মেঘ ভাঙ্গা রৌদ্দুর
মুস্তাকী নাঈমা
তিন্নি
***
- এক -
এক ঝুম বৃষ্টি থেমে গিয়েছে
মিনিট দশেক আগে। টিপটিপ বৃষ্টি
আর ভ্যাপসা গরমে গুমোট
এ্যাম্বুলেন্সে আমরা ক'জন দম বন্ধ
করে বসে আছি। আমি বাহিরে
তাকালাম, ঢাকা মহানগরীর
বিস্মৃত জ্যাম দেখছি, অসহ্য লাগছে।
তবু দেখছি, কারণ সামনে থাকা
কফিনটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না
এতটুকুও।
নায়লা কফিন আঁকড়ে ধরে আছে শক্ত
করে, যেন ছোট্ট বাবুটা মায়ের
আঁচল ধরে আছে হারিয়ে যাওয়ার
ভয়ে। নায়লার নিঃশব্দে কাঁদার
অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তাই অনবরত
চোখের জলে বান নেমেছে ওর
গালে।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ
ফিরিয়ে ড্রাইভারের দিকে
তাকালাম। ভাবলেশহীন মুখে
স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে।
জ্যামের কারণে নয়, পাথর হয়ে
যাওয়া এই আমাকে নিয়েই আমি
বিব্রত,তাই ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে
বেড়িয়ে যাই গাড়ি থেকে।
পারছি না,কিছুই পারি না আমি।
আজকাল কাঁদতেও পারিনা,গলায়
কি যেন দলা পাকিয়ে থাকে।
ইমনের লাশ নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স
থেকে নামার পর বাড়ি পর্যন্ত
ঢোকার আগেই নায়লা জ্ঞান
হারিয়ে ফেলল। সবাই লাশ ফেলে
ওর জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত। আমি
দাঁড়িয়ে আছে আমার ভাইটার
কফিনের পাশে।সবার অলক্ষ্যে
আলতো ছুঁয়ে দিলাম
কফিন,চারপাশে অদ্ভুত শূন্যতা
আমার। মা,বাবা,বিথী,নায়লা
আমার আপন আপন লাগা মানুষগুলো
নেই পাশে।
হঠাৎ আবার বৃষ্টি নামলো,ইমন আর
আমি ভাইবোন মিলে ভিজে
যাচ্ছি শ্রাবণ ধারায়। সেই
ছোটবেলার মত,ভিজে যাচ্ছি
আমরা। ইমন,'ভাইটি দেখতে পাচ্ছিস
তুই?'
- দুই -
ইমনের মৃত্যু মায়ের উপর কোন প্রভাব
ফেলেনি।মা আগের মতই
আছেন,মাথার উপর চলা সিলিং
ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকেন
একদৃষ্টিতে। মুখে খাবার গুঁজে
দিলে খায়,গোসল আর অন্যসবকিছুই
এভাবে চলছে,আর চলছে সিলিং
ফ্যান ঘুরতে থাকা দেখা। মায়ের
মাথায় হাত রেখে বসে
আছি,জানালার গ্রিলে একটি
ফড়িং ছোটাছুটি করছে, ফর ফর
কেমন একটা শব্দ কানে লাগছে।
কলিংবেলের শব্দে চমকে উঠলাম।
খাট থেকে নেমে দরজার কাছে
যেতে যেতে ভাবছি কে হতে
পারে,নায়লা ছাড়া কে আসবে
আর। দরজা খুলে হতবাক। বিথী
এসেছে।চোখ অসম্ভব ফোলা,ইমনের
দাফন হয়েছে তিনদিন আগে।
বিথীর নম্বরে ফোন করেছিলাম
ইমনের লাশ আনার আগে।বিথী
থাইল্যান্ড গিয়েছিল,ফোন
ধরেছিল ওর বাসায় থাকা কাজের
মেয়েটা। মেয়েটাকে
দিয়েছিলাম ইমনের মৃত্যুর খবর,কিন্তু
মেয়েটার কাছে বিথীর নম্বর না
থাকায় জানাতে পারেনি ও।আজ
সকালেই নাকি ফিরেছে বিথী।
ওর চোখ ফোলা দেখে মনে
হচ্ছিলো,এই বিথী যেন আমাদের
আগের বিথী। ঝগড়া করে
অভিমানে গাল ফুলোনো,কেঁদে
চোখ ফুলোনো বিথী। দরজার পাশ
থেকে সরে গেলাম। বিথী
নিঃশব্দে চলে গেল ইমনের ঘরে।
আমি অবাক হচ্ছিলাম,বিথী আমার
সাথে কোন কথা বলেনি।
দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানটায়,ইমনের
ঘর থেকে ভেসে আসছে বিথীর
হাউমাউ করে কান্নার শব্দ।দৌঁড়ে
যেতেই দেখি ইমনের খাটে,ইমনের
প্রিয় কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে
কেঁদে যাচ্ছে বিথী।সেই
কোলবালিশ,ইমনের বড্ড প্রিয় ছিল
এইটা,বিথী কম খোঁচাতো না
ইমনকে। সুযোগে প্রায়ই
কোলবালিশ সরিয়ে নিত বিথী।
মারামারি, চুল ছেঁড়া কম হয়নি এই
বালিশ নিয়ে ইমন আর বিথীর
মাঝে। আজ সেই কোলবালিশ
জড়িয়ে বিথী বসে আছে, অথচ ইমন
আর কোনদিন ফিরে আসবেনা
বিথীর সাথে মারামারি করতে।
বিথী সারাদিন ইমনের খাটে শুয়ে
রইল নিরবে। সন্ধ্যের আগে আগে
চুপচাপ কাউকে না বলে চলে গেল।
এমন কি মা কে একবার দেখেও গেল
না। একটুও কষ্ট পাইনি, বিথীর হৃদয়ে
যে এখনও ইমনের প্রতি এত অঘাত
ভালবাসা জমে আছে, সেটা
দেখে ওর পূর্বের সব ভুলের জন্য মাফ
করে দিতে ইচ্ছে করছিল।
- তিন -
তিথু, বিথু আর ইমু। বাবার দেওয়া
আমাদের তিন ভাইবোনের নাম।
বাবা আদর করে আমাদের এ নামে
ডাকতেন। মা অবশ্য তিথী, বিথী,
ইমন বলেই ডাকতেন। তবু মাঝে
মাঝে ইমনকে ডাকতেন বাবু। এ
নিয়ে বিথীর অভিযোগের শেষ
ছিল না, কেন ইমনকে বাবু ডাকা হয়?
একটা ছেলে বলে? নাকি বেশি
আদুরে তাই!
