আমার যদি আর না আসে তোমায় নিয়ে গান
সিনি মনি
আমার দুইরুমের ছোট্ট বাসাটির খুব কাছে যে কালচে সবুজ রঙের বিশাল একটি পাহাড় রয়েছে , আমি চাইলেই তার কাছে নিজের সব না বলা কথা বলে ফেলতে পারি অনায়াসেই । আমি যতদিন যতবার এই পাহাড়ে উঠেছি , কেন জানিনা একটা সময়ে মনের অজান্তেই আমার চোখে পানি চলে এসেছে প্রতিবার । এই পাহাড় , পাহাড়টির খুব কাছ ঘেষে বয়ে যাওয়া চিকনধারার ছোট্ট নদীটা – এদের সাথে জন্ম থেকেই আমার কোন যোগাযোগ রয়ে গেছে কিনা , আমি বুঝতে পারিনা কিছুতেই ।
আমি যখন ঢাকার ব্যস্ত ছাত্রজীবনে আবদ্ধ ছিলাম , তখন আমার শীতের রাতগুলো পেরিয়ে যেত এরকম একটি পাহাড়ি নদীর আবহে বেড়ে ওঠা অসম্ভব সুন্দর কিছু কল্পনাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে । আর আজ যখন সেই কল্পনা আমার জন্য বাস্তবতায় পরিনত হয়েছে , তখন কিনা আমার সুখ সুখ রঙের রাতগুলো রঙ বদলে হয়ে গিয়েছে মন খারাপ রঙের - যে রাতের প্রতিটি ক্ষণে আমি অপেক্ষা করি আমার অরোরার চোখে চোখ রাখব বলে ।
রাতের শেষে আকাশে যে অমানবিক স্নিগ্ধ একটি আলো দেখতে পাওয়া যায় , তাকে হয়ত অরোরার মূল ডেফিনিশানের সাথে মেলানো যায়না কিছুতেই । কিন্তু তবুও আমি ভীষণ ভালবাসায় এই আলোটির নাম দিয়েছি অরোরা । আমার কেন যেন মনে হয়, এই নরম আলোটি যখন আলতো করে আমার চোখদুটোকে ছুঁয়ে যায় , ঠিক তখন আমার বুকের ভেতরের সবটুকু অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে রাঙ্গিয়ে দেয় ঐ আকাশে । তাই আমার মনখারাপের রাতগুলোর পুরোটা সময় ধরে আমি জেগে থাকি শুধুমাত্র ভোরের আকাশে আমার এই নিজস্ব অরোরাকে দেখব বলে ।
রোজকার নিয়মে অরোরা আসে । আমিও বুভুক্ষের মত ভোরের আকাশে আমার অরোরাকে দেখতে থাকি অচেনা মাদকতায় - আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার পাশে বসে থাকা মৃত্তিকা নামের মেয়েটি প্রচন্ড শক্তিতে তার দুচোখ উপচে আসা পানিকে আটকে রাখবার চেষ্টা চালায় । অরোরার সৌন্দর্যে আকুল আমি তবুও তৃষ্ণার্তের মত শ্বাস আটকে রেখে মৃত্তিকাকে বলি ,
“ মৃত্তিকা , তুমি কি অরোরা দেখতে পাও ?”
মৃত্তিকা তার দুচোখ ভরা পানিতে অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে , “না , পাইনা।”
আমি তখন আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মৃত্তিকার আটকে রাখা কান্নার রঙ দেখতে থাকি । এই অপূর্ব মেয়েটিকে কি আমি কোনদিন বোঝাতে পারব , কোন এক অদ্ভুত কারনে আমি ওর কান্নার রঙ দেখতে পাই ? মৃত্তিকার কান্নার রঙ নীল – ভীষণ রকম নীল !
আজকে সারাটা রাত ধরে নির্বাণ নামের এক বিভ্রান্ত তরুন ভিনদেশী একটি আকাশকে সাক্ষী করে তার ভালবাসার মানুষটির বিষণ্ণতার আওয়াজ শুনে গিয়েছে অবিরাম । চাইলেই সে হয়ত তাকে তার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসে সেই দুঃখবিলাসকে মাঝপথে থামিয়ে দিতে পারত । চাইলেই সে হয়ত প্রচন্ড চিৎকার করে তাকে বলতে পারত , “ তুমি আমাকে কেন চাও না ?” কিন্তু একটিবারের জন্যেও ছেলেটি এর কোন চেষ্টাই করেনি ।
পাঠক হয়ত বুঝে গিয়েছেন , আমিই সেই নির্বাণ । শুনেছি, কিছু কান্নাকে নাকি বুকের ভেতর চেপে রাখতে নেই । হয়ত চেপে থাকা ঐ কান্নার কারণেই আমি একটিদিনের জন্যেও এই মেয়েটির ভালবাসা পাইনি । হয়ত এই কান্না না থাকলেও আমি তার মনের কাছাকাছি যেতে পারতাম না কোনদিন – কিন্তু তবুও আমি আশা ছাড়তে পারিনা । কাউকে সত্যিসত্যি ভালবেসে ফেলাটা যে পৃথিবীর সবচাইতে বড় অপরাধগুলোর মধ্যে একটি – এই কথাটা কেউ আমাকে আগে বলেনি কেন ?
