অবশেষে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম! বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালকের চাকরিটা আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে...,এবং তা আজই!! সকালবেলা অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই সালাম সাহেব মুখের উপর বলে ফেললেন-'বুঝলেন ভাই,বয়স তো আপনার আর বেশি হয়নি,সবে ২৮! এই বয়সটা কেন শুধু শুধু ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে নষ্ট করে ফেলবেন? আমার আপন বড় ভাইয়ের মেয়ে,আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিবো আপনার সাথে!'--নিজের বাপের বয়সী একজনের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর স্থির হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ,মাথা কাজ করছিলো না আমার! এবং সাথে সাথেই সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম- যে করেই হোক চাকরিটা আমার ছাড়তেই হবে......
.
২০০৬ সালের কথা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করার পর হাতে অখন্ড অবসর। কোন এক বিকালে এক বন্ধুসহ অসুস্থ ইংরেজী স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম। স্যার আমাকে খুব আদর করতেন,স্কুলের ৫টা বছর প্রায়ই স্যারের সান্নিধ্যে ছিলাম। কিন্তু কখনোই স্যারের পরিবার সম্পর্কে অত বেশি কিছু জানতে পারিনি- হয়তো স্যার জানাননি বলে কিংবা ওসবে আমার আগ্রহ ছিলনা বলে। স্যারের বাসায় যাওয়ার পর জানতে পারলাম উনার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা মেয়ে আছে। আমাদের নাস্তা দিতে আসায় তার সাথে আমার পরিচয়,টুকটাক কথাবার্তাও হয়। হঠাৎ করে কি হলো জানিনা মনের ভেতর এক অন্যরকম আনন্দ দোল খেয়ে গেলো! বয়েজ স্কুলে পড়ার সুবাধে এমনিতেই মেয়েদের সাথে কথা বলতাম কম। তারপরও এই মেয়েকে দেখার পর মনে হতে লাগলো-আমি এমন কাউকে পেয়ে গেছি যার সাথে অনেক অনেক কথা বলার আছে আমার! কি আশ্চর্য,অতটুকু বয়সেই আমি তাকে নিয়ে হরেক রকম চিন্তা করা শুরু করে দিলাম!!
.
পরদিনই খোজ নিয়ে ফেললাম ও কোন স্কুলে পড়ে,কোথায় যায়,কোন স্যারের কাছে পড়ে সব! খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম বলেই হয়তো দেখা হওয়ার দুই দিনের মাথায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে থামিয়ে জানিয়ে দিলাম -'তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে! ভালোবাসি,খু-উ-ব ভালোবাসি তোমায়!!' আমার এমন আচরনে তার অবাক হওয়ার কথা অথচ তা না হয়ে সে আমাকে মুখের উপর বলে দিলো-আপনি আমাকে পছন্দ করেন এ কথা আপনার বাবাকে বলতে পারবেন? আমি বলেছিলাম পারবো! সে বলেছিলো-দেখা যাক,আপনার বাবাকে বলতে পারলে আসবেন। মনের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকে বলেছিলাম-আমি আসবো,কালই আসবো তোমার সামনে...।
.
কিন্তু আমার আর ওর সামনে যাওয়া হয়নি। আমার বাবা কঠিন প্রকৃতির মানুষ। আমরা ভাই বোনেরা পারতপক্ষে উনার সামনেই যাইতে চাইতাম না। বাবা ঘরে থাকলে গলা উচু করে কথা বলতাম না পর্যন্ত! সে আমি বয়সের দোষেই হোক কিংবা আবেগে ভেসে গিয়েই হোক বাবাকে সরাসরি বলে বসলাম-বাবা আমি আমাদের ইংরেজী স্যারের মেয়ে ঐশীকে বিয়ে করবো!?! ও হ্যাঁ,আপনাদের বলাই হয়নি ওর নাম ঐশী।।
পরিবারের সবার ছোট ছেলেটার মুখে এরকম কথা শুনে বাবা কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হা করা মুখ নিয়ে অবাক বিস্ময়ে উনি ওনার সদ্য ১৬ বছর পেরনো কিশোর সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অপলক দৃষ্টিতে! নিমিষেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার। কিছু বুঝে না ওঠার আগেই দুই গালে দুইটা ভয়ংকর চপেটাঘাতের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার প্রথম প্রেম,ভালোবাসা কিংবা আত্মবিশ্বাসের সমুদ্র ওখানেই মাটি চাপা পড়ে গেলো। আমি ভুলে যেতে থাকলাম বাবাকে ওসব কথা আমিই বলেছিলাম।
.
