গল্পঃ অরণ্যে রোদন
.
লিখাঃ Al Farabee ( ক্যাপ্টেন ফারাবী)
.
বাতাসে ভেজা গন্ধ,আকাশে কালো মেঘ।
সেই স্পর্শ, সেই গন্ধের জন্য সমস্ত তনু মন উদগ্রীব হয়ে উঠে।
অপূর্ব এই অনুভূতি কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দেয়।
আর সেই সাথে জাগিয়ে তোলে পুরেনো স্মৃতি।
আমি চোখ বন্ধ করে আছি।
স্মৃতির পাতাগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমি ডুব দিলাম আমার স্মৃতির সাগরে.........!
.
সেদিনই প্রথম পুরুষের প্রতি আমার ঘৃনা জন্মেছিলো,
যেদিন দেখি আমার বাবা নামক মানুষটা নির্মমভাবে মেরে তালাকের বোঝা বুকে চাপিয়ে আমার মা'কে প্রত্যাখান করে।
বয়স তখন কত আর আমার?
বড় জোর সাত।
আমার মা বলেছিলো,
দত্তদের বাড়ির রাস্তায় যে বছর পুল করেছে, সে বছর আমার জন্ম।
হিসেব করলেই বেরিয়ে যাবে।
একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার মা উঠোনের কাঁদায় গড়াগড়ি করে কাঁদছে।
ঘোর বর্ষাকাল!
জুম বৃষ্টি!!
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে কলাপাতার ছাতা মাথায় যখন স্কুল থেকে এসে দেখি,
মা কাদায় মাখামাখি হয়ে শ্রাবণের মেঘের কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে কাঁদছে;
তখন মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মায়ের দিকে একবার তাকিয়েই আমি
ধুপধাপ করে কাদায় পা চালিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
কিন্ত একি দেখছি আমি?!
আমার মায়ের খাটের ওপর আরেক রমনী
বসে বসে বাবার সাথে খোশ গল্প করছে।
মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো।
ঘর হতে বেরিয়ে এলাম।
মায়ের পিঠে হাত রাখলাম।
মা কান্না জড়িত মুখেই আঁতকে উঠে
আমার দিকে তাকালেন।
আমি মায়ের হাত ধরে মাকে দাড় করালাম।
ঠিকমতো সোজা হতে পারছেনা মা।
বাবা নামক কাপুরুষ টা এমন বিশ্রী ভাবেই মেরেছিলো মা'কে!
মা আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাড়ালেন।
তারপর আমার চোখের দিকে তাকালেন।
আমিও মায়ের চোখের দিকে তাকালাম।
সেদিন প্রথম আমি বুঝতে পেরেছিলাম,
চোখেরও ভাষা আছে।
চোখও কথা বলে,কথা......
সেদিন মায়ের চোখের জলের আড়ালে
অলিখিত কিছু শব্দ আমি দেখতে পেয়েছিলাম।
আমি আর মা শেষবারের মতো ঘরের দিকে ফিরে তাকালাম।
মা আঁচলে মুখ ডেকে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।
আর আমি একদলা "থুহ্" ফেললাম।
তারপর দুজনেই নিরুদ্দেশের ঠিকানায় পা বাড়ালাম।
শুধু সালেহা চাচীর কন্ঠটা কানে বাজছিলো আসার সময়,
"ভাবী,আমাগোরে ছাড়ি যাইয়ো না,
কইলজা ফাইট্টা মইরা যামু ভাবি।"
.
আমি ফারাবী,
ক্লাস টু'তে পড়ি।
আমার বাবা সরকারী অফিসের কেরানী।
ভালো টাকা পয়সা আর সম্পদের মালিক।
কিন্ত বড্ড বদমেজাজি আর খিটখিটে টাইপের মানুষ।
অপরদিকে, আমার মা!
যেমন রূপবতী তেমনই গুনবতী।
খুব ঠান্ডা আর মননশীল মানুষ।
কিন্ত গরীবের সন্তান ছিলেন।
মায়ের মা বাবা মানে আমার নানা নানু মায়ের জন্মের পরেই মারা যান।
নানা নাকি কলেরায় মরেছে,
লোকে ভয়ে গোসলও দেয় নাই।
যদি আবার তাদেরও কলেরা হয়?!