আর দশটা সুখি পরিবারের সাথে
আমাদের কোন পার্থক্য করা
যাবেনা। বাবা বেসরকারী
কোম্পানীতে ছিলেন সিনিয়র
অফিসার পদে, দাদার থেকে
পাওয়া এই বাড়িতে বাবা, মা
আমাদের নিয়ে থাকতেন। খুব
ভোরে বাবা ডেকে তুলতেন
আমাদের। বিথী কখনই উঠতো না।
ইমন উঠলেও ঘুমিয়ে যেত প্রায়ই।
আমিই যেতাম বাবার সাথে,
হেঁটে বেড়াতাম ভোরের মিষ্টি
হাওয়ায়। বাবা অনেক গল্প করতেন,
জীবনের গল্প, প্রকৃতি, বিজ্ঞান,
রাজনীতি, সমাজ, সভ্যতা। অবাক
হতাম আর ভাবতাম, আমার বাবা কত
কিছু জানে।
বাবা মাঝে মাঝে আফসোস
করতো, বিথী আর ইমনকে নিয়ে।
ওরা ঠিক আমার মত নয় বলে বাবা
অনুযোগ করতো। মায়ের বিরুদ্ধেও
অভিযোগের শেষ ছিল না বাবার।
মা বাবার এত যত্ন করতো, যে আমরা
অবাক হতাম। এত কাজের মাঝেও
মা ঠিকই বাবার সবকিছু খেয়াল
রেখে গেছে। কিন্তু মা কখনই
বাবার সাথে কোথাও বেড়াতে
যেত না বলে মায়ের বিরুদ্ধে এত
অভিযোগ বাবার। মা সংসার
ছেড়ে এক মূহুর্ত থাকতে চাইতেন
না, অথচ বাবা এই নিয়ে সবচেয়ে
বেশি বিরক্ত ছিলেন।
বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন
দেখতেন বেশি। বরবারই নিজের
পড়ালেখা নিয়ে সচেতন ছিলাম।
এইচ এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ
পাওয়ার পর বাবার স্বপ্ন যেন আকাশ
সমান হল। বাবার স্বপ্ন আমি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, নিজেকে
তৈরি করে নিচ্ছিলাম সেভাবেই।
বিথীকে নিয়ে বাবা কোন স্বপ্নই
দেখতেন না। বিথী ছিল নিজের
মত করে চলা একটি মেয়ে। এক কথায়
প্রচন্ড স্বার্থপর, জেদি মেয়ে।
লেখাপড়াও করতে চাইতো না।
বাবার মন ভেঙ্গে এস এস সি তে
পেল এ মাইনাস। বাবা ওকে
ঘাঁটলেন না। আমরাও কথা বলা
কমিয়ে দিলাম তবে মা একেবারই
কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। মা তো
মা ই, হয়তো আগে থেকে বুঝে
গিয়েছিলেন বিথীকে আর
ফেরানো যাবেনা। বিথীর
সবচাইতে ভাল জামা-জুতো,
খাবার এসব লাগতো, আমাদের
আছে কি নেই সেটা ও ভাবার
প্রয়োজন বোধ করতো না। সমস্যা
সেখানেই ছিল, ইমন বিথীকে
ডাকতোই সেলফিশ বলে। ইমন ছিল
প্রচন্ড চঞ্চল, খেলা পাগল ছেলে।
খেলাধূলা ওর কাছে প্রাণ ছিল।
সারাদিন বাইরে টো টো আর
সারারাত জেগে পড়ালেখা করা
এই ছেলের দিনলিপি বাবার অপছন্দ
ছিল। বাবার কথা হল, সারাদিন
ঘুরে, সারারাত পড়ে, এই ছেলে
ঘুমায় কখন? মা মুচকি হেসে বলতেন,
'ছাড়ো তো। রেজাল্ট তো ভাল
করছে বাবু। রেজাল্ট খারাপ হলে
তখন নয়তো দেখা যাবে।'
বাবা এসব মানতে চাইতেন না।
বাবা বলতেন, ছাত্র জীবনে
লেখাপড়া, খেলাধূলার যেমন
প্রয়োজন আছে, বিশ্রামেরও
প্রয়োজন ঠিক তেমন। বাবা হতাশ
চোখে আমার দিকে তাকিয়ে
থাকতেন। আমি সেই চোখে আমার
জন্য বোনা স্বপ্ন দেখতে পেতাম।
- চার -
বাবাকে খুব ভালভাবে খেয়াল
করে দেখতাম হঠাৎ বাবা কেমন
যেন উদাসী হয়ে গিয়েছেন। অফিস
থেকে এসে মায়ের সাথে টুকটাক
কি যেন বলতেন। আমার কানে
আসতো না,তবে ধারণা করতাম
খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং
নিয়ে ব্যস্তভাবে দিন কাটছে
আমার। মডেল টেষ্ট দিয়ে কোচিং
থেকে বাসায় ফেরার পথে
প্রতিদিন কোচিং ক্লাসের একটি
ছেলে আমার পিছু নিয়ে বাসা
পর্যন্ত এসে ফিরে যায়। অস্বস্তিকর
ব্যাপার। কিন্তু ছেলেটির সাথে
আমার এ পর্যন্ত কথা হয়নি,
চোখাচোখি হলেও এড়িয়ে
গিয়েছি। ছেলেটিকে যে কেউ
পছন্দ করবে,তুখোড় ছাত্র।মডেল
টেষ্টগুলোতে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ নম্বর
পাওয়া,এত মেধা সম্পন্ন ছেলে কেন
আমার পিছু নিয়েছে সেটা আমার
কাছে রহস্যজনক ঠেকলো। আমি ওকে
দেখেও না দেখার ভাণ করতে
থাকলাম। আমাকে যে পড়তে
হবে,আমার বাবার স্বপ্ন একমাত্র
আমিই পারি পূরণ করতে।
ইমন চমৎকার একটি কাজ করে ফেলল।
এস এস সি তে জিপিএ ফাইভ পেয়ে
সবাইকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে
দিল। বাবা খুশিতে একটা সাইকেল
কিনে হাজির। আমি আর বিথী
ইমনের শখের জিন্স আর টিশার্ট
কিনে আনলাম দুজনের জমানো
টাকা দিয়ে। মা ধরতে গেলে
সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁদলেন, আর মিষ্টি
পাঠালেন বাসায় বাসায়। বাবা
বার বার বলতে লাগলেন, 'ইমু টা
সারাদিন না পড়েও কি রেজাল্ট
করে ফেলল বল তো, তিথু। আসলে সব
তোর মায়ের অবদান।ও ব্যাটাকে
পাহারা না দিলে তো পরে পরে
ঘুমাতো। তোর মা ই তো ইমু রাত
জেগে পড়ার সময় পাশে বসে
থাকতো। এটা ওটা খাইয়ে
এনার্জি ফিরিয়ে দিত। ওরে ইমু
মায়ের পা ধরে পড়ে থাক।' ইমনও কম
যেতনা। দৌঁড়ে মায়ের পায়ের
কাছে বসে পড়লো। মা হা হা করে
উঠলেন, 'তুইও দেখি বাপটার মত
ফাযিল। সরে যা বলছি।' বাবা
উচ্চস্বরে হাসছেন, মা আঁচলে মুখ
চেপে হাসতে লাগলেন। ইমন
মায়ের পা ধরে বসে আছে আর
আমরা দুটি বোন একে অন্যকে ধরে
বসে আছি সোফায়। আমার কাছে
ওই সময়টা মনে হল আমার এই পরিবার
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী পরিবার।
নায়লাও জিপিএ ফাইভ পেল।
পেতেই হবে।ইমনের বান্ধবী বলে
কথা।নায়লার চাইতে ইমন যেন
বেশি উত্তেজিত নায়লার
রেজাল্টে। নায়লা পাশের
বাড়ির আলী চাচার মেয়ে।চোখ
ঝলসে যাওয়া সুন্দরী বলতে যা
বোঝায় নায়লা ঠিক তেমন। বিথী,
ইমন, নায়লা। এই তিনজন সেই
ছোটবেলা থেকে এলাকার শ্রেষ্ঠ
পাজি খেতাব পেয়ে যায়।এ
বাড়ি ও বাড়ি ছুটোছুটি করতে
করতে দুবাড়ির সম্পর্কও হয়ে যায়
অন্যরকম।নায়লা ছোটবেলা থেকে
আমার মায়ের রান্নার ভক্ত।নায়লা
ছাড়া স্পেশাল রেসিপি মুখেও
তুলতো না কেউ।বিশেষ করে ইমন।
একটু বড় হওয়ার পরে দেখা যেত ইমন
আর নায়লা ছাদের
কার্নিশে,নয়তো বাড়ির বাইরের
গেটে না হয় গলির মোড়ে
দাঁড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছে।
মা নায়লাকে ভালবাসতেন,তবু
ইমনের সাথে এই কথাবার্তা
মায়ের একদম অপছন্দ ছিল। মা রেগে
বলতেন,'এত কি কথা তোর নায়লার
সাথে? পড়াশুনা সংক্রান্ত কথা
তো ঘরে বসেই বলতে পারিস।
এলাকার মানুষকে দেখানো কেন?'
