বিছানা হতে উঠে বাহিরে এলাম। আশ্চর্য আজ পূর্নিমা! রাত চাদের আলোয় দিনের মতোই উজ্জল। সেই আলোতে দেখলাম আঙিনার একটা চেয়ারে নুর নাহার সোহেলকে কোলে নিয়ে চাঁদ দেখাচ্ছে, আর গুনগুনিয়ে গাচ্ছে-
' আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা,
আব্বুর কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
ধান কাটলে কুড়ো দিবে, মাছ কুটলে......
শত প্রলোভনেও সে চাঁদ কি আর আসে! ছোট ছেলেটাই বা তার কি বোঝে ! সে চাঁদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে, যেন হাত বাড়ালেই ছুতে পারবে চাঁদ। তা দেখে নুর নাহার তার ছেলের কপালে বার বার চুমু খাচ্ছে । চাঁদ টিপ দিয়ে না গেলেও মায়ের ভালোবাসার চুম্বনটা ঠিকই ছেলেটার কপালে টিপ দিয়ে যাচ্ছে অবিরত ভাবে ।
আমি দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম মা ছেলেকে। রাতে বাবারা নিশ্চিন্তে ঘুমালেও মা দের ঘুম হয় না। এই তো আমি ঘুমাচ্ছিলাম, আর নুর নাহার ছেলেটাকে বাহিরে নিয়ে এসে চাঁদ দেখাচ্ছে, গান শোনাচ্ছে! আমাকে যদি একটা রাতের জন্য সোহেলের দায়িত্ব দেয়া হয়, আমি বাবা, তবু পারবো না সঠিক ভাবে তা পালন করতে! কিন্তু রাতের পর রাত, দিনের পর দিন নুর নাহার ছেলেটার দায়িত্ব কি সুন্দর ভাবে তা পালন করে চলছে! সব মায়েরাই এ কাজে সিদ্ধহস্ত। আর এ কারনেই হয়তো সন্তানেরা প্রথমেই মা ডাকটা ডাকতে শিখে যায়।
বেশ ভালোইে লাগছে মা ছেলেকে চাঁদের আলোয় দেখতে। কিন্তু ভালোলাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেল না। আমার মায়ের কথা মনে পড়লো। আমার মা, উনিও তো আমার জন্য এভাবে রাতের পর রাত জেগে গান শুনিয়েছিলেন, চাঁদ দেখিয়েছিলেন, কাপর নোংরা করলে তা বদলে দিয়েছিলেন - যে মা আমাকে কষ্ট করে, আমাকে কষ্ট না দিয়ে এত বড় করেছেন, সে মাকে আজ বৃদ্ধ বয়সে এসে কিনা একা তাকে আলাদা রান্না করে খেতে হচ্ছে!
বৃদ্ধা বয়সে এসে মানুষেরর ধৈর্য শক্তি, বুদ্ধিমত্তা কিছুটা হলেও লোপ পায়। আমার মা তার বাহিরে নন। এক সময় তিনি খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু এই শেষ বয়সে তিনি একটা বিষয় নিয়ে বার বার কথা বলেন, যাকে বলা হয় কথার প্যাচাল!
এই জন্য একদিন নুর নাহার বাবার বাড়ি চলে গেল। আর সংসার করবে না বলে পণ করলো। কারন কি? কারন আমার মা। মা যদি আলাদা থাকে, খায় - তাহলে সংসার করবে সে। না হলে নয়। আমি পড়লুম বিপদে। সবে বাবা হয়েছি। এই অবস্থায় ডিভোর্স? প্রশ্নই ওঠে না। অথচ নুর নাহারকে ভালোবাসি খুব।
একদিকে নুর নাহার, অন্য দিকে মা। কি করা যায়? এই বৃদ্ধ বয়সে মাকে একা আলাদা রান্না করে খেতে হবে? এটা সন্তান হিসাবে সহ্য করবো কিভাবে? কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।
শেষে সমাধান দিল মা নিজেই। সব শুনে তিনি নিজেই আলাদা হয়ে গেলেন। আমি মানা করেছিলাম, বলেছিলাম, " মা ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেই । যে তোমাকে সহ্য করতে পারে না, তার সাথে সংসার করার মানে হয় না! "
মা কথাটা শুনে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল, " ডিভোর্স দিলি, তার পর? আবার বিয়ে করলি, সে যদি এর চেয়ে খারাপ হয়? ছেলের বাপ হয়েছিস, আমার জন্য সংসার ভাঙলে চিন্তা কর ছেলেটার কি হবে? আমি এখনো চল আছি, নিজেই করে খেতে পারবো। আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। এমনিতে বৌমা কিন্তু ভালো। যা তুই গিয়ে নিয়ে আয়। "
