'নবনীন্দ্রনীল'
-Naim Aman
পাশের বাড়ির অরুন’দার ছোট বোনটা বেশ ভালো গান গায়। প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার একতলার বারান্দায় দাড়ালেই শুনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধছে, ‘আমি কান পেতে রই।’
প্রায় প্রতিদিনই কান পেতে থাকা আমার সকাল শুরু হয় রবী ঠাকুরের কান পেতে রই শুনে।
মেয়েটাকে এ পর্যন্ত দেখেছি মাত্র দু-বার। ৪বছর আগে প্রথমবার যখন অরুন’দারা পাশের বাড়িতে উঠলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে নবনীকে সেদিন প্রথম একঝলক দেখেছিলাম। হলদে রঙের একটা শাড়ি আর চওড়া করে খোঁপা বাঁধা মেয়েটা বেশ পুরোনো আমলের একটা সুটকেস নিয়ে কসরত করতে করতে বাগান পেরুলো। বাড়ির চৌকাঠে পা রাখার সময় একবার এদিকে তাকিয়েছিলো। আমি থতবত খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গীতে জানালা থেকে সরে গিয়েছিলাম।
আর দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিলো তার প্রায় দেড়বছর পর। বাবা মারা যাওয়ার ঠিক তিন-দিন আগে। অরুন’দার সাথে করে এসেছিলো বাবাকে শেষ দেখা দেখে যাওয়ার জন্য। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেমন আছি। আমি উত্তর দেইনি, মাথা নীচু করে ছিলাম। সেদিনের পর থেকে প্রায় সকালে ঐ গান ছাড়া নবনীর আর কিছু আমার কানেও বাজেনি, চোখেও পড়েনি। তবে অরুন’দা প্রায়ই আসতেন। বাবার সাথে কিছুক্ষণ আর আমার সাথে কিছুক্ষণ করে সময় কাটিয়ে যেতেন। বাবার অসুস্থতা বাড়তে থাকলে অরুন’দার সাথে দেখা হওয়াও কমে যেতে লাগলো।
.
মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাবা বিছানায় পরে গিয়েছিলেন। তার আর ওঠা হয়নি। আমিও আশ-পাশ থেকে নিজেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছিলাম। বন্ধু-আড্ডা সব ছেড়েছুড়ে কোনো রকমে চোখমুখ লুকিয়ে বাংলা থেকে পাশ দিয়ে বেরিয়েই নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেললাম পুরোপুরি। বাড়ির কোণার ঘরটাতে বসে কাগজের পর কাগজ এটা-ওটা লিখতাম আবার সব দুমড়ে-মুচড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতাম।
বাবা মাঝে মাঝে মনি কাকাকে দিয়ে ডেকে পাঠাতেন আমাকে। আমি বিছানার পাশে গিয়ে বসলে বেশীরভাগ সময়ই চকচকে চোখে চুপ করে তাকিয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। মাঝে মধ্যে খুব কষ্ট করে ফিসফিসে গলায় বলে উঠতেন,
= এবার একটু বের হরে নীল। সূর্যটা দেখ। আর কতোদিন বন্দী থাকবি? আমি নাহয় বুড়িয়ে গেছি। তোর তো পুরো জীবনটাই বাকি পরে আছে রে। এখনই বুড়িয়ে গেলে চলবে কেমন? তোর শিবু আংকেলের সাথে কথা হয়েছিলো আমার। ওর প্রেসে গিয়ে দু-একদিন বসলেও পারিস। খুশী হবে। সময় করে ঢু মেরে আয় না আজকে একবার?
দু-সপ্তাহ পরপর একই কথা শুনতে ভালো লাগতো না আমার। একই কথাগুলো প্রতিবার পুনরাবৃত্তি করে যেতেন বাবা। পার্থক্য একটাই, দিনকে দিন তার গলার জোর জড়ায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। তারপর একদিন হুট করে পুরোটাই নিয়ে গেলো।
.
বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের ভেতরেই আরো বেশ খানিকটা গুটিয়ে গেলাম। মাঝে দিয়ে শিবু কাকা বেশ কয়েকবার এসে জোরাজুরী করে গেলেন ওনার সাথে বসার জন্যে। রাজী করাতে না পেরে উনিও একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। পুরো বাড়িতে তখন শুধু আমি আর মনি কাকা। একই ছাদের নীচে থেকেও খাবার সময়টা ছাড়া দুজনের তেমন একটা দেখাও হয়না। সপ্তায় সপ্তায় এসে শুধু ডেকে বলেন, ইন্দ্রবাবা, বাজারের দরকার ছিলো। আমি সিন্দুক খুলে টাকা দিয়ে দিই।
বাবার সম্পত্তির কতোটুকু অবশিষ্ট আছে বা আর কতোদিন চলবে এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। বাবা যথেষ্ট রেখে গিয়েছেন জানি। মা যখন ছিলেন বাবা তখন দু-বাহুর জোরে শুধু খেটেই গেছেন। আশে পাশে আর তাকাননি। জমির পর জমি কিনেছেন, ব্যবসা ছড়িয়েছেন আর শহরের মফস্বল অংশে বাড়ি করেছেন। ডানে বায়ে তাকাননি কখনো। আর সেটাই বাবার কাল হলো। বাবার চারটা বাড়ি আর একশো সতের একর জমিতে মার মন বসেনি। মা চলে গেলেন।
.
দিন পার হতে লাগলো, রাত ফুরোতে লাগলো, সপ্তাহ-মাস সব একই কায়দায় চলে যেতে লাগলো। আমিও হাপিয়ে উঠলাম একটা সময় পর। স্বেচ্ছায় কারাবাসে যাওয়া কয়েদীর মনও এক সময় পাথুরে প্রাচীরের ওপাশটা দেখার জন্য গুমড়ে ওঠে। নিজের ঘর ছেড়ে বাবার ঘর, সেখান থেকে ছাদে তারপর বাড়ীর পেছনের পুকুর-ঘাটায় আমার যাতায়াত বাড়তে লাগলো।
.
একসময়ের ভ্রমণ পাগল আমার মনের তেষ্টা পুকুর-ঘাটায় আর পোষাচ্ছিলো না। আমি সময় করে শিবু কাকাকে খবর পাঠিয়ে দিলাম সামনের সপ্তাহেই জয়েন করছি। সেদিন বিকেলেই শিবু কাকা সন্দেশ রসগোল্লা সহ এসে হাজির। আমার মুখে প্রমাণ সাইজের কয়েকটা রসগোল্লা পুরে দিয়ে বেশ ক-ঘন্টা হাসি তামাশা করে চলে গেলেন। চৌকাঠ পেরুবার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “বুঝলি ইন্দ্র, তোর বাবা বেঁচে থাকলে বেশ খুশী হতো আজ। অনেক শখ ছিলো তোকে কিছু একটা করতে দেখে যাওয়ার।“
আমি মাথাটা হালকা ঝুকালাম শুধু, মুখে কিছু বললাম না। শেষের দিকে বাবার কতোটুকু খুশী হওয়ার সামর্থ্য ছিলো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার...
.
এটা সেটা ভাবতে ভাবতে লাইটারটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে পুকুর-ঘাটে চলে গেলাম। সন্ধ্যা নেমে আসছে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরানোর সময় মনে হলো অরুন'’দার বাড়ির পেছনের জানালায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা নারী অবয়ব। চশমটা রেখে আসার কারণে ঝাপসা লাগছে। নবনীই হবে হয়তো। মনে হলো এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমি বিব্রত বোধ করছি। ঝাপসা দেখার কারণে বুঝতে পারছি না সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা অথবা আমার সেদিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে কিনা! উশখুশ করতে করতে উঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই জানালাটা থেকে কিছু একটা উড়ে এসে দেয়ালের এপাশটায় পড়লো। নারী অবয়বটা সাথে সাথেই জানালা থেকে সরে গেলো।
আমার বেশ খটকা লাগলো ব্যাপারটায়। কোনো ইশারা ছিলো? নাকি নিছকই কোনো আবর্জনা ফেলতে জানালায় এসেছিলো? আমার কি গিয়ে দেখা উচিৎ জিনিসটা কি? নাকি গিয়ে শুধুই একটা ধোঁকা খাবো?
