম! এত বছর পর আজ আবার পরেছি !!”
অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোন সুদুর অতীত থেকে কত বছরের ক্ষুধার্ত বাল্যপ্রেম ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বোমার মত বিস্ফোরিত হল হতচেতন দেহের ভেতরে। থরথর করে কেঁপে উঠল দেহ, নড়ে গেল নাক-মুখের পাইপ, হাতের সুঁচ নড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। আতংকে চীৎকার করে উঠলাম- "সুমাইয়া !!!" ছুটে এল নার্সের দল কিন্তু সেই ভূমিকম্প থামায় কার সাধ্য। মহিলা ধরে আছেন তাঁর হাত, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
"শান্ত হও, শান্ত হও টোনা! আমি তোমার পাশে এখনো আছি তো....আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাইনি....শান্ত হও....! ”
কি এক নিবিড় প্রশান্তিতে স্থির হয়ে এল দেহ, রুদ্ধশ্বাসে আমি তাকিয়ে আছি পাথরের মূর্তির মত। পেশেন্টের হাতের একটা আঙ্গুল একটু একটু নড়ছে, মহিলা সেই আঙ্গুলটা ছুঁয়ে রইলেন। যেন দুটো টোনাটুনি পাখী ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জীবনের শেষবার কথা বলছে।
এদিকে নার্সের চোখে ফুটে উঠেছে মিনতি। মহিলা সেটা বুঝলেন। অচেতন রোগীর চোখে মুখে গালে কপালে বুকে ক্ষুধার্তের মতো হাত বুলোলেন, তারপর গভীর নি:শ্বাস ফেলে বললেন –
বাইরে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সে চোখে ফুটে উঠেছে অনুরোধ। আস্তে করে বললাম –
মহিলা নিজের মনে বললেন - "আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না”। তারপর একটু থেমে বললেন – “আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ"।
আমি সম্মোহিতের মত, মূর্তির মত অপলক হতবাক দাঁড়িয়ে আছি সেই মরুভুমির মাঝরাতে।
পেশেন্টের লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়েছিল পরদিন।
টোনা-টুনি |
Collected
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