ইমনও রেগে যেত।'আহ মা,আমরা বন্ধু।'
বিথীও চটতো খুব।বলতো,'বন্ধু নাকি
বান্ধবী নাকি প্রেমিকা!' ব্যাস
লেগে যেত দুটোর মধ্যে।নায়লার
জন্য ইমন,বিথী কম রক্তারক্তি
করেনি।কেন যেন আমি আর বাবা
ব্যাপারটা সহজ ভাবে মেনে
নিয়েছিলাম।ইমনক বাঁধা দিতে
ইচ্ছে হতো না,তাছাড়া
নায়লাকে পড়ে ফেলেছিলাম। ওর
মন বুঝে গিয়েছিলাম খুব সহজে।
তাছাড়া দুজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে
খুশি ছিলাম আমরা।বাবা আর আমার
চিন্তাভাবনা মিলে যেত সবসময়।
- পাঁচ -
ছেলেটি মন্থর গতিতে এগিয়ে এল
সামনে।আদনান ফাহিম।কোচিং
ক্লাসে সবচেয়ে সেরা ছেলেটি।
সামনে দাঁড়িয়ে বলল,বল।আমি ভ্রু
কুঁচকে তাকালাম। ছেলেটার মুখ
ভাবলেশহীন।যেন আমাকে চেনে
না অথবা কোন দিন দেখিনি।
নিতান্ত বাধ্য হয়ে ডাকলাম
ফাহিমকে।ফাহিম কখনই আমার
সাথে যেচে কথা বলেনি,ক্লাসে
এক নাগারে তাকিয়ে থাকেনি।
শুধু পিছু নিয়ে বাসা পর্যন্ত
আসাটাই এখন চরম বিরক্তের কারণ
হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচিং এ
বেশিরভাগ মেয়ে ফাহিমকে পছন্দ
করে সেটা আমি বুঝি,সেখানে
ফাহিম আমার পিছু নেয় এটা কারও
চোখ এড়ায় না।অনেকেই
অনেকভাবে তাকায়।তাছাড়া
আমার এলাকা পর্যন্ত এভাবে আসার
ব্যাপারটা কারও নজরে পড়ুক সেটা
চাই না।তাই ডেকেছি ফাহিমকে।
ছেলেটি এখনও উদাসী ভঙ্গিতে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,
-এভাবে পিছু নেও কেন আমার?কিছু
বলতে চাও?
-না।
-তাহলে এভাবে পিছু নেওয়ার
মানে কি?
-তোমাকে ভালবাসি তাই।
আচমকা এমন কথায় হতবাক আমি
তাকিয়ে রইলাম। এভাবে সরাসরি
ভালবাসা প্রকাশের সাহসও সবার
থাকে না।আমি তাকিয়ে
থাকলাম অনেকক্ষণ।সেই
ভাবলেশহীন মুখ,তবে চোখের
চাহনীতে অনেক কথা লেখা
আছে।ছেলেটাকে এক কথায় না
করে দিতে পারে সেই মেয়েটা
যে কিনা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি সম্পূর্ণা
নই,আমাকে বিধাতা সবকিছু দিয়ে
পাঠাননি।আমি কিভাবে এরকম
ছেলেকে ইগনর করতে পারি সেটা
ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া
ফাহিমকে যে আমার ভাল
লাগেনি তা নয়,আমার পিছু যখন
নিত,বিরক্তির চরম শেখরে
পৌঁছোনোর পরেও বাসায় যাবার
পর কয়েক ঘন্টা ফাহিমের মুখ
চোখের সামনে ভেসে থাকতো।
সেটাই বড় সমস্যা।সমস্যা সমাধানে
তাই আমার এত তাড়াহুড়ো।
-আমার বাবা আমাকে নিয়ে
অনেক স্বপ্ন দেখেন। আমি বাবার
স্বপ্ন পূরণে জীবনের শেষটুকু দিয়ে
যাব। এভাবে পিছনে ঘুরে আমাকে
বিব্রত করো না। তাছাড়া তুমি এত
স্কলার,ঘুরে সময় কেন নষ্ট করছো?
-আমি সময় নষ্ট করছি তোমায় কে
বলল? তাছাড়া তোমার স্বপ্ন পূরণে
আমি তো বাঁধা দেইনি। তোমার
বিব্রত হওয়ার কারণ নেই,আমি আর
তোমার পিছু নেব না। কথাটা শুনে
হঠাৎ কানে বাজলো,আমি আর
তোমার পিছু নেব না। সত্যি কি
তা ই?তবে আমারতো খুশি হবার
কথা,অথচ এই রোবট ছেলেটিকেই
কেন এত ভাল লাগছে?কেন চাইছি
ও আবার পিছু নিক। হঠাৎ বাবাকে
মনে পড়লো।চেতনা ফিরে এল।
বললাম,
-ঠিক আছে।ভাল থেকো।অনেক
ভাল মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী
হিসেবে পাও দোয়া রইলো।
আলতো হেসে দুকদম হেঁটে যেতেই
শুনলাম ফাহিমের কন্ঠ,
-সবাইকে বন্ধু ভাবা যায়,সবাইকে
ভালবাসা যায়,সবাইকে মিস করা
যায়।কিন্তু হৃদয় মাঝে একজন
থাকে,যাকে দেখলে বুকের
মাঝখানটা ফাঁকা লাগে,হার্ট
একটা বিট মিস করে।মনে হতে
থাকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে
আসছে,সেই মানুষটাকে মনে হয়
বিশুদ্ধ অক্সিজেন।যার পিছু নেওয়া
যায় সারাজীবন।
তিরতির একটা স্রোত বয়ে গেল
হৃদপিন্ড বরাবর। একেই কি বলে
হার্টের একটা বিট মিস হয়ে
যাওয়া! পিছনে ফিরে দেখি
ফাহিম ফিরে যাচ্ছে সেই মন্থর
গতিতে।ফাহিমকে আমার তখন
বিশুদ্ধ অক্সিজেন মনে হচ্ছিলো ।
বাসায় এলাম সাড়ে পাঁচটায়। ঘরে
ঢুকে বাবাকে দেখে অবাক। বাবা
আজ বিকেলেই বাসায়। বাবা
চায়ের কাপ হাতে উদাসী
ভঙ্গিতে জানালার বাহিরে
তাকিয়ে আছে।বাবার চাহনীতে
বুকটা খচখচ করছে। কথা না বাড়িয়ে
রান্নাঘরের দিকে যেতে
দেখি,মা আঁচলে চোখ মুছছেন।ছুটে
গিয়ে ধরলাম মাকে।
- 'কাঁদছো কেন মা?'
-তোর বাবার চাকরিটা বোধহয়
থাকবেনা আর।
-সে কি!!!
-ম্যানেজার উঠেপড়ে লেগেছে।
তোর বাবা একাউন্টের হিসেব
ঠিকমত দেখাচ্ছেন,এটা উনি
চাইছেন না। উনি চাইছেন
হিসেবে গড়মিল করুক।
-তাতে উনার লাভ?
-তোর বাবাসহ অনেকের
ধারণা,লোকটার ডিল আছে
কোথাও।কোম্পানীর লস করে
দেওয়ার ডিল।
-বাবা কেন প্রশাসনকে জানাচ্ছে
না?
-সেটা জানাতেই তো বিপদ
ঘটলো।তোর বাবাকে দেখে
নেবে বলেছে।
বলেই মা কাঁদতে শুরু করলেন।আমি
স্তব্ধ হয়ে ঘরে ঢুকলাম।এসব কি হচ্ছে!
বাবা এতটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ
করছে ভেবে আমার দম বন্ধ হয়ে
আসছে।
বিথী খাটের কোণায় বসে পায়ের
নখে নেইলপলিশ লাগাচ্ছে,দেখে
মেজাজটা খিঁচে গেল। গত পরশু ওর
রেজাল্ট বেরিয়েছে। দুই বিষয়ে
অকৃতকার্য হয়ে দ্বিতীয়বর্ষে
উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বাবার এই
অবস্থাতেও বিথীর মনে এত রঙ
দেখে,ওর রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত
না দেখে ঝড়ের বেগে ওর সামনে
গেলাম।নেইলপলিশের বোতল ছুঁড়ে
ফেললাম মেঝেতে।ভ্রু কুঁচকে
ভেঙ্গে টুকরো হওয়া বোতল দেখতে
লাগলো বিথী।আশ্চর্য ওর চোখ
নির্বাক,বিথী যেন অনুভূতি শূন্য এক
মানুষ।
ইমন আর নায়লাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছি নটরডেম কলেজের সামনে।
ইমনের স্বপ্ন নটরডেম কলেজে ভর্তি
হবার।কাগজপত্র জমা দিয়ে
বেরিয়ে এলাম তিনজন। ফুচকা
খাওয়ার আয়োজন চলছে,আমরা
দাঁড়িয়ে আছি ফুচকাওয়ালার
সামনে।নায়লার দিকে তাকিয়ে
দেখি মুখটা শুকনো লাগছে। গাল
টিপে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
'কি হয়েছে তোর?মুখটা ওমন শুকনো
কেন?' নায়লা ইমনের দিকে একবার
তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল
রাস্তায়। টুংটাং বেল বাজিয়ে
যাওয়া রিক্সার চলে যাওয়া
দেখছে সে।ইমনও নির্বিকার,চুপচাপ
ফুচকা বানানো দেখছে। হাত
দিয়ে নায়লার মুখটা আমার দিকে
ফিরিয়ে নিলাম।চোখ দুটো
ছলছলে ওর।এ কারণেই মুখ ঘুরিয়ে
রেখেছে।
-বলবি না আমাকে কি হয়েছে?