দোনোমনা করতে করতে আমি দেয়ালটার পাশে এসে দাড়ালাম। দোমড়ানো একটা কাগজ। ভাজগুলো সোজা করে দেখলাম দু-পাশেই ছাড়া ছাড়া কিছু কথা লিখে রাখা। একটা হাতের লেখা বেশ পরিচিত। আমার-ই লেখা একটা আধেক কবিতার কিছু লাইন বলে মনে হলো। সন্ধ্যার আধো আলো-ছায়ায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা।
.
একরাজ্য বিস্ময় আর কৌতুহল নিয়ে ঘরে চলে এলাম। একরাশ প্রশ্ন মনের ভেতর কাটাকুটি খেলছে আমার।
যতোদূর মনে পড়ে, কখনো কিছু লিখলেই আমি তা দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। এ-কাগজটা নবনীর হাতে কি করে পৌছুলো? জানালায় কি সেটা নবনীই ছিলো? নাকি অন্য কেউ? ও বাড়িতে তো অরুন’দা আর নবনী ছাড়া আর কেউ থাকেও না। আমি পুকুর পারে যাওয়ার পর কাগজটা ছুড়ে ফেলা কি ইচ্ছাকৃত ছিলো নাকি নিছক দুর্ঘটনা?
.
আমার লেখাটা নবনীর হাতে যাওয়ার কোনোরকম সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। দ্বিধা শংকায় দুলতে দুলতে কাগজটা খুললাম আমি। বেশ পুরোনো লেখা। ঝাপসা হয়ে এসেছে প্রায়।
.
কতোটাকালের হিসেব ভুলেছি, কান পেতেছি
নীলচে সাদা চুড়ির খোঁজে হাত পেতেছি,
শুনিনি তবু অশ্রুত সেই রেশম জড়ানো কাঁচের আঘাত
অনন্ত থেকে আদির পথে পা বাড়িয়েছি,
মেহেদী রাঙ্গা হাতের স্বপ্নে পথ ভুলেছি,
পাইনি দেখা, বয়েই গেলো ঝর্ণাধারা, আজন্ম এক অশ্রুপ্রপাত...
.
অনেক অনেকদিন আগে লিখেছিলাম। তারপর অভ্যাসবশত ছুড়ে ফেলে দিয়েছি বাইরে। কাগজটা কোনো একভাবে পৌঁছে গেছে নবনীর হাতে। অপর পাশে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে চিঠির মতো কিছু একটা লেখা। গোটা গোটা অক্ষরের এপাশের লেখাগুলো বেশ স্পষ্ট এখনো।
.
প্রিয় ইন্দ্রনীল,
একটা মানুষকে ভালোবাসতে গেলে কতোটুকু জানতে হয় তাকে? এক মুহুর্তই যথেষ্ট নাকি এক জন্ম লেগে যায়? যতোটুকুই লাগুক, তারচেয়ে এক আকাশ বেশী জেনে ফেলেছি আমি আপনাকে। আমি জানি, আমার বিধাতা জানে।
হ্যাঁ, সরাসরি বলে ফেললাম। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লেখার, আকার-ইঙ্গিতে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি, হয়নি আমাকে দিয়ে। খসড়াগুলো ঝুড়িতে পড়ে আছে এখনো।
আপনি যখন দিনের পর দিন নিজেকে ঘরের ভেতর বদ্ধ করে রাখেন, তখন এই কোণার ঘরটাকে আমার একটা ভীষণ লাশঘর মনে হয়। আবার প্রতিদিন বিকেল-সন্ধ্যায় আপনি যখন ছাদে অথবা পুকুর ঘাটায় উদ্ভ্রান্তের মতো হাটাহাটি করেন, আমি তখন এপাশের জানালায় বসে তাকিয়ে দেখি আপনাকে। খুব করে চাই একটাবার যেন আপনার চোখ যেন জানালাটায় পড়ে। পড়ে না।
আপনার অস্তিত্ব মাখানো কাগজগুলোও এপাশের দেয়ালে এসে কড়া নাড়া বন্ধ করে দিয়েছে বেশ ক-মাস হলো। তবু এখনো প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় ভেতর বাড়ির তুলসীর সামনে বসে পড়ি। প্রত্যেক শাখা-প্রশাখায় লুকিয়ে থাকা ব্রহ্মদেব থেকে শুরু করে শেকড়ে বয়ে চলা গঙ্গার তীর্থযাত্রা কেন্দ্র, সকলের কাছে প্রার্থনারত থাকি। খুব করে চাই আরেকটাবার আপনার কোনো দোমড়ানো কাগজ এসে কড়া নাড়ুক এপাশের দেয়ালটায়। আসেনা।
আচ্ছা, আমি যে চিঠিটা লিখতে নীল রঙের কলম ব্যাবহার করেছি খেয়াল করেছেন? আপনার নাম নীল হতে গেলো কেন? নীল রঙ আমার কখনোই পছন্দের ছিলো না। তবে গত দুবছর ধরে আমি খুব করে চেয়েছি যেন আপনার আকাশ মাখা অমাবস্যার আধার মুছে দিয়ে শুভ্র নীল হয়ে জ্বলে উঠতে পারি।
আপনি নীল আকাশটা দেখেন না অনেকদিন, তাইনা? একটা আবদার করি? একদিন সময় করে দিনের বেলা শুধু নীল আকাশটা দেখতে বের হবেন একটাবার। আমিও সেদিন এই একা জানালা থেকে আপনার সাথে নীল আকাশ দেখবো। একমাত্র আবদার। রাখা যায়?
