ডাকিনী
সানজিদা সুলতানা সুমা
২য় পর্ব
মার্টিনির জন্যে আমার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। স্রষ্টাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হতে লাগলো আমার কাছে। এভাবে পুতুলের মতো একটা মেয়েকে অকালে এভাবে নিয়ে গেল কেন? কি দোষ ছিলো তার? একজন বা কয়েকজনের প্রাণ নিলে সে খুনি। কিন্তু একে একে যে সবার প্রাণ যে হরণ করে সেই ঈশ্বর। জগতের কি অমোঘ লীলা! পরের পৃষ্টায় গেলাম,
আলেস লিখেছে,
"কাল রাতে একটুও ঘুমুতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই মার্টিনীর চেহারাটা ভেসে উঠছে! জানি আজ রাতে ওর মৃতদেহটাকে শুদ্ধিকরণের নামে প্রিস্ট ভোগ উৎসবে মেতে উঠবে। আমি যেন ওর আত্মার আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। গীর্জার ঐ উপরের তলায় সে সাহায্যের জন্যে হাহাকার করছে। ওর অতৃপ্ত আত্মাটা হয়তো অসহায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে, নিজের প্রাণহীন দেহটাকে কিভাবে ঐ জানোয়ারটা খুবলে খুবলে খাচ্ছে! ছিঃ। কোন মানুষ তার স্বজাতির মৃতদেহের এমন অমর্যাদা করতে পারে তা আমার জানা ছিলো নাহ। তাও আবার ঈশ্বর গৃহ গীর্জার ভেতরে বসে! হে ঈশ্বর তোমার গজব দিয়ে এই নষ্ট গীর্জাকে ধ্বংস করে দাও। এই শয়তানের আখড়া পুড়িয়ে ছাই করে ফেলো! প্রতিদিনকার মতো আজ সকালেও ওরা খাবার দিয়ে গেছে। চারটে রুটি। কিন্তু আজ আমি কার সাথে ভাগ করে খাব? মার্টিনী তো চলে গেছে। তাই খাবারের পুটলিটা আমি সেলের ফাঁক গলে ওদের উপর ছুড়ে ফেলে দিলাম। আর চিৎকার করে বললাম, তোদের খাবার তোরাই খা। শুধু আমার মার্টিনীকে ফিরিয়ে দে। এক শয়তান রক্ষী ভেঙ্গচি কেটে বলল, "ঐ ডাইনিকে নরকে পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই তোকেও সেখানে পাঠানো হবে।" যদিও আমি খুন না করেও খুনের দায়ে দোষী তবুও জীবনে কখনোই আমার মনে কারো প্রাণনাশের স্পৃহা জাগেনি। কিন্তু আজ প্রচন্ড ইচ্ছা করছিলো ঐ রক্ষীকে মেরে নরকে পাঠিয়ে দেই। একরাশ থুথু ওর মুখে ছিটিয়ে দিলাম। শয়তানটা অপর রক্ষীর হাত থেকে চাবুক নিয়ে আমার সেলে ঢুকে আমাকে খুব পিটালো। নিয়মিত চাবুক খেতে খেতে আমার পিটে পূঁজ হয়ে গেছে। ও যখন এই ক্ষত বিক্ষত পিঠে আবার মারলো তখন মনে হলো প্রতিটা চাবুক যেন পিঠ ভেদ করে হৃদপিন্ডে আঘাত করছে। খুব বেশীক্ষণ এ আঘাত সহ্য করতে হয়নি আমায়। দুচারটা চাবুক খাবার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সেলে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করলাম। একাকীত্ব আর শূন্যতা পুরো হৃদয়কে গ্রাস করলো। এই একাকীত্ব থেকে বাঁচতেই বাইবেলটা নিয়ে লিখতে বসলাম।"
এ পৃষ্ঠাটা পড়ে চোখ বন্ধ করতেই যেন আলেসের ক্ষত বিক্ষত পিঠটা দেখতে পেলাম। ওহ! এই সাহসী মেয়েটা এতকিছু সহ্য করতে পেরেছে শুধু মার্টিনীর অপমান ছাড়া। তাই রক্ষীটা যখন মার্টিনীকে নরকে পাঠানোর কথা বলে তখনই সে সাপের মতো ফুসে উঠেছে। নির্যাতন নিশ্চিত যেনেও এর প্রতিবাদ করেছে! শুধু অনুভব করলাম জেলের অন্ধপ্রকোষ্টে এই দুই নারীর প্রেম অবলীলায় লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদের মত প্রেমগাথাঁকে ম্লান করে দেবার যোগ্যতা রাখে।
পরের পৃষ্টায়,
"সেদিনের ঘটনার পর থেকে আজ দুদিন হয়ে গেল, ওরা আমাকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর সপ্তাহ খানেক আগের সেই নোংরা শুদ্ধিকরণের পর থেকেই ওরা আমাকে নগ্ন করে রেখেছে। ধীরে ধীরে গ্রীষ্ম এগিয়ে আসছে বলে ঠান্ডা থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছি। কিন্তু পিপাসায় বোধ শক্তি ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করেছে। গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি মার্টিনীকে আমার সেলের ভেতর ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছে। ওর ঘাড় ভেঙ্গে ধড়টা বেকায়দা ভাবে ঝুলছে। মৃত্যু যন্ত্রনায় সুন্দর মুখটা হা হয়ে জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। ওর খোলা মুখ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে আর আমি তৃষ্ণার তাড়নায় মেঝে থেকে সে রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছি। উহঃ। কি বীভৎস স্বপ্ন। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি অনেক ক্ষণ কেঁদেছিলাম। কিন্তু তৃষ্ণায় সবটুকু পানিই শুকিয়ে গেছে। চোখ থেকে বেরুনোর মত আর কোন পানি অবশিষ্ট ছিলো না। দুপুরের দিকে তৃষ্ণার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে অঞ্জলি ভরে নিজের মুত্র পান করেছি। হলুদ বিস্বাদ তরলটা যেন আমার পিপাসাটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বুঝতে পারছি, তাড়াতাড়ি খাবার -পানি না পেলে আজ রাতই আমার জীবনের শেষ রাত। তাই শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে এখন লিখতেছি। জীবনের শেষ অক্ষরমালা। জীবনের শেষ শব্দ, মার্টিনী।......