এরপর কেটে গেছে আরো অনেক দিন। এসব কথা আমি আর মনে রাখিনি কিংবা মনে রাখার চেষ্টা করিনি। ২০১০ সালের কথা। তখন আমি অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। শহর থেকে শাটলে করে ভার্সিটি যাওয়া আসা করতাম। আমাদের ভার্সিটির ট্রেনগুলোর সমস্যা ছিলো আমরা যারা মাঝপথ থেকে ট্রেন ধরতাম কেউই বসার জায়গা পেতাম না যদি না আমাদের একজন বয়ফ্রেন্ড কিংবা গার্লফ্রেন্ড ট্রেন ছাড়ার স্টেশন থেকে তাদের ব্যাগ দিয়ে আমাদের জন্য একখানা সিট দখল করে না রাখতো! সেরকম কেউ ছিলোনা বলেই প্রায় অন্য অনেকের মতো দাঁড়িয়ে ভার্সিটি যেতাম। নভেম্বর মাসের কোন একদিন আমি ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাটলে উঠেই আল্লাহর নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ট্রেন কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ শার্টের পিছনে কারো হাতের ছোঁয়া অনূভব করলাম। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই শুনি- 'ভাইয়া,আপনি চাইলে এই সিটে বসতে পারেন। আজ আমার বান্ধবী আসবে না।' ঐ মুহূর্তে ট্রেনে সিট পাওয়া মানে আমাদের কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। সাত পাঁচ না ভেবেই তাই বসে পড়লাম।
--- থ্যাংক ইউ। আমি রানা,মার্কেটিং ২য় বর্ষ।
--- আমি ঐশী। আইন ১ম বর্ষ। নিচু করে রাখা মাথাটা খানিকটা উপরে তুলে বললো মেয়েটি।
আচমকা বুকের ভেতর বিদ্যুৎ চমকে গেলো আমার। এই সেই মেয়ে যাকে ৪ বছর আগে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে তার কথামতো বাবাকে বলতে গিয়ে আমি বেহুশ হয়েছিলাম। এক কথা,দুই কথা করে সেদিন আমাদের মাঝে অনেক কথা হয়। আহা...,কতদিন...,কতদিন পর আমরা দুজন দুজনকে দেখলাম। কি অদ্ভূতভাবেই না স্রষ্টা আমাদের দেখা করিয়ে দিলেন!
.
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল কিংবা ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের প্রেমটা আর অংকুর হয়ে থাকেনি। ফুল হয়ে ফুটতে সময়ও লাগেনি। জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর কারণে এক অপ্রতিরোধ্য লজ্জা,অসহনীয় যন্ত্রণা দিনের পর দিন নিঃসঙ্ঘ করে তুলেছিলো আমাকে। আমি হয়ে পড়েছিলাম স্বার্থপর আর ভীষণ রকমের অসামাজিক! সেই আমাকে কেউ একজন এতোটা আপন করে নিবে এ আমি সত্যিই কল্পনা করিনি! সেই শুরু...,এই অবশ্যম্ভাবী ভালোবাসার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি আমাদের কোন স্বভাবগত বিপরীত অবস্থান! আমাদের উত্তাল প্রেমের স্বাক্ষী হয়ে আছে ভার্সিটির শাটল ট্রেন,শহরের আনাচ কানাচ কিংবা ক্যাম্পাসের দীর্ঘ পথ। গোলাপী আর ম্যাজেন্টার পার্থক্য বুঝতে যে আমাকে হিমশিম খেতে হতো সেই আমি তার সাথে থাকতে থাকতে শিখে গেলাম কীভাবে জীবনের দুঃখগুলোর পরতে পরতে আনন্দের রঙ লাগাতে হয়। আমি তার কাছে বেঁচে থাকার সংজ্ঞা শিখেছিলাম,শিখেছিলাম কীভাবে টুকরো টুকরো আনন্দগুলো জমা করে সুখের প্রাসাদ গড়তে হয়।।
.