এর পর হতে মা আলাদা। বাড়িতে দু দুটো রান্না ঘড় এখন। একটা বাড়ি, অথচ দু চূলোয় রান্না হয় সকাল সন্ধায়। শ্বাশুড়ি কি রান্না করলো বউ খোজ রাখে না। বউয়ের রান্নারো খোজ শ্বাশুড়ি রাখে না। আমি রাখি, কারন আলাদা রান্না করে খেলেই মা পর হয়ে যায় না। মা, চিরকালই মা। মা সদাই আপনজন।
আজ নুর নাহার মা হয়েছে। যেমনটা আমার মা হয়েছিল একদিন। আজ তার ছেলে বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে - নুর নাহারের ছেলেও বড় হবে বিয়ে করবে। আচ্ছা সেদিন কি আমার মায়ের মতো নুর নাহারকেও এ অবস্থায় পড়তে হবে? ভাবনায় আসতেই আমি নুর নাহারের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, " কখন উঠলে? " তার পর আবার ছেলের দিকে মনোযোগ দিলো।
- "একটা কথা বলি।" নিচু স্বরে বললাম।
- "বলো। " ছেলেটাকে বুকে নিয়ে আমার দিকে তাকালো।
- "শেষ বয়সে যখন আমি মারা যাবো, হয়তো তখন তুমি বেঁচে থাকবে। সে সময় তোমার ছেলের বউ যদি তোমাকে সহ্য করতে না পারে তখন তোমার কেমন লাগবে বলতে পারো? " ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি। ও দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে, আমি ওর দিকে। নিরবতা।
এই নিরবতা ভঙ্গ করে কেঁদে উঠলো ছেলেটা । নুর নাহার ব্যস্ত হয়ে গেল ছেলেকে নিয়ে।
- " জাদু, সোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, লক্ষী, খোকা ঐ দেখো চাঁদ মামা....."
আমি জবাব পেলাম না। ছেলের কান্না থামাতে ব্যস্ত নুর নাহারের পাশ হতে চলে এলাম। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো আমি - মা ছেলের সুখের মহুর্ত্যে অনধিকার প্রবেশ করে সেখানে অশান্তির বীজ বপন করে এলুম! আমি না গেলে ছেলেটা কাঁদতো না! নিশ্চই নুর নাহারের মাঝেও কোন প্রকার ঝড় উঠেছে।
বিছানায শুয়ে আছি। কিছুক্ষনের মধ্যে নুর নাহার ছেলেটার কান্না থামিয়ে নিয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পরলো। কোন কথা বললো না আমার সাথে, অথচ সে জানে আমি জেগেই আছি। আচ্ছা সে কি ভাবছে এখন? আবার কি সংসার না করার কথা চিন্তা করছে? ভাবতে ভাবতে দু'চোখে ঘুম এসে বাসা বাধলো।
ঘুম ভাঙলো চিৎকার চেঁচামেচিতে। এই সকালে কারা চিৎকার করছে এভাবে? যাদের গলার চিৎকার শুনলাম তারা হলো মা, আর নুর নাহার। কি নিয়ে এত চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে? বেশ কিছুক্ষন শোনার পর বুঝতে পারলুম ব্যাপারটা।
নুর নাহার আর মাকে আলাদা রান্না করে খেতে দিবে না। কিন্তু মায়ের কথা, না তিনি আলাদা রান্না করে খাবেন। তিনি চান না তার ছেলের সংসার নষ্ট হোক। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে।
জানি নুর নাহারই জিৎবে। জিতুক। অন্তত গত রাতের পর সে হযতো বুঝতে পেরেছে । আসলে প্রত্যেক বউ ই বুঝবে এটা, বোধোদয় হবে তাদের, যদি তাদের বোঝানো হয়। যেমনটা আমি বোঝাতে পেরেছি নুর নাহারকে, বোধোদয় হয়েছে ওর।
আজ আর এত সকালে ঘুম হতে জাগার প্রয়োজন মনে করছি না । বউ শ্বাশুড়ি নিজেদের মধ্যকার বিভেদটা নিজেরাই ঘুচাক। আমি আর কিছুক্ষন ঘুম দেই। ঘুমিয়ে সপ্ন দেখি একটি সুখি পরিবারের, যেখানে মায়ের অমর্যাদা করে না কেউই।
#বোধোদয়
লেখা : নুর আলম সিদ্দিক
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