"পৃষ্ঠাটি পড়ার পর মনে হয়েছিল আলেস তবে এভাবেই ধুকেধুকে মরেছিল! আজ পোল্যান্ডে প্রতি বছর ৬০ হাজার টন মেয়াদউত্তীর্ণ খাদ্য ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এদেশেরই একটা অকুতোভয় কন্যা একসময় খাবারের অভাবে ধুকেধুকে মরতে হয়েছিলো। নিজের দেশের(বাংলাদেশ) দিকে তাকিয়ে দুঃখ হল। সেই অজ্ঞতা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন পোল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ নুয়ে পড়ার পরেও আজ উন্নতির শীর্ষে। কিন্তু আমার সুজলা সুফলা শস্য শামলা বাংলাদেশ আজো তৃতীয়বিশ্বের ক্ষুদা আর দারিদ্র পীড়িতদের কাঁতারে। যাহোক, ক্ষানিকের জন্যে আমি ভেবেছিলাম আলেসের মৃত। কিন্তু পৃষ্ঠা উল্টাতেই আবারো আলেসের লেখা বেড়িয়ে পড়লো।
"আজ সন্ধ্যায় এক রক্ষী দুটো ভূট্টা আর এক মশক পানি নিয়ে এসেছিল। আমি ওর কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে খাবার নেইনি। কেন জানি মনে হল সেই হয়তো আমার মার্টিনীকে খুন করেছে। হয়তো ওর হাতে এখনো মৃত মার্টিনীর রক্ত লেগে আছে। গত রাতের স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। ওর হাত থেকে খাবার নেওয়াটা আমার কাছে সেই স্বপ্নে দেখা মার্টিনীর ঝুলন্ত লাশ থেকে ঝরা রক্ত খাবার মতোই নিকৃষ্ট মনে হলো। আমি শুয়ে থাকলাম। ও কিছুক্ষণ খাবার হাতে দাড়িয়ে থাকল। যখন দেখলো আমি উঠে ওর কাছ থেকে খাবার নিচ্ছি নাহ তখন সে মশক আর ভূট্টা দুটো আমার সেলের ভেতর ছুড়ে ফেলে চলে গেল। মাটিতে পড়ে মশক ফেটে মেঝেতে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি আর সহ্য করতে পারলাম নাহ। সে পানির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মেঝে থেকে সবটুকু পানি চুষে খেলাম। আহ পানি.....।
ঈশ্বরের এক মহিমান্বিত উপহার। পানিটুকু খাওয়ার পর আমি ভূট্টা দুটো কুড়িয়ে খেতে লাগলাম। পানির অভাবে আমার গলাটা এতটাই শুকিয়ে গেছিলো যে ভূট্টার দানাগুলি বারবার আটকে যাচ্ছিলো। খাবার সময় গলায় প্রচন্ড জ্বালাপোড়া হচ্ছিল, মনে হচ্ছিলো যেন জ্বলন্ত কয়লা খাচ্ছি। কিন্তু তবুও পেটের দায়ে না খেয়ে উপায় ছিলো নাহ। একটা ভূট্টা খাওয়ার পর যখন অপরটিতে কামড় বসালাম তখন মনে পড়লো মার্টিনীর কথা। ও থাকলে হয়তো দুজনে ভাগ করে খেতাম। এতে পেট কম ভরলেই মনটা আনন্দে ভরে যেত। বুকের গহীন থেকে এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। মনেমনে বললাম আমি আর পারছি না প্রভু।এই নৃসংশতা থেকে এবার আমায় মুক্তি দাও। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চল প্রভু। আজ রাতই যেন আমার এই ঘৃন্য জীবনের শেষ রাত হয়। কিন্তু প্রভু যীশু আমার গতরাতের প্রার্থনা অগ্রাহ্য করলেন। আমি বেঁচে রইলাম আরেকটি দুর্বিষহ দিনের অভিজ্ঞতা গ্রহণের জন্যে। "
তার পরের পৃষ্টায় আবার লিখেছে,
" আজ সকালে এক প্রহরীর লাথি খেয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গল। অনাহারক্লিষ্ট দুর্বল শরীর নিয়ে আমি এতটাই গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম যে প্রহরীর হাঁকডাঁকে কোন কাজই হয়নি। বাধ্য হয়েই ওকে কষ্ট করে সেলের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আমাকে জাগাতে হয়েছে। আমাকে লাথি মেরে সে তার এই অতিরিক্ত পরিশ্রমের শোধ নিতে চাইছে। ব্যাথ্যা পেলেও আমি ওকে কিছুই বললাম নাহ। ইদানীং ব্যাথা পেতে পেতে তা মুখবুজে সহ্য করাও শিখে ফেলেছি। শুধু অবাধ্য চোখ দুটো কোন বাধা মানে না। ব্যাথা পেলেই কয়েক ফোঁটা জল ছেড়ে দেয়। প্রহরী আমায় এক প্রস্থ কাপড় দিয়ে বলল তাড়াতাড়ি কাপড় পরে তৈরি হয়ে যেতে। আজ নাকি জনসম্মুখে আমার বিচার করা হবে। কাপড় পড়তে গিয়েও আমার মার্টিনীকে মনে পড়ে গেল। এইতো সেদিন আমরা একটা কাপড়কে দুজনে ভাগ করে পড়েছিলাম। আজ তার অনুপস্থিতিতে এ কাপড়ের মালিক আমি একাই। কিন্তু এই একাকীত্বই আমাকে সবচেয়ে বেশী যন্ত্রনা দিচ্ছে। ক্ষুদা, পিপাসা, চাবুকের আঘাত বা অন্যকোন নির্যাতন নয়। মানুষের স্মৃতির এক আশ্চর্য ত্রুটি হল দুঃখ ভুলে যাওয়া কিন্তু সুখময় দিনগুলি মনে রাখা। মার্টিনীর সাথে সেই সুখময় দিনগুলির স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। মৃত্যু ব্যাতিত এর থেকে মুক্তির আর কোন পথ খুলা নেই। কাপড় পরা মাত্র ওরা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একসময় আমরা একতালা গীর্জার ছাদে পৌছে গেলাম। রক্ষীরা আমাকে একটা ঝুলন্ত কাঠের ফ্রেমের সাথে বেঁধে দিল। পূর্ব দিগন্তে তখন সবে মাত্র গ্রীষ্ম ঝলমলে সূর্যোদয় হয়েছে। তার উষ্ম পরশ আমার ভাঙ্গাচুরা শরীরটাকে রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে। একজন ঘোষক এসে গ্রামবাসীকে গীর্জা প্রাঙ্গণে একত্রিত হওয়ার আহব্বান জানালো। মানুষজন ধীরে ধীরে জমা হতে শুরু করলো। তারপর সম্মান্বিত পাদ্রী গীর্জার ছাদে এসে বসলেন। শুরু হল তিন তিনটে খুনের দায়ে অভিযুক্ত ডাকিনী আলেসের বিচার।"
তার পরের পৃষ্টায়,
" মাননীয় পাদ্রী একে একে আমার উপর আনা সকল অভিযোগ উপস্থিত সবাইকে পড়ে শুনালেন! প্রথম অভিযোগ হল আমি নাকি সরাইখানার একক মালিক হওয়ার আশায় আমার বাবাকে অভিশাপ দিয়ে মেরে ফেলেছি। কি অদ্ভুত অভিযোগ। বাবা বেঁচে থাকতে আমি কখনোই সরাইখানায় যেতাম না। আমার ব্যবসাপাতিতে একটুও আগ্রহ ছিলো নাহ। যে জিনিসে আমার আগ্রহই নেই তার একচ্ছত্র মালিকানার জন্যে আমি আমার জন্মদাতা পিতাকে খুন করব! এটা ভাবা যায়? তাছাড়াও বাবার সম্পত্তি তো তার একমাত্র সন্তান হিসাবে আমার কপালেই জুটতো। তাকে খুন করে ছিনিয়ে নেবার কোন প্রয়োজনই তো ছিলো না। তবুও আমি পিতৃঘাতী। এটাই কি পৃথিবীর ন্যায়বিচারের উদাহরণ?
