āĻŦুāϧāĻŦাāϰ, ⧍⧧ āĻĢেāĻŦ্āϰুāϝ়াāϰী, ⧍ā§Ļā§§ā§Ž

4801

লিখেছেনঃআসাদুজ্জামান জীবন

একটা বাস্তব গল্প বলি ,
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ! মার্কেটিং এর স্টুডেন্ট হওয়া সত্বেও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে-মেয়েদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল।
একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের আমার এক জুনিয়র মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় ! মেয়েটা দেখতে সুন্দরী ! একটা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের মুখে যে স্নিগ্ধতা থাকে, তার কোনো অভাবই এই মেয়েটার মাঝে নেই !
বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের চেয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের সাথে মেলামেশা করতে আমি সব সময়ই কমফোর্টেবল ফিল করেছি।
সেই সুবাদেই ওই মেয়েটার সাথে আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয় !
মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো ! তবে এই ভালো লাগাটার মাঝে কোন কামনা এবং প্রেমের স্পর্শ ছিল না !
রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পরা যায় কিন্তু মায়াবতী মেয়েদের প্রেমে পড়তে নেই , এদের দিকে দু মিনিট তাকিয়ে থাকলেই জীবনটা সুন্দর মনে হয় !
আমি সব সময় স্নিগ্ধতা প্রিয় মানুষ ! প্রেম-ভালোবাসাতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই, তবে স্নিগ্ধতার প্রতি আমার দুর্বলতা খুব তীব্র রকমের !

যাইহোক,
যে মেয়েটার কথা বলছি, তার নাম নীতু !
এই মেয়েটার সাথে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক হয়নি ! আমি কখনো ওরকম ভাবে চিন্তাও করিনি ! সে সময় নীতুর একজন প্রেমিক ছিল ! ছেলেটার একটা ছোটখাটো কাপড়ের দোকান আছে !
নীতুর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু খারাপ হওয়ার কারণে  তার হাত খরচের টাকাটাও ওই ছেলেই দিতো !
আমার মনে আছে , নীতুর জন্মদিনে ওই ছেলেটা রাত ১২ টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত দুটো গ্লাডিওলাস আর একটি গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল !
কনকনে শীতের মধ্যেও প্রেমিকাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার একটা ছোট্ট প্রচেষ্টাকে আমার কাছে খুব বিশাল মনে হয় !
ওদের দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হতো ! তবে দুজনের মাঝে একটা পবিত্র প্রেমের সম্পর্ক ছিল ! একজনের প্রতি অন্য জনের শ্রদ্ধার জায়গাটা ছিল খুব গভীর ! নীতুর ছোট-খাটো প্রয়োজন গুলোর অভাববোধ করতে দেয়নি কখনো !
যেভাবে সম্ভব হয়েছে, ছেলেটা তার পাশে থেকেছে ! আমি নীতুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ার কারণে তার প্রেমিকের সাথেও আমার পরিচয় ছিল ! ছেলেটা অসম্ভব ভালো ! কথার মাঝে এক ধরণের ম্যাজিক আছে ! নীতু বলেছিলো, সে তার কথা শুনেই প্রেমে পরে গিয়েছিলো ! এতো সাংঘাতিক রকমের কথা বলার স্টাইল আর কোনো ছেলের মাঝে সে পায়নি !
ওদের প্রেমের সম্পর্কটা দেখলেও আমার জেলাস ফিল হয় ! কত সুন্দর একটা কাপল !

একদিন সকাল ১০ টায় নীতুর ফোন পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে ঘুম থেকে উঠলাম !
নীতুর একটা চাকরি হয়েছে, একটা টেলিভিশনে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে ! এই সংবাদটা আমাকে তীব্র রকমের আনন্দিত করেছিলো ! একটা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের এমন অর্জনে খুশি না হয়ে আসলে পারা যায় না!
সেদিন বিকেলেই আমি নীতু আর তার প্রেমিক বনানীর একটা রেস্তোরাতে বসে আড্ডা দিলাম প্রায় ৪ ঘন্টা !
নীতুর প্রেমিকের চোখে মুখে আনন্দ মিশ্রিত একটা আতংকের চাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে !

প্রায় ৪ মাস পর নীতু ভীষণ বদলে যেতে শুরু করলো ! নীতুর সাথে তার প্রেমিকের যোগাযোগ এখন তেমন একটা হয়না !
নীতু তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে , এই অজুহাতে আবীরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন ! ও আচ্ছা বলা হয়নি, নীতুর প্রেমিকের নাম ছিল আবীর!
নীতুর মুখ থেকে স্নিগ্ধতা সরে গিয়ে কর্পোরেট আস্তরণ পরে গ্যাছে ! নীতুর সাবলীল ড্রেস কোড পরিবর্তন হয়ে ওয়েস্টার্ন হয়ে গ্যাছে !
নীতুর রুচিবোধে পরিবর্তন এসেছে ! একটা জামা-কাপড়ের দোকানদারের সাথে সম্পর্ক আছে , এই পরিচয়টা নীতু আর তার সাথে বহন করতে চাইছে না !
নীতুর ভালো লাগা তৈরী হয়েছে , একই টেলিভিশন চ্যানেলের একজন বড় কর্মকর্তার সাথে ! ফেইসবুক এ এড থাকার কারণে আমি তাদের কাপল ছবি প্রায়ই দেখি !
নীতুর জন্য আমার মায়া হয় , কারণ সে আজকাল মানুষের লাইন থেকে বের হয়ে নরকের দিকে হাটছে !
একদিন রাতে নীতুকে ফোন দিলাম ,