-না
-ইমন বকেছে?
-ও কেন বকবে বল।বন্ধু কি বন্ধুকে
বকে? হেসে ফেললাম।
-তোরা বন্ধু?
-জানিনা
-তবে যে বললি...
-আমি বলিনিতো, বলেছে ইমন।
ইমন তখনও নির্বিকার।ফুচকার প্লেট
হাতে নিয়েছে।এবার ইমনের
দিকে প্রশ্ন পাঠালাম-
-তোরা বুঝি বন্ধু?
-কোন সন্দেহ আছে?
-এতদিন তো জানতাম তোরা এর
থেকেও বেশি কিছু।
-ভুল জেনেছো।তিলকে তাল
বানানো মানুষের সহজাত স্বভাব।
আর মানুষের রটানো কথায় যদি
কেউ আবেগে ভাসতে থাকে
সেখানে আমার কি করার আছে!
-মানে কি ইমু?
-মানে আমি কখনই নায়লার প্রেমে
পড়িনি। ওকে ভালবেসে বিয়ে
টিয়ে করা এসবও কখনও ভাবিনি।
তবে নায়লা আমার বন্ধু,প্রাণের বন্ধু।
যে বন্ধু মনের কথা পড়তে
পারে,নায়লা ঠিক তেমন।
নায়লা কাঁদছে।আমি এমন
সারপ্রাইজ বোধহয় জীবনে পাইনি।
কি ভেবেছিলাম, কি হতে
যাচ্ছে। পরিস্কার বুঝতে পারছি
ইমন নায়লাকে ভালবাসেনি কখনও।
ওদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল
না,বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু নায়লার
চোখের জল তো বলছে অন্য কথা!
আবার ইমনকে বললাম,
-নায়লাতো তোকে ভালবাসে।
-আমিতো ওকে বলিনি
ভালবাসতে।
ইমনের এমন কথায় আমি নায়লার
দিকে তাকাতে পারছিলাম না।
ইমন সবসময় বলতো,আমরা বন্ধু।
ভেবেছিলাম নিজেদের সম্পর্ক
গোপন রাখতে হয়তো মিথ্যে বলছে।
নায়লা বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ
থাকেনি,ভালবেসেছে ইমনকে।
কি ভুল করে ফেলেছি এখন বুঝতে
পারছি। নায়লাকে ঠেলে
দিয়েছি অন্ধকারে,এদিকে
নিজের ভাইকেই বুঝতে পারিনি।
ইমন আবার বলল,'জিজ্ঞাসা কর
নায়লাকে।কোনদিন বলেছি
কিনা,ওকে ভালবাসি।'
কিছু বলার আগে নায়লা বলে
ফেলল,'বলতে হবে না কিছু। ভাল
হয়তো আমি বেসেছি,কিন্তু যাকে
ভালবাসছি,সে প্রতিনিয়ত বুঝতে
পারতো তাকে আমি ভালবাসি।
বুঝেও তো সরে যায়নি অথবা
আমাকে ফিরিয়ে আনেনি।'
নায়লা আর কথা বাড়ালো না।ওর
গলাটা কাঁপছে। পিছনে ফিরে
লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে
নায়লা ফুটপাথ ধরে। ইমনকে বিদায়
করে চলে এলাম টিএসসি। সারাটা
পথ শুধু কেঁদেছি নায়লার কথা
ভেবে।রাস্তা পার হয়ে ফাহিমের
পাশে এসে বসলাম।ফাহিম ঘুরিয়ে
আমার চোখের দিকে তাকালো
একবার,তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে
বলল,কেঁদেছো কেন? সেদিনের পর
ফাহিমকে নিজে থেকেই
জানিয়েছিলাম,সারাজীবন ওর
পাশে থাকতে চাই।
ফাহিম যেন জানতো আমি ফিরে
আসবো।সেই ভাবলেশহীন মুখ এখনও
আছে।এত চুপচাপ থাকতে খুব কম
ছেলেদের দেখেছি।অথচ ওর এই
উদাসী চাহনী,নিরব কথন এসবই যেন
আমাকে ওর প্রতি আরও আগ্রহী করে
তুলছে।আমি অনেক কিছু ভেবেই
ফাহিমকে ভালবাসতে শুরু করেছি।
ছেলেটি এক কথায় সৎ! তাছাড়া
আমাদের লেখাপড়ার
বিষয়,আমাদের গন্তব্য সবকিছুই এক।
বাবাকে ঠিক একটা সময় রাজি
করিয়ে নিব। ফাহিমকে খুলে
বললাম কেন কেঁদেছি,নায়লা আর
ইমনের কথাগুলো বললাম।কেমন যেন
হালকা লাগছিল ওকে এসব বলে।
দুজনে ঘুরলাম অনেক।লেকের পাড়ে
বসে এলোমেলো হাওয়ায়
ফাহিমকে যেন আরও চিনতে পারি
ভাল করে।আমি বলে যাই,ফাহিম
চুপচাপ শোনে।অনেক কথা জানতে
ইচ্ছে হয়,জানা হয়না।বড্ড চুপচাপ
ছেলেটি কিছুই বলেনা। দুজনে
গোধূলী লগনে হুড খোলা রিক্সায়
শেষ বিকেলের আলো দেখতে
থাকি।
- ছয় -
বিকেল বেলাটা আজকাল পড়তে
ভাল লাগে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি
ফরম জমা দিয়েছি। স্বপ্ন পূরণের
অনেকটা পথ বাকী।ফাহিমকে
নিয়ে এতটা ভাবিনা। খুব কঠিন
পড়াগুলো কত সহজে সমাধান করে
আমাকে বুঝিয়ে দেয়,অথচ আমি
নিজে থেকে কিছুই পারিনা। দুবছর
যা পড়েছি,সে থেকে অনেক
বেশি কঠিন এই ভর্তি পরীক্ষার
পড়া।অনেক প্রতিযোগীতা,অনেক
যুদ্ধ।
বাসার ল্যান্ড ফোনটা বাজছে।
মায়ের গলা পেলাম,রিসিভ
করেছে বোধহয়। পড়ায় মনযোগ
দিলাম।বিথী কোথায় যেন
গিয়েছে,কেউ জিজ্ঞাসা
করিনি।ইমন ঘুমোচ্ছে।পড়তে পড়তে
দেখি হঠাৎ মা আমার সামনে এসে
দাঁড়িয়েছে।থরথর করে কাঁপছে মা।
ছুটে গিয়ে ধরলাম মাকে।জ্ঞান
হারিয়েছে মা। মায়ের জ্ঞান
ফিরতে মিনিট পাঁচেক লেগেছে।
ইমন শক্ত করে ধরে রেখেছে মাকে।
নায়লা ধরে রেখেছে আমাকে।
বিথী সোফায় হেলান দিয়ে বসে
দেখছে আমাদের। আমরা সকলেই
বিধ্বস্ত।নায়লার মা,ফিরোজা
আন্টি আমাদের একবার পানি
ঢেলে খাওয়াচ্ছেন,একবার বাতাস
করছেন।দরজা ঠেলে নায়লার বাবা
আলী চাচা ঢুকলেন ঘরে। আমি উঠে
দাঁড়ানোর আগে ইমন ছুটে গিয়ে
ধরলো চাচাকে।চাচা ইমনের হাত
ছাড়িয়ে সোফায় এসে বসলেন।
মুখে বিষণ্নতার কালি লেপটে
আছে। মায়ের কাছে ফোন আসে
বাবার অফিস থেকে।বাবার কলিগ
ফোন করে জানান,বাবাকে
থানায় নিয়ে গিয়েছে।বাবার
বিরুদ্ধে অভিযোগ বাবা নাকি
কদিন ধরে তার এক মহিলা কলিগকে
কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে আসছে।
মহিলাটিও মুখ বুজ সহ্য করছিল,কিন্তু
আজ বাবা মহিলাকে একা পেয়ে
হাত ধরতে চাইলে,সে চিৎকার
করে অফিসের সবাইকে একত্রিত
করে।এরকম স্বনামধন্য একটি
কোম্পানীতে কোন অফিসার এমন
কেলংকারিতে জড়িয়ে পড়াতে
কোম্পানী বাবাকে দ্রুত থানায়
সোপার্দ করে। মা তখনই যেতে
চেয়েছিলেন। আলী চাচা যেতে
না দিয়ে নিজে যাচাই করতে
থানায় গিয়েছিলেন। অবস্থা
ভয়াবহ। মহিলা নিজে এসে থানায়
বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে
গিয়েছেন।
সেদিনের পর আলী চাচা বাবার