এভাবে পথ চলতে গিয়ে একটা সময় দুজনেই আবিষ্কার করলাম আমরা কেউই ফেরেশতা নই,আমরা মানুষ। আমাদেরও একজনের হাত আরেকজনের ধরতে ইচ্ছে করে,রিকশার হুড তুলে দিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে দুজন দুজনের আরো কাছাকাছি আসি! দুজনের অসীম রক্ষণাত্মক অবস্থান কিংবা ধর্মীয় রীতিনীতি দুজনেই যথাযথ মানার কারনে হয়তো তা সম্ভব হচ্ছিলোনা। নিজেদের ইচ্ছেগুলো বিবেকের কাছে মার খাচ্ছিলো বারবার। অনেক ভেবে চিন্তে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিয়ে করবো! বিয়ের বয়স কিংবা নিজেদের ম্যাচুরিটি কিছুই আমাদের বিপক্ষে ছিলোনা। বিপক্ষে ছিলো দুজনের পরিবার! প্রায় একইসাথে দুই পুরিবার থেকেই জানিয়ে দেওয়া হলো এমন কাজ করলে আমাদেরকে তাঁরা ত্যাজ্য করতে বাধ্য হবেন!! নিজেদের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখালাম,ধর্মীয় অনুশাষনের ভয় দেখালাম কিন্তু কিছুতেই কাউকে রাজি করানো গেলনা। সামাজিক দায়বদ্ধতা আর দুই পরিবারের স্ট্যাটাসের কাছে আমাদের বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা পানশে হয়ে আসছিলো প্রায়। দুই পরিবারের দেয়া সকল প্রকার হুমকি ধামকি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ২০১২ সালের ২৯শে জানুয়ারি আমরা স্থানীয় কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি! স্বাক্ষী হিসেবে ছিলো আমার দুইজন বন্ধু আর ওর একজন বান্ধবী।।
.
কবুল বলার পরপরই আমরা দুজন ফোন করে নিজেদের পরিবারে বিষয়টা জানাই। ফলস্বরুপ দুই পরিবার থেকেই আমাদের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলো! আমাদেরকে ছেলে কিংবা মেয়ে পরিচয় দেয়াটাও তাঁরা এক পর্যায়ে বন্ধ করে দেন! এরপর শুরু হলো আমাদের কঠিন সংগ্রামের দিনগুলো। আমি তখন অনার্স শেষ বর্ষে আর ও ২য় বর্ষে। মাথার উপর আমাদের কোন আকাশ ছিলনা তখন। আমি চাচ্ছিলাম না কোনভাবেই ওর পড়ালেখার ক্ষতি হোক! দিন রাত টিউশনি করতাম আমি। ওকে কিছুই করতে দিতাম না। এক রুমের একটা বাসা ভাড়া করে কোনমতে দিনাতিপাত করতে লাগলাম। ভালো কাপড় কিনতে পারতাম না,ভালো কিছু খেতে পারতাম না, সপ্তাহের প্রায় প্রত্যেকটা দিন সবজি রান্না করে খেতাম! অসহনীয় একেকটা দিন যেনো একেকটা বছর হয়ে আসতে লাগলো আমাদের জীবনে। কিন্তু দিনশেষে আমাদের মাঝে অশেষ ভালোবাসা ছিলো! সেই ভালোবাসার জোরেই হয়তোবা এসব কষ্ট আমাদের দুজনেরই একসময় সয়ে আসতে লাগলো। সবাই বলে-অভাব যখন দরজা দিয়ে আসে ভালোবাসা নাকি তখন জানালা দিয়ে পালায় কিন্তু আমাদেরটা পালায়নি!! এমন অনেক দিন গেছে সারাদিন আমরা স্রেফ কলা আর রুটি খেয়ে পার করে দিছি,টিউশনি না থাকায় রমজান মাসে দুজন শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেছি! তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমতো কান্না করেছি। জানিনা আকাশ বাতাস কিংবা পশু পাখি আমাদের সে কষ্টে কান্না করেছিলো কিনা কিন্তু মহান করুণাময়ের রহমত বর্ষিত হয়েছিলো আমাদের উপর। ১ বছরের মাথায় আমাদের অবর্ণনীয় কষ্টের দিনগুলো শেষ হয়ে আসে! ২০১৩ সালে অনার্স রেসাল্ট বের হওয়ার সাথে সাথেই আমার পূবালী ব্যাংকে চাকরিটা হয়ে যায়!! ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি-সে সময়ে আমাদের জন্য এক মহা আশীর্বাদ...।
.
