ছোটগল্প:: অপেক্ষা
না সি র খা ন
: আশ্বিনের সকাল।
আকাশের দিকে তাকানো যায় না। কেমন চড়চড়ে রোদ উঠেছে। বাইরের প্রকৃতি অসম্ভব ঝকঝক করছে। কী সুন্দর ঝলমল করছে রোদ। অসহনীয় ব্যাপার যা, তা হলো অসহ্য গরম।
প্যান্ট-শার্ট পরে বাইরে বের হওয়ার আগেই শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে।
বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নামতেই দেখলাম পুরো দু'বালতি কাপড় নিয়ে মা কলতলায় ধোয়ার আয়োজন করছে। কেমন দুঃখি দুঃখি লাগছে মাকে। বেশি পুরাতন কাপড় পরেছেন বলেই হয়তো।
কিছু বলব না বলব না করেও মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
"মা, যাই।"
অন্য সময়ের মত এখনও কোন উত্তর পাবো না জানতাম, কিন্তু মা আমার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললো, "কোথায় যাস?"
আমি থমকে গেলাম। আসলেই তো কোথায় যাচ্ছি আমি? মা কে কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবো। পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপণ দেখব, এইতো।
আমি চুপ করে থাকলাম। কথা বললেই মা আমাকে অপমানসূচক কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। কী লাভ উত্তর দিয়ে। বের হওয়ার জন্য পা বাড়াবো, মা তখন ডেকে উঠলো, "কবির শোন।"
আমি স্বাভাবিক থাকার চেস্টা করলাম।
-"বলো মা।"
-"কই যাচ্ছিস বলে যা।"
-"কোথাও না মা। একটু বাজারের দিকে যাব আর রাজুদের বাসায় একটু কাজ ছিলো। "
মা বালতিতে কাপড় ঠাসতে ঠাসতে আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
-"তোর বয়স কত হলো যেন?"
আমি নিশ্চিত মা এখন আমাকে খুবই অপমানজনক কিছু কথা শোনাবে। আমার অন্য ভাই-বোনকে মা ঠিকই আদর করে। আমি কি দোষ করেছি কে জানে। আমার সাথে মা আজকাল ভালো করে একটা কথাও বলে না।
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম-
-"এই জানুয়ারিতে ত্রিশ হবে।"
মা আগের থেকে আরো শান্ত গলায় বলল-
-"ত্রিশ বছরের ছেলে হয়ে বুড়া বাপের ঘাড়ে বসে ভাত খাস, লজ্জা করে না তোর?"
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার।
একবার ইচ্ছা হলো বলি, "করে মা, খুবই লজ্জা করে। আর খাবো না ঘাড়ে বসে। খুশি?"
ভাবলাম, থাক। কি লাভ বলে। কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
ইদানিং মা'কে খুব অচেনা মনে হয়। এমন ব্যবহারের কারণ আমার কিছু না করা। ইচ্ছা করেই যে কিছু করছি না, তাও কিন্তু না। চাকরির জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কিছুতেই কিছু হয় না। মাকে একথা কে বোঝাবে?
মায়ের মুখ থেকে আমি ভাল কথা শোনার অপেক্ষায় থাকি, মা একথা বুঝতে পারে না।
সেদিন রাতে খাওয়ার সময় মা একটু নরম সুরে বলল,
-"কবির তোকে আরেক টুকরা মাছ দেই?"
কণ্ঠে এমন মমতা ছিলো যে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ছোট ভাই হিরু বলল, "দাদা কাঁদছো কেন?"
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, "একটা থাবড়া খাবি। কাঁদছি মানে?"
আমি চাই প্রতিদিনই মা আমার সাথে এমন মমতা নিয়ে কথা বলুক । প্রতিদিনই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসুক। এর থেকে সুখ আমি কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারি না।
দুপুর পর্যন্ত প্রচণ্ড রোদের মধ্যে এখানে সেখানে ঘুরলাম। রোদ আর ক্ষুধায় মাথা ঝিমঝিম করছিলো আমার। ঠিক দেড়টার দিকে রাজুদের বাসায় আসলাম। দরজা খুলে দিলো রাজুর বোন মীরা। বললাম,
-"কেমন আছিস মীরা? রাজু বাসায় আছে নাকি রে?"