আহারে...........
ছোট্ট একটা কবর স্বরূপ গর্ত করে কোনোরকম জানাজা দিয়ে বাঁশ দিয়ে ঠেলে ফেলে উপরে মাটিচাপা দিয়েছে।
আর নানু?!
হাহ্...... আভাগী শুকনো পাতা কুড়াতে গিয়ে তালুকদারের বাগানে মরে পড়ে ছিলো।
পরে লোকে বলাবলি করছিলো,
সাপে কাটছে,জ্বীনে মারছে,
আরো কত কি!
সে যাই হোক,অভাগী কিন্ত পুরো অভাগী ছিলো না।
অভাগীর জানাজা হলো,সুন্দর মতো দাফনও হলো।
সে সাথে দাফন হয়ে গেলো আমার কপালপোড়া মায়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ।
মা'কে তার চাচা চাচী দেখভালো করতে লাগলেন।
.
আমার বাবা অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকতেন।
আমি কিন্ত খুব একটা কাছে পেতাম না বাবা কে।
মাঝে মাঝে বাবা ঘরে থাকতেন।
রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন,
"ওই ফারাবী,,,,,পড়ালেখা কেমন চলে?
বল তো,কুত্তা ইংরেজী কি?"
আমি বলতাম,"ডগ"।
বাবা আবার বলতেন "বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব কে?"
আমি বলতাম "জানিনা আব্বা"
তখন বাবা খুব করে খিস্তি দিতেন,
"হারামজাদা পুলা,পড়ালেহা নাই।
খালি ঢেং ঢেং করবো আর খাইবো।
মা আর পুলা দুইডাই একরকম।"
বাবা খিস্তি দিতেই থাকতো,দিতেই থাকতো.......
আমি ভয়ে চুপসে যেতাম, হারিকেনের সলতেটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে পড়তে থাকতাম, এসব তো আমি জানি।
জানিনা শুধু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব কে?
মাঝে মাঝে মনে হতো,
ইশ্,,,,,,আমি যদি নবাব হইতাম।
তবে বাবা মাঝে মাঝে আমাকে খুব মারতো।
আর তখন বলতো,"নবাবের বাচ্চা নবাব"
না নাহ্,আমি নবাব হমু নাহ্,
নবাবরা শুধু মার খায়।
.
যাই হোক,
পরদিন সকালে নিজেদের আবিষ্কার করি রাস্তার পাশের একটা গাছতলায়।
কাল রাতে যখন বৃষ্টিতে জুবুথুবু হয়ে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তার উপর দাড়িয়ে ছিলাম,
তখন একটা ট্রাক আমাদের কাছে এসে থামে।
তারপর ট্রাকের ড্রাইভারকে সব বলার পর তিনি আমাদের ট্রাকে তুলেন।
ভোর বেলা নামিয়ে দিলেন এক অচেনা জায়গায়।
আলো ফুটতেই দেখি কি ব্যাস্ত শহর!
গাড়ি আর গাড়ি,
বড় বড় বাড়ি।
আহ্,কি সুন্দর গো!
জ্বর জ্বর লাগছে মনে হচ্ছে,
মুখের ভেতরটা পুরো তিতা!
আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
মা আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
হঠাৎ করেই আমি আমার গলায় পানির ফোটা আবিষ্কার করলাম।
যা ঝরছে আমার মায়ের চোখ হতে।
আমি চমকাইনি, মেনে নিয়েছি।
কেননা,আমি মায়ের চোখের,চোখের পানির ভাষা বুঝতে শিখে গেছি।
আমি ঘাড় বাঁকিয়ে উপরের দিকে তাকালাম।
সেখানে নাকি বিশ্ব পরিচালক আছেন।
একটা নালিশ জানাতে খুব ইচ্ছে করছে,
কিন্ত জানাবো না।
তিনি কি দেখেন না?
জানেন না?
বুঝেন না?
তিনি সব জানেন, বোঝেন,দেখেন,সব!