- হ্যালো , নীতু!
- কি রে কেমন আছিস ?
- হুম, ভালো ! তুই কেমন আছিস ? জব কেমন চলছে ?
- সবই ভালো চলছে ! কাজের এতো প্রেসার তাই খোঁজ ও নিতে পারি না !
- আমি অবশ্য এখন আর সেটা প্রত্যাশাও করি না ! যাইহোক, তোর প্রেমিকের খবর কি ?
- কেন, ফেসবুকে ছবি দেখিস না ?
- না মানে, আবীরের কথা বলছিলাম আর কি !
- ওহ, ওর কথা জানি না রে ! ওর সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গ্যাছে প্রায় ৩ মাস হলো !
- ওর জন্য খারাপ লাগে না ?
- এসব বাদ দে তো দোস্ত ! ভালো লাগছে না !
- হুম, জানি ভালো লাগবে না ! আচ্ছা ঠিক আছে, রাখি এখন ! ভালো থাকিস !
- ওকে বাই!

আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম ! কর্পোরেট কত দ্রুত একটা মানুষকে পরিবর্তন করে দেয় ! এই যে নীতু একটা সময় আবীরের জন্য পাগলের মতো করতো , এই যে এই মেয়েটার বুকের ভেতর একটা পবিত্র হৃদপিন্ড ছিল , এসব কি করে এতো দ্রুত বদলে গ্যালো !

কিছুক্ষন পর আমি আবীরকে ফোন দিয়েছিলাম ,
- হ্যালো, আবীর !
- হুম, কেমন আছেন ভাই ?
- আমি তো ভালো আছি, তোমার কি খবর?
- খুব সম্ভবত আপনি জানেন , এই মুহূর্তে আমার কেমন থাকা উচিত ?
- নীতুকে মনে পরে খুব ?
- নাহ, একদম মনে পরে না ! যখন মনে পরে, তখন নিজেকে নিজে বলতে থাকি " একজন জামা-কাপড় বিক্রেতার জীবনে সবকিছু পেতে হয়না )''!
- আমি জানি , তোমার কষ্ট হচ্ছে , তবুও বলবো একটু নিজেকে বদলে জীবনটা শুরু করো?
- আমি নিজেকে বদলে ফেললে তো নীতু আর আমার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না ! ভালোবাসলে তো বদলে যাওয়া যায়না ! যে বদলে যায় আর যে বদলে ফেলতে চায় তারা আসলে কেউ কখনো কাউকে ভালোবাসেনি!
- এভাবে বুকের ভেতর যন্ত্রনা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাও ?
- তাতে সমস্যা নেই , এই যন্ত্রণার ভেতর ও তো তার একটা অস্তিত্ব আছে ! এটাই সুখের !
- এতটা ভালোবাসা পাপ !
- জানি , আমি পাপী ! পাপী না হলে বোধয় একটা ভুল মানুষকে ভালোবাসতাম না কখনো !
- থাক বাদ দাও ওসব কথা ! অনেক রাত হয়েছে , ঘুমাও !
- আপনিও ঘুমান ভাই! ভালো থাকবেন !

দুজনের সাথে কথা বলা শেষে আমি ছোট-খাটো একটা ধাক্কা খেলাম !
আমি বুঝতে শিখলাম,
কর্পোরেট অহমিকার চাদরটা বড্ড রহস্যময় ! কর্পোরেটে সাকসেসফুল একটা মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথে মাঝে মাঝে ভালোবাসাও বদলায় এমনকি ভালো লাগার মানুষটাও অসহ্য হতে শুরু করে !
জীবন একটা বাজে রকমের চলমান প্রক্রিয়া !

4800

গল্প:: এক্সপায়ার্ড
নাসির খান

এক.
যেদিন সবাই জানতে পারলো আমার অসুখটা  ভয়ঙ্কর এবং আমি আর চারমাস মত বাঁচবো, সেদিন থেকেই আমাকে দেখতে হাসপাতালে লোক আসতে শুরু করলো। আমি যতটা সহজে বললাম যে আমি আর চার মাস বাঁচবো, ব্যাপারটা আসলে অত সোজা না।
আমি সত্যিই  মারা যাচ্ছি। এতদিন ছেলেমানুষি  করে যেভাবে ছুটে চলেছি, তাতে করে আমি আর আমার  পরিচিতরা বুঝতেই পারেনি, এই ছেলেটা পৃথিবীতে  আর অল্প কিছুদিন থাকবে।

আমাকে দেখতে সবার আগে এলেন ছোটচাচী। সোমবার সকাল সকাল হাতে ফুডবক্স  আর দোলনকে  নিয়ে  তিনি আসলেন। আমি ছোটচাচীকে দেখে বললাম, "বক্সে কি ছোটমা? খাবার এনেছেন?"