তার পরের অভিযোগ, আমি নাকি সামান্য কটা স্বর্নমুদ্রা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যে সরাইখানার এক ঘুমন্ত অতীথিকে খুন করেছি! ঐ মদ্যপ বুড়োটার কাছে স্বর্নমুদ্রা থাকলে তো নিবো। সে যা আয় করে সবই আমার সরাইখানায় মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। ওর কাছে স্বর্নমুদ্রা আছে এমনটা ভাবাও পাগলামি। আর যদি ঘুর্ণাক্ষরে দু একটা স্বর্নমুদ্রা থাকতো এবং আমার সেটার প্রয়োজন হতো তো আমি ওকে দু বোতল মদ দিয়েই তা বাগিয়ে নিতে পারতাম। খামাখা ওকে খুন করতে যেতাম কেন?আমার এই অতিসাধারণ যুক্তি তর্ক গুলি বিচারে গ্রহণ করা হলো নাহ। আমাকে ওই মদ্যপটার খুনি হিসাবেই চিহ্নিত করা হলো।
অতপর ওই অভাগা রক্ষীকে হত্যার অভিযোগ উঠলো। এবং যথারীতি সকল যুক্তিতর্কের উর্ধে উঠে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। অতপর প্রিস্ট এসে সর্বসম্মুখে আমার গালে চড় মারলেন। নিচে গীর্জা প্রাঙ্গণে গণজমায়েতের মাঝে ওনেক শিশুও ছিলো। এতো গুলি লোকের সামনে এভাবে অপমানিত হওয়ার লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো। অতঃপর বিচারের রায় ঘোষনা করা হলো। "ডাইনি আলেসকে আগামী রোববার প্রার্থনার পর গীর্জা প্রাঙ্গণে সর্বসম্মুখে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে। " মৃত্যুদণ্ড শব্দটা আমার কানে যেন মধু বর্ষণ করলো। আর মাত্র চারদিন। এর পরেই আমি এই নির্মম পৃথিবী ছেড়ে আমার স্রষ্টার পাণ পাড়ি জমাবো। শাস্তি ঘোষনার পর প্রিস্ট তার হাতের আংটি খুলে তা আগুনে পুড়িয়ে লাল টকটকে করে আমার কপালে ছ্যাঁকা দিলেন। গভীর একটা পোড়া দাগ আংটির উপর মুদ্রিত নকশা সমেত আমার কপালে বসে গেল। এটা সেই চিহ্ন যা দ্বারা একজন ডাইনিকে চিহ্নিত করা হয়। কপালের অসহ্য জ্বালাপোড়া আর মিথ্যা ডাইনি অপবাদের যন্ত্রনায় আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না দেখে উপস্থিত অনেকেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অতপর প্রিস্ট সগর্বে গীর্জার ছাদ থেকে নেমে গেলেন। প্রিস্ট চলে যেতেই উপস্থিত জনতা আমার দিকে বৃষ্টির মত পাথর ছুড়তে লাগলো! যারা পাথর ছুড়ছিল তাদের প্রায় সবাইকেই আমি চিনি। তাদের মধ্যে ছিলো জোসেফ আন্টোনিও, সেই মোখপোড়া চাষি। গতবছর ওর ক্ষেতের ফসল আগাম শীতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ফসল ফলাতে পারেনি বলে সে বউ বাচ্চা নিয়ে শীতে উপোস করে মরতে বসেছিলো। একরাতে সে আমাদের বাসায় এসে কিছু অর্থকড়ি ভিক্ষা চায়। আমার বাবা ওকে সাফ মানা করে দেন। কিন্তু ওর অসহায় মুখের দিকে চেয়ে আমি আমার বড়দিনের উপহার কেনার জন্যে জমানো টাকার পুরোটাই তার হাতে তুলে দেই। সেই শীতের রাতে সে আমাকে মা মেরী অবতার বলে কুর্নিশ করেছিল। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধ্যানে আজ রোদ্রউজ্জল গৃষ্মে সে আমাকে ডাইনি বলে পাথর ছুড়ছে! কতই না দ্রুত এই মানুষগুলি বদলে যায়। তারপর চোখ পড়লো রজার বরিসের দিকে। আমার প্রাক্তন প্রেমিক। সেও সবার সাথে তাল মিলিয়ে আমার দিকে সমানে পাথর ছুড়ছে। অথছ কদিন আগেও সে কতনা মধুর কন্ঠে আমার রূপের প্রসংশা করতো। প্রতি বৃহষ্পতিবার সন্ধায় ও আমাদের গোয়ালঘরের পেছনে আমার সাথে মিলিত হবার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতো। আমিও বোকার মতো বাবার চোখকে ফাকি দিয়ে ওর মতো একটা লম্পটের সাথে মিলিত হতাম। ও আমাকে স্বর্গদেবী বলে ডাকতো। এইতো দুমাস আগেও সে তার স্বর্গদেবীকে বিছানায় পাবার জন্যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আজ সেই স্বর্গ দেবীকে নরকের ডাইনি বলে গালি দিচ্ছে আর খুজে খুঁজে বড় পাথরগুলি বের করে ছুড়ে মারছে। ধ্বংস হোক এমন স্বার্থপর লম্পট পুরুষজাতির। ওর দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে।
গীর্জা প্রাঙ্গণের এক কোণে কতগুলি শিশু কিশোর জড় হয়ে হৈ হোল্লড় করছে আর আমার দিকে পাথর মারছে। কচি অপ্রস্তুত হাতে ছোড়া পাথরগুলির বেশীরভাগই লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছে। তাদের মধ্যে আমি আলেক্স রবার্ট উইলসন কে দেখতে পেলাম। ওর মা আমার প্রতিবেশী। ছেলেটা দেখতে খুবই সুন্দর। কচি বয়স ৪-৫ হবে। এইতো সেদিন ওর জন্মের সময় খুব বেশী তুষার ঝড় হয়েছিল। রাস্তায় তুষার জমে আমাদের গ্রামটা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। এমন প্রতিকুল পরিবেশে ওর মায়ের যখন প্রসব বেদনা উঠে তখন কোন ধত্রীকেই খুজে পাওয়া যাচ্ছিলো নাহ। ওদিকে সে তার মায়ের যৌনিতে উল্টো হয়ে আটকে গেছিলো। ওর বাবা বাড়ি ছিলো নাহ। লোকটা কাঠ কাটতে পার্শ্ববর্তী উইলো জঙ্গলে গিয়েছিলো। ওর মা ঘরে সম্পূর্ণ একা কাতরাচ্ছিলো। সেদিন তার আর্তচিৎকার শুনে আমি ওদের বাড়ি ছুটে গিয়েছিলাম। গরম পানি তৈরি করে, ওর মা কে শুইয়ে আমি নিজের হাতে ছেলেটাকে টেনে বের করেছিলাম। আমার হাত ধরেই ও এই পৃথিবীতে এসেছিলো। কৃতজ্ঞতাবশত তার মা আমার নামের সাথে মিলিয়ে তার নামকরণ করেন আলেক্স। আজ সেও আমার পর হয়ে গেছে! অতপর পাথরের আঘাতের তীব্রতায় আমি এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। রক্ষীরা আমার অজ্ঞান দেহকে বয়ে সেলের ভেতর নিয়ে এলো। জানিনা কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম রাত হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই দেখলাম সেলের এক কোনে রক্ষীরা খাবার আর পানি রেখে গেছে। হয়তো জীবনের শেষ চারটে দিন ওরা আমায় অভুক্ত রাখতে চায় না। খেয়ে দেয়ে আমি আবারো লিখতে বসলাম। মৃত্যু প্রতিক্ষায়, জীবনের আতিবাহিত আরেকটি দীর্ঘ গ্রীষ্মের দিনের বর্ণনা.............