হঠাৎ করে দমকা বাতাস উঠে,সর্ সর্ করে গড়াতে থাকে পাতায় লেগে থাকা পানি।
সবুঝ পাতায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে গাছগুলো কে।
শীত শীত করছে।
এবছর কি বর্ষাকালেই শীত চলে এলো নাকি?
দু'হাতে নিজেকে জাপটে ধরে রাখি।
একটা পাতলা শার্ট গায়ে,তাও আধভেজা!
এই চকমকে শহরে নিজেকে বড়ই দীন,হীন মনে হলো।
মানসিক হীনম্মন্যতা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
.
কয়েকদিন ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম শহরের আনাচে কানাচে।
এ কয়দিনেই বুঝে গেছি,
টাকা ছাড়া ঢাকা অচল।
আমি আর মা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এখানে ওখানে ধরনা দিয়ে যাচ্ছি,
কোনো কাজ নেই।
অবশ্য ছ'সাত বৎসরের বাচ্চাকে কাজ দেবে কে?
যা একটা চায়ের দোকানে কাজ করবো ভাবলাম,
তাও শুধু কাজ আর খাবারের বিনিময়ে।
কিন্ত মায়ের কি হবে?
সেটা ভেবে আর কাজটা করিনি।
এভাবে সহায় সম্বলহীন আর ক'দিন?
আমি আর মা বসে পড়ি,
হাঁটতে হাঁটতে যে আমরা ক্লান্ত।
একঝলক বাতাস এসে গায়ে লাগে।
উষ্ণ- যেন বা উত্তপ্ত বালুকারাশির উপর দিয়ে বয়ে এসেছে এ বাতাস।
মুখের ঘামটা শুকিয়ে আসে।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছি,
তেতো লাগে।
জ্বরটা কি তাহলে......?!
চারপাশে যান্ত্রিকতার ভীড়।
নিঃশ্বাসে চাপা কষ্ট।
পৃথিবী রে.....ও পৃথিবী!
তুই কতটা কঠিন?!
.
হঠাৎ দেখি এক মধ্যবয়স্কা নারী আমাদের সামনে দাড়ানো,
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
পান চিবুচ্ছে আর পানের পিক ঠোটের কোনা বেয়ে বেয়ে পড়ছে।
মা মহিলার দিকে তাকায় আরেকবার আমার দিকে তাকায়।
একসময় মহিলা পানের পিক ফেলে মায়ের হাত ধরে।
মহিলার চোখের তারা উজ্জল হয়ে উঠে।
মায়ের হাত ধরে বলে,
"যাবি লো? "
মা কিছু বলে না,
মহিলাটি আবার বলে,
"আরে আয় না, পেট পুরে খাওন পাবি।
..... ওটা কে? তোর ছেলে নাকি লো? আয় বাপু,তুই ও আয়।"
আমি জানিনা,মহিলাটি কি এমন যাদুর ফাঁদ পেতেছিলেন,
যাতে আমরা বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।
.
অনেকদিন পর পেট পুরে খেলাম,
আহ্,সেই মুরগীর ঝোল ঝোল তরকারী আর ডাল।
অনেকগুলো ভাত খেয়েছি আজ।
মহিলাটিকে মা "রঙ্গিলা আপা" বলে ডাকে।
যদিও বা তার নাম ছলেমা খাতুন।
আমি ডাকি "খালা" বলে।
খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি।
ছোট্ট একটা ঝুপড়ি,
মাকড়সা আর পোকামাকড়ের ঘর বসতি ঝুপড়িটা।
আমি যখন ঝুপড়িটা দেখে মায়ের দিকে তাকালাম,
তখন খালা আমার কাঁধে হাত দিয়া বললো,
"বাজান রে,জীবন যুদ্ধ অনেক কঠিন।
মাথা গোঁজার ঠাই পাইতে মানুষ অহন মাথা কাটে।
ঝুপড়ি যে পেলি সেটাই বড় কতা।"
আমি নীরবে ঝুপড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ি,
ভ্যাপসা গরম আর মাকড়সার জাল।
কোনোরকম একটু ঝেড়ে শুয়ে পড়লাম।
তেল সিটসিটে বালিশ আর হোগলার মাদুর।
আহ্,একটু ঘুম....
