#_সোনালী
পাশের বাড়ির আমজাদ ভাই, বউ মারা যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে আবার নতুন বউ ঘরে এনেছে। বিছানায় আমাদের মাঝে শিমু, মেয়েটা ঘুমিয়েছে, এই শীত পেরুলেই বয়স হবে ছয়। আমরা দুজন ওর দুপাশে - মুখোমুখি। আমি আর সোনালী। সোনালী হঠাৎ আমজাদ ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুলে আমাকে প্রশ্ন করলো,
' আমি মারা গেলে তুমিও কি আবার বিয়ে করবে?'
..হ্যা বুড়ো তো হইনি!
মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে কথাটা। কি আর, পরিবারের প্রত্যেক বউয়ের শরীরে নিশ্চই পেট্রোল থাকে, আর স্বামীদের এই ভুল গুলো তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়! ব্যাস জ্বলে ওঠে তারা ! সোনালীও জ্বলে উঠলো!
'নামো বিছানা হতে, তার পর এ ঘর হতে বের হবে। আজ হতে আমাদের মা মেয়ের সাথে এক ঘরে থাকা তোমার বন্ধ। '
এ্যা বলে কি? এই শীতের রাতে বাহিরে থাকতে হবে! ঠান্ডার ভয়ে যাতে রাতে বিছানা হতে উঠতে না হয় সেজন্য খুব কম পরিমান পানি পান করে শুই! তিন দিন পর গত কাল সকালে গোসল দিয়েছি! ইচ্ছে ছিল সাত দিন গোসল দিবো না! কিন্তু সোনালীর দোষেই, ও যদি হঠাৎ ..! হিম শীতল জলে গোসল দিয়ে সারাটা দিন কেঁপেছিলাম! না আগুনে জল ঢালতে হবে।
..'সোনা, ভুল হয়েছে সোনা , আসলে আমি বলতে চাইনি! সোনা।
'খবরদার তোমার ঐ মুখে সোনা ডাকবে না বলে দিলাম, নতুন বউ এনে তাকেই ডাকো। এখন বের হবা না আমি আর শিমু বাইরে যাবো! '
আগুনে অনেক জল ঢাললাম, কিন্তু কাজ হলো না, বরং আগুনের তেজ বেড়েই গেল। বাধ্য হয়েই ঘর হতে বের হয়ে এলাম। কিন্তু বাহিরে বের হয়েই বুঝলাম যে কেন লোকে বলে মাঘের শীতে বাঘ কাঁদে! এ শীতের প্রকোপ ভয়বহ! সোনালী দরজা বদ্ধ করে শুয়েছে, তাই বাধ্য হয়ে সাহস করেই এই ঘরে এসে শোয়া ।
ভয় করছে আমার, ভীষন ভয়। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে এই ঘরে একরাত ঘুমাতে চেয়েছিলাম , তার পর তের বছর কেটে গেছে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এ ঘরে দিনের আলোতেও প্রবেশ করি নি আমি ভয়ে। কি হয়েছিল সে রাতে? ভাবতেই মেরুদণ্ডে শিতল শিহরন অনুভব করলাম। শীতের রাত, প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝেও আমি ঘেমে উঠেছি। না সে রাতের স্মৃতি গুলো আর ভাবতে চাই না।
এক সময় এই ঘরটাতে আমার দাদাকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল। তার পর হতে এ ঘরে আমাদের বাসার তেমন কেউই শোয় না। মাঝে মধ্যে আত্মীয়রা এলে তাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। কিন্তু এই ঘরটা আমার জন্য নিষিদ্ধ, সেই চৌদ্দ বছর বয়সের সেই রাত হতে।
নিস্তব্ধ রাত, অন্ধকারের মাঝে ঘরের ভিতরে একটা জোনাকি দেখতে পেলাম সেই রাতের মতো। সাথে সাথে কম্বলের তলে মুখ লুকালাম। স্থির হয়ে রইলাম, কিন্তু ভয়ে কাঁপছি - তের বছর আগের রাতটা আবার ফিরে আসছে! সাতাশ বছরের যুবক আমি যেন আবার সতের বছরের কিশোরে পরিনত হচ্ছি!