এরপর আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চাকরি করে করেই আমি এমবিএ শেষ করি। আর ততদিনে ওর অনার্স শেষ হয়ে আসে। আমরা দুই রুমের একটা বাসা নিলাম। গুছিয়েও ফেললাম বাসাটা নিজেদের মতো করে। আমি অফিসে যাওয়ার পর ও খুব একা ফিল করতো বাসায়। আল্লাহ ওকে বেশিদিন একা রাখেন নি। ২০১৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আমাদের কোল জুড়ে আমাদের প্রথম সন্তান 'আফনান' এই পৃথিবীর বুকে আসে! আদরে,যত্নে,ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে লাগলো আমাদের ভালোবাসার ১ম ফল। আমাদের আফনান। আমাদের ফ্যামিলির বড় সন্তান।।
.
২০১৬ সালটা আমাদের অনেক অনেক কিছুই পাওয়ার বছর! প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পরিশ্রম করেও আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে এই বছরটায় আমরা পেয়েছি অনেক কিছু। বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি হয় আমার!সেই সুবাধে আমরা ঢাকায় শিফট করি। ঢাকা আসার ২ মাসের মাথায় আমার স্ত্রী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদানের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়! এসব অর্জনের বাইরেও এ বছর আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি-মার্চের ৫ তারিখ পৃথিবীর মুখ দেখে আমাদের ২য় সন্তান,আমাদের মেয়ে 'আরশি'!! মা হারা আমি কিংবা ফ্যামিলির সাথে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন আমাদের দুজনের জন্য ১টা মেয়ে পরম আরাধনার ধন ছিলো। আল্লাহ তাআলা আমাদের বেশিদিন অপেক্ষায় রাখেননি। অনেকদিন পর 'মা' বলে ডাকার মতো কাউকে পেয়ে আমাদের ছোট্ট সংসারে আনন্দের বন্যা বয়ছিলো যেন। একটা সময় যে ঘরে কিছুই ছিলোনা সে ঘরে আল্লাহ সব দিলেন। পূর্ণতার কোন অভাবই ছিলনা আমাদের!!
.
ইতিমধ্যেই দুই ফ্যামিলির সাথে আমদের যোগাযোগ শুরু হলো। আমার বাবা মহা আয়োজন করে তাঁর নাতী নাতনীদের দেখে গেলেন। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর ওর দুই ভাই সবাই এলেন। সবাই মিলে এতো হাসি খুশির মধ্যে দিনগুলো চলে যাচ্ছিলো যেন মনে হচ্ছিলো স্বর্গ নেমে এসেছে আমদের ছোট্ট ঘরে! ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আমরা সবাই মিলে ইন্ডিয়া ঘুরতে গেলাম। বিয়ের পর আমাদের এই প্রথম কোথাও এতো আয়োজন করে ঘুরতে যাওয়া। বিয়ের পর হানিমুন করার কোন সুযোগ পাইনি বলে এই বেড়ানো যাওয়াটা আমাদের জন্য ছিলো এক পরম পাওয়ার আর ভালোবাসার ভ্রমন। প্রায় ১১ দিন বেড়ানোর পর আমরা দেশে ফিরে আসি। আগের মতোই আনন্দে কাটতে লাগলো আমদের দিন।
.