একটু শান্তি।
চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে।
মোমের আলো চারপাশ মায়াচ্ছন্ন।
চোখ বন্ধ হবার আগ মুহূর্তে দেখতে লাগলাম,
গপ করে একটা পোকা ধরে টিকটিকি।
পোকাটি নড়াচড়া করতে পারে না,
চলে যায় টিকটিকির উদরে।
আমি সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই,
আনমনে বিড়বিড় করে উঠি ঘুমজড়ানো কন্ঠে,
"অন্যায়- অন্যায়ই",
তা সে যেই করুন।
বাবা নামের লোকটিও অন্যায় করেছেন।
বাবা....অন্যায়.....ঘৃনা....ঘুম.......শান্তি......!
.
মা এখন একটা লোকের বাড়ি কাজ করে,
আমি একটা স্কুলে ভর্তি হলাম।
স্কুলে যাই,ক্লাস করি।
কোনো কষ্ট নেই,কেনো কষ্ট নেই।
এভাবেই পার করলাম প্রাইমারী স্কুল লাইফ।
হাইস্কুলে ভর্তি হলাম।
অনেক কিছুই এখন বুঝতে শিখেছি।
মানুষের চোখের ভাষা,মনের সুপ্ত ইচ্ছা সবই বুঝি।
এই ইট পাথরের শহরে আমাকে অনেক বড় হতে হবে।
কবে বড় হবো?
মাঝে মাঝে মনে হয়,
সময় যেন শশ্মানভূমির উপর দিয়ে বহমান।
হৃদয়াবেগের সাথে বস্তবতার,
বাস্তবতার সাথে প্রাত্যহিকতার এবং
প্রাত্যহিকতার সাথে যান্ত্রিকতার মিল হারিয়ে ফেলি আমি।
মাঝে মাঝে বড়ই একাকী লাগে নিজেকে।
একে একে পার করি হাইস্কুলের প্রতিটি ক্লাস।
অসময় আমাকে সাহস যোগায়।
সামনে এসএসসি পরীক্ষা,
ফরমফিলাপ করতে পারছি না।
আগামীকাল শেষ তারিখ।
মায়ের কাছে অনেক কান্নাকাটি করলাম,
মা যে বাড়িতে কাজ করে, সে বাড়ির মনিবের কাছে মা অনেক কেঁদেছে।
ফলাফল শূন্য,অরণ্যে রোদন করে কোনো লাভ আছে?
আমি নীরবে চোখ মুছি,
কিইবা করার আছে আর?
আমার পকেটে ৩০০ টাকা,
এ টাকায় কি হবে?
কিন্ত এটা যে আমার মায়ের দু'মাসের বেতন।
আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে,
বুক ফেটে যাচ্ছে আমার।
আমার ফরমফিলাপ, আমার ভবিষ্যৎ!
আমি কাঁদছি,
চিৎকার করে কাঁদছি।
খালা এসে উঁকি দিলো,
"কিরে ফারা, কি অইছে?
আমি বললাম,"আমার ফরমফিলাপ খালা।"
খালা বললো,"কান্দিস না"
খালা কোথা থেকে জানি টাকা এনে দিলেন,
আমার ফরমফিলাপ হলো।
যথারীতি পরীক্ষা দিলাম,লেটার মার্কস পেলাম।
.
কলেজে ভর্তি হলাম।
কারো সাথেই খাপ খাইয়ে নিতে পারিনা।
একাকী নিঃসঙ্গ এক ধ্রুবতারা আমি।
সেদিন ক্লাসে টিচার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
"তোমার নাম কি?"
আমি মাথা উঁচু করে বললাম,
"আমার নাম গরীব"
ক্লাসের সবাই হেঁসে উঠলো।
স্যারের উজ্জ্বল মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো।
তিনি মুখটাকে আরো গম্ভীর করে পুনুরায় জিজ্ঞেস করলেন,
"তোমার ধর্ম কি ?"
আমি স্যারের চোখে চোখ রেখে বললাম,
"আমি ক্ষুধার্ত"
স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পুরো ক্লাস জুড়ে পিনপিন নীরবতা।
তারপর স্যার ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
শুধু একটা মেয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো।
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম।
মেয়েটি আমার কাছে এলো,
আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"সাবাস গরীব,সাবাস......!
.