পৃষ্ঠাটি শেষ করে বিড়বিড় করে বললাম, হায় আলেস। এসব বিচারের নামে প্রহসন তোমার জন্মের আগেও মানব সমাজে ছিলো, তোমার মৃত্যুর পরে এখনো টিকে আছে। তোমার আগে সক্রেটিস, গ্যালিলিও, পিথাগোরাস প্রমুখ এর শিকার হয়েছেন। তোমার পরে, আমেরিকার লুথার কিং, ইতালির মোসলিনী, মার্কো, প্রমুখ। এমনকি এই কয়েক সপ্তাহ আগে আমার বাংলাদেশে মানবতাবিরোধীদের বিচারের নামে প্রহসন হয়ে গেছে। মানব সমাজে কোন কালেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত ছিলো না, আর কখনো হবেও না। তাই বলে তুমি মরে গিয়েও এই কর্টেজকে আঁকড়ে পড়ে থাকবে? পরপারে তোমার জন্যে নতুন জীবন অপেক্ষা করছে। হয়তো ওখানে মার্টিনী তোমার পথ চেয়ে আছে। তুমি যাচ্ছ না কেন? লাইব্রেরীর এক কোন থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। দরজায় লেখা ভাসলো, "মুক্তি দাও আমায়।" এবার আমি গলা চড়িয়ে বললাম, কিন্তু কিসের মুক্তি? কার থেকে মুক্তি? প্রত্যুত্তরে বাইবেলের পৃষ্ঠা উল্টে নতুন লেখা বেরুলো।
আলেসের লেখায়,
"বাহ। আজ সকাল হতে না হতেই এক প্রহরী এসে আমায় কতগুলি ফল, পানি, আর রুটি দিলো। প্রথমে এদের এই আকর্ষিক মহানুভবতার কারণ বুঝতে না পারলেও এখন ভালই বুঝতে পারছি। চারদিন পর যখন আমার লাশটা শুদ্ধিকরণের জন্যে প্রিস্টের হাতে তুলে দেওয়া হবে তখন সে জীর্ণশীর্ণ দেহ থেকে যথেষ্ট যৌন সুখ নাও পেতে পারে। তাই এই চারদিন আমাকে খাইয়ে দাইয়ে কিছুটা ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। আমি গতরাতে আমার ডাকিণী হওয়ার রহস্য উদঘাটন করেছি। আমার ডাকিণী হওয়ার আসল কারণ হল আমার বাবার ফেলে যাওয়া পারিবারিক সরাইখানাটি। আমাদের সরাইখানাটি শহরের প্রায় তোরণদ্বারে অবস্থিত। শহর থেকে যারাই বেরুয় বা যারাই শহরে নতুন আসে তারা সবাই এই সরাইখানায় রাত কাটাতো। ফলে আমাদের প্রচুর মুনাফা হতো। বাবার মৃত্যুর পর ওটা আমার মালিকানাধীন ছিলো। এমতাবস্থায় যেহেতু আমার কোন সন্তান বা উত্তরাধিকারী ছিলো নাহ তাই আমি মারা গেলে সরাইখানাটি পরিতাজ্য সম্পত্তি হিসাবে গির্জার অধীনে চলে যাবে। গির্জার প্রিস্ট ও সেবকদের জন্যে অতিরিক্ত আয়ের উৎস খুলবে। তাই শুধু এই সরাইখানাটির মালিকানার জন্যেই আমি আজ এক ভয়ঙ্কর ডাকিণীতে পরিণত হয়েছি। এসব বিচার, ডাকিণী অপবাদ, কেবল লোক দেখানোর নাটক বৈকি আর কিছু নয়। সবই স্পষ্টত ষড়যন্ত্র। কিন্তু আমি এতে এতটাই জড়িয়ে গেছি যে মৃত্যুর পরেও আমি এ থেকে বেরুতে পারব নাহ। রবিবার প্রার্থনার পর ফাঁসির দড়ি আমাকে এখান থেকে মুক্তি দিতে আসবে নাহ। আসবে আমাকে এখানে চিরতরে বেধে রাখতে। চারিদিকে কেবলি অন্ধকার। আমি একা একা এর মধ্যে কেবলই তলিয়ে যাচ্ছি, আরো গহীনে। কপালে দাসত্বের চিহ্ন নিয়ে। "
পরের পাতায়,
" আজ দুপুরে ওরা আমায় সেই পুকুরে নিয়ে গেছিলো গোছল করাতে। কাল যে আমাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। তাই আজ শরীরটাকে একটু ঘসা মাজা করে একে প্রিস্টের যৌন শুদ্ধিকরণের জন্যে তৈরি করে নিতে হবে তো। আমি গোসল করতেই চাইছিলাম নাহ। কিন্তু আমাকে গোসল করানোর জন্যে দুজন বিশালদেহী মহিলাকে নিয়োগ দিয়েছে। ওদের সাথে জোরাজোরি করার শক্তি আমার শরীরে অবশিষ্ট নেই। তাই বাধ্য হয়েই সুবোধ মেয়ের মতো গোসল করে নিলাম। ওরা আমার সারা দেহকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিষ্কার করে দিলো। ওরা আমার স্তন যৌনি নিতম্বে সবচেয়ে বেশী মনযোগ দিয়ে পরিষ্কার করলো। বুঝলাম এরা প্রফেশনাল। এদের কাজই হল মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত মেয়েদের দেহকে প্রিস্টের বিকৃত কামনা পুরণের জন্যে তৈরি করা। ওদের একনিষ্ঠ পরিশ্রমে আমার জীর্ণ দেহটা খানিকটা হলেও আকর্ষণীয় হয়ে ঊঠলো। কিন্তু কপালে আংটির পোড়া দাগটা থেকেই গেল। এত সহজে যাবে বলে মনেও হয় না। একটা ছোট্ট আংটি, কিন্তু ক্ষতটা পুরো কপাল ভরে ছড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কপালে কেউ একটা পুকুর খুঁড়েছিলো। আর যন্ত্রনার কথা না হয় নাই বললাম। পুরো মাথা ঝিমঝিম করতেছে। মেঝে থেকে মাথাটা তুলতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে যেন। বাকিটা দিন আমি শুয়েই কাটালাম। কিন্তু মনেই হলো নাহ যে আমি পবিত্র গীর্জায় শুয়ে আছি। মনে হচ্ছিল যেন আমি নরকের তপ্ত অগ্নি পিন্ডে ঝলসে যাচ্ছি। অনুভব করলাম নরকের কীট এই লোকগুলি পবিত্র গীর্জাকেও নরকে পরিণত করে ফেলেছে। ছোটবেলায় যখন আমি এ গীর্জার শিক্ষানবিশ ছিলাম তখন আমাদের রোজ সকালে বলা হতো, " ঈশ্বর এই গীর্জার পুজো বেদীর উপর স্থাপিত ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে আছেন। যাও, তাকে ফুল দিয়ে সম্মান জানাও।" কিন্তু আজ বুঝলাম ঈশ্বর কখনোই কোন গীর্জায় থাকেন নাহ। গির্জায় প্রিস্টের মতো কতগুলি ছদ্মবেশী নরকের কীটগুলি বাস করে। আর ঈশ্বর থাকেন বিশ্বাসীদের হৃদয়ের মনিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে।"