জামিনের ব্যবস্থা করে
দিয়েছিলেন,অনেক ছোটাছুটি
করে।বাবাকে আনতে মা আর আমি
গিয়েছিলাম।বাবা এরপর থেকে
একেবারেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন।
বাবার চাকরী চলে গিয়েছে,যে
মহিলাকে নিয়ে এত ঘটনা,সেই
মহিলা অফিসের ম্যানেজারের
কথায় এমন কাজ করেছিল বাবাকে
সরানোর জন্য। বাবার এক কলিগ
এসেছিলেন বাবাকে
দেখতে,বাবা সামনে গিয়ে
বসেছিলেন। কিন্তু একটা কথাও
বলেননি।বাবার চাহনি এখন
দিশেহারা।বাবা এখন অল্পতেই
চমকে যান,ভয়ে নিজের ঘরে
গুটিসুঁটি মেরে শুয়ে থাকেন। বাবা
এক কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় দিন
কাটাচ্ছেন। বাবার কলিগই খুলে
বললেন সব। কিভাবে প্রতিনিয়ত
ম্যানেজার বাবার ওপর চাপ প্রয়োগ
করেছে,কিভাবে বাবাকে হুমকি
দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কিছু উপায় না
দেখে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে
অফিস সহকারী একজন মহিলাকে
দিয়ে এসব কাজ করান।মহিলা
সুযোগে ছিল বাবাকে অপদস্থ
করার,একা পেয়ে সেরকমটাই
করেছিল। তাইতো বাবা এত বেশী
আঘাতে জর্জরিত।
বাবার এখন চাকরি নেই,এতদিন
আমাদের নীচতলার দুটো ফ্ল্যাট
ভাড়া পেয়ে আসছিলাম আমরা।
কিন্তু ভাড়ার টাকা তোলাই
থাকতো।বাবার বেতনের টাকায়
আমাদের বেশ চলে যেত। এখন আর
তা হচ্ছেনা।ভাড়ার টাকায় চলতে
হচ্ছে,আগের চেয়ে ব্যস্ততা
বেড়েছে। আগে দুটো টিউশনি
করতাম এখন করছি তিনটে।ভর্তি
পরীক্ষার কথা যেন মনেই নেই
আমার,ফাহিম একদমই সময় দিতে
পারিনা।ও বোঝে সবই,ফোনে কথা
বলার সময় দেখা করতে না পারায়
যখন অনুতপ্ত হতে থাকি ফাহিম তখন
নির্লিপ্ত জবাব দেয়,'পরিবারকে
সময় দেও। তোমাকে ওদের খুব
দরকার।' ফোন রেখে বারান্দায়
দাঁড়াই।শেষ বিকেলের আলো বড্ড
বেশি পোড়ায় আমাকে,ইচ্ছে হয়
পড়ন্ত বিকেলের শেষ রঙ গালে
মেখে নেই,হারিয়ে যাই সন্ধ্যের
আঁধারে।
- সাত -
জীবন যেন পাল্টে গিয়েছে খুব
দ্রুত।এত ঝর বয়ে যাওয়ার পরও,হয়তো
পরমকরুণাময়ের দয়া হয়েছিল আমার
উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির
সুযোগ পেয়ে গেলাম।ফাহিম আর
আমি একই ডিপার্টমেন্টে,ব
্যাপারটা কাকতালীয় তবু সত্যি।
বাবার স্বপ্ন সত্যি হল,কিন্তু বাবার
মুখে হাসি আর ফোঁটাতে পারলাম
না।বাবা এখন পুরোপুরি বোবা
হয়ে গিয়েছেন।কারো কোন কথার
উত্তর দেন না,আমরাও তাই প্রশ্ন
করিনা। মা যেন একদমই ভেঙ্গে
টুকরো হয়ে গিয়েছেন। নিঃশব্দে
কাজ করেন,বাবাকে গোসল করিয়ে
খাইয়ে দেন।যেন নিজের শিশুকে
আগলে রাখছেন।কাজের ফাঁকে
মায়ের গাল ভিজে যায় চোখের
জলে,বুঝি তবু কিছু বলিনা।মাসের
শুরুতে মায়ের হাতে বাসা ভাড়ার
টাকা আর টিউশনির বেতন তুলে
দেই।মা কথা না বলে হাতে নেন
টাকা,আমি সব বুঝি।মায়ের গলায়
কি যেন আটকে থাকে তখন।হয়তো
একদলা কষ্ট। বিথী এখন ইচ্ছে হলে
বাসায় ফেরে,নয়তো ফেরেনা।
কেউ ওকে কিছু বলেও না।সামনে
বিথীর এইচ এস সি পরীক্ষা,অথচ
আমি ওর বইগুলোর ধুলো ঝেরে
রাখি।
ইমন, সে তো অন্যরকম বদলে
গিয়েছে।অনেক টাকা লাগলেও
কষ্ট করে কলেজে ভর্তি করার পর
আমাকে চরম হতাশ করে ফার্স্ট
টার্মে এক বিষয়ে ফেইল করলো।
রেজাল্ট নিয়ে ওর কোন মাথা
ব্যাথা নেই।মা,বাবা,বিথী কেউ
ভাবছে না শুধু আমি ইমনের রেজাল্ট
কার্ড হাতে বসে আছি অবাক
বিস্ময়ে।আমি কেন যেন ইমনের উপর
বিথীর ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম।
নায়লা ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষায়
কলেজের চারটি শাখায় প্রথম স্থান
অধিকার করলো।খবরটা আমাকে
দিতে এসে চুপচাপ মায়ের কোলে
মাথা দিয়ে শুয়ে রইলো।ওর
চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা মায়ের
শাড়িতে পড়ছে,মা ও নিঃশব্দে
কেঁদে যাচ্ছে।নায়লার এই ঘরের
মানুষদের প্রতি এত টান কেন ভেবে
পাইনা,ওকে কতবার বলেছি
এখানে আর না আসতে তবু ওর আসা
চাই।মায়ের হাতে খাওয়া
চাই,মায়ের কোলে ঘুমোনো চাই।
নায়লা যাওয়ার আগে বলে
গেলো,ইমনকে প্রায়ই দেখে
এলাকার বাজে ছেলেদের ভীড়ে
আড্ডা দিতে,বুকটা কেঁপে কেঁপে
উঠছিল। ইমনও কি বিথীর পথের
পথিক হতে যাচ্ছে!তবেতো আমার
আর কেউ রইলো না আপন।
এর কিছুদিন পরই ক্লাস শেষে
বাসায় ফেরার পথে ইমনকে দেখি
একটি নির্মাণাধীন ভবনের এক
কোণে কিছু ছেলের সাথে বসে
আড্ডা দিচ্ছে।মুখগুলো
অপরিচিত,তবে একটি ছেলেকে
চিনি।এই ছেলেটি বিথী আর
নায়লা যখন আগে স্কুল থেকে
ফিরতো তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে
বিরক্ত করতো।ইমন নিজেও এ কারণে
ওদের পাহারা দিয়ে বাসায়
নিয়ে যেত।এখন এই ছেলেদের
সাথে ইমন কি করছে ভেবে কুল
কিনারা না পেয়ে বাসার দিকে
যেতে যেতে পিছনে আবার ঘুরে
তাকালাম।যা দেখলাম তার জন্য
প্রস্তুত ছিলাম না একেবারই।দেখি
ইমনের পাশে বসা ছেলে ছেলেটি
সিগারেটের মাথা কেটে
তামাকের গুঁড়ো ঝেরে
ফেলছে,আরেকজন কিসের গুঁড়ো
যেন ভরে দিচ্ছে। আমার মাথা
এমনভাবে ঘুরে উঠলো যে পড়ে
যেতে যেতে নিজেকে সামলে
নিলাম। ইমন একদল মাদকাসক্ত
ছেলের দলে বসে আছে,এ কথা
ভাবতেই পারছিনা সেখানে
নিজের চোখে দেখে কিভাবে
দাঁড়িয়ে আছি জানিনা।
টলতে টলতে বাসায় এলাম। বাবা
জানালা দিয়ে দুটো চড়ুই পাখির
খুনসুঁটি দেখছেন,পেছন দিয়ে
বাবার কাঁধে হাত রাখলাম।বাবা
একবারও পেছনে তাকালেন
না,কিন্তু নিজের একটা হাত আমার