নিয়মিত ক্লাস করছি,
ভালো ছাত্র হিসেবে কলেজে নাম ছড়িয়ে পড়লো।
অনেকেই এখন বন্ধু হতে চায়।
আমি শুধু চুপ করে সবাইকে অবলোকন করি।
আমি যে একটু আধটু চোখের ভাষা বুঝি গো।
সবার চোখের তারাতে স্বার্থ,
শুধু একজন বাদে।
সে হলো ইরি; ইরিত্রা ইরি।
মেয়েটি মানে ইরিই আমার একমাত্র বন্ধু।
একদিন আমি আর ইরি রাস্তার ধারে পাশাপাশি বসে আছি।
ইরি আমার দিকে তাকালো।
আজকের দৃষ্টিটা কেমন জানি।
কিছু জিজ্ঞেস করবে মনে হচ্ছে।
জিজ্ঞেস করেও ফেললো।
.
---- আচ্ছা ফারাবী,কিছু কথা বলতে চাই তোমাকে।(ইরি)
---- বলো।(আমি)
---- তোমার বাসা কোথায়?
---- কাকরাইল।
---- তেমার মা বাবা কি করে?
---- বাবা থেকেও নেই,আর মা?
মা লেকের বাসায় কাজ করে।
---- সরি ফারাবী,
---- ইটস ওকে ইরি।
---- তোমার মা বাবা কি করে?
---- বাবা মা কেউ নেই,
আমি একা।
---- কি বলো?!
---- হুম,একটা আজব বিষয় কি জানো?
---- না,বলো।
---- আমিও দুদিন পর কাকরাইল উঠবো।
---- বাসা নিয়েছো সেখানে?
---- নাহ্
---- তবে?
---- ঝুপড়িতে থাকবো।
---- পারবে থাকতে?
---- এতোদিন তো ঝুপড়িতেই ছিলাম।
---- ওহ্,কিন্ত তোমার স্টাডি খরচ?
---- ফারাবী আজ উঠি।
---- কি হয়েছে?
---- কিছু নাহ্, ভালো থেকো।
.
আমি কিছুই বলতে পারছিনা।
ইরি চলে যায় উত্তরদিকে,
উত্তরহীন চোখে।
আমি বসে আছি পথের প্রান্তে,
নিশ্চুপ নতমুখে।
.
সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমেছে।
রাস্তার ধারেই বসে ছিলাম এতক্ষন।
উঠে দাড়ালাম।
একটা ট্রাক চলে যায় দ্রুত,
নাক-মুখ ধুলায় বন্ধ হয়ে যায়।
শুকনো ঠোঁটকে চেটে নিতে জিভ বের করতেই জঘন্য লাগে আমার।
ভার্সিটির বুড়ো অশ্বথ গাছের পাতায় পাতায় কাঁপন।
রাস্তার লাইটের দিকে তাকাতেই নিজেকে বড্ড আলোকহীন মনে হয়।
যুগ্ম কালেক্টরের বাসভবনের সীমানা প্রাচীর, প্রাচীর ঘেঁষে কয়েকজন প্রসাধনে ব্যাস্ত,
যাত্রার সঙের মতো নিজেদের রাঙ্গিয়ে নিচ্ছে।
আমার দৃষ্টিটা সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিলাম।
কিছুই ভাল্লাগছে না।
নিঃশব্দে গন্তব্যের দিকে পা চালাতে থাকি।
এ রাস্তার সবকটা লাইট নষ্ট,গরীবের চলাচলের রাস্তা যে তাই হয়তো।
নিরিবিলি রাস্তা,গা ছমছমে অন্ধকার!
হাঁটতে হাঁটতে ঝুপড়িতে চলে আসলাম।
.
এভাবেই কাটতে লাগলো চিরাচরিত জীবন আমার।
দুটো টিউশনি, স্টাডি নিয়ে।
মায়েরও বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারে না।
দুমাসের টিউশনির টাকায় একটা ছোটো পান দোকান বানিয়ে দিলাম মা'কে।
এইচএসসি পরীক্ষাও আসি আসি করছে।
ইরির প্রতি আমি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ি।
রাতে বিছানায় গেলে আর ঘুমাতে পারিনা।
ইরি তো আজ কয়েকমাস যাবৎ কাকরাইলেই আছে।
মেয়েটি আমার হৃদয়ের সবগুলো গলি চেনে,
ভালোবাসার গলিটাই চিনলোনা।
কত যে তাকে বেসেছি ভালো,
সেকথা সে যদি জানতো.....!