. ইতি, দন্ত্য ন...
.
আমি থম মেতে বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। আমার মাথা কাজ করছে না।
আচ্ছা, আমি কি কখনোই ও-বাড়ির দখিনের জানালাটার দিকে আড়চোখে তাকাইনি? আজই প্রথম নিছক চোখ পড়ে গিয়েছিলো? প্রতিদিন সকালে চা খাওয়ার সময় গলায় এক দিঘী আবেগ মেখে গাইতে থাকা নিষ্পাপ চেহারাটা খুব করে দেখতে ইচ্ছে করেনি কখনো আমার?
আমার ছিন্ন জীবনে এসে আবার চলে যাওয়া কারো লাগামই আকড়ে ধরে রাখতে পারিনি আমি। জানতাম না কি করা উচিৎ ছিলো তখন আমার। এখনও কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছি না।
সহস্র প্রশ্নবিদ্ধ আমার ঘুম এলো না সারারাত। উচ্ছন্নের মতো শুধু হাটাহাটি করে গেলাম পুরো বারান্দাময়। ভোরের আলো ফুটতেই মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পুকুরের শীতল জলে স্নান করে স্নায়ু শান্ত করে নিলাম। মুখে দুটো দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম প্রেসের উদ্দেশ্যে।
.
শিবু কাকার কাছ থেকে বিষয়-আসয় বুঝে নিতে সময় লাগলো না তেমন বেশী। আমাকে একটা মোটামুটি বড় আকারের ঘরে বসিয়ে দিলেন। কাজ তেমন কিছুই না। পত্রিকার সাব-এডিটর প্রণয় কোনো কাগজ নিয়ে এলে সেগুলো খুটিয়ে দেখতে হবে পরদিনের সংখ্যায় সেটা ছাপানো যায় কিনা। ব্যাচেলরে বাংলায় ছিলাম বলে মূল এডিটরের দায়িত্ব আমাকে সপে দিয়েছেন শিবু কাকা। দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি ব্যস্ততায় কেটে গেলো। দুপুরের খাবারের পর তেমন কিছু করার বাকী থাকলো না। শিবুকাকা একবার এসে ঢু মেরে বলে গেলেন আমি চাইলেই চলে যেতে পারি। তেমন চাপ নেই আজ।
.
ক্লান্ত বিকেলবেলায় একটু অবসর পেতেই আবার নবনীর চিন্তা ঢুকে গেলো মাথায়। মনযোগ সরাতে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রেসের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। ছাপা মেশিনের একঘেয়ে ঝকঝক শব্দে মাথা ধরে আসতে লাগলো। চলে যাবো সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি প্রণয়ের অফিস থেকে অরুন’দা বেরুচ্ছেন। অরুন’দা টুকটাক লিখতেন জানতাম। শিবুকাকার প্রেসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, তা জানা ছিলো না। আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন।
- আরে ইন্দ্র যে? কতোদিন পর দেখছি তোমায়। তুমি এখানে?