দূর মহাসাগর থেকে ভেসে আসা বাতাসে মৃত্তিকার চুল যখন অল্প অল্প উড়তে থাকে , আমি তখন সময়কে আমাদের দুজনের মাঝে আটকে রাখবার অসম্ভব ইচ্ছেয় মত্ত হয়ে যাই নিজের অজান্তেই । অথচ এই মেয়েটি কিনা কখনোই আমাকে চায়নি – সে কিনা কখনোই স্বপ্ন দেখেনি, অনেকদূরের পাহাড়চূড়ায় যার হাত ধরে সে একদিন বসে থাকবে, সেই মানুষটি কখনো আমি হতে পারি । তবুও এতটা দিন ধরে আমিই শুধু একপাক্ষিকভাবে ওকে ভালবেসে গেছি । ও যতদিন যতবার আমাকে উপেক্ষা করে বলেছে , “ এভাবে ভালবেস না নির্বাণ, আমি বাসতে পারিনা” – ততবার আমি দ্বিগুণ মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই । আর এখন শুধু মনে হয় , আমার বোধ হয় মৃত্তিকার ভালবাসার আর কোন প্রয়োজন নেই – শুধুমাত্র সে যদি আমাকে তার পাশে থাকবার অনুমতিটুকু দেয়, রাত বিরেতে তার বরফের মত শীতল হাতদুটোকে উষ্ণতায় জড়িয়ে দিতে দেয় ; তাহলেই বোধ হয় আমার হাজার বছর বেঁচে থাকবার সাধ মিটবেনা কোনদিন !
মৃত্তিকা আমাকে যতদিন যতবার আঘাত দেয়ার চেষ্টা করেছে, ঠিক ততটুকু নিয়ে মরুভুমির বিরক্ত প্রকৃতি সহজেই নামিয়ে দিতে পারত মরুঝড় । আমিতো ঝড় ভালবাসতাম না ,কিন্তু মৃত্তিকাকে ভালবাসতে গিয়ে কখন যেন ঝড়ের আঘাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি । তবু হয়ত মাথা ভর্তি ধুলোবালি নিয়ে আমি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম ,যদি সে একবার বলত , "তুমি থাকো , নির্বাণ - তোমাকে কষ্ট দিয়েই আমি নাহয় বেঁচে থাকি ।"
মৃত্তিকাকে এই কথাটা আমি অবশ্য বলেছিলাম – শুনে সে আস্তে করে বলেছিল , " তুমি থেকো না ; তুমি কষ্ট না পেলেও আমার দিন চলে যেত - চলে যাবে ।"
তবুও আমি শরীর ভরা ঝড়ের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ - কেন থাকি , কেউ আমাকে এখনো সেই উত্তরটা দিয়ে যায়নি ।
মৃত্তিকা নামের এই মায়াবী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আজ থেকে তিন বছর আগের একটি বরফ শুভ্র সন্ধ্যায় । ওহাইও থেকে সেদিনই আমি প্রথমবারের মত পা রেখেছিলাম মিশিগানের মাটিতে । আর সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটিবারের জন্যেও আমার মনে হয়নি , মৃত্তিকার সাথে আমার পরিচয়টা কেবলই একটা কোইন্সিডেন্স হতে পারে । যে পাহাড় আর নদীটি খুব পরিচিত এক অতীত থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে গিয়েছে , মৃত্তিকার জন্য আমার এই ভালবাসাটা হয়ত তাদেরই উদ্দেশ্য ছিল ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপ পার করে উচ্চশিক্ষার কারনে আমি দেশছাড়া হয়েছিলাম অনেকদিন আগেই । ওহাইওতে যখন পড়াশোনা করেছি , তখন ঘুম আটকে রেখে ক্লাস করার যন্ত্রণাটাকে রোজ বাসায় ফিরে রান্না করার চাইতেও বেশি ঝামেলার বলে মনে হত । আমার সমবয়সী বাকি যে কয়জন এশিয়ানের সাথে আমি টুকটাক কথাবার্তা চালাতাম, তারা প্রত্যেকেই রাতের সময়টা কাটাতো পরিবারের সাথে স্কাইপিং করে । কিন্তু ব্রোকেন ফ্যামিলির একজন নগন্য সদস্যকে তার দূরে দূরে থাকা বাবা-মা মাসে একবার যদিও ফেসবুকে নক দিয়ে “কেমন