মীরা হাসি মুখে বাঁকা কথায় উত্তর দিলো,
-"কবির ভাই আপনি ভালো করেই জানেন এই সময় বাসায় আমি ছাড়া এখন কেউ থাকে না। ভাইয়া অফিসে। খেতে আসলে বলেন খেতে দেই। এত ভাণ জানেন আপনি।"
মীরার কথায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।
শুকনো মুখে বিদায় নিলাম ওদের ওখান থেকে। বাসায় গেলেই আবার মন খারাপ করা আরো পরিস্থিতির সম্মুখীন হব, তাই ভাবলাম বড় আপার বাসায় গিয়ে আপাকে চমকে দিয়ে আসি। মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরই তো আপার বাসা। আমাদের বাড়ির কেউ আপাদের বাসায় যাবে, এটা হয়ত আপা কল্পনাও করতে পারবে না।
পৃথিবীতে ধনী আর গরীবের মাঝে আসলেই যে পার্থক্য আছে, এটা বড় আপার নতুন সংসার দেখলেই বোঝা যায়। আপার অসাধারণ রূপ-সৌন্দর্যের কারণে এত ধনী পরিবারে আপার বিয়ে হলো। ব্যাস, এই পর্যন্তই। বছরে একবার দুবার আমাদের বাড়িতে আসা ছাড়া আপাদের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই আমাদের।
যা ভেবেছিলাম তাই। আমাকে দেখে আপা ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। কি করবে দিশা খুঁজে পেলো না।
প্রায় টেনে হিঁচড়ে আপা মুহূর্তে ওর রুমে আমাকে নিয়ে গেলো।
আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে আপা।
"আপা কেমন আছিস" প্রশ্নটা করতে কোন ইচ্ছা হলো না। আপাকে দেখেই মনে হলো আপা ভাল ছাড়া খারাপ নেই।
উত্তেজনায় আপা তেমন কিছু বলতে পারলো না। শুধু কি খাবি কি খাবি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যেন পৃথিবীর সকল খাবার আপাদের বাসায় আছে। আর আমি এই বাসায় যেন খেতেই এসেছি শুধু।
দশ মিনিটের মধ্যেই আপা ওর রুমে খাবার নিয়ে এল। এত তাড়া কিসের বুঝলাম না। বললাম,
-"তোর শাশুড়ির সাথে দেখা করে এসে বাইরের টেবিলে বসে খাই?"
ইচ্ছা করেই বললাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী আপা তাড়াহুড়া করে বলল,
-"না দরকার নাই। এখানেই খাবি। ভাই তারাতারি খা। "
যেন আমি চুরি করতে এসেছি। বললাম,
-"তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন আপা?"
আপার অবাক করা উত্তর,
-"একটু পরই তোর দুলাভাই খেতে আসবে। আমি চাই ও আসার আগেই তুই চলে যা।"
-"কেন? দুলাভাই কি আগের মতই আছে?"
-"না আগের মত নেই। আগের থেকে বেশি জানোয়ার হয়েছে। তুই খা তো।"
-"কিন্তু আপা আমি তো একটু আগেই রাজুদের বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আমি এখন খাবো না প্লিজ।"
আপার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আপাকে বললাম,
-"আপা একশ টাকা দে'তো। আমার জন্য না। ঘরে অনেকদিন ধরে চা-চিনি নেই। মা প্রতিদিন বাবার সাথে এ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে।"
আপা এক দৌড়ে ড্রয়ার খুলে পাঁচশ টাকা এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।"
আমি নিশ্চিত যে আমি বিদায় নেয়ার পর আপা আমাদের কথা ভেবে দরজা আটকে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বসে বসে কাঁদবে। আমার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম আপাকে বলে দুলাভাইয়ের অফিসের সেই স্টোর কিপারের চাকরিটা নেব। কিন্তু অবস্থা যা দেখলাম, তাতে আমরা আমাদের প্রতীজ্ঞা ভেঙে দুলাভাইয়ের স্মরণাপন্ন হতে সাহস দেখালাম না।
ধরে নিলাম জীবনটা এমনই।
সারা বিকেল বাইরে বাইরে কাটিয়ে রাতে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্ধ্যার পর চা আর চিনি কেনার জন্যে বাজারে ঢুকতেই ডাকপিওন চাচার সাথে দেখা। আমার নাকি দু'টি চিঠি এসেছে। কাল হাতে পাবো।
আমার বুকটা অজানা এক অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো।
ঢাকার কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছিলো চাকরির ব্যাপারে। তারা বলেছিলো চিঠি লিখে জনাবে।
দু'টি চিঠি তাদের কাছ থেকে আসা নয়তো?
রাত করে বাসায় ফিরলাম। দুয়ারে পা দেয়ার সাথে সাথে ছোটবোন রেনু কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না শুরু করলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলে মানুষের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-" দাদা, মা খুব চিন্তা করছে। মা বলল তুমি নাকি রাগ করে ঢাকা চলে গেছো। আর আসবে না বাড়িতে। আমার খুব কষ্ট লাগছে দাদা। হিরু তোমাকে বিকাল থেকে খুঁজছে।"
পারিবারিক ভালোবাসার অস্বাভাবিক মমত্বে আমার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে গেলো। এই বুঝি কেঁদে ফেলব আমি। কি বলব বুঝে পেলাম না।
মায়ের হাতে চা-চিনি দিলাম। বাড়িতে এত কাণ্ড হচ্ছে অথচ মা কিছুই বলল না। জিজ্ঞেসও করল না আমি কোথায় ছিলাম। সারাদিন খেয়েছি কিনা। আবার সবকিছুই আগের মত। আমি ফিরে এসেছি, এই হয়তো বেশি।
রাত বারোটার দিকে রেনু আমার রুমের দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলল,
-"দাদা একটা অনুরোধ রাখবে?"