তবে ইরি আমার কাছে আজও রহস্য।
রহস্যময় চাঁপাগাছের চাঁপাকলি থেকে ফোঁটা চাঁপাফুল!
ইরি একা,স্টাডি খরচ, চলাফেরার খরচ কোথায় পায় সে?!
বিছানায় শুয়ে থাকতে ভাল্লাগেনা আর।
উঠে বসে পানির গ্লাস হাতড়ে নিয়ে ঢক ঢক করে গিলে ফেলি কয়েক ঢোক।কত তারিখ আজ?..... মনে পড়ে না,
মধ্যরাতে তারিখ হারিয়ে গেছে স্মৃতির টানে,একাকী নির্ঘুম রাত পোহানোর খাতিরে।
যেন এইতো সেদিন,ক্লাসরুমে দেখা পাওয়া, একটু হাঁসি,কাঁধে হাত রাখা,সাবাস গরীব,সবাস.... বলে কাঁধ চাপড়ে দেয়া.....!
মেয়েটি আমাকে চেনে,
আমার হদয়ে লিখা নাম-ধাম-পরিচয়!
অথচ সে আজও রহস্য!
একই বস্তিতে বসবাস, অথচ রহস্য উদঘাটন করা হয় নি কখনো!
আচ্ছা,ইরি কি বোঝেনা?
বোঝার চেষ্টা করেনা?
বুনো ঘোড়ার খুর পিষ্ট করে চলে হৃৎপিন্ড।
ইরি মেয়েটা আমাকে এতো টানে কেনো?
কেনো মুখটা রঙিন ঘুড়ি হয়ে মনের আকাশে উড়ে উড়ে স্বপ্নসৌধ গড়ে তুলে? ও মুখে বিষ জ্বালা।
মন্দির ভাঙ্গা হয়,নারী লুন্ঠিত হয় সম্পদের সাথে।
শ্বাপদের দীর্ঘ মিছিল দীর্ঘতর হয় রাতের আঁধারে।
পরিচয়-পরিচয়ই, হবে না কখনো হয়তো দু'জনে দু'দন্ড নিবিড়ভাবে বসে সংসারের ক্লান্তি শাড়ির জমানে মুছে নেয়া।
নিঃশব্দে সম্পর্কের জাল বুনে চলে হৃদয়।
.
এইচএসসি শেষ;
লেটার মার্কস পেলাম।
মা তার দোকান থেকে সবাইকে চকলেট বিলিয়েছে।
ইরিও পাশ করেছে।
আমি ভর্তি হলাম ঢাকা ভার্সিটিতে,
ইরি ন্যাশনাল।
আজ ইরিকে প্রপোজ করবো,
ইরির সাথে রাস্তার মাথায় দেখা।
আমি ইরিকে ডাক দিলাম।
ইরি কাছে এলো।
ও মা গো.....
হৃদয়টা আমার এতো মোচড়াচ্ছে কেনো?
আমিই বলা শুধু করলাম।
.
---- কিছু কথা ছিলো। (আমি)
---- বলো।(ইরি)
---- আমার তোমাকে খুব ভালো লাগে।
---- আমি যে গরীব।
---- আমি তোমাকে চাই।
---- আমি যে ক্ষুধার্ত।
---- আমি তোমাকে ভালোবাসি।
---- আমি পারবোনা তোমার হতে।
---- কেনো পারবে না ইরি?
---- আমার সম্পর্কে কিছু জানোনা।
---- আজ বলো।
---- না,
---- কেনো?
---- এম্নি,শুধু বলবো, আমি তোমার যোগ্য নই।
---- আমি নিজেই তো অযোগ্য।
---- না ফারাবী,তুমি অনেক বড় হবে।
---- তার জন্য তোমাকে চাই।
---- না,আমি বিভীষিকা!