আছি” জিজ্ঞেস করার সময় পান , কিন্তু স্কাইপিতে ডেইলি চেহারা দেখানোর সময়টা ম্যানেজ করতে পারেন না কোনভাবেই । তাই অফটাইমটা আমি কাটিয়ে দিতাম ফেসবুকে । হোমেপেজে যখন কাছের বন্ধুদের নতুন জীবনে প্রবেশসংক্রান্ত ছবিগুলো দেখতে পেতাম , তখনও আমার মনে হয়নি – খুব বেশি ভালবাসতে পারব এরকম একজন মানুষকে আমি সত্যিই কখনো খুঁজে পাব । তাই একদিন একদিন করে বাঁচার সেই জীবনটায় আমি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে । কখনো ভাবতেই পারিনি , এই ছকে বাঁধা অভ্যাসগুলো থেকে বেরিয়ে এসে অজানা কোন একজনের ওপর আমার ভাল থাকার বিষয়টা নির্ভর করতে পারে ।
মিশিগানে আমার চেয়ে বয়সে বছর দশেক বড় একজন কাজিন থাকতেন অনেকদিন ধরে । তাই এখানে আসবার আগে তার সাথেই যোগাযোগ করি আমি । আমার আসার কথা শুনে শওকত ভাই প্রচন্ড খুশি হয়ে জানালেন , এয়ারপোর্টে তিনিই আমাকে রিসিভ করবেন আর থাকা-খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে আমি যেন কোন চিন্তা না করি ।
কিন্তু এয়ারপোর্টে নামবার পর আমি জানতে পারলাম , শওকত ভাই মিশিগানে নেই – তার শাশুড়ির অসুস্থতার কারনে আগের দিনই ইন্ডিয়ানার দিকে দৌড় দিয়েছেন । তবে নিজে না থাকলেও তিনি তার পরিচিত একজনকে অবশ্যই বলে দেবেন আমাকে কয়েকদিন হেল্প করবার জন্যে ।
আমি জানতাম , শওকত ভাই ঠিক ম্যানেজ করতে পারবে , কিন্তু তাই বলে এতক্ষন বসে থাকবার ধৈর্য আমার ছিল না । খিদে পেয়েছিল ভীষণ , তাই দুইবার না ভেবেই কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম । খেতে খেতে আশেপাশে তাকাতেই হুট করে একটা মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল আমার । সেদিন থেকে আমার সেই আটকে থাকা নির্বোধ চোখদুটো আজও কোন পথ খুঁজে পায়নি ।
মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম ,সে আমাদের উপমহাদেশের মেয়ে , বাঙালি অথবা ইন্ডিয়ান যেকোনটাই হতে পারে - কিন্তু এর জন্য যে তার দিকে আমার চোখ গিয়েছিল ব্যাপারটি কিন্তু সেরকম না । হালকা নীলচে আলোতে বিয়ারের গ্লাস সামনে নিয়ে বসে থাকা ছিপছিপে শরীরের মেয়েটিকে কেমন যেন অপার্থিব লাগছিল দেখতে । উইন্ডো গ্লাসের আড়াল থেকে সে বড়বড় চোখে তাকিয়েছিল সন্ধ্যার কালচে আকাশের দিকে । সন্ধ্যার আবছায়াতে তার বিষণ্ণতা ঠিক এতটাই বিমূর্ত সৌন্দর্য হয়ে ফুটে উঠছিল যে, আমি তার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই ।
বিষণ্ণ মেয়েটি একটু পর পর তার বিয়ারে চুমুক দিচ্ছিল – প্রতিবার চুমুকের সাথে সাথে কুচকে উঠছিল তার চোখ , কিন্তু তবুও সে থামছিল না । খানিকক্ষণ পর দেখলাম , মেয়েটা টেবিল থেকে চশমাটা চোখে লাগিয়ে আরেকটা বিয়ারের ক্যান কিনে আনল , তারপর তার নেভিব্লু রঙা জ্যাকেটের কলারে কান ঢাকতে ঢাকতে বেরিয়ে গেল চারদিক স্তব্ধ করে দিয়ে । সে বেরিয়ে যাবার পর আমি হঠাত করে লক্ষ করলাম , তার অপার্থিব মায়াতে ডুবতে ডুবতে আমি যেন আমার সারাদিনের খিদেকেই ভুলতে বসেছি । আর তখন থেকে বারবার শুধু এটাই মনে হচ্ছিল, এই রহস্যময় নারীর দেখা আমি আর কখনো পাব কি ?