২০১৭ সালের ৫ই মার্চ আমাদের মেয়ের ১ম জন্মদিনে আমরা একটা ছোটখাটো অনুষ্টানের আয়োজন করি। কাছের বন্ধুরা ছাড়াও আমার শ্বাশুড়ি এসেছিলেন ঐদিন। অনুষ্টান শেষে সবাই চলে গেলেও আমরা দুজনই জোর করে উনাকে রেখে দেই। ইচ্ছে ছিলো আমাদের ছেলে মেয়ে কয়েকটা দিন ওদের নানুর সাথে খেলবে,হাসিখুশি সময় কাটাবে। তাই একপ্রকার অনুনয় বিনয় করে উনাকে রেখে দেওয়া। ২-৩ দিন পর কোন এক শুক্রবার বিকেলে আমি আম্র স্ত্রীকে বললাম-'কতদিন হলো আমরা দুজন একসাথে বের হয়না! চলো আজকে আমরা বের হই দুজন মিলে,ছেলে মেয়ে দুইটা ওদের নানুর কাছে থাক।আমরা দুজন হাতে হাত ধরে রিকশায় ঘুরে আসি কিছুক্ষণ!' বউ আমার প্রথমে বুড়া বয়সে ভিমরতি বলে আমাকে কটাক্ষ করলেও পরে আমার চাপাচাপিতে রাজি হয়। সন্ধ্যার পর দুজন মিলে বের হয়ে পড়ি,রিকশা করে শুধু দুজন মিলে ঘুরাঘুরি করি এদিক সেদিক। মতিঝিল গিয়ে হিরাঝিল হোটেলে চা খেলাম,ওয়ারী গিয়ে ঝালমুড়ি খেলাম,শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম তালতলা মার্কেটে গিয়ে বউয়ের অতি প্রিয় ফুচকা খাবো। যে কথা সেই কাজ। রাত ৮টা বাজে তখন। রিকশা নিয়ে ওয়ারী থেকে খিলগাঁও,তালতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে এসে অল্প কিছুক্ষণ জ্যামে আটকা ছিলাম আমরা। জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে যেই রিকশা চলা শুরু করলো হঠাৎ করে কেউ একজন এসে আমার স্ত্রীর পার্সটা ধরে হ্যাচকা টান দেয়। সেকেন্ডের ব্যবধানে ও কিছু বুঝে না ওঠার আগেই নিচে পড়ে যায়। আমি প্রায় সাথে সাথেই রিকশা থেকে নামতে যাবো এমন সময় দেখি আমার স্ত্রীর শরীরের বেশ কিছু অংশ পেছন দিক থেকে ছুটে আসা সিএনজির নিচে! আশে পাশের লোকজন সবাই এগিয়ে আসেন। তাঁদের সহায়তায় সাথে সাথে আমি ওকে পাশের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওরা এই কেইস হ্যান্ডেল করবেনা বলে দিয়ে একটা সেলাইন পুশ করে দিয়ে আমাদেরকে ঢাকা মেডিকেল পাঠিয়ে দেয়। ওর শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে তখন রক্ত ঝরছিলো আর ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো আমার কোলে। রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিলো আমার পরনের প্যান্ট শার্ট। কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিলাম না। চাইছিলাম যে করেই হোক ওকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ওর জ্ঞান না ফিরলে ডাক্তার আমাদেরকে সিএমএইচ হাসপাতাল সাজেস্ট করেন। রাত ৩ টার দিকে আমরা সিএমএইচ হাসপাতাল পৌঁছাই। জরুরী বিভাগ থেকে ডাক্তার ওকে সরাসরি আইসিইউতে নিয়ে যান। ডাক্তার বলেছিলেন রিকশা থেকে নিচে পড়ে যাওয়ায় ও মাথায় প্রচন্ড ব্যথা পায়, যার কারনে জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। তিনদিন পর আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফেরে! আইসিইউর বাইরে নির্ঘুম রাত কাটানো আমাকেই ডাক্তার প্রথমে ওর সাথে দেখা করার জন্য ডাকেন। আমি ঢুকে ওকে দেখেই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি। অঝরে কান্না আসছিলো দুজনের। এই তিন দিনেই ও কতটা না বদলে গেছে। বাইরে অপেক্ষামান আমার দুই অবুঝ ছেলে মেয়ে,ভেতরে আমরা অসহায় দুইটা মানব মানবী! ১০ মিনিট মতো আমি ওর কাছে ছিলাম। ও কোন কথাই বলতে পারেনি,আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলাম-'দেখো,সব ঠিক হয়ে যাবে,ঠিক আগের মতন হয়ে যাবে সবকিছুই।'
.