কি ভুলটা করলাম, কেন জেনে শুনেই মরতে এলাম এ ঘরে? এই তীব্র শীত আর ঠান্ডায় বাহিরে থাকলে নির্ঘাত জমে যেতাম। সেটাই বোধহয় ভালো ছিল, এই ভয় নিয়ে মরার চেয়ে!
কম্বলের নিচে দম বদ্ধ হয়ে আসছে আমার। কিন্তু উপায় নেই, আমার ভিতু সত্তা আমাকে গ্রাস করে রেখেছে। ভূত প্রেতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না এই বিশ্বাসই এখন হারিয়ে ফেলেছি। দশ বছর আগের রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মেন্টালি ডিসঅর্ডার বলে ভেবে নিজেকে শান্তনা দিয়েছিলাম নিজেকে এতদিন । কিন্তু এখন!
মেঝে হতে কিছু এলোমেলো পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ আমার বিছানা কেঁপে উঠলো জোরে, কেউ একজন ঝাকি দিয়েছে। কিন্তু এই মহুর্তে এ ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই। ঘর ময় ফিসফিস অস্পষ্ট কথাবলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি !
ভয়ে আতঙ্কে আমি নির্জীব হয়ে যাচ্ছি। কম্বলের নিচ হতে মুখ বের করলেই হয়তো দেখতে পাবো সে রাতের মতো, 'অন্ধকারে ঘরের কোনে একটা কালো বিড়াল - আগুনের মতো জ্বলছে চোখ দুটো, ধীরে ধীরে বিড়াট আকার ধারন করছে সেটি, আর হঠাৎ করেই দেখতে পাবো বিড়াল নয়, একটা বিশাল দানব যে আমার দিকে ছুটে আসছে ! আমি চিৎকার করতে চাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। গলায় যেন সব আওয়াজ আটকে গেছে! '
এর পরের কি হয়েছে জানি না, সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলুম। যখন জেগে উঠলাম, তখন বুঝলাম শরীরে প্রচন্ড জ্বর আর ব্যাথা। সেই সাথে নিজেকে আমার বিছানায় দেখতে পেলাম। পাশে বসে আছে সোনালী। বেশ চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছে ওকে। শিমুকে ঘরে দেখলুম না, নিশ্চই ওর দাদীর সাথে খেলছে। জানালা দিয়ে ঘরে যে আলো এসেছে, তাতে বুঝলুম বেশ বেলা হয়েছে।
... " আমি এখানে কিভাবে ? " জানতে চাইলাম সোনালীর কাছে।
" কি হয়েছিল তোমার রাতে ? আমি বলেছি বলে কি ওভাবে ঘর হতে বের হয়ে যাবে! ও ঘরে যেতে বলেছে কে? যদি কিছু হতো তখন, আমার কি হতো? " সোনালী আমার প্রশ্নের জবাবে পাল্টা একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করলো। সেই সাথে ওর ডানহাতটা কপালে রাখলো ।
" না , জ্বরটা একটুও কমে নি । শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে গরমে! আমি তো চিন্তায় মরে যাই, আমার জন্য তোমার এ অবস্থা। বাবা ডা. ডাকতে গেছে। ডা. আজকাল জমিদার হয়েছে, সেই সকালে বাবা গেছে এখনো এলো না! খবরদার উঠবা না। পানি নিয়ে আসতেছি। কুলি করে খাবে। "
বলতে বলতে বিছানা হতে নেমে বাহিরে গেল। হাঁসি পেল কেন যেন! রাতে যে রুক্ষমূর্তি ধারন করেছিল এখন তার উল্টো! আমার জন্য ব্যাস্ত, মায়া, মমতায় পূর্ন যেন কোন দেবী সে!