হাতের উপর রেখে বাহিরেই
তাকিয়ে থাকলেন। ভাবছিলাম
বাবা কি বুঝতে পারছেন,আমিই
এসে দাঁড়িয়েছি?বাবার কাঁধ
আমার চোখের পানির ফোঁটায়
ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে,তবু বাবা
বিচলিত নন।বসে আছেন আগের মতই।
আমি মনে মনে চিৎকার করে
বলছি,'বাবা তোমাকে যে বড্ড
প্রয়োজন আমার।তোমার ছায়া সরে
গিয়েছে এই পরিবারের উপর
থেকে,মায়ের যত্ন মুছে গিয়েছে
আমাদের উপর থেকে।আমি যে
পারছিনা আর সবাইকে বেঁধে
রাখতে,লাগাম ছাড়া ঘোড়া
ছুটেই যাচ্ছে।থামাতে পারার
ক্ষমতা হারিয়েছি আমি।'
- আট -
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ঘর
থেকে বের হইনি।চোখে মুখে জল
ছিটিয়ে বসে পড়লাম মায়ের
সেলাই মেশিন নিয়ে।মায়ের
সেলাই মেশিন আজকাল আমার
ঘরেই থাকে।মা এখন এসব ছেড়ে
দিয়েছেন,আর আমি ধরেছি।টুকটাক
অর্ডার আসে।জামা,কভার এসব
বানিয়ে যতটুকু রোজগার হয় জমিয়ে
রাখি ইমনের পড়ার খরচ মেটাতে।
এসব ভাবতে ভাবতে ইমনের কথা
মনে পড়ে গেল।গতকাল ওকে
জীবনে প্রথম প্রচন্ড মারলাম। মেরে
ঠোঁট কেটে ফেলেছি ওর। গতকাল
রাত পৌনে এগারটায় মা আর আমি
বসেছিলাম সোফায়।বাবা ঘুমিয়ে
ছিলেন।মা আর আমি না খেয়ে
বসেছিলাম দুজন মানুষের
অপেক্ষায়।বিথী আসবে কি আসবে
না অনিশ্চিত,কিন্তু ইমন এই প্রথম
এতরাত পর্যন্ত বাহিরে।ইমন এল
বারটা বাজার কিছু আগে।এসেই
আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ
নামিয়ে ফেলল।নিজের ঘরের
দিকে যাওয়ার আগে ছুটে ওর
টিশার্টের কলার ধরে ঘুরিয়ে
আনলাম।
-কোথায় ছিলি তুই
-বন্ধুদের সাথে।
-ওই নেশাখোরদের সাথে? লজ্জা
করেনা তোর?
-লজ্জার কি আছে?ওরা কি আমার
কোন ক্ষতি করছে?
-ক্ষতি?ওরা তোকে ধ্বংস করে
দিচ্ছে।তুই বুঝতে পারছিস না।
-আমার এত বুঝতে হবে না।এত বিরক্ত
কেন করছো?ঘুমোও গিয়ে।
-ইমন,তুই কত মেধাবী ছেলে।তোর
মেধা,তোর আচরণ সবকিছুই এই
এলাকার মানুষের কাছে তোকে
সম্মানিত করে রেখেছে।তোকে
সবাই ভালবাসে,একটা সময়ে
তোকে কত শ্রদ্ধা করবে দেখিস।
-শ্রদ্ধা!!!ফু... তাচ্ছিল্য মিশিয়ে
শ্রদ্ধা শব্দটি উড়িয়ে দিল ইমন।আবার
বলতে শুরু করল,
-এলাকায় এখন আমি চরিত্রহীন
একজন মানুষের সন্তান হিসেবে
পরিচিত।আমার দিকে সবাই সেরকম
দৃষ্টিতেই তাকায়।আমার তখন মরে
যেতে ইচ্ছে করে আপু।ওই
ছেলেগুলোই শুধু আমাকে গুরুত্ব দেয়।
-ওরা তোকে নষ্ট করতে তোর
দূর্বলতার এই সুযোগকে কাজে
লাগাচ্ছে। বাবা কি করেছে
সেটা তুই জানিস না?বাবা যে
ষড়যন্ত্রের শিকার তা বুঝিস না?
-এসব ফাউল প্যাচাল না পেরে
ঘুমোতে যাও।আর আমি কি করবো
না করবো সেটা আমার ব্যাপার।
কথাটা টং করে আঘাত দিল
মাথায়।শরীরে সর্বোচ্চ শক্তি
দিয়ে চড় বসিয়ে দিলাম ইমনের
গালে।পরে যেতে গিয়ে সামলাল
ইমন,ততক্ষণে আরও চড় থাপ্পর দিতে
লাগলাম ওর গায়ে,মুখে যেখানে
পারছি।একসময় ছুটে গিয়ে
টেবিলের কোণায় পড়লো
ছেলেটা।ঠোঁট ফেটে যাওয়ার পর
মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে
টেনে নিয়ে গেলেন। ইমন কিছুক্ষণ
ওভাবেই ছিল,তারপর একছুটে
নিজের ঘরে যেয়ে দরজা
লাগিয়ে দিল। মা আর আমি তখনও
সোফায় বসে আছি।রাত দুটোর পর
মা সোফায় এলিয়ে পড়লেন।আমি
জেগে ছিলাম বিথীর আসার
অপেক্ষায়।
- নয় -
বিথী এল পরদিন বিকেলে।মা
দরজা খুলতেই কোনদিকে না
তাকিয়ে হনহন করে যেতে লাগলো
নিজের ঘরে।পথ আগলে দাঁড়ালাম
ওর।সেই অনুভূতিহীন শূন্য চোখে
বিথী তাকিয়ে আছে আমার
দিকে।আমি কিছু বলার আগেই
বিথী বলে উঠলো,'কোন প্রশ্ন
করবিনা আপু।কোথায় ছিলাম,কেন
ছিলাম এসব উত্তর দিতে পারবো
না।আমি এখনই চলে যাব,তোদের
সাথে থাকবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে
আমার নেই।'
আমিও বোধহয় বিথীর মত অনুভূতিহীন
হয়ে গিয়েছি।পাশে সরে গিয়ে
জায়গা করে দিলাম।বিথী ঘরে
ঢোকার পর থেকে খুটখাট শব্দ
আসছিলো।কিছুক্ষণের ভিতর বিথী
বেরিয়ে এল,হাতে ব্যাগ।বোঝাই
যাচ্ছে তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিদেয়
হচ্ছে বিথী।দরজার কাছ পর্যন্ত
যেতেই মা হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
মাকে আমি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে
রাখলাম আর মা ও যেন চেষ্টা করে
যাচ্ছেন নিজেকে সামলাবার।
কান্নার দমকে কেঁপে উঠছিলেন
মা বারবার।
কিছুক্ষণ পর নায়লা এল।এসেই
আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে
কাঁদতে লাগলো মেয়েটা।ইমনকে
রাস্তায় একা পেয়ে পা জড়িয়ে
ধরে বসেছিল ও।ইমনকে ফিরিয়ে
আনার সবরকম চেষ্টা করেও যখন
ইমনকে রাজি করানো যাচ্ছিলো
না ঠিক ওই মূহুর্তে ইমনের
নেশাখোর সঙ্গীগুলো এসে ইমন আর
নায়লার চারপাশে দাঁড়িয়ে
বাজে মন্তব্য করতে লাগলো।
নায়লা তবুও ধরে রইলো ইমনের পা।
ইমন একসময় নায়লাকে একপ্রকার
জোড় করে উঠিয়ে সজোরে চড়
বসিয়ে দিল।সেই চড়ের দাগ গালে
নিয়েই ছুটে এসেছে নায়লা আমার
কাছে।তখনও কেঁদেই চলেছে
মেয়েটা,গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ
বসে আছে।মা,আমি আর নায়লা
সন্ধ্যে পর্যন্ত বসে থাকলাম
বারান্দায়।বাবা চুপচাপ আগের মতই
ঘরে।ইমন ফেরেনি,আর বিথী তো
চলেই গিয়েছে কোন বিকেলে।
রাত নয়টায় একটি লোক এল।হাতে
খাম,কিছু না বলে খাম দিয়ে চলে
গেল।খাম ছিঁড়ে দেখি একটি রোল
টানা কাগজ ভাঁজ করা।খুলতেই বুঝে
গেলাম বিথীর হাতের লেখা।
পড়তে শুরু করলাম...