আমি ছোটচাচীকে ডাকি ছোটমা। মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমাকে ধমক দিয়ে  মা বলতেন, "চাচী আবার কি ডাক? এখন থেকে ছোটমা ডাকবি। বল ছোটমা।"

আমি লজ্জায় মরে  গিয়ে বলতাম ছোটমা। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

ছোটমা আমার কেবিনের ছোট্ট টেবিলটায় বক্স রাখতে রাখতে বললেন, 
"খিচুড়ি  আর মোরগ রান্না করে এনেছি। তোর প্রিয় খাবার।"
আমি বসা থেকে শুয়ে পড়লাম। চোখ চিটমিট করছে। হয়তো কান্নার পূর্বাভাস। ছোটমা আমাকে দু'চোখে দেখতে পারতেন না। মা মারা গেলেন। কদিন পর বাবাও চাকরি থেকে রিটায়ার্ড  হলেন। একান্নবর্তী  পরিবারে আমি আর বাবা হয়ে পড়লাম জঞ্জাল।

আমার মনে আছে, একবার ছোটমার বড় বোন এলেন ঢাকা থেকে। সেদিন ছিলো শুক্রবার। আমি জুমা'র নামায পড়ে দোলনকে ডাকতে ছোটমার ঘরে গেলাম। দেখলাম খিচুড়ি  আর মোরগ রান্না হয়েছে। এটা আমার প্রিয় খাবার জানা সত্ত্বেও ছোটমা আমাকে খেতে ডাকলেন না।

আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। ঘরে এসে মন খারাপ করে বসে থাকলাম। এ নিয়ে সেদিন আমার বৃদ্ধ বাবার সাথে ছোটমা'র তুমুল ঝগড়া  বেঁধে গেল। এক পর্যায়ে বাবা  অতিরিক্ত রাগে  ছোটমাকে মারতে ছুটে গেলেন। এবং ছোটমার কাছে পৌঁছানোর  আগেই বাবার ছোট-খাটো একটা স্ট্রোক হয়ে গেল।

আমি শুয়ে থাকা অবস্থায় ছোটমা প্লেটে করে খাবার নিয়ে বসে গেলেন। উদ্দেশ্য  আমাকে খাইয়ে দেয়া। খিচুড়ি  মুঠো  পাকিয়ে ছোটমা পরম মমতা নিয়ে বললেন-
"দেখি মিঠু, হা কর।"

আমি হা করতে পারলাম না। মুখ যেন বন্ধ হয়ে গেলো আমার। চোখ খুলে দিল আবেগের দরজা। সারা শরীর কাঁপতে লাগল আমার কান্না থামানোর প্রচেষ্টায়।

এক পর্যায়ে আমি বাঁধভাঙা  কষ্টে ছোটমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কেবিনে লোক জমে গেল। আমি থামলাম।

চার বছরের দোলনের চোখে পানি দেখে আমার প্রচণ্ড  বাঁচতে ইচ্ছা হলো। এক পর্যায়ে দোলন স্যালাইনের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
"তুমি কি মারা যাচ্ছ মিঠু  ভাইয়া?"

আমি দোলনের হাত ধরে কাছে টেনে বললাম,
"হ্যাঁ দুষ্টি মেয়ে, মারা যাচ্ছি। এখন থেকে কেউ আর তোর পুতুলের কাপড়  দিয়ে জুতো মুছবে না।"

দোলন কি বুঝলো কে জানে, বারবার চোখ  মুছতে  লাগল। অবুঝ, শান্ত, ভালাবাসাময় দুটি স্নিগ্ধ চোখ।
আমি  শুধু শুধু  হেসে ফেললাম।
জীবনকে ব্যঙ্গ করতেই হয়তো।

যাওয়ার আগে ছোটমা আমার কানে কানে একরকম ফিসফিস করে বললো,  
"মিঠু, আমাদের উপর কোন রাগ রাখিস না। মাফ করে দিস।"
আমি চুপ থাকলাম। কিছু বলার শক্তি পেলাম না। কারণ ছোটমা যে উদ্দেশ্যে  এসেছেন, তা হাসিল করতে মৃত্যুপথযাত্রী এই আমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন যে, আমি সত্যি  মারা যাচ্ছি।

দুই.
একদিন   সন্ধ্যার  দিকে আমার বাবা এলেন। চোখমুখ শুকনো করে বাবা আমার পাশে বসে থাকলেন।
আমার বড় মায়া লাগতে লাগল। আমি না থাকলে বাবাকে দেখার মত কেউ থাকবে না পৃথিবীতে।  রাতে ঘুম ভাঙিয়ে  বাবা আর কাউকে বলতে পারবেন না, "মিঠু আমার পায়ে আবার বাত বেড়েছে। পায়ের উপর উঠে একটু হাঁটবি?"

আমি এত বড় হয়ে গেছি, তবু বাবার পায়ের উপর  আমাকে একপা দিয়ে চেপে চেপে হাঁটতে হয়। কতবার বলেছি, "বাবা ডাক্তার দেখান।"
কিন্তু তিনি একটা টাকাও খরচ করবেন না।

আমার বাবার সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, উনি বেশ কৃপণ।  টাকা খরচ করতে তার খুব অনীহা। বাবাকে কতবার বলেছি, "বাবা আমার দুইশ টাকা লাগবে। একটা বেল্ট কিনতে হবে  প্যান্টের। "
বাবা কোনোদিনও দেননি।

আমিই প্রথম কথা বললাম, "বাবা আপনি কষ্ট  করে আসতে গেলেন কেন? বাতের ব্যথাটা কমেছে?"