খাওয়া শেষ করে বের হতে হতেই শওকত ভাইয়ের ফোন পেলাম আমি – জানতে পারলাম , তার পরিচিত একজন স্টুডেন্টকে তিনি ম্যানেজ করেছেন যে কিনা আমাকে হেল্প করতে পারবে ; তাই আমি যেন এয়ারপোর্টের কাছাকাছিই থাকি । আমি কোনমতে হা হু করে ফোন রাখলাম । সারাদিনের স্ট্রেসে আমি তখন ভয়াবহ টায়ার্ড - তার উপর সেই অচেনা মেয়েটির ডিপ্রেসড বিউটির কথাও মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই । সব মিলিয়ে পুরোপুরি বিদ্ধস্ত অবস্থা নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম গা এলিয়ে দেবার মত নরম একটি বিছানার জন্যে ।
প্রিয় পাঠক, শওকত ভাই সেদিন তার যে স্টুডেন্টটিকে আমার হেল্পের জন্য পাঠিয়েছিলেন , তাকে কিন্তু এক দেখাতেই আমি চিনতে পেরেছিলাম । নেভিব্লু হুডির আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকা তার সেই বিশাল দুটি চোখ দেখে আমার অপরিনত মন ঠিক সেই মুহূর্তে কোন বিষণ্ণ পরিনতির কথা ভাবতে পারেনি । বলা যায়, সেদিন রাতেই আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল - সন্ধ্যাবেলায় দেখা অচেনা সেই ডিপ্রেসড বিউটির জীবনের সাথে জড়িয়ে ।
প্রথমটায় আনন্দের সাথেসাথে আমি যে খানিকটা অবাক হইনি তা কিন্তু না , শওকত ভাই কি ভেবে একটা মেয়ের কাছে আমার শেল্টারের ব্যবস্থা করতে গেলেন - চিন্তিত আমি কেবল সেটাই ভাবছিলাম । বাইরের প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে মেয়েটাকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব সেই সাহসও পাচ্ছিলাম না । তাছাড়া আর কিই বা জানতে চাইব , ওয়েটিং রুমে আমার দিকে গডগড করে হেঁটে এসে সে তো শুরুতেই বলে দিয়েছে , “ হ্যালো , ইটজ মৃত্তিকা । আপনি নির্বাণ , রাইট ? শওকত স্যার আমাকে আসতে বলেছেন । আমার বাসার বেজমেন্ট খালি আছে , আপনার প্রব্লেম হবেনা, আই হোপ ।” এইটুকু বলেই সে এমন একটা লুক দিয়েছিল, যার মানে ছিল অনেকটা এরকম – “এই মুহূর্তে এই পিনিকের ওয়েটিং রুম থেকে উঠে আসলে আসেন , নাইলে থাকেন !” তাই এরকম লুকের সামনে পড়ে আমিও কোনরকম উচ্চবাচ্য না করেই ওর গাড়িতে গিয়ে বসেছিলাম ।
সাঁই করে গাড়ি ছুটিয়ে মৃত্তিকা যেখানে তার গাড়ি এনে থামাল , বাইরে থেকেই তাকিয়ে দেখি সেটা এক বিশাল বাড়ি । বিশাল মানে - একটা মেয়ের একা থাকার জন্য বেশ ভয়াবহ রকমের বড় । আমি ভয়ে ভয়ে হুডির নিচ থেকে চোখ বাড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম । কে জানে , ডাইনি চর্চা করে না তো আবার ? নিজের মায়ায় জড়িয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছে ভ্যানিশ করে দেবার জন্যে – হতেও তো পারে !
কিন্তু জাদুর ধার না টেনেই মেয়েটা আমার হাতে বেজমেন্টের চাবি ধরিয়ে দেখিয়ে দিল কোনদিকে যেতে হবে । আমি বারান্দায় আমার লাগেজটা রেখে পুরো বাড়িটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি । ডাইনি বাড়ি হোক আর যাই হোক , লোকেশানটা ছিল ভীষণ চমৎকার , বারান্দার আলোয় দাঁড়িয়ে যতটুকু বুঝলাম – মিনিট দশেক হাঁটলেই পাহাড়- টাহাড় খুঁজে পাওয়া যাবে । অবশ্য এই ভরা ডিসেম্বরে পাহাড় খুঁজতে যাওয়াটা আমার সাথে ঠিক আসেনা । আমার মত অলস মানুষরা যে সময় কাটাতে কম্বলের উষ্ণতাকেই বেছে নেবে, এতে আর অবাক হবার কি আছে ?
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে যেভাবে লম্বা একটা ঘুম দেবার প্ল্যান করেছিলাম আমি , তার সবটাই ভেস্তে দিয়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল পরদিন খুব ভোরে । তাই অভারঅলটা গায়ে জড়িয়েই বেড়িয়ে পড়লাম আশপাশটা দেখার জন্য । সেই ভয়াবহ রকমের বিশাল বাড়িটার একমাত্র বাসিন্দা যে মৃত্তিকা নিজেই , সেটা তখনই আন্দাজ করতে পারলাম । অবশ্য শহর থেকে দূরে এই জায়গায় আর কোন মানুষ না আসতে চাইলে তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায়না । মেয়েটার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি !
মৃত্তিকার সাথে আমার পরিচয়টা এরকম অনাকাংখিতভাবে হয়ে যাওয়ার কারনে আমি মনেমনে মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে হাওয়ায় ভাসছিলাম । কিন্তু তার দুদিন পরেই আমি বুঝতে পারি , আমি যেমনটা ভাবছি – বাস্তবতা আসলে ঠিক তেমনটা না । মৃত্তিকা মেয়েটি ভীষণ রকম চুপচাপ একটা মেয়ে । আমি নিজে খুব কথা বলতে পছন্দ করি বলে চিরকাল ভেবে এসেছিলাম আমার পাশের মেয়েটিও আমার মতই বকবক করুক । কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম , মৃত্তিকা যে আসলে শুধু কম কথা বলে তাই ই না , কোন প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছে না করলে সে একটা ব্ল্যাংক লুকে তাকিয়ে থাকে । এসব দেখে ভয়ে ভয়ে তার উপর আমার ক্রাশ আমি প্রায় প্রত্যাহারই করে নিচ্ছিলাম যদি না তার সেই ব্ল্যাংক লুক আমাকে এক সমুদ্র নীরবতার প্রেমে ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দিত ।
মৃত্তিকা আটলান্টিক পার হয়ে ভিনদেশের মাটিতে এসেছিল গ্রাজুয়েশানের পর , কিন্তু আমার থেকে ক্লিয়ারকাট চার বছরের জুনিয়র এই মেয়েটির হাবভাব দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে সে মাত্র দেড় বছর ধরে এখানে থাকে । আগা মাথা কিছু না ভেবে একদিন জানতেই চেয়েছিলাম , “ একা থাকতে খারাপ লাগে না ?” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করবার সময় মেয়েটা তার ঘুম ভাঙ্গা চেহারায় নির্মমভাবে একটা গাজর চিবাচ্ছিল – কিন্তু আমার কথা শুনে গাজর চিবানো বন্ধ করে কিছুক্ষন সেই ব্ল্যাংক লুক দেয়া ছাড়া সে আর কিছুই বলেনি !
টিনটিনে খাপ খোলা তলোয়াড়ের মত ধারালো মেয়েটা ভার্সিটিতে পড়াশোনার বাইরে একটা জায়গায় পার্ট টাইম জব করত – তিনদিনে সে আমার একবেলার খাবার খেতে পারে কিনা সেই ব্যাপারে আমার অনেকখানি সন্দেহ থাকলেও ব্যাংকিং, গ্রোসারি , টুকটাক রান্না সবই সে কোনরকম জড়তা ছাড়াই ম্যানেজ করে ফেলত । এতদিনের প্রবাসী জীবনে এক রান্নাই যে আমাকে সবদিকে ফেইল মেরে দিয়েছে , তার কাছে মৃত্তিকাকে অতিমানবী লাগাটা খুবই স্বাভাবিক ।
মৃত্তিকার বাড়িতে আমি মাস খানেকের মত ছিলাম । আমি কখনো ভাবিনি , এরকম আনন্দে উড়ে বেড়ানোর মত একটা বয়সে মৃত্তিকার মত কোন মেয়ে নিজের মাঝে ভীষণ গভীর কোন কষ্টকে চেপে রেখে বাঁচতে পারে । অবশ্য এরকম নিঃসঙ্গ জীবন যে সে খুব হাসিখুশিমনে গ্রহন করেছে – সেটা আমার কখনোই মনে হয়নি । তার ঘরে একদিন মেইল রেখে আসতে যাবার সময় দেখি, সে খুব শান্ত মুখে তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে – স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে সে কি দেখছিল বলতে পারিনা , কিন্তু তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল । শুনতে হয়ত অদ্ভুত লাগবে , কিন্তু আমি তার ঘরের দরজার সামনে অবারিত মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেক্ষন । চেপে রাখা দুঃখ যে কোনদিন কারো সৌন্দর্য হয়ে ধরা দিতে পারে , সেদিনই আমি যেন প্রথম সেটা আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম ।
আমি অনেকদিন নিজের মনকে স্থির করবার জন্যেই মৃত্তিকার সাথে কথা বলতে গিয়েছি । কিন্তু যতদিনই নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ না করার চেষ্টা করেছি ততদিনই সে ঠিক চোর ধরে ফেলবার মত করে বলেছে , “ দেখুন নির্বাণ, আমি যদি একদম ভুল না হয়ে থাকি , তাহলে ইদানিং আপনাকে দেখে আমি যা বুঝতে পারছি – আপনি আমার ব্যাপারে একইসাথে ভীষণরকম মুগ্ধ এবং আগ্রহী হয়ে আছেন । এই নিয়ে আমি ভুল হলেই খুশি । কিন্তু যদি আমি ভুল না হয়ে থাকি , যদি আপনার অবস্থা সত্যি এমনই হয় তাহলে অনুগ্রহ করে বলছি , আমার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন ।”