আমি হেসে ফেললাম,
-"না রাখব না।"
-"না শুনেই না বলছো কেন?"
-"আমাকে তোর জন্য রাখা এক গ্লাস দুধ চুরি করে খেয়ে ফেলতে বলবি এই তো?"
দেখলাম রেনু চুপ করে আছে। আমাদের সংসারে অভাব লেগে আছে, তারপরও মা রেনু আর হিরুর জন্য প্রতিরাতে এক গ্লাস করে দুধের ব্যবস্থা করেছে। কাঁথা সেলাই করে প্রতি মাসের দুধের টাকা শোধ করে মা।
আমি বড় হয়ে গেছি, এই জন্যই হয়ত আমার জন্য দুধ রাখা হয় না। এতে আমার কোন মন খারাপও নেই। কিন্তু প্রায়ই রেনু চুরি করে ওর জন্য বরাদ্দের দুধটুকু আমাকে দিয়ে খাওয়ায়। ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা। এইতো কত সুখে আছি আমি।
অনেকক্ষণ পর রেনু বললো,
-"দাদা প্লিজ। খাবে না?"
আমি খুশি হয়ে বললাম,
-"নিয়ে আয়। অর্ধেক আমি, অর্ধেক তুই।"
খেতে খেতে আপার বাসায় যাওয়ার গল্পটা বললাম ওকে। ওর চোখ খুশি আর উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠলো। সব সত্যি বললাম না। বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলে ফেললাম। মাকে না বলার জন্য নিষেধ করে দিলাম রেনুকে।
মাঝরাতে ভুবন ভাসানো জোসনায় ভেসে গেলো প্রকৃতি। মনে আমার চাপা উত্তেজনা। কাল দুটা চিঠি হাতে পাবো। কি জানি কি লেখা আছে। হয়ত আমার চাকরি হয়ে গেছে। আবার হয়তবা হয়নি।প্রহর শেষে কী অপেক্ষা করছে কে জানে।
ভাবলাম অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে জোসনা দেখব আজ। মোড়া আনার জন্য বারান্দায় যাওয়ার সময় স্পষ্ট শুনলাম মা কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। একটু থমকে দাঁড়ালাম। শুনলাম বাবা দুঃখভারাক্রান্ত গলায় মা কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন,
-"কাঁদে না শাহানা। কবিরের সাথে তুমি যতই খারাপ ব্যবহার কর, এতে ও কিছু মনে করে না। তুমি জানো না কবির কত ভাল ছেলে আমাদের।"
সৃষ্টিকর্তা কি ইচ্ছা করেই কথাগুলো আমাকে শুনিয়ে দিলেন? নিজের গালে হাত দিয়ে অস্তিত্ব পেলাম জলের। চোখ থেকে নেমে আসা এক ধারা কষ্ট। ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে মাকে বলি,
"আমি যে তোমাদের কত ভালোবাসি, তা তোমরা কেউ জানো না মা। কেউ না।"
রাত বাড়ে। জোসনা গাঢ় হয়। আমার অপেক্ষার প্রহর সেই সাথে আরো গভীর হয়। কখন সকাল হবে। আমার হাতে চিঠি আসবে।
ভাগ্য বদলানোর কথা সেখানে লেখা থাকলে হয়তো আমার প্রতি মায়ের তখন থাকবে না কোন অনিচ্ছার ঝড়।
আমাদের পৃথিবীটা বদলে যাবে। রাতের বেলা মা আমার জন্য দুধের গ্লাস নিয়ে বলবে,
"কবির তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমা বাপ। সকালে অফিস আছে না?"
রেনুকে আর খেলতে হবে না ভাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার দুধচুরি খেলা।
অপেক্ষায় কত কল্পনা আমার। ঘুম আসে না। রাতের পক্ষ বদল হয়। নিকষ আঁধারকে বিদায় দিয়ে আমি ঘুমাতে আসি। অপেক্ষা আর কল্পনার পৃথিবীকে আপন করে আমার চোখে তখন ঘুম জড়িয়ে আসে।
সকালে যে পৃথিবীটা দেখব, হতে কি পারে সে পৃথিবী ভোরের স্নিগ্ধতার মত জড়াবিহীন? এত সুন্দর?:::
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