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন-
"কেবিনে থাকছিস, টাকা পাচ্ছিস কোথায়?"
আমি হেসে বললাম, "টাকা তো তেমন লাগছে না বাবা।  আমার এক পরিচিত আছেন এই হাসপাতালে। তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে  টাকা পয়সা তেমন লাগে না।"

বাবা আবার থম মেরে গেলেন। আমিও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ  পর বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে অপরাধীর মত বললেন-
"তোকে সেদিন দুইশ টাকা দিতে পারিনি বলে খুব খারাপ লাগছেরে মিঠু। তুই কোনোদিন টাকা চাস না আমার কাছে। অথচ  তোকে দিলাম না।"

আমি কণ্ঠে শীতল ভাব এনে বললাম, "বেল্ট  তো আমি কিনেছি। আপনি মন খারাপ করবেন না। এখন বাসায় যান। নিয়মিত  ওষুধ খাবেন।"

বাবা আমার কথা চুপ করে শুনলেন। এবং আমকে অবাক করে দিয়ে বললেন-
"মিঠু, আমার কাছে চৌত্রিশ  হাজার টাকা আছে। কাল এসে তোকে দিয়ে যাব। তুই খরচ করিস।"

আমার মনটা  ভয়ঙ্কর  কষ্টে ভরে গেলো। বাবার জন্য প্রচণ্ড  মায়া লাগলো আমার। কিন্তু আমি  চাইনি তার টাকা আমি খরচ করে ফেলি। টাকা খরচ করলেও যা হবে, খরচ না করলেও তাই হবে।
শুধু শুধু বাবার টাকা খরচ  করার কোনো মানে নেই। আমি বাবাকে না করে দিলাম।
তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে গেলেন।

তার পাঁচ মিনিট পরেই হাসপাতালের রশীদ ভাই আর একজন মিলে বাবাকে ধরে  আমার কাছে দিয়ে গেলেন।
বাবা নাকি নীচতলার বারান্দার গ্রীল ধরে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলেন। আমার চোখের জল উপচে পড়লো গাল বেয়ে। পৃথিবীর  উপর তীক্ষ্ণ  এক অভিমান চেপে ধরল আমাকে। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, "এত কষ্ট জীবনে। আমি এত দুঃখী কেন!"

তিন.
কয়েকদিনে হাসপাতাল  নামক দুর্গন্ধময়  পৃথিবীটা আমার কাছে অত্যন্ত  আপন হয়ে গেলো। কেবিন থেকে বেড়িয়ে যখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে  ঘুরে বেড়াই, মৃত্যুপথযাত্রী  রোগীগুলোকে কত আপন লাগে তখন। তাঁদের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলি। তারা এত খুশি হন। আমার মানসিক  প্রশান্তিও সীমা ছাড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবি এদের অনেকের সাথেই হয়তো আবার দেখা হয়ে যাবে অচেনা এক জগতে। পৃথিবীতে  আমি যেমন সবসময় ছেলেমানুষি  করেছি, হয়তো সেখানে গিয়েও পরিচিত কাউকে দেখে ঘাড়ে হাত রেখে বলব, "ভাইসাহেব,  আপনার কোথায় জায়গা হয়েছে? যত যাই বলেন, আমার কিন্তু দোযখে থাকার ইচ্ছা। জান্নাতের এত সুখ দিয়ে আমি কী করব? আমার বাবা পৃথিবীতে  একা একা আমাকে ছাড়া এত কষ্টে আছেন।"

আমার কেবিনে বেডের নীচে তিনটা বিড়াল থাকে। তিনটাই দেখতে সুন্দর। একটা মা আর দুইটা বাচ্চা। ওদের বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে আমার।
হাসপাতাল  থেকে দেয়া খাবারের বেশিরভাগই আমি ওদের দিয়ে দেই। আমাকে ওরা ভয় পায় না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।  ছোট বাচ্চা দুটো খাবার খায় আর আমার দিকে তাকিয়ে মিঁউ মিঁউ করে। হয়ত বলতে চায়, "সব খাবার তো আমাদেরই দিয়ে দিলেন। আপনি খাবেন কী?"

খাওয়া নিয়ে আমার  চিন্তা নেই। আমার খাবার নিয়ে প্রত্যেক বেলা যে আসে, সে হলো আমার বন্ধু সাদাত। হাসপাতালে আমাকে দেখতে ওই সব থেকে বেশি আসে। আমার মৃত্যু নিয়ে সবার থেকে, এমনকি  আমার থেকেও বেশি চিন্তিত আর ব্যথিত এই সাদাত।

অথচ ওর কি ক্ষতিটাই না আমি করেছি। বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করে আমাকে বলেছিল ওর ভালবাসা মিথিলাকে একটু সাহায্য  করবার জন্য। ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা  করে আমি প্রেমে পড়ে যাই মিথিলার। মিথিলাও সুড়সুড় করে আমার প্রেমে পড়ে যায়।

থাক, এসব কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মৃত্যুপথযাত্রী  একজনের মুখে প্রেমের এসব গৎবাঁধা  প্যাঁচাল  মানায় না।