আমি দূরে থাকতে পারিনি । নিজের অজান্তেই আমি তার পথ ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছি । খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে বাইরে আসার পর মাঝেমাঝেই আমি তাকে পাহাড়ের রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে দেখেছি । প্রচন্ড তুষারের মাঝে তাকে হাইওয়ের সামনে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি । রেগুলার ড্রিংক করে চুপচাপ বাড়ি ফেরা বিষণ্ণতায় অসুস্থ মেয়েটাকে সাহায্য করতে চেয়েছি – কিন্তু প্রত্যেকবার সে হাত সরিয়ে নিয়েছে অবহেলায় । তবুও তাকে দূর থেকে দেখে রাখার মাঝেই আমার এক পৃথিবী আনন্দ ছিল । মেয়েটাকে সামনাসামনি দেখতে পেলে আমি বুঝতে পারতাম , তার চোখ-মুখ- আঙ্গুলে কি ভীষণ না পাওয়ার গল্পরা কথা বলে যায় । তার সেই গল্পের হাতছানিতে আমার দিশেহারা অবস্থাটা দিন দিন যেন কেমন করে বাড়তে থাকে । আমি তাকে চিনিনা – জানিনা, তার কষ্টগুলো আমার অজানা, তবুও কেন যেন আমার মনে হতে থাকে , আমি বুঝি আমার সবটুকু অনুভূতি নিয়ে সারাজীবন তার পাশে থাকবার ক্ষমতা রাখি !
আমি আবিষ্কার করলাম , ভালবাসা শব্দটা আগে আমার কাছে যেমন বানান করে লেখা তুচ্ছ একটা শব্দ ছিল – মৃত্তিকা নিজের অজান্তেই আমাকে সেই শব্দটা অনুভব করতে শিখিয়েছে ।
খুব সাহস করে মৃত্তিকাকে আমার এই আবিষ্কারের কথাও বলেছিলাম – কিন্তু সেদিন আর কোন শান্ত জবাব পাই নি । প্রথমবারের মত আমাকে তুমি সম্বোধন করে সে বলেছিল ,
“ সাবধান নির্বাণ , আমাকে মিথ্যে বলবে না !”
আমি ওর সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম , “ একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে ভালবাসবার অধিকার আমার আছে , মৃত্তিকা । আমি তোমার কাছে আমার অনুভূতির কোন মুল্যায়ন চাইনি । ”
মৃত্তিকা কোন উত্তর দিতে পারেনি , শুধু চোখটা সরিয়ে নিয়েছিল । আমি যখন চলে আসতে নিলাম , তখন সে ক্ষীণ গলায় আমাকে ডেকে বলল , “ যেও না , নির্বাণ । তোমার অধিকার বোধ হয় আমার দুঃখগুলোকে জানবার অধিকার রাখে ।”
মৃত্তিকা সেদিন আমার হাত ধরে আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গিয়েছিল । ওর টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বলেছিল ,
“ দেখ নির্বাণ – আমার ল্যাপটপের ওয়ালপেপারটা দেখ ।”
আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম, মৃত্তিকা ভালবেসে আঘাত পাওয়া মানুষদের একজন – কিন্তু এতটা আঘাত পাওয়া , সেটা ভাবতে পারিনি । ওর ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে একটা বিয়ের ছবি ছিল । আমি ছেলেটাকে চিনি না , কিন্তু ভাল করে তাকিয়ে মেয়েটাকেও চিনতে পারলাম না ।
“ so this is the one who belongs to your love , হুম ?”
মৃত্তিকা হেসে ফেলেছিল , “ একটা চিহ্ন বলতে পারো । এভাবে আমার পাশে একজন থাকবে বলে কথা দিয়েছিল । আমি হয়ত যোগ্য ছিলাম না , কিন্তু ভালবাসতে তো আর যোগ্যতা লাগেনা । ও আমার থাকে নি । আমাকে দেখানো স্বপ্নগুলোর অধিকার ত্যাগ করে ও চলে গিয়েছে , অন্য একজনকে নিয়ে বাঁচতে শিখেছে । কোন সমস্যা নেই আমার । তোমার মত করেই বলি , আমি ওর কাছে আমার অনুভূতির মূল্যায়ন চাইনি !”