বললাম,
- আজকেই জয়েন করেছি অরুন’দা। শিবু কাকা বাবার বন্ধু মানুষ ছিলেন। বাবার ইচ্ছায় সাহায্য করতে আসা।
- তাই নাকি? বেশ ভালো সিদ্ধান্ত ইন্দ্র, বেশ ভালো। তোমাকে বন্দী খাঁচায় একদমই মানায় না। আমি এসেছিলাম একটা প্রবন্ধের ব্যাপারে। তা কতক্ষণ আছো আর? এসো না আজকে, কতোদিন কথা হয়না। সন্ধ্যায় একসাথে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবেক্ষণ।
- এখনই বেরিয়ে যাবো ভাবছিলাম।
- বেশ তো, চলো তাহলে একসাথেই যাই। সন্ধ্যার বদলে বিকেলেই হয়ে যাক, কি বলো?
আমি মাথা ঝুকিয়ে মিনমিনে গলায় সায় জানলাম। শিবু কাকাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম দুজন।
.
বাড়ি পৌঁছে আমাকে বাগানের চেয়ারে বসিয়ে ভেতরে চায়ের কথা বলতে গেলেন অরুন’দা। আমি দখিন কোণের জানালায় তাকালাম। কেউ নেই। আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। বাড়ি ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করতে লাগলো। ফুসফুস প্রচন্ড পরিমাণের ধোঁয়া চাইতে লাগলো। উশখুশ করতে করতে উঠে যাবো ভাবছি, এমন সময় অরুন’দা ফিরে এলেন। মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বললেন,
- আমার বোনটা একটা পাগলী হয়েছে বুঝলে? গিয়ে দেখি এর মধ্যেই চা বানানো শুরু করে দিয়েছে। ও নাকি জানতো আজ আমি তোমাকে নিয়ে আসবো।
আমার অস্বস্তি দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। অরুন’দা বললেন,
- কি ব্যাপার ইন্দ্র, এভাবে ঘামছো কেন তুমি? বেশী চাপ গেছে নাকি আজকে? সমস্যা নেই, চা-টা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। নবনী বেশ ভালো চা বানাতে পারে। এসে যাবে এক্ষুনি।
আমি মাথা ঝুকিয়ে হু বললাম শুধু। অরুন'’দা বলতে লাগলেন,
- তারপর ইন্দ্র, কি করার চিন্তা-ভাবনা সামনে? বসে বসে তো সময় পার করা যাবেনা তাইনা? কিছু একটা করে যেতে হবে। একটা চিহ্ন তো অবশ্যই রেখে যেতে হবে।
- জ্বী দাদা, সবে তো বেরোলাম। একটু শুনি, বুঝি, তারপর নাহয় কি করবো সিদ্ধান্তে আসা যাবেক্ষণ। আমি ভাবছিলাম,
আমার কথা মাঝপথেই থেমে গেলো। নবনী চায়ের ট্রে হাতে ভেতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। ভোরের প্রথম সূর্যের মতো শুভ্র মুখটার দিকে একবার তাকিয়েই আমার ঘোর লেগে গেলো। এই শুভ্রতা, এই পেলবতা আমার জন্যে নয়। আমার বসত অন্ধকারে। এই শুভ্রতায় আমার নেশা পেয়ে যাচ্ছে। নেশা পুরোপুরি ধরে যাওয়ার আগেই আমাকে চলে যেতে হবে। পালাতে হবে আবার।
- ক চামচ?
নবনীর প্রশ্নে আমি বিশাল ধাধায় পড়ে গেলাম। ক চামচ চিনি নিই আমি চায়ের সাথে? হাজার হাতড়েও আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না আমার। অরুন’দা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে নবনীকে বললেন, তুই ভেতরে যা, আমরা নিয়ে নিচ্ছি।
আমি মুখ বন্ধ করে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নবনী ভেতরে চলে গেলে অরুন’দা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন।
- নাও কতোটুকু লাগবে চিনি নিয়ে নাও।
.
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চিনি ছাড়াই চুমুক দিলাম। এ চায়ে কি আর চিনির দরকার পড়ে? ক চামচ লাগবে জিজ্ঞেস করার পরই তো আমার হয়ে গেছে। ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আমার নেশা পেয়ে গেছে। সামনে বসা অরুন’দা বলে যেতে লাগলেন,
- বোনটার যে কি হয়েছে আমার! সারাটাক্ষণই জানালার পাশে বসে থাকবে। আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি এখন গিয়ে ওখানেই বসবে আবার। এর কোনো মানে হয় ইন্দ্র? বলো দেখিনি আমাকে?