চার.
একবার রাতে সাদাত আমার সঙ্গে  কেবিনে থেকে গেল। উদ্ভ্রান্তের মত সে রাত ও সারা হাসপাতাল  ঘুরে বেড়ালো। সৃষ্টিকর্তা এই ছেলেকে কেন এত আবেগ দিয়ে তৈরী করেছে আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। আমি করলাম কী এক টুকরো কাগজে কিছু কথা লিখে সাদাতের হাতে দিলাম।
প্রাথমিক  স্কুলে পড়ুয়া  বাচ্চাদের মত শব্দ করে আমার সামনেই পড়তে লাগলো  সাদাত।
লেখাটা এমন-

"আমি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে চারজন আমার সাথে  দেখা করতে  আসবে না-

১. মিথিলা।
আমি ওকে আর ভালোবাসি না এখন।  ও একটা স্বার্থপর  মেয়ে। তাছাড়া ও আমার সামনে আসলে নিজেকে আমার মহাঅপরাধী  মনে হয়। সাদাত, তুই কি চাস আমি অপরাধী  হয়ে মারা যাই?

২. রেনু।
যে মেয়ে আমাকে পাগলের  মত ভালোবাসে। যেদিন আমি ওকে ফিরিয়ে দিলাম, সেদিনই ও একগাদা ঘুমের ওষুধ  খেয়ে ফেললো। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসে পরিবারের গুচ্ছ প্রশ্নের উত্তরে এই মেয়ে নির্বিকার ভাবে বলল, "মিঠুকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।"
সাদাত, তুই কি একটু  বলবি, আমার কী দেখে এই মেয়েটা এত ভালোবাসে? কী আছে আমার?
এখন ও বাঁচবে কেমন করে?

৩. আমার বাবা।
বাবা যদি আমার আগে মারা যেতেন, তবে হয়তো আমি এতিম হতাম না। কিন্তু বাবার আগে আমি মারা গেলে আমার বাবা এতিম হয়ে যাবে সাদাত।আমি খুব কষ্ট পাই আমিহীন বাবাকে ভেবে।

৪. সাদাত।
পৃথিবীতে  এই একটি  মাত্র ছেলে, যাকে আমি  বন্ধু করেছি। আমি মারা গেলে ও কীভাবে কাঁদবে, এটা কল্পনা করলে আমার বুক ভেঙে কান্না আসে।

এই চারজন যেন আমার সামনে না আসে, এই ব্যবস্থা তুই করবি। কারণ এদের জন্যই আমার এই পৃথিবীতে  সবচেয়ে বেশি বাঁচতে ইচ্ছা করে।"

সাদাত যখন পড়া শেষ করেছে তখন ওর চাপদাড়ি  ভিজে গেছে চোখের জলে। ঠোঁট কাঁপছে কান্নায়। আর আমি অবাক হয়ে অসম্ভব মায়াময় এই মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি।

পাঁচ.
সাদাত আমার অনুরোধ  রাখেনি। এই চারটা মুখকেই আমার সামনে ও ইচ্ছা করে বারবার হাজির করেছে।
আমি শুকনো মুখ আর মৃত চোখ নিয়ে  হাসতে হাসতে ওকে বলেছি-
-"এসব কী হচ্ছে সাদাত? মজা করিস আমার সাথে?"

ও তখন রাগে, অভিমানে, কষ্টে  আমার গলা টিপে ধরে বলে, "কী হচ্ছে মানে? নিজেকে তুই ভেবেছিসটা কী?"

চার মাস হতে খুব বেশি দেরি নেই। আমার শরীরটাও ভেঙে গেছে খুব। ছেষট্টি  কেজি ওজনের এই আমার ওজন কত হয়েছে শুনবেন? তেতাল্লিশ কেজি। ফারুক ভাই শুনলে হয়ত হেসে গড়াগড়ি খেতো। ফারুক ভাইয়ের সাথে সব সময় আমার কথা হত ওজন আর উচ্চতা নিয়ে। সাদাতকে বললাম ফরিদপুরে খবর পাঠাতে। ফারুক ভাই যেন একবার এসে আমাকে দেখে যায়।

সত্যি সত্যি নতুন বিয়ে করা বউ নিয়ে ফারুক ভাই একদিন আমাকে দেখতে চলে এলো। আমাকে  দেখেই চোখ যতদূর সম্ভব কপালে তুলে বলল,
"এটা কে? অসম্ভব !"

আমি ভাঙা  গলায় হাসতে হাসতে বললাম, "ভাই, আপনি তো সবসময় আমার বিপক্ষে বলতেন। আমি উত্তর  বললে আপনি বলতেন দক্ষিণ।  আপনার কথা মাঝে মাঝে সত্যিও হত। কিন্তু আজ কী বলবেন? চার-পাঁচ দিনের ভেতর আমি মারা যাচ্ছি। আজও চলে যেতে পারি অজানা গন্তব্যে।"

ফারুক  ভাইয়ের মুখে রাজ্যের অন্ধকার। বিদায় নেয়ার আগে দরজা থেকে ফিরে এসে কী মনে হতে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, "তুই  মারা যাচ্ছিস না। দেখিস।"

আহারে!  ফারুক ভাইয়ের  কী প্রচেষ্টা সান্ত্বনা দেয়ার। আমি কীভাবে বোঝাবো, আমি মারা যাচ্ছি সেই কারণে আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার কষ্ট কিছু মানুষের ভালবাসার জন্য।