-“ কিন্তু সে তো তোমাকে কথা দিয়েছিল ।”
মৃত্তিকার চশমার কাঁচে তখন জানলা গলে শেষ বিকেলের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল । সে ওইদিকেই তাকিয়ে বলল ,
“ এজন্যই এই ছবিটা আমার ওয়ালে । আমি তো খুব পরাজিত একটা মানুষ - সবখান থেকে পালিয়ে বেড়াই , তাই মাঝে মাঝে একা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলি । তখন এই ছবিটা আমাকে রিচার্জ করে । জানো , এই আড়াইটা বছরে আমি প্রতিদিন এই ছবিটা দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছি । বারবার নিজেকে বলেছি , এই পৃথিবীতে সবটুকু কাঁদবার জন্য আমিই একজন না , আমি পারিনি ! ”
আমি প্রচন্ড বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি , অসহায় মেয়েটার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে – অথচ কথা বলার সময় তার একটুও গলা কাঁপছে না ।
আমি ভেবেছিলাম , মৃত্তিকার মৃত হৃদয়টাতে আবার হয়ত প্রান জাগিয়ে তুলতে পারব । কিন্তু দিনে দিনে বুঝতে পারলাম , যে অস্তিত্ব স্বেচ্ছায় মরে গেছে , তাকে বাচানো যায়না । তবুও একদিন বললাম , “ একবার কি চেষ্টা করা যায় মৃত্তিকা ?”
মেয়েটা নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলেছিল, "কখনো জানতে চেয়োনা , কেন পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন মনের মানুষগুলো ভেতরে ভেতরে ভীষণরকম অসহায় হয়ে বেঁচে থাকে আজীবন । ঠিকানাহীন ট্রেনের অপরাধী যাত্রীদের কখনো ঠিকানার লোভ দেখিয়োনা । তারা কুয়াশার মাঝে নিজেকে আড়াল করে রাখতে রাখতে একদিন ঠিক মিলিয়ে যাবে ঝরাপাতার মত । চলে যাও, নির্বাণ; পারলে ভুলে যাও আমাকে - অথবা মনে রেখোনা ,আমি কখনো ছিলাম কিংবা আমি এখনো আছি ।"
আমি একরাশ ভালবাসা নিয়ে মৃত্তিকার জলস্নাত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি । আমি কি এই মেয়েটিকে কখনো বোঝাতে পারব, ঠিকানাহীন যাত্রীরা কখনো কখনো অন্যের স্থায়ী ঠিকানাকে ভুলিয়ে দেয় ? আমি আমার ঠিকানাকেই ভুলে গেছি , আমারতো আর ভুলে যাবার কিচ্ছু নেই ।
আগেই বলেছি , মৃত্তিকা আমাকে ভালবাসুক কিংবা না বাসুক তাতে কোনরকম লাভ ক্ষতির হিসেব থেকে আমি নিজেই নিজেকে মুক্তি দিয়েছিলাম । আমি শুধু চাইতাম ওর কষ্টগুলোর ভাগ নিতে । কিন্তু যে মানুষটির জন্য মৃত্তিকার বুকের ভেতরটায় এক জীবন অভিমান লুকিয়েছিল , একদিন হঠাত করেই সেই মানুষটি তার কাছে ফিরে এল । সে বোধ হয় জানত না - অতীতের মৃত্তিকাকে ভুলতে না পারার ব্যর্থতা তাকে ফিরিয়ে এনেছিল এমন এক মৃত্তিকার কাছে , যে মেয়েটি কিনা নিজের জীবন থেকে সবটুকু ভালবাসার প্রয়োজনীয়তাকে উৎসর্গ করেছিল বিনা অপরাধে । তবুও নিজের অপরাধের জন্য যতভাবে ক্ষমা চাওয়া যায় , তার সব চেষ্টাই ছেলেটি করেছিল । কিন্তু মৃত্তিকার চোখের মাঝে যে ভয়াবহ শুন্যতা আমি দেখতে পেতাম, কেন যেন তার কোন পরিবর্তন হল না । আমি আমার বুকের ভেতর চলতে থাকা ভয়ংকর অস্থিরতাকে কোনভাবে চেপে রেখে বললাম ,
“ মৃত্তিকা , ফিরে যাবে না ?”
মৃত্তিকা কোন উত্তর দেয়নি । চুপচাপ উঠে চলে গিয়েছিল ।
সেদিনের পর থেকে মৃত্তিকার সাথে আমার আর কখনো দেখা হল না । আমি বুঝে নিয়েছিলাম , সে তার ভালবাসার কাছে ফিরে গিয়েছে ।
মৃত্তিকা চলে যাবার পর আমি আবার আমার নিজের চিরাচরিত জীবনে ফিরে আসবার চেষ্টা চালালাম । কিন্তু আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম , মেয়েটিকে হারিয়ে ফেললে আমি ঠিক যতটুকু কষ্ট পাব বলে ভেবেছিলাম , আমার কষ্টটা তার তুলনায় অনেকখানি বেশি । আমি সর্বহারার মত আমার পুরনো আমাকে খুজতে গিয়ে দেখি , সেখানে মৃত্তিকার ছায়া ছাড়া আর কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই ।
সময় চলতে লাগল পুরনো নিয়মে । আর মৃত্তিকা ফিরে এল ঠিক তিন বছর পর এক বসন্তে । আমার বাসার বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শেষ বিকেলের মেয়েটাকে দেখে আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল , আমার চারপাশের সময়টা বুঝি থেমে গিয়েছে - প্রচন্ড কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার তিনটি বছর আমার জীবনে যেন কখনই আসেনি !