ডা. এসে জ্বর মেপে, আমার দেখে দু তিন প্রকার ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে চলে গেল। ছোট বেলা হতেই এই ট্যাবলেটের প্রতি অরুচি আমার। দেখলেই পেটের ভিতরের নাড়িভূড়ি বের হতে চায় গলা দিয়ে, এখন কিনা এই ট্যাবলেটই গিলতে হবে! সিরাপ হলেও না হয় কথা ছিল!
রাতে সোনালী সিমুকে পাঠিয়ে দিলো মায়ের কাছে। ও ওখানেই রাত কাটাবে। আমি সারাদিন বিছানা হতে উঠি নি । বাইরে কুয়াশা ঠান্ডা। তাছাড়া শরীরের তাপমাত্রা এই নেমেছে তো, কিছুক্ষন পরেই ১০৪ ডিগ্রি। ট্যাবলেটে খাবো না, সোনালী জোর করে গেলালো।
আলো নিভিয়ে, আমার পাশে বসে বললো, ' তুমি ঘুমাও, তোমার মাথা টিপে দি'
... তুমি ঘুমাবে না?
" তোমার এ অবস্থা, আর আমি ঘুমাবো তাই না! আমার ঘুম আসবে না কিছুতেই "
... ঘুমাতে না পারো তো ভালোই, আজ সারা রাত গল্প করে কাটানো যাবে কি বলো!
" না, তুমি ঘুমাবে, অসুস্থ শরীরে রাত জাগার দরকার নেই। তুমি সুস্থ হও তার পর রাত জেগে গল্প করবো। বুঝেছো।"
... হু।
সারা রাত ঘুমায় নি সোনালী। আমিও আধা ঘুম আধা জাগার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিলুম রাত। সারা রাতে ও অনেক বার আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বরের উপস্থিতি দেখেছে। শরীরের কাঁথা কম্বল ঠিক করে দিয়েছে। যেমনটি ছোট বেলায় আমার মা করতো। নারী মাত্রই মা। মা, মা। বোনও মা। স্ত্রীও মা। একজন নারী কি সন্তান, কি স্বামী, কি ভাই- সকলকে মায়ের মমতা দিতে পারে, ভালোবাসা দিতে পারে!
অনেক বছর কেটে গেছে। আজ শিমু, জামাই সহ বাড়িতে এসেছে। গত বছর বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠিয়েছি ওকে । এখন মস্ত বড় বাড়িতে একা থাকি। সোনালী নেই, অভিমান করে চলে গেছে। তখন শিমুর বারো। এখন উনিশ। না দ্বিতীয় বিয়ে করি নি। সোনালীর ভালোবাসা বুকে নিয়ে দশ বছর কেটে গেছে কিভাবে বুঝতেই পারি নি। ইদানিং শিমু আমাকে প্রায়ই জোড় করছে। বলছে,
" বাবা, একটা বিয়ে করো। আমি অন্যের বাড়িতে, তুমি একা থাকো। আমি নেই, কে দেখবে তোমায়? "
... "নারে মা, এ বয়সে বিয়ে! তোর বুড়ো বাপকে নিয়ে লোকে হাঁসাহাঁসি করুক তাই চাস বুঝি! তোর মাকে নিয়েই সুখে আছি। " জবাব দেই।
" মা তো মারা গেছে সেই কবে। অত বুঝি না, বিয়ে করতেই হবে, বলে দিলুম। এটাই শেষ কথা। "
আর কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। সে বলেতেই থাকে, খুব ভালো, ঠিক ওর মায়ের মতো না কি মহিলা দেখেছে আমার জন্য! আমি শুনি না। শেষ বয়সে বিয়ে! না আমার এ কল্পনাও যেন পাপ। সোনালীর মুখ ভেসে ওঠে দুচোখে। ওর মুখ খানা স্মৃতিপটে আগলে, শিমুকে নিয়েই তো বেশ কেটে গেছে এত দিন। আর বা কয়টা দিন বাকী?
লেখা: নুর আলম সিদ্দিক
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