ছয়.
চারমাস পার হয়ে গেলো। আমি মারা গেলাম না সত্যি সত্যি। মানুষের প্রবল ভালবাসা নিয়ে হয়তো জীবন  প্রদীপটা দপদপ করছিলো। যেকোন সময় নিভে যেতে পারে সে প্রদীপ। এটা হলো বোনাস। শরীরের দিকে তাকিয়েও আমার আরো বাঁচতে ইচ্ছা হলো অনেকদিন।

ভালবাসার প্রশ্নে আমি অনেকের কাছে ঋণী।  ঋণ শোধ করার প্রবল ইচ্ছা আমার। হয়তো প্রকৃতি চায় না ভালোবাসার ঋণ শোধ হোক।
মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে এখন আমি বাড়িতে থাকি।বাবা আমার সাথে সারাক্ষণ হেসে হেসে গল্প করে।
বাবার ধারণা আমি সুস্থ হয়ে গেছি।

ছোটমা প্রতিদিন ভোরে রুটিন করে আমার কাছে এসে জানতে চায় আমি কেমন আছি। ছোটমা কী উত্তর  আশা করে আমি জানি না। আমি বড় বড় শ্বাস টেনে বলি-
"ভাল আছি ছোটমা।"♦

4799

ছোটগল্প:: অপেক্ষা
না সি র     খা ন

: আশ্বিনের সকাল।
আকাশের দিকে তাকানো যায় না। কেমন চড়চড়ে রোদ উঠেছে। বাইরের প্রকৃতি অসম্ভব ঝকঝক করছে। কী সুন্দর ঝলমল করছে রোদ। অসহনীয় ব্যাপার যা, তা হলো অসহ্য গরম।
প্যান্ট-শার্ট পরে বাইরে বের হওয়ার আগেই শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে।

বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নামতেই  দেখলাম পুরো দু'বালতি কাপড় নিয়ে মা কলতলায় ধোয়ার আয়োজন করছে। কেমন দুঃখি দুঃখি লাগছে মাকে। বেশি পুরাতন কাপড় পরেছেন বলেই হয়তো।

কিছু বলব না বলব  না করেও মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
"মা, যাই।"
অন্য সময়ের মত এখনও কোন উত্তর পাবো না জানতাম, কিন্তু মা আমার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললো, "কোথায় যাস?"

আমি থমকে গেলাম। আসলেই তো কোথায় যাচ্ছি আমি? মা কে কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবো। পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপণ দেখব, এইতো।

আমি চুপ করে থাকলাম। কথা বললেই মা আমাকে অপমানসূচক কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। কী লাভ উত্তর দিয়ে। বের হওয়ার জন্য পা বাড়াবো, মা তখন ডেকে উঠলো, "কবির শোন।"

আমি স্বাভাবিক থাকার চেস্টা করলাম।
-"বলো মা।"
-"কই যাচ্ছিস বলে যা।"
-"কোথাও না  মা।  একটু বাজারের দিকে যাব আর রাজুদের বাসায় একটু কাজ ছিলো। "

মা বালতিতে কাপড় ঠাসতে ঠাসতে আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
-"তোর বয়স  কত  হলো যেন?"

আমি নিশ্চিত মা এখন আমাকে খুবই অপমানজনক কিছু কথা শোনাবে। আমার অন্য ভাই-বোনকে মা ঠিকই আদর করে। আমি কি দোষ করেছি কে জানে। আমার সাথে মা আজকাল ভালো করে একটা কথাও বলে না।

আমি মাটির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম-
-"এই জানুয়ারিতে ত্রিশ হবে।"
মা আগের থেকে আরো শান্ত গলায় বলল-
-"ত্রিশ বছরের ছেলে হয়ে বুড়া বাপের ঘাড়ে বসে ভাত খাস, লজ্জা করে না তোর?"

নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস  পড়ল আমার।
একবার ইচ্ছা হলো বলি, "করে মা, খুবই লজ্জা করে। আর খাবো না ঘাড়ে বসে। খুশি?"

ভাবলাম, থাক। কি লাভ বলে। কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
ইদানিং মা'কে খুব অচেনা মনে হয়। এমন ব্যবহারের কারণ আমার কিছু না করা। ইচ্ছা করেই যে কিছু করছি না, তাও কিন্তু না। চাকরির জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কিছুতেই কিছু হয় না। মাকে একথা কে বোঝাবে?

মায়ের মুখ থেকে আমি ভাল কথা শোনার অপেক্ষায় থাকি, মা একথা বুঝতে পারে না।

সেদিন রাতে খাওয়ার সময় মা একটু নরম সুরে  বলল,
-"কবির তোকে আরেক টুকরা মাছ দেই?"

কণ্ঠে এমন মমতা ছিলো যে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ছোট ভাই হিরু বলল, "দাদা কাঁদছো কেন?"

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, "একটা থাবড়া খাবি। কাঁদছি মানে?"

আমি চাই প্রতিদিনই মা আমার সাথে এমন মমতা নিয়ে কথা বলুক । প্রতিদিনই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসুক। এর থেকে সুখ আমি কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারি না।

দুপুর পর্যন্ত প্রচণ্ড রোদের মধ্যে এখানে সেখানে ঘুরলাম। রোদ আর ক্ষুধায় মাথা ঝিমঝিম করছিলো আমার। ঠিক দেড়টার দিকে রাজুদের বাসায় আসলাম। দরজা খুলে দিলো রাজুর বোন মীরা। বললাম,
-"কেমন আছিস মীরা? রাজু বাসায় আছে নাকি রে?"