আমিই প্রথমে নীরবতা ভেঙ্গে দিলাম , “ মৃত্তিকা , তুমি কি এখনো কলম্বিয়ান কফি পছন্দ করো ?”
মৃত্তিকা বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বলল , “ নির্বাণ , এতদিন পরেও তুমি একটুও বদলাও নি কেন ?”
অতঃপর মৃত্তিকার পাশে বসে মন খারাপ করা একটা রাতে আমার অরোরার জন্য অপেক্ষা করা । কোন একটা কারনে আমার মন খারাপ করতেই ভীষণ ভাল লাগছিল । আমার পছন্দের এই পাহাড়ে আমি যে কখনো মৃত্তিকার সাথে বসে থাকবার সুযোগ পাব – এটা বোধ হয় আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি ।
মৃত্তিকার চোখ থেকে টুপ টাপ করে পানি পড়ছে । আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম ,
“ মেয়ে , তুমি কি চাও ? ধুপ করে হারিয়ে গেলে – আমি ধরে নিলাম , সুখী হয়েছ । তারপর আবার ফিরে এলে - আর এখন ফিরে আসার পর কাদছো ? কেন মৃত্তিকা ?”
- “ নির্বাণ , আমি তো ওর কাছে ফিরে যাইনি ।”
- “ কোথায় গিয়েছিলে তাহলে ?”
- “ হারাতে চেয়েছিলাম । আবার কারো মায়ায় জড়াতে ভয় হচ্ছিল ।”
আমি এতদিনের চেপে রাখা ক্ষোভকে ভাষা দিয়ে বললাম , “ মিথ্যেবাদী ! তুমি মিথ্যেবাদী !”
-“ কেন বলছো ? আমি তোমাকে অপেক্ষায় তো রাখিনি ?”
- “ কিন্তু আমি থেকেছি ! তুমিও তো কাউকে ভালবেসেছো মৃত্তিকা , অপেক্ষায় কেন থাকতে হয় তুমি বোঝোনা ?”
মৃত্তিকা তার বর্ষা নামা চোখে অপলক তাকিয়ে বলল ,
“ আমি বারবার বলেছি এভাবে ভালবেসো না , আমি বাসতে পারিনা ।”
আমি হেসে ফেললাম ,
- “একটা পাখি , তিনটা পাখি আর দুইটা পাখিকে বুকের মাঝে আটকে রেখে যে ভালবাসার গল্পগুলো শুরু হয় , সেই পাখিগুলোকে আমি তো শুরুতেই উড়িয়ে দিয়েছি , মৃত্তিকা । তারা ইচ্ছেমত উড়েছে , ইচ্ছেমত উড়তে গিয়ে তোমার চোখে পড়ার আগেই হারিয়েও গিয়েছে । কিন্তু আমি অবাক হয়ে কি আবিষ্কার করেছি জানো ? তোমার জন্য আমার অনুভুতিগুলো ঠিক পাখি ওড়ানো ভালবাসার ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়না কিছুতেই । তোমাকে ভালবাসাটা আমার জন্য একটা অভ্যাস , ঠিক যে অভ্যাসের কারনে আমরা ঘুমিয়ে থেকেও নিঃশ্বাস নেই , তুমি আমার সেই অভ্যাস । আর তাই তুমি আমার থাকো কিংবা নাই থাকো , আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা - বিশ্বাস করো, একদম কিচ্ছু না !”
মৃত্তিকা তার শীতল চোখের দৃষ্টিতে আমার হৃদয়ে তুষারপাত নামাতে নামাতে বলল , " আমাকে ভালবাসাটা যদি তোমার জন্য নিঃশ্বাস নেয়া হয় - তবে সেই নিঃশ্বাস তুমি নিয়োনা, নির্বাণ । তুমি জানোনা , আমি কি ভীষণ রকম বিষাক্ত ! "
আমি একবার মুখ খোলার চেষ্টা করতেই চুপ হয়ে যাই, এই মেয়েটিকে আমি এখন কেমন করে বোঝাই - নির্বাণ নামের ছেলেটা আর বিষাক্ত বাতাস ছাড়া শ্বাস নিতে পারেনা !
তারপর আমাদের মাথার উপর একটু একটু করে একটা ভোর নেমে আসে । আমার পাশ ছুয়ে যাওয়া মৃত্তিকার চুলের ঘ্রানে আমি বুঝতে পারি , এই মেয়েটি আমাকে তার কান্নাকে স্পর্শ করার অধিকারটুকু দিয়েছে ।
হয়ত এই অধিকারটুকু নিয়েই আমি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব ।
-
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