---- আমি যে নিকষ আঁধার।
---- আমি নীচ,
---- আমি যে বিষাদ বর্বর।
---- আমি পারবোনা তোমাকে আমার সাথে জড়াতে।
---- কেনো ইরি?
---- আমি পারবোনা তো পারবো না।
.
বলেই ইরি উঠে চলে গেলো।
আমি জানি,ইরি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।
আমি যে ইরির চোখের ভাষা বুঝি!
সে কি তা জানে নাহ্?
তপ্ত রোদ মিঠে রঙের ফতুয়া হয়ে অজস্র হরিণের গায়ে লেপ্টে থাকে,ময়ূরের পালক জোৎস্নায় গাঙুরের জলে ভেসে চলে,শ্যামার নরম গানের সাথে ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো নেচে চলে।
কীর্তিনাশা - ধাঁনসিড়ি - ধলেশ্বরী - কর্ণফুলী - পদ্মা - মেঘনা - যমুনা মিলেমিশে নৃত্য করে।
নীলকন্ঠ স্নিগ্ধ নীলাম্বর আকাশ শুধু রৌদ্র - গোধূলি - জোৎস্নায় মহাকাশের সাথে আত্মীয়তা খুঁজে।
শুধু আমার মনটাই আত্মীয় করতে পারলো না ইরিকে।
.
সেদিন রাতে বসে বসে সিগারেট ফুঁকছি গলির মাথায়।
পেছনে একটা খচখচ শব্দ।
ইলেকট্রিসিটি নেই,কলিজা ধড়াস করে উঠলো।
হঠাৎ করেই কেউ বলে উঠলো,
"কি বাবু? কেমন লাগছে গো আমায়?"
আমি ফিরে তাকাই।
কিছুই দেখা যাচ্ছে নাহ্।
পকেট হাতড়ে লাইটার বের করা।
লাইটারের পেছনে লাইট আছে।
লাইটের আলো মারলাম,মুখটা দেখা যাচ্ছে না।
শাড়িটা কেমন আঁটোসাটোঁ করে পড়েছে।
বেদের মেয়ের ভূমিকায় বেশ মানিয়ে যাবে।
বড় যত্নে শাড়িটা জড়িয়েছে শরীরে নৈশ সুন্দরীটি।
ঘোমটার আড়ালে চোখ নাক ঢাকা।
শুধু ঠোঁট দেখা যাচ্ছে।
মারাত্মক রকমের লাল!
তারওপর আধো অন্ধকারেই মেয়েটি একটা আয়না বের করলো,
ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে দিচ্ছে।
মনমতো হচ্ছে না,মুছে ফেলছে আবার লাগাচ্ছে,আবার মুছছে।
কোনো কিছুতেই যেনো ভ্রুক্ষেপ নেই,আপন মনে কাজ করে চলছে সে।
বিশ্বসংসারে ভ্রুক্ষেপ করার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই,কাউকে লজ্জা পাওয়া অবান্তর।
আমি চোখ সরিয়ে নেই,
লাইট অফ করি।
মেয়েটি আবার চিৎকার করে উঠে,
"ও বাবু.......রেট কম!"
আমার কেনো জানি শব্দটা পরিচিত মনে হলো।
পকেট থেকে লাইটার বের করে আলো ফেললাম।
একি!
ইরি.........!
আমার হাত থেকে লাইটার পড়ে গেলো।
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
বুকে চেপে বসে পড়লাম।
আনমনেই বলে ফেললাম,
"ইরি.........
বড় কষ্ট"
আমি দৌড়ে চলে যাবার শব্দ শুনতে পেলাম।
তাহলে কি ইরি?......!
আর ভাবতে পারছিনা,
এতো ভালোবাসার পরও কেনো ইরি আমাকে তার সাথে জড়াতে চায় নি,
তা আজ বুঝলাম।
এই পথই তার চলার খরচের জোগানদাতা!