ডায়ারীটা সমাপ্ত। আলেসের আর কোন লেখা খুঁজে পেলাম না। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। ওর শেষ উক্তিটি বারবার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। ঈশ্বর গীর্জায় থাকেন নাহ। গীর্জায় প্রিস্টের মতো কতগুলি ছদ্মবেশী নরকের কীট বাস করে। ঈশ্বর থাকেন বিশ্বাসীদের হৃদয়ের মনিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে! ও এক চিরায়ত সত্য কথা বলেছিলো যা প্রায় সব ধর্মের জন্যেই প্রযোজ্য। খৃষ্টানদের গীর্জা, মুসলমানদের মাজার, বৌদ্ধদের পাগোডা, হিন্দুদের মন্দির এগুলি শুধুই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে বানানো এক একটা ব্যাবসা প্রতিষ্টান ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলিতে কখনই ঈশ্বর থাকতে পারেন নাহ। মনে পড়লো বাংলাদেশে থাকতে আমি একবার শাহজালালের মাজারে গিয়ে ১০০ টাকা দিয়েছিলাম। নিজের বোকামির কথা মনে পড়ায় নিজেকেই ধিক্কার দিলাম। কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি। আলেস কেন এই কটেজে আটকে আছে? কেন পরপারে যেতে পারছে নাহ! কিসের মায়ায় ও এখানে এতদিন ধরে পড়ে আছে? যাহোক গত রাত আমি লাইব্রেরীতে কাটিয়েছি আলেসের ডায়ারীটা পড়ে পড়ে। আজকের রাতটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এবার আমার ঘুমানোর প্রয়োজন। লাইব্রেরীর আলো নিভিয়ে আমার বেডরুমের দিকে রওনা হলাম। কিন্তু তখনো লাইব্রেরীতে একটা নারী কণ্ঠ কেঁদেই যাচ্ছিলো। একটানা বিলাপের সুর। আমি ওকে কাঁদতে দিলাম। ওর উপর দিয়ে সীমাহীন ঝড় বৃষ্টি বয়ে গেছে। প্রাণ খুলে কাঁদলে হয়তো ওর দুঃখের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হবে। নিজের বেডরুমে এসে দেহটাকে বিছানায় ছুড়ে দিলাম। মনে হল সমগ্র পৃথিবীটাই নরকের মতো অশান্তিপূর্ণ। শুধু বিছানাটা ছাড়া। বিছানার প্রশান্তিতে মুহূর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম.....সেরাতে তিনটে বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। প্রথমে দেখলাম আমি অফিস শেষে গাড়িতে করে প্রতিদিনের মতোই আমার কর্টেজে ফিরছি। গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে হেঁটেহেঁটে কর্টেজের দিকে আসছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার কটেজের ছাদ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে বাথরুমের আয়নায় দেখা সেই মেয়েটা ঝুলে আছে। তার ঘাড় ভেঙ্গে একপাশে বেঁকে আছে। হা করা মুখটা আমার দিকেই ফেরানো। নিষ্প্রাণ চোখ দুটো আমারই দিকে অপলক চেয়ে আছে। হায় হায়! আমার কটেজে একটা মরা লাশ ঝুলছে! আমি ভাবতে শুরু করলাম এটা কে নিয়ে কি করা যায়। পুলিশে ফোন দিবো না কি বিশাল কটেজের কোথাও গর্ত করে পুঁতে দিবো। কিছুই বুঝতে পারছিলাম নাহ। তখনই লাশটা আমার দিকে তাকিয়ে এক বিকৃত হাসি দেয় এতে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছিলো! আমি ভয় পেয়ে কটেজ থেকে দৌড়ে পালাতে শুরু করি। দৌড়াতে দৌড়াতে যখনই কুয়ার পাশ দিয়ে প্রধান ফটকের কাছে চলে আসি তখনই আমার পথ রোধ করে একটা অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জলিত হয়। আমি বিষ্ময়ে দু পা পিছিয়ে আসে। অগ্নিকোণ্ডে সুষ্পষ্ট দেখলাম একটা লাশ পোড়ানো হচ্ছে। আমি বাংলাদেশে থাকতে বেশ কয়েকবার শশ্মান ঘাটে লাশ পুড়াতে দেখেছি। তাই ব্যাপারটা এতটা ভয়াবহ লাগল নাহ। কিন্তু লাশটা কার? মনে কৌতুহল নিয়ে আমি অগ্নিকুণ্ডের কাছাকাছি গেলাম। কাছে যেতেই পুড়তে থাকা লাশটা হঠাৎ দাড়িয়ে গেল। লাশটার ঘাড়টা ছিলো পেছনের দিকে বাঁকানো! বুঝতে বাকি রইল না এটা সেই মেয়েটার লাশ যাকে আমি খানিক আগে আমার কটেজের ছাদে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখেছি। ভয়ে আমি জমে কাঠ হয়ে গেলাম। পা দুটোর সাথে যেন কয়েক মন ওজনের পাথর আটকে দেয়া হয়েছে! একসময় পুড়তে থাকা লাশটা চিৎকার করে উঠলো! লাশটার আর্তচিৎকারে আমি হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেলাম। বুঝলাম আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। তাই ঘুরেই কটেজের দিকে ফিরে দৌড় দিলাম। কিছুদূর যেতেই কতগুলি হাত আমায় ঝাপটে ধরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম কতগুলি কালো আলখাল্লা পরিহিত লোক আমাকে ধরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এই ছোটাছোটিতে এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে ওদের বাঁধা দিতে পারলাম নাহ। ওরা সিঁড়ি বেয়ে আমায় কটেজের ছাদে নিয়ে গেল। ছাদে পৌছতেই ওরা আমাকে একটা ঝুলন্ত কাঠের ফ্রেমের সাথে হাত পা বেধে দিলো। আমি কটেজের ছাদ থেকে মাটির দিকে মুখ করে ঝুলছি। নীচে আমি একদল অপেক্ষমান জনতাকে দেখতে পেলাম, কিন্তু এদের কাউকেই আমি চিনি নাহ। অতপর আমি শুনলাম কে যেন চেঁচিয়ে বলছে "তিন তিনজন মানুষ খুনের অপরাধে তোমাকে আগামী রোববার প্রার্থনার পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। অতপর এক বিশ্রী চেহারার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা, সাদা আলখাল্লা পরিহিত এক মাঝ বয়সী লোক এসে আমায় কষে থাপ্পড় মারলো! আমি ব্যাথায় কেঁদে ফেললাম। চারপাশে তখন হাসির রোল উঠলো। তারপর দেখলাম লোকটা তার হাতের কড়ে আঙ্গুল থেকে বিচিত্র নকশা খচিত আংটি খলে নিয়ে একটা ধাতব শিকে ঝুলিয়ে জ্বলন্ত গনগনে কয়লার উপর বসিয়ে গরম করতে লাগলো। আলেসের ডায়ারীটা পড়া থাকায় আমি বুঝতে পারলাম এখন কি হতে যাচ্ছে। ওই লোকটা আংটি গরম করে আমার কপালে ছ্যাঁকা দিতে যাচ্ছে। আতংকে আমার হাত পা অসার হয়ে আসলো। দেহের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমি হাত পায়েবাঁধন খুলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করছি দড়ির বাঁধন গুলি যেন মাংস কেটে আরো গভীরে বসে যাচ্ছে। এরই মধ্যে উত্তপ্ত আংটি টকটকে লাল হয়ে গেছে। লোকটা আংটা দিয়ে সেটা ধরে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সবকিছুই যেন স্লোমোশনে হচ্ছিলো। যেন অনন্তকাল লাগলো লোকটার দশ কদম হেটে আমার কাছে পোঁছাতে। অতঃপর লোকটা গরম আংটিটা বাগিয়ে ধরলো আমার কপাল বরাবর। ওটা ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে, আরো কাছে! আমি যতটা সম্ভব মাথাটা পেছনে হেলিয়ে ওটার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দুরে সরে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটা শেষ পর্যন্ত আমার নাগাল পেয়ে গেলো। উত্তপ্ত আংটিটা ও ঠেসে ধরলো আমার কপালে। আমি এতদিন জানতাম মানুষের স্বপ্নের কোন রং থাকে নাহ। স্বপ্নে মানুষ স্পর্ষ, ব্যাথা অনুভব করে নাহ। কিন্তু গতরাতের স্বপ্নে আমি গনগনে কয়লার টকটকে লাল রঙ দেখেছি। তারপর লোকটা যখন ওটা আমার কপালে ঠেসে ধরলো তখন মনে হলো আমার কপালে একটা বুলেট ঢুকছে। এটা যেন আমার কপাল পুড়িয়ে হাড় ভেদ করে আমার মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছে! এত্ত বেশী যন্ত্রনা হচ্ছিলো যে আমি ঘুমের মাঝে চিৎকার করে উঠে বসলাম। যাক বাবা। একটা ভয়াবহ স্বপ্ন থেকে বাঁচা গেলো। আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেছে! আজ অফিসে যে কি হবে। লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠেই তৈরি হয়ে অফিসপাণে ছুটলাম। তাড়াহুড়োয় নাস্তা করতে ভুলে গেলাম। অফিসে পৌছাতে পৌছাতে আধা ঘন্টা দেরি হয়ে গেল। যে অফিসের প্রধান নির্বাহীই অফিসে আসতে আধাঘণ্টা দেরি করে সে অফিসের ভবিষ্যৎ তো শুধুই অন্ধকার। সবার সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে হাটতে হাটতে নিজের অফিসে গিয়ে বসলাম। আমি এসব আর সইতে পারছি নাহ। আলেসের ব্যাপারটা একটা এসপারওসপার করতেই হবে আমাকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এসব উদ্ভট স্বপ্ন গুলির পেছনে নিঃসন্দেহে ওর হাত আছে। কিন্তু আমাকে এসব দেখিয়ে ওর লাভটা কি? প্রকৃতপক্ষে ও কি চায় আমার কাছ থেকে? ও কি সত্যিই বন্ধুপ্রতিম? নাকি বন্ধুত্বের নাম ভাঙ্গিয়ে ও আমার উপর ভর করে এই জীবন্ত জগতে ফিরে আসতে চায়? আমি কিছুই জানি না। এতগুলো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি কিছুতেই অফিসে মনযোগ দিতে পারলাম না।
আজ অফিসের সময়টা যেন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। অফিস ছেড়ে আমার কর্টেজে ফিরতে কেমন জানি ভয়ভয় করছে। কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ওখানে নিরাপদ না। ওখানে আজ রাতে বাজে কিছু হতে চলেছে। গতরাতের ভয়াবহ স্বপ্নটা যেন তারই আগামবার্তা বহন করছিলো।
আজ বাহিরে একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করলাম। সাধারণত আমি বাহিরে খাই না। তবে আজ অফিস শেষে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছিলো না বলে এভাবে খানিকটা অতিরিক্ত সময় বাহিরে কাটালাম। অতঃপর নিজের মনকে অনেক কিছু বলে প্রবোধ দিয়ে কটেজের পথ ধরলাম। ফিরতে ফিরতে সূর্যাস্ত হয়ে গেল। গুধুলির আধারে কটেজটা সেই অভিশপ্ত গীর্জার অবয়ব ধারণ করলো। মনের মধ্যে চাপা দেওয়া ভয়টা আবার ফিরে এলো। গ্যারেজে গাড়িটা পার্ক করে কটেজের দিকে হাটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো কি হবে যদি গতরাতের স্বপ্নটা এখন সত্যি হয়ে যায়? যদি ওখানে গিয়ে দেখি ছাদ থেকে একটা মরা লাশ ফাঁসিতে ঝুলছে! কটেজের ছাদের দিকে তাকালাম। এতদুর থেকে গুধুলির অধাঁরে কিছুই দেখতে পারলাম না। সত্যি সত্যিই ঝুলছে কি না তা নিশ্চিত হতে আমাকে কটেজের আরো কাছে যেতে হবে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা হাতুড়ি পিটাচ্ছে। আমি এলো মেলো পদক্ষেপে কাপাঁ কাপাঁ পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি সেই অভিশপ্ত কটেজটার দিকে।.....