আপুরে,
আমার যে খুব চাহিদা।ভাল
পোশাক,ভাল খাবার,থাকবার ভাল
জায়গা এসবের যে আমার খুব লোভ।
আমি খুব স্বার্থপর রে আপু।আমাকে
মাফ করে দিস।আমার বিয়ে হয়েছে
গতকাল।আমার বরের বয়স পঞ্চাশ হবে
হয়তো,তাতে কি বল?যখন যা
চাইবো পাবো তো।
তোদের কাছে যা পাইনি
সেসবের শখ না হয় এই লোকটাই
মিটিয়ে দেবে।আমার বিলাসী
জীবনের শখ তোরাতো পারলিনা
পূরণ করতে,তাই তোদের জ্বালিয়ে
লাভ নেই।
ভাল থাকিস।
-বিথী
চিঠিটা টুকরো করে ছুটে গেলাম
বাবার ঘরে।
- দশ -
বাবা শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে
আছেন আমার দিকে।আমি বাবার
মুখোমুখি বসে আছি এই রাত দশটায়।
বাবাকে বললাম,'বাবা তাকাও
আমার দিকে।কি ভেবেছো?জীবন
থেকে পালিয়ে যাওয়া এত
সোজা?এত সহজে তো তুমি
পরিত্রাণ পাবেনা বাবা।এ
সংসারে তোমার অবদান কতটুকু
ছিল বলতে পার?এ সংসার আজ
তোমার জন্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
তোমাকে আমি কখনই মাফ করবো
না বাবা।কখনই না'
বাবার ঘর থেকে বের হবার সময় মা
আঁকড়ে ধরল আমাকে।ঠোঁট কাঁপছে
মায়ের,'আধমরা মানুষটাকে ঘাঁই
দিলি মা?মরে যাবে তো।'
বিছানায় এসে উপুর হয়ে শুয়ে
পড়লাম।মায়ের কথাগুলো কানে
বাজছে।বাজতেই থাকলো,একসময়
চোখ লেগে গেল।ঘুম ভাঙ্গলো
মায়ের তীব্র চিৎকারে।ধরফর করে
উঠে বসেছি কি বসিনি দৌঁড়ে
গেলাম বাবার ঘরে।মা বাবার
কোমড়ের কাছে আঁছরে পড়ে
চিৎকার করছেন আর বাবা একদম
নিশ্চিন্তে ডান দিকে মাথা
এলিয়ে পড়ে আছেন।
আমি কাছে যাওয়ার আগেই মা
আমার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে
যাচ্ছেন,'তুই মেরে ফেললি তোর
বাবাকে।তুই...'
আমি মেঝেতে ধপ করে বসে
পড়লাম।মাথা কী ভীষণ ঘুরে
উঠেছে,কানে বেজেই
চলেছে,'আধমরা মানুষটাকে ঘাঁই
দিলি মা?মরে যাবে তো।', 'তুই
মেরে ফেললি তোর বাবাকে।তুই...'
- এগার -
আইসি ইউর সামনে বসে আছি।
নায়লা আমার কাঁধে মাথা দিয়ে
এলিয়ে পড়েছে।আলী চাচা
পাইচারি বন্ধ করে বসলেন আমাদের
পাশে।আমি তাকিয়ে আছি
দেয়ালে ঝোলানো টিকটিক
শব্দে চলা ঘড়িটির দিকে।এই
ঘড়িটা যদি হঠাৎ থেমে যেত,যদি
পৃথিবী ভেঙ্গে পড়তো,সব শেষ হয়ে
যেত...ভাবতে ভাবতে চোখ আবার
ভরে গেল জলে।সামলাতেও
পারছিনা,মাথা ঠেকিয়ে দিলাম
পিছনের দেয়ালে।
বাবাকে দাফন করা হয়েছে বাদ
জহুর।মা আর আমি ছাড়া কেউ
জানেনা বাবার মৃত্যুর কারণ।আমার
কথাগুলো বাবা নিতে
পারেনি,হয়তো শেষবারের মত
আমাদের তিনভাইবোনকে
দেখতেও ইচ্ছে করছিল বাবার।
হয়তো আরও কতশত ইচ্ছে ছিল বাবার।
বাবাকে দাফন করা শেষ
হলে,মায়ের প্রেশার হুহু করে বেরে
যেতে থাকে।জানতাম না আমরা।
মা নিজের ঘরেই মাথা ঘুরে পড়ে
গেলে মাথার পিছনের হাড়
ভেঙ্গে যায়।বিথীর সাথে
যোগাযোগের কোন উপায় না
দেখে ওকে আর খবর দেওয়া হইনি
বাবার।ইমন সেই যে আমার মার
খেয়ে বাসা ছেড়েছে আর
আসেনি।আলী চাচা,নায়লা আর
আমি ধরাধরি করে আনলাম
হাসপাতালে মাকে।ডাক্তার
বলে দিয়েছে জ্ঞান না ফেরা
পর্যন্ত সবকিছুই অনিশ্চিত।
কি করবো আমি!এক এক করে সবাই
চলে যাচ্ছে আমাকে ছেড়ে।মা
বেঁচে থাকবে তো?না হলে
বাঁচবো কাকে নিয়ে!বিথী বা
ইমন কেউই জানেনা বাবার মৃত্যুর খবর
কিংবা মায়ের এই অবস্থার কথা।
জানতে পারলে কি ওরা ছুটে চলে
আসবে নাকি থাকবে যে যার মত!
মাঝে মাঝে বলে উঠি,খোদা
ওদের মত বানিয়ে দিলে না কেন!
কোন অনুভূতি থাকতো না আমার!
মায়ের জ্ঞান ফিরছে না এখনও।
নায়লার পরীক্ষা ছিল তাই ঠেলে
বাসায় পাঠিয়েছি ওকে আলী
চাচার সাথে।ভোরের স্নিগ্ধতায়
হাসপাতালের কোরিডর ধরে
ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াই।এত
মিষ্টি একটি সকাল,অথচ এ সকাল
আমার নয়।ফাহিমের জন্য দাঁড়িয়ে
আছি।ভোর চারটায় ওর সাথে কথা
বলেছি,ও বলেছে ভোরের আলো
ফুটতেই চলে আসবে হাসপাতালে।
এসেছে সেই মন্থর গতিতে।সিঁড়ি
দিয়ে উঠছে আমি তাকিয়ে আছি।
এত মায়া কেন লাগছে ওকে দেখে
বুঝতে পারছিলাম না।চোখ ঘুরিয়ে
বাহিরে তাকালাম।সময়টা
আবেগের নয়,বাস্তবতার।ফাহিম
এসে দাঁড়ালো সামনে।সারারাত
নির্ঘুম কাটানো আমার এলো চুল
কপালে জড়িয়ে আছে,ফাহিম সেই
চুলের গোছা সরিয়ে দিল আস্তে
করে।তাকিয়ে বলল,'এখন কেমন
আছেন মা?'
অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।ওর
মুখে মা ডাক কেমন যেন মায়ায়
জড়ানো মনে হল।মাথা
নাড়ালাম,'ভাল না ফাহিম।চল
ওখানটায় গিয়ে বসি।কিছু কথা
আছে তোমার সাথে।'
ফাহিমকে নিয়ে বসে আছি
চুপচাপ।মিনিট পাঁচেক পর ডাক্তার
এলেন।মায়ের জ্ঞান ফিরেছে তবু
আশংকা মুক্ত নয়।অক্সিজেন চলছে
এখনও।আমার বুকের ধরফরানি বেরে
গেল।ফাহিমের দিকে
তাকালাম,মনে মনে ভাবছি মা
বাঁচবে তো!ফাহিম আমাকে ধরে
বসিয়ে দিল বেঞ্চটায়।নিজেও
বসলো পাশে।আমার চলে আসা
চোখের পানি আটকে ওকে বলতে
শুরু করলাম,'আমাদের এই সম্পর্ক আর
এগিয়ে না নেওয়াই ভাল।দেখছো
তো আমার অবস্থটা।তুমি ভাল
ছেলে,ভাল থাক।জড়িয়োনা
আমার সাথে।আমার জীবন সংগ্রাম
আমি একাই করে যাব।'
সামনেই স্ট্রেচারে করে এক
রোগীকে আইসিইউতে ঢোকানো
হচ্ছে।ফাহিম তাকিয়ে আছে
নিস্পলক সেদিকে।হঠাৎ আমার
দিকে ফিরে বলল,'আমিতো
তোমায় বলিনি আমায় ভালবাসো।
কেন বেসেছিলে?মাঝ নদীতে
ফেলে দিতে?আমি যে সাঁতার
পারিনা তিথী!যাক সে
কথা,তোমাকে আজও জোড় করবো
না।আমাকে তুমি কতটা ভালবাস
আমি জানি।কেঁদেই যাবে
সারাজীবন তাও জানি,তবু কষ্ট
পেতে চাইলে পাও।আমি কাউকে
জোড় করতে পারিনা।আমার
ব্যার্থতা।'
উঠে দাঁড়ালো ফাহিম।আবার
আমার কপালে লেপটে থাকা এক
গোছা চুল কানে গুঁজে দিল
ফাহিম।এরপর,ভাল থেকো বলেই
হেঁটে যেত লাগলো।
আমার কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে
গিয়েছে!অবাক হয়ে ফাহিমের
চলে যাওয়া দেখছি।একটাবারও
ফিরে তাকালো না ছেলেটা।এর
নামই কি ভালবাসা!ওই
ভাবলেশহীন ছেলেটা কি সত্যিই
জোড় করে আটকে রাখতে
পারেনা ওর বাহুডোরে!
- বার -
কাঁদতে কাঁদতেই ফোন বেজে
উঠলো।নায়লার ফোন।বাসায় পুলিশ
এসেছিল।ইমনের ওই নেশাখোর
সঙ্গীদের দলের একজন খুন হয়েছে।
প্রধান আসামী তিনজন।তাদের
একজন ইমন।ব্যক্তিগত রেশারেশি
থেকেই নাকি হয়েছে এমনটা।
ইমনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ।আমি
টলতে টলতে বসে পড়লাম মেঝেতে।
ওই সময়টা উন্মাদ হয়ে গেলে মন্দ
হতো না,বাবার মত জীবন থেকে
পালিয়ে বাঁচতে পারতাম।
বাসায় আর গেলাম না।কি হবে
ওখানে যেয়ে।মায়ের জ্ঞান
ফিরলেও বার বার চলে যাচ্ছে।
নাকে নল ঢুকিয়ে খাওয়ানো
হচ্ছে।নায়লা আর নায়লার মা
বিকেলেই চলে এসেছে এখানে।
নায়লার ফোনটা বেজে উঠতেই
রিসিভ করলো ও।কয়েক সেকেন্ডের
নিরবতা শেষে নায়লা চিৎকার
করে কাঁদতে লাগলো,হাউমাউ করে
কি সব বলতে লাগলো কিছুই বুঝতে
পারছিলাম না।এক প্রকার জোড়
করে ওর ফোনটা কানে নিতেই
ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শরীরে।
ইমনের গলা।খুব কাঁদছে ইমন।যেন
কেউ মারছে ওকে।আমি কোন রকমে
বললাম,
-ইমু...
-আপু আমাকে বাঁচাও।আমি খুন
করিনিরে আপু।এতটা অমানুষ এখনও
হইনি।খুন করেছে সুমন।এখন
ফাঁসিয়েছে আমাদের তিনজনকে।
তোমার মনে আছে আপু তুমি
আমাকে খুব মেরেছিলে?ওইদিন
রাতেই রাজু খুন হয়,আমিতো
বাসায়ই ছিলাম।আপু আমাকে
বাঁচাও।
-তুই কোথায়?
-আমরা পালিয়ে আছি।আমি
বাসায় আসবো আপু।তোমাদের
কাছে।আমি আবার আগের মত হয়ে
যাব দেখো।
বুঝতে পারলাম ইমন কিছুই জানেনা।
ভাবলাম আসুক তারপরই বলবো না হয়।
এমনিতেই কষ্টে আছে বাবুটা।
বললাম,
-কবে আসবি?পুলিশ তোকে খুঁজছে।
-পুলিশ তো আমাকে গ্রেফতার
করবে আর সুমন আমাকে পেলে
কুপিয়ে মারবে আপু।ওর নাম
পুলিশের কানে যাওয়ার আগে ও
আমাদের মেরে ফেলবে।আমি ওর
ভয়ে লুকিয়ে আছি।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে
বললাম,সাবধানে থাকিস।কবে
আসবি ফোনে জানিয়ে দিস।
ফোন রেখে দিতে যাব ওমনি ইমন
বলে উঠলো,'আপু গতকাল থেকে না
খেয়ে আছি।নায়লা তখন হাউমাউ
করে কি বলল বলতো?বারবার আন্টি
আংকেল এসব বলছিল।বাবা মা
কেমন আছে?আচ্ছা নায়লাকে দেও।
ওকে কিছু বলবো।'
আমি ফোনের লাইন কেটে দিলাম।
ইমন গতকাল থেকে না খেয়ে আছে।
তারচেয়েও বড় কথা ও জানতে
চাইছে মা বাবা কেমন আছে!
মেসেজ টোন বেজে উঠলে
ফোনটা নায়লার হাতে দিয়ে
বারান্দায় গেলাম।দু মিনিটের
মাথায় নায়লা ছুটে এসে আমাকে
জড়িয়ে ধরে মুঠোফোনের
স্ক্রিনটা দেখালো।ইমনের
মেসেজ,'নায়লা,তোকে যে খুব
বেশি ভালবাসি এইরকম
পরিস্থিতিতে না পড়লে বুঝতামই
না।মাফ করে দিস যদি মরে যাই।'
নায়লা আমাকে ধরে ঝাঁকাতে
লাগল।আর বলতে 'লাগল,কেন কেন
এমন হল আপু?'
- তেরো -
ইমন আসবে সেই অপেক্ষায় কলেজ
না গিয়ে সারাদিন বসে রইল
নায়লা।আমি বাসায় এলাম
দুপুরে,গোসল সেরে এক কাপ চা
হাতে বসে রইলাম নায়লার পাশে।
নায়লা বারান্দায়,ওর দৃষ্টি
আমাদের বাড়ির দিকে আসা
রাস্তায়।কে জানে ইমন কোন দিক
দিয়ে আসবে,নায়লা তবু বসেই
রইলো।ডাক্তার বলেছে মাকে আরও
কিছুদিন হাসপাতালে রাখতে
হবে,কিন্তু এত খরচ কুলিয়ে উঠতে
হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে।
দুদিনেই অনেক টাকা বেরিয়ে
গিয়েছে,বাকী টাকা কিভাবে
যোগাড় করবো ভেবে না পেয়ে
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে চা খেতে
বসলাম।
ইমন আসেনি।বিকেল হয়ে
আসছে,আমি উঠে পড়লাম।মায়ের
কাছে যেতে হবে।নায়লা তখনও
ঠাঁয় বসে রয়েছে।আমি জানি
আমি চলে যাওয়ার পর নায়লা বসে
বসে কাঁদবে।কাঁদুক,আমার
কান্নাকাটি করে বুক ভাসানোর
সময় নেই।সময় আমাকে বদলে দিচ্ছে
প্রতিনিয়ত।
বই হাতে শেষ কবে বসেছিলাম
ভুলে গিয়েছি।লেখাপড়া বুঝি
এখানেই শেষ।ক্লাসে যাই না
কতদিন।ক্লাসের কথা মনে পড়তেই
ফাহিমের চেহারা সামনে এসে
হাজির।ক্লাসে গেলেইতো
ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে
যাবে।কি করবো তখন!ফাহিম কি
আমাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