কুহেলিকাময় অমাবস্যার আলো প্রাচীন বৃক্ষশীর্ষে অপার্থিব আবরন সৃষ্টি করেছে।
শুকনো পাতার শব্দ হয়।
হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে একটি কাক কা-কা করে সমস্ত পরিবেশকে সচকিত করে তোলে।
হারিয়ে গেছে মহুয়ার ঘ্রান উগ্র সিগারেটের ফিল্টার পোড়া গন্ধে।
সোজন বাদিয়ার ঘাট হারিয়ে গেছে কালের অতলে।
হারিয়ে গেছে ছাতিম - হাড়ভাঙ্গা - কেলিকদম্ব - কুম্ভী - কুর্চি,
হারিয়ে গেছে মায়া - মমতা - মানবিকতা - মননশীলতা - মূল্যবোধ।
কেনোরকম হেঁটে ঝুপড়িতে চলে এলাম।
আসার সময় কিনে আনা ঘুমের ট্যাবলেটের পুরো পাতাটা খালি করে শুয়ে পড়লাম।
একটু ঘুম......
একটু প্রশান্তি!
.
ঘুম ভাঙ্গার পর শুনলাম ইরি সুইসাইড করেছে।
অবাক হইনি আমি,যা হবার তা কাল হয়ে গেছি।
খালা এসে আমার হাতে একটুকরো কাগজ ধরিয়ে দিলো।
ইরির লিখা,
"ফারাবী,প্রচন্ড ভালোবাসি রে তোমায়।
কিন্ত আমি তো আমার নোংরামি জীবন দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখতে পারবো না।
এ যে পতিতাবৃত্তি থেকেও বড় পাপ।
তাই সরে গেলাম,আশা করি রহস্যের সমাধান হয়েছে তোমার।
ভালো থাকুক ভালোবাসা।"
আমার লিখাটা পড়ে মনে হলো,
নিজের প্রতি তীব্র ঘৃনা নিয়ে মরেছে ইরি,
কিন্ত কেনো জানি আমারই নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা হচ্ছে।
আজ দ্বিতীয় বারের মতো কোনো পুরুষের প্রতি ঘৃনা জন্মালো।
তাও নিজের প্রতি নিজের!
.
সময় গড়িয়ে যায় বেশ ক'বছর।
আমি ভার্সিটি লাইফ শেষ করে এখন সে ভার্সিটিরই টিচার।
ইরিকে ভুলতে পারিনি,
প্রতিটি গোধূলি লগ্নে ছাদে উঠি আমি।
ছাদ থেকে আকাশ একটু কাছে।
চাইলেই ইরিকে ছুঁয়ে দেয়া সম্ভব!
হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে যাই।
আজ আমি সফল,সফলরা নাকি যা চায় তাই পায়।
কিন্ত আমি পাইনা কেনো?
বাতাসে ভেজা গন্ধ, আকাশে কালো মেঘ।
সেই স্পর্শ, সেই গন্ধের জন্য সমস্ত তনু মন উদগ্রীব হয়ে উঠে।
অপূর্ব এ অনুভূতি কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দেয়।
বৃষ্টি শুরু হয়,ভিজতে থাকি।
চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে যায়।
সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে চলে ইরির জন্য ক্রন্দন।
জানি ইরি আসবেনা,
এ যে আমার অরণ্যে রোদন.........!
.
গল্পঃ অরণ্যে রোদন
.
লিখাঃ Al Farabee (Captain Farabee)
.
উৎসর্গঃ তাসফিয়া নিশাত হ্যাপী
āĻāϞ্āĻĒ āϏংāĻ্āϰāĻš āĻāϰা āĻāĻŽাāϰ āύেāĻļা। āϰোāĻŽাāύ্āĻিāĻ, āĻৌāϤিāĻ, āϰāĻŽ্āϝ, āĻৌāϤুāĻ āϏāĻš āĻšাāĻাāϰো āĻāϞ্āĻĒ āĻāĻে āĻāĻŽাāϰ āϏংāĻ্āϰāĻšে।
āĻŽāĻ্āĻāϞāĻŦাāϰ, ⧍ā§Ģ āĻāĻĒ্āϰিāϞ, ⧍ā§Ļā§§ā§
481
āĻāϰ āĻĻ্āĻŦাāϰা āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰা
Rahathossain1010100@gmail.com
āĻāĻ āϏāĻŽā§ে
ā§§ā§Ļ:ā§Ģ⧝ AM

āĻāϤে āϏāĻĻāϏ্āϝāϤা:
āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝāĻুāϞি āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ (Atom)
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