নাহ। কটেজের ছাদটা তো একদমই ফাঁকা। গলায় দড়ি দিয়ে কেউ ঝুলছে না। সামান্য একটা স্বপ্নকে নিয়ে আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম। ভাবতেই নিজেকে হাস্যকর মনে হল। খুশি মনে শিস দিতে দিতে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। উহঃ, ঘরের ভেতরটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে! অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালে সুইচ খুজতে লাগলাম। হঠাৎ কিসে যেন পা বেধে আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম। মাথাটা মেঝেতে ঠুকে গেল। অনেকটা নিঃশব্দেই জ্ঞান হারালাম।
যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে পার্শবর্তী খ্রিস্টান সিমেট্রিতে আবিষ্কার করলাম। সারি সারি কবরের নাম ফলক দাড়িয়ে আছে চারপাশে। আমি চারদিকে অপ্রস্তুত হয়ে হেটে হেটে দেখতে লাগলাম কবর গুলি। হঠাৎ একট কবরের নাম ফলকে চোখ আটকে গেল। ওতে লেখা ছিল, "স্যারিয়ান জোসেফ ভেলমন্ড, গীর্জার সম্মান্বিত প্রিস্ট। ১৪২০-১৪৯৮।" কেন জানি মনে হল এটাই সেই নরপশু প্রিস্টের কবর। ওর কবরের কাছে যেয়ে নাম ফলকের উপর খুদাই করা একটা আংটির চিহ্ন। সেই আংটি যা দিয়ে সে ডাকিনীদের কপালে ছ্যাঁকা দিত। এই আংটিকেই আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। যাক, আর কোন সন্দেহ নেই এটাই সেই শয়তানের কবর। একরাশ ঘৃনা হৃদয়ের গভীর থেকে ওর জন্যে উগলে বেরিয়ে এলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম জীবনে যদি কখনো এই শহরের গভর্ণর নির্বাচিত হই তবে আমার প্রথম কাজ হবে এই শয়তানটার কবরের উপর একটা পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা। আইডিয়াটা আমার খুব মনে ধরলো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই। মনে একটা দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হলো। ভবিষ্যতের পাবলিক টয়লেটের উদ্ধোধন আজকে করে ফেললে কেমন হয়? আজই, এখনই এই শয়তানটার কবরে প্রসাব করে দিলেই তো উদ্ধোধন হয়ে যাবে! যেই ভাবা সেই কাজ। স্কার্টটা নিচে নামিয়ে, দিলাম শয়তানটাকে ভিজিয়ে। প্রস্রাব শেষে অনেক খানি থুথু ও ছিটিয়ে দিলাম ওর কবরে। অতপর লাথি মেরে কবরের নামফলটা মাটিতে ফেলে দিলাম। যাক। এখন অনেকটাই সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। এবার কটেজে ফিরতে হবে। রাত অনেক হয়ে গেছে। অভিশপ্ত কবরটা ফেলে চলে যাওয়ার জন্যে যখনই উঠে দাড়ালাম, সাথে সাথেই মাটি ফুড়ে একটা হাত এসে আমার পায়ে আঁকড়ে ধরলো। চাঁদনি আলোয় স্পষ্ট দেখলাম ঐ হাতের মধ্যমায় জ্বলজ্বল করছে সেই গনগনে লাল আংটি। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। কি অসুরিক শক্তি হাতটায়। আমার এক পা এত শক্ত করে আকড়ে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। আমি প্রাণপণে অপর পা দিয়ে অনবরত ওর হাতে লাথি মারতে লাগলাম। কিন্তু ও আমায় কিছুতেই ছাড়লো নাহ। একটু একটু করে কবরের পাশে টেনে নিয়ে গেল। তারপর একটা হেচকা টানে টেনে নিলো একদম কবরের ভেতরে।
কবরের ভেতরটায় নিরেট অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছিলো নাহ। ঐ আংটি পরা হাতটাকে নাহ। তবে এইটুকু জানি ঐ হাতের মালিক এ অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আশেপাশে কোথাও বসে আছে। আমাকে চরম শাস্তি দেয়ার জন্যে। হঠাৎ মনে পড়লো আমার পকেটে নেক্সাস ফোনটা আছে। ওটা বের করে ওর স্কিনের আলোয় কিছুটা হলেও ভেতরটা দেখতে পারবো। প্রয়োজন হলে সাহায্যের জন্যে পুলিশে ফোন দেয়া যাবে। পকেট টা হাতড়ে ফোনটা বের করে আনলাম। পাওয়ার বাটনটা টিপে সামনে বাড়িয়ে ধরলাম। আরে! এটাতো সেই কবরের ভেতরটা নয়। এটা আমার কটেজ। পাশেই দেখলাম একটা ফুলের টব ভেঙ্গে পড়ে আছে। বুঝলাম আমার কটেজে প্রবেশের পর এই টবে পা বেধেই আমি উল্টে পরে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কবরস্থান আর প্রিস্টের কবরের ঘটনাটা নিছক অজ্ঞান অবস্থায় দেখা আরেকটি দুঃস্বপ্ন। আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠে বসলাম। তারপর খেয়াল হলো আমার স্কার্ট সম্পূর্ণ ভিজে গেছে! হায় ঈশ্বর! আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছি! ধ্যাত। মোবাইলের আলোয় সহজেই দেয়ালের সুইচবোর্ড খুজে নিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম। উজ্জ্বল আলোয় চোখ সয়ে এলে যেখানে আমি পড়ে গেছিলাম সেদিকে ফিরে তাকালাম। আমার প্রস্রাবটুকু সেখানে কার্পেটকে ভিজিয়ে একটা গোলাকার চাকতির মতো দাগ তৈরি করেছে। অনেকটা স্বপ্নে দেখা সেই আংটির আকৃতি। কিন্তু এই আংটির রহস্যটা কি? আলেস কি এই আংটির জন্যে এত দিন এখানে পড়ে আছে। সম্ভবত ও চায় যেন আমি আংটিটা এনে দেই। অন্তত উদ্ভট স্বপ্ন গুলি আমাকে সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। একটু আগে ও আমায় দেখিয়ে দিয়েছে আংটিটা কোথায় আছে। খ্রিস্টান কবরস্থানে সেই মৃত প্রিস্টের কবরের ভেতর। চোখ বন্ধ করতেই সেই আংটি পরা হাতের ছবি মনে ভেসে উঠলো, যা স্বপ্নে আমার পা চেপে ধরেছিলো। উহঃ। আমি আর ভাবতে পারছিনা। মাথায় আঘাতের যন্ত্রনা, প্রস্রাবের উৎকট গন্ধ, সারাদিনের ক্লান্তি সব মিলিয়ে একটা নরকের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। আমি সব কিছুকেই উপেক্ষা করে, সোজা বাথরুমে গোসল করতে ঢুকলাম।