নাহ! কিছুই আর আগের মতো হয়নি। টানা ৩৯ দিন আইসিইউতে থাকার পর ৬ ই মে বিকাল ৫ টায় আমার স্ত্রী অন্যভূবনে চলে গেলেন। ঐ সময়টায় আমি ওর হাত ধরে ছিলাম। মাথায় রেখেছিলাম আরেকটা হাত। দেখছিলাম হাতটা আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে যাচ্ছে,নিথর নিস্তব্দ হয়ে যাচ্ছে ওর পুরা শরীর! ডাক্তার দেখামাত্রই বলে দিলেন সব শেষ। আমার অনন্তকালের ভালোবাসা,আমার প্রেম,আমার স্ত্রী,এ পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ,আমার আফনান-আরশির মা,আমার সবকিছুর অংশীদার হয়ে ওঠা মানুষটা এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিলেন! আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে কান্না করছিলেন আমার শ্বাশুড়ি। আমি মুহূর্তের ভয়াবহতায় অসাঢ হয়ে পড়েছিলাম। মাঝে মাঝে বিধাতা এতোটা নিষ্টুর হয় কেন?
.
আমার মেয়েটা এখনো দুধের শিশু,ছেলেটা সবে বুঝতে শিখেছে। এই বয়সে তাদের মা নেই,পরম নির্ভরতার স্থানটুকু হারিয়ে ফেলা আমার এই অবুঝ ছেলে মেয়ে দুইটার দিকে আমি তাকাতে পারিনা। আমার কান্না আসে,আসমান জমিন এক করে ফেলতে ইচ্ছে করে কান্না করতে করতে। আমি ওদের কিছুই বুঝাতে পারিনা। পৃথিবীর বুকে এই মুহূর্তে আমার চেয়ে অসহায় মানুষ আর আছে নাকি আমি জানিনা। শুধু জানি আমি খুব কষ্টে আছি,খুব। ছেলে মেয়ে দুইটাকে চোখের আড়াল করে রাখতে পারিনা মোটেও। আবার ওদের সামলে অফিস করাটাও কষ্টকর। তাই ওদের নানুকেই আমাদের সাথে রাখছি। রাতের বেলা আমি অফিস থেকে ফিরলেই ওদের সাথে সময় দেই,গল্প করি,খাইয়ে দেই,দুজনকে দুই পাশে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওদের খাইয়ে দেই,খেলি ওদের সাথে,গোসল করিয়ে দেই,তারপর অফিসে আসি। মা মরা এই দুই অবুঝ ছেলে মেয়ের চিন্তায় আমি কাজে একটুও মন বসাতে পারিনা। আমাদের ড্রয়িং রুমের ওয়াল জুড়ে আমদের গোটা বিশেক ছবি। ওসব দেখলে আমি আর স্থির থাকতে পারিনা। ওদের মা,সে তো আমার স্ত্রীও!
.