মীরা  হাসি মুখে বাঁকা কথায় উত্তর দিলো,
-"কবির ভাই আপনি ভালো করেই জানেন এই সময় বাসায় আমি ছাড়া এখন কেউ থাকে না। ভাইয়া অফিসে। খেতে আসলে বলেন খেতে দেই। এত ভাণ জানেন আপনি।"

মীরার কথায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।
শুকনো মুখে বিদায় নিলাম ওদের ওখান থেকে।  বাসায় গেলেই আবার মন খারাপ করা  আরো পরিস্থিতির  সম্মুখীন হব, তাই ভাবলাম বড় আপার বাসায় গিয়ে আপাকে চমকে দিয়ে আসি। মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরই তো আপার বাসা। আমাদের বাড়ির কেউ আপাদের বাসায় যাবে, এটা হয়ত আপা কল্পনাও করতে পারবে না।

পৃথিবীতে  ধনী আর গরীবের মাঝে আসলেই  যে পার্থক্য আছে, এটা বড় আপার নতুন সংসার দেখলেই বোঝা যায়। আপার অসাধারণ রূপ-সৌন্দর্যের কারণে এত ধনী পরিবারে আপার বিয়ে হলো। ব্যাস, এই পর্যন্তই। বছরে একবার দুবার আমাদের বাড়িতে আসা ছাড়া আপাদের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই আমাদের।

যা ভেবেছিলাম তাই। আমাকে দেখে আপা ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। কি করবে দিশা খুঁজে পেলো না।
প্রায় টেনে হিঁচড়ে আপা মুহূর্তে ওর রুমে আমাকে নিয়ে গেলো।
আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে আপা।
"আপা কেমন আছিস" প্রশ্নটা করতে কোন ইচ্ছা হলো না। আপাকে দেখেই মনে হলো আপা ভাল ছাড়া খারাপ নেই।
উত্তেজনায় আপা তেমন কিছু বলতে পারলো না। শুধু কি খাবি কি খাবি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যেন পৃথিবীর সকল খাবার আপাদের বাসায় আছে। আর আমি এই বাসায় যেন খেতেই এসেছি শুধু।

দশ মিনিটের মধ্যেই আপা ওর রুমে খাবার নিয়ে এল। এত তাড়া কিসের বুঝলাম না। বললাম,
-"তোর শাশুড়ির সাথে দেখা করে এসে বাইরের টেবিলে বসে খাই?"

ইচ্ছা করেই বললাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী আপা তাড়াহুড়া করে বলল,
-"না দরকার নাই। এখানেই খাবি। ভাই তারাতারি খা। "

যেন আমি চুরি করতে এসেছি। বললাম,
-"তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন আপা?"
আপার অবাক করা উত্তর,
-"একটু পরই তোর দুলাভাই খেতে আসবে। আমি চাই ও আসার আগেই তুই চলে যা।"
-"কেন? দুলাভাই কি আগের মতই  আছে?"
-"না আগের মত নেই। আগের থেকে বেশি জানোয়ার হয়েছে। তুই খা তো।"
-"কিন্তু আপা আমি তো একটু আগেই রাজুদের বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আমি এখন খাবো না প্লিজ।"

আপার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আপাকে বললাম,
-"আপা একশ টাকা দে'তো। আমার জন্য না। ঘরে অনেকদিন ধরে চা-চিনি নেই। মা প্রতিদিন বাবার সাথে এ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি  করে।"

আপা এক দৌড়ে ড্রয়ার খুলে পাঁচশ টাকা এনে আমার হাতে ধরিয়ে  দিলো।"
আমি নিশ্চিত  যে আমি বিদায় নেয়ার পর আপা আমাদের কথা ভেবে দরজা আটকে অনেকক্ষণ  সময় নিয়ে বসে বসে কাঁদবে। আমার মনটাও ভীষণ  খারাপ হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম  আপাকে বলে  দুলাভাইয়ের অফিসের সেই স্টোর কিপারের চাকরিটা নেব। কিন্তু অবস্থা যা দেখলাম, তাতে আমরা আমাদের প্রতীজ্ঞা ভেঙে দুলাভাইয়ের স্মরণাপন্ন হতে সাহস দেখালাম না।
ধরে নিলাম জীবনটা এমনই।

সারা বিকেল বাইরে বাইরে কাটিয়ে রাতে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্ধ্যার পর চা আর চিনি কেনার জন্যে বাজারে ঢুকতেই ডাকপিওন চাচার সাথে দেখা। আমার নাকি দু'টি চিঠি এসেছে। কাল হাতে পাবো।
আমার বুকটা অজানা এক অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো।
ঢাকার কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছিলো চাকরির ব্যাপারে। তারা বলেছিলো চিঠি লিখে জনাবে।
দু'টি  চিঠি তাদের কাছ থেকে আসা নয়তো?