গোসল করতে করতে হঠাৎ আয়নায় চোখ গেল। আমার প্রতিবিম্ব দেখলাম কপালটা ফুলে একটা আলু গজিয়েছে। বুঝলাম এটা একটু আগে পড়ে যাওয়ার ফল। ইশ। কেন যে মোবাইলের আলো জ্বালানোর কথা প্রথমেই মাথায় এলো নাহ। তাহলে এভাবে অন্ধকারে পড়ে যেতে হত নাহ। এসব যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ আয়নায় আমার প্রতিবিম্বটা বদলে আলেসের চাহারা ফুটে উঠলো। আসলে ওর উপস্থিতিটা এখন অনেকটা গা সহা হয়ে গেছে। এখন আর ওকে দেখে এখন আর আগের মতো ভয় বা আনন্দ কিছুই হয়। মুখে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। খানিক পরে ও আয়না থেকে চলে গেল। কিন্তু আয়নার ধুলোর মাঝে লেখা ফুটলো, "আংটিটা পুড়াও। আমায় মুক্তি দাও।"
আমি লেখাটা মুছে না যাওয়া পর্যন্ত ওটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রকৃতপক্ষে কি চায় আলেস? প্রথমে আমায় ওর ডায়ারী পড়াতে চাইলো। এখন আবার একটা আংটি চাইছে যেটা কবরের ভেতরে প্রিস্টের লাশের হাতে পড়ানো আছে। কি করতে চায় ও সেই আংটি দিয়ে? ঐ আংটি এনে না দিলে ও কি আমার ক্ষতি করবে? আর কি করলে এসব বিদঘুটে স্বপ্ন আমার পিছু ছাড়বে? এ প্রশ্নগুলি আমায় পাগল করে দিচ্ছে। আমি এর সমাধান চাই। আমাকে এর সমাধান করতেই হবে। গোসল সেরে খানিকটা হালকা লাগলো। তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাহিরে আসা মাত্র শুনতে পেলাম একটা মেয়েলী কন্ঠ একটানা আমার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। সাঞ্জে সাঞ্জে সাঞ্জে
এক অমোঘ আকর্ষণ এ ডাকে। আমি অনেকটা মোহবিষ্টের মতো এগিয়ে গেলাম ঐ ডাকটা লক্ষ্য করে। কিন্তু এটা আগের মতো লাইব্রেরী থেকে আসছে নাহ। এটা আসছে আমার ঠিক পায়ের নীচ থেকে! বেসমেন্ট! আলেস আমাকে সেই বেসমেন্টের বন্দিশালায় ডাকছে? কিন্তু ওখানে তো সম্পূর্ণ অন্ধকার। বেসমেন্টে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগানো হয়নি। আমি সেই ডাক উপেক্ষা করে আবার আমার বেডরুমে ফিরে এসে দু গ্লাস পানি খেলাম। ডাকটা তখনো চলছে। আমার মনের একটা অংশ বলছে বেসমেন্টে নেমে দেখে আসো, আলেস কি জন্যে ডাকছে। হয়তো ও আমায় এমন কিছু দেখাতে চায় যা ওর আত্মার মুক্তিতে সহায়তা করবে। অপর অংশ বলছে আলেস থেকে দুরে থাকো। যাই হোক না কেন ও একটা অশরীরী। ওই অন্ধকার বেসমেন্টে ও আমার যে কোন ধরনের ক্ষতি করতে পারে! কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে এ দুটো মনের লড়াইয়ে অনুসন্ধিৎসু মনটাই বিজয়ী হল। আমি বেসমেন্টের দরজা খুলে আমার ফোনটায় আলো জ্বেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সিড়ি ভেঙ্গে যতই নিচে নামছি ডাকটা যেন ততই জোরালো হচ্ছে। একটা সময় সেই এক সারির পাঁচটা সেলের সামনে এসে দাড়ালাম। বুঝতে পারলাম ডাকটা আসছে ডান দিক থেকে ৩ নম্বর সেলের ভেতর থেকে। ভয়ে হৃদপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে এসেছে। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে আমি ঐ সেলে ফোনের আলো ফেললাম। নাহ। বাকি সেল গুলির মতোই ওটাও সম্পূর্ণ খালি। সেই পুরানো দিনের মতো সেলটায় কোন তালা ঝুলছে নাহ। ভেতরে কোন বন্দিও নেই। তবুও সেল গুলির অবয়বে নিষ্ঠুরতার ছাপ এতটুকু কমে নি। হঠাৎ মনে খেয়াল জাগলো, ভেতরে ঢুকে দেখলে কেমন হয়? আমি বুঝতে চাই কিভাবে আলেস আর মার্টিনী এখানে জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাতো। দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ৮ ফিট বাই ৮ ফিটের এক বর্গাকার সেল। তিন দিকেই পাথুড়ে দেয়াল। শুধু সামনের দিকটায় শিখ দিয়ে আটকানো। তাতে ৫ ফিট বাই ৩ ফিটের একটা দরজা, কয়েদীদের ভেতরে আনা নেয়ার জন্যে। ভেতরটা সম্পূর্ণ খালি। কোন আসবাবপত্র নেই। এসব যখন ঘুরে ফিরে দেখছিলাম তখনই হঠাৎ সেলের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল! আমি উন্মাদের মতো দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বশক্তিতে ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু তালা না থাকা সত্ত্বেও দরজাটা শক্ত হয়ে আটকে গেছে। হায় হায়। এই শতাব্দী প্রাচীন বন্দিশালায় এখন আমি বন্দি হয়ে পড়েছি! না কি আলেস আমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছে! ভয়ের এক ঠান্ডা স্রোত ঘাড় বেয়ে নেমে গেল! আবার মনে পড়লো হাতে ধরে থাকা ফোনটার কথা। আমি পুলিশে মেসেজ দিয়ে আমাকে এখান থেকে উদ্ধারের জন্যে বলতে পারি। কিন্তু ফোনের দিকে তাকাতেই সেই আশা গুড়েবালি হয়ে গেল। ওয়াই ফাই কানেকশন লস্ট দেখাচ্ছে। তার চেয়েও ভয়াবহ কথাটা হল ফোনে মাত্র ৪% চার্জ আছে। একটু পরেই এর স্কিনের আলো বন্ধ হয়ে যাবে। আমি ভয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি। যদিও জানি এ বিশাল শূন্য কটেজে কেউই আমার চিৎকার শুনবে নাহ। সেলের দরজায় ধাক্কাতে ধাক্কাতে কাঁদ ব্যাথা হয়ে গেছে। তবুও খুলছে নাহ। একসময় চলতে চলতে বার দুয়েক লো ব্যাটারি সিগনাল দিয়ে ফোনটা অফ হয়ে গেল। নিরেট আধার পুরো সেলটা কে গ্রাস করে নিল। অবিশ্বাস্য ভাবে বদ্ধ বেসমেন্টের ভেতরই একটা ঝটকা বাতাস এসে আমার শরীরে পেঁচানো তোয়ালেটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেলের ভেতর প্রায় সব জায়গা হাতড়েও আমি তোয়ালেটা পেলাম নাহ। আমি এটারই ভয় পাচ্ছিলাম। আলেসের মৃত্যুর শত শত বছর পরে ওর সেলে, ওরই মতো সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আমি আটকে পড়েছি!
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