আমি চোখ তুলে দখিনের জানালায় তাকালাম। নবনী। এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমার বুকে খচ করে কিছু একটা বিঁধে উঠলো। আমার ভালো লাগছে না।
চায়ের কাপ রেখে চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাড়ালাম আমি।
- আমি যাই অরুন’দা।
.
পেছন থেকে অরুন’দা কি বলছেন আমার কানে ঢুকছে না। সরাসরি ছাদে চলে এলাম আমি। একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠোনের কড়ি গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা শালিক বসে ছিলো ডালে। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে হুট করে উড়ে চলে গেলো। সবাই কি যাওয়ার নয় একটা সময়? কেউই থাকেনা শেষটা পর্যন্ত। পথের শেষটুকু একাই পারি দেয়ার সবসময়।
.
সে আসে সে যায়,
কেউ কি কভু দেখা পায়?
একটি শালিক তবু অপেক্ষায়,
অষ্টাদশী প্রহর গুণে যায়...
.
- ফেলে দিন।
চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকালাম আমি। নবনী দাঁড়িয়ে আছে সিড়ির ধারে।
- এ আকাশ আপনার একার না। কেন দূষিত করছেন একে?
হাতের সিগারেটের দিকে একবার তাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম আমি।
- দাদা বললো আপনি নাকি হুট করে কিছু না বলে চলে এসেছেন? কিছু কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো?
- হু, ঠিক আছি।
নবনী সিড়ি দরজার কোণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের সোনা রোদ এসে পড়ছে গায়ে। আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছিলো দেখে সরিয়ে নিলাম।
হঠাত করেই আশেপাশের পাখি ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে। একদম পিনপতন নীরবতা। নবনীই শব্দ বুনলো আবার। ধীরলয়ে আহত পাখির মতো জানতে চাইলো,
- আপনি কি কিছু বলবেন আমাকে?
হ্যাঁ কিছু তো অবশ্যই বলা দরকার। এভাবে আর হচ্ছে না। চোখ তুলে নবনীর দিকে তাকালাম।
- তুমি তোমার জানালায় ফিরে যাও নবনী। আমার রাস্তা সরে গেছে অনেক আগেই। তোমার দখিনের জানালায় আর সে রাস্তা বাঁকার নয়।
মাথা নিচু করে ফেললো নবনী। ওর চোখের কোণে রোদ পড়ে কিছু একটা চকচক করতে দেখলাম আমি। ভাঙ্গা গলায় শুধু বললো,
- পথ বেঁকে আসুক বা না আসুক, সেই জানালাতেই থাকবো আমি।
আর একটিবারও মুখ না তুলে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো নবনী। আমি কড়ি গাছের দিকে ঘুরে দাড়ালাম আবার। শালিকটা ফিরে এসেছে। তবে এবার আর একা না সে। সঙ্গী আছে। আমি তাদের খুনসুটি দেখতে লাগলাম।
আচ্ছা পথ বেঁকে ভুল গন্তব্যে চলে গেলে সে রাস্তা ডিঙ্গিয়ে আসা কি আদৌ সম্ভব? পথ ছেড়ে নাহয় ঘন বনেই নেমে পড়া যায়? কাটারী হাতে নিয়ে নতুন করে পথ তৈরী করতে করতে এগিয়ে যাওয়া!
.
আমি ঘুরে একবার দখিনের জানালায় তাকালাম। নবনী।
ছাদ থকে পথে নেমে এলাম আমি। আমার নেশা পেয়ে গেছে। নীল আকাশ দেখতে হবে আমার। অনেকদিন মন ভরে নীল আকাশ দেখিনা। সিগারেটের খোঁজে পাঞ্জাবীর পকেটে হার দিয়েও সরিয়ে নিলাম। এ আকাশ কলুষিত করা আমার মানায় না। এই নীল আকাশ আমার একার না। দখিনের একা জানালাটার ধারে বসা এক মানবীরও আছে এ আকাশ দেখার অধিকার। জানালাটায় জোড়া আকাশ আজ...
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