এসবের মাঝে একদিন আমার শ্বাশুড়ি আমাকে প্রস্তাব দিলেন-'তুমি আর একটা বিয়ে করো! আমার ছোট বোনের ইন্টারমিডিয়েট পড়া মেয়েটাকে তুমি চাইলে বিয়ে করতে পারো।' উনার এই কথা শুনে আমি চুপ করে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ,তারপর বলে দিলাম-আমি বিয়ে করবোনা! আইসিইউতে থাকাকালীন শেষবার যখন ওর সাথে আমার কথা হয় তখন ও আমাকে দুইটা কথা বলেছিলো--(১) আমি জানি তোমার প্রয়োজনেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে,বিয়ে করো আমার আপত্তি নেই তবে তার আগে আমার ছেলে মেয়ে দুইটাকে হোস্টেলে দিয়ে দিও (২) পারলে আমার স্বপ্নটা পূরণ করো-ছেলেটাকে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর মেয়েটাকে ডাক্তার, দেখো দূর আকাশের তারা হয়ে আমি তোমাদের দেখে নিবো। এই কথাগুলো আমি কাউকেই বলিনি। নিজের বুকের গহীনে পুশে রেখেছি পরম মমতায় আর অসীম ভালোবাসায়! তাই যেই বিয়ের কথা বলেন তাকে মুখের উপর বলে দেই ওসব ছাড়া আমার সাথে কথা বলেন।
.
আজ যখন বাপের বয়সী কলিগ সালাম সাহেব অফিসে ঢুকার সাথে সাথে কথাটা বললেন বিশ্বাস করেন মাথায় রক্ত ওঠে গিয়েছিলো আমার। তাও নিজেকে শান্ত রেখেছি। নিজেকে বুঝিয়েছি-আমি না এখন দুই সন্তানের গর্বিত পিতা,আমার এখন রাগ থাকলে চলে! আমার জীবন নিয়ে বাইরের মানুষদের কেন এতো চিন্তা আমি বুঝিনা। তা কি শুধু আমি ভালো একটা জব করি বলে নাকি আমার ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে বলে? প্রতিনিয়ত এসব বিয়ের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন মাত্র তিন মাস হলো। এর মাঝেই আমি প্রায় ১০টা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে গেছি! তাই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিবো। যত দ্রুত সম্ভব এই কাজটা আমার করতে হবে। ঢাকা শহর ছেড়ে আমার দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমি গ্রামে চলে যাবো। বাবার প্রতিষ্টিত স্কুলে পড়াবো আর আমার স্ত্রীর স্বপ্ন পূরনের জন্য আজীবন চেষ্টা করে যাবো। আমার সহজেই ঘুম আসেনা এখন,যদি কখনো চোখ বুজে আসে তাহলে আমিও ঐ একটা স্বপ্ন দেখি-“ক্যাপ্টেন আফনান” আর “ডাক্তার আরশি”। আমি জানি মন থেকে চাইলে সব সম্ভব। মানুষ তার স্বপ্নের সমানই বড়। আমি সেই স্বপ্ন পূরনের পথেই হাঁটছি। আপনারা আমার সঙ্গে থাকবেন তো??
.
(রানা কুতুব)
āĻāϞ্āĻĒ āϏংāĻ্āϰāĻš āĻāϰা āĻāĻŽাāϰ āύেāĻļা। āϰোāĻŽাāύ্āĻিāĻ, āĻৌāϤিāĻ, āϰāĻŽ্āϝ, āĻৌāϤুāĻ āϏāĻš āĻšাāĻাāϰো āĻāϞ্āĻĒ āĻāĻে āĻāĻŽাāϰ āϏংāĻ্āϰāĻšে।
āϏোāĻŽāĻŦাāϰ, ā§¨ā§Š āĻ āĻ্āĻোāĻŦāϰ, ⧍ā§Ļā§§ā§
3548
āĻāϰ āĻĻ্āĻŦাāϰা āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰা
Rahathossain1010100@gmail.com
āĻāĻ āϏāĻŽā§ে
⧧⧍:ā§Ēā§§ AM

āĻāϤে āϏāĻĻāϏ্āϝāϤা:
āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝāĻুāϞি āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ (Atom)
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