রাত করে বাসায় ফিরলাম। দুয়ারে পা দেয়ার সাথে সাথে ছোটবোন রেনু কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না শুরু করলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলে মানুষের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-" দাদা, মা খুব চিন্তা করছে। মা বলল তুমি নাকি রাগ করে ঢাকা চলে গেছো। আর আসবে না বাড়িতে। আমার খুব কষ্ট  লাগছে দাদা। হিরু তোমাকে বিকাল থেকে খুঁজছে।"

পারিবারিক ভালোবাসার অস্বাভাবিক মমত্বে আমার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে গেলো। এই বুঝি কেঁদে ফেলব আমি। কি বলব বুঝে পেলাম না।

মায়ের হাতে চা-চিনি দিলাম। বাড়িতে এত কাণ্ড হচ্ছে অথচ মা কিছুই বলল না। জিজ্ঞেসও করল না আমি কোথায় ছিলাম। সারাদিন খেয়েছি কিনা। আবার সবকিছুই আগের মত। আমি ফিরে এসেছি, এই হয়তো বেশি।

রাত বারোটার দিকে রেনু আমার রুমের দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলল,
-"দাদা একটা অনুরোধ রাখবে?"
আমি হেসে ফেললাম,
-"না রাখব না।"
-"না শুনেই না বলছো কেন?"
-"আমাকে  তোর জন্য রাখা এক গ্লাস দুধ চুরি করে খেয়ে ফেলতে বলবি এই তো?"

দেখলাম রেনু চুপ করে আছে। আমাদের সংসারে অভাব  লেগে আছে, তারপরও মা রেনু আর হিরুর জন্য প্রতিরাতে এক গ্লাস করে দুধের ব্যবস্থা করেছে। কাঁথা সেলাই করে প্রতি মাসের দুধের টাকা শোধ করে মা।
আমি বড় হয়ে গেছি, এই জন্যই হয়ত আমার জন্য দুধ রাখা হয় না। এতে আমার কোন মন খারাপও নেই। কিন্তু প্রায়ই রেনু চুরি করে ওর জন্য বরাদ্দের দুধটুকু আমাকে দিয়ে খাওয়ায়। ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা। এইতো কত সুখে আছি আমি।

অনেকক্ষণ পর রেনু বললো,
-"দাদা প্লিজ। খাবে না?"
আমি খুশি হয়ে বললাম,
-"নিয়ে আয়। অর্ধেক আমি, অর্ধেক তুই।"

খেতে খেতে আপার বাসায় যাওয়ার গল্পটা বললাম ওকে। ওর চোখ খুশি আর উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠলো। সব সত্যি বললাম না। বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলে ফেললাম। মাকে না বলার জন্য নিষেধ করে দিলাম রেনুকে।

মাঝরাতে ভুবন ভাসানো জোসনায় ভেসে গেলো প্রকৃতি। মনে আমার চাপা উত্তেজনা। কাল দুটা চিঠি হাতে পাবো। কি জানি কি লেখা আছে। হয়ত আমার চাকরি হয়ে গেছে। আবার হয়তবা হয়নি।প্রহর শেষে কী অপেক্ষা করছে কে জানে।

ভাবলাম অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে জোসনা দেখব আজ। মোড়া আনার জন্য বারান্দায় যাওয়ার সময় স্পষ্ট শুনলাম মা  কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে।  একটু থমকে দাঁড়ালাম। শুনলাম বাবা দুঃখভারাক্রান্ত গলায় মা কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন,
-"কাঁদে না শাহানা। কবিরের সাথে তুমি যতই খারাপ ব্যবহার কর, এতে ও কিছু মনে করে না। তুমি জানো না কবির কত ভাল ছেলে আমাদের।"

সৃষ্টিকর্তা কি ইচ্ছা করেই কথাগুলো আমাকে শুনিয়ে দিলেন? নিজের গালে হাত দিয়ে অস্তিত্ব পেলাম জলের। চোখ থেকে নেমে আসা এক ধারা কষ্ট। ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে মাকে বলি,
"আমি যে তোমাদের কত ভালোবাসি, তা তোমরা কেউ জানো না মা। কেউ না।"

রাত বাড়ে। জোসনা গাঢ় হয়। আমার অপেক্ষার প্রহর সেই সাথে আরো গভীর হয়। কখন সকাল হবে। আমার হাতে চিঠি আসবে।
ভাগ্য বদলানোর কথা সেখানে লেখা থাকলে হয়তো আমার প্রতি মায়ের তখন থাকবে না কোন অনিচ্ছার ঝড়।
আমাদের পৃথিবীটা বদলে যাবে। রাতের বেলা মা আমার জন্য দুধের গ্লাস নিয়ে বলবে,
"কবির তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমা বাপ। সকালে অফিস আছে না?"

রেনুকে আর খেলতে হবে না ভাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার দুধচুরি খেলা।

অপেক্ষায় কত কল্পনা আমার। ঘুম আসে না। রাতের পক্ষ বদল হয়। নিকষ আঁধারকে বিদায় দিয়ে আমি ঘুমাতে আসি। অপেক্ষা আর কল্পনার পৃথিবীকে আপন করে আমার চোখে তখন ঘুম জড়িয়ে আসে।
সকালে যে পৃথিবীটা দেখব, হতে কি পারে সে পৃথিবী ভোরের স্নিগ্ধতার মত জড়াবিহীন? এত সুন্দর?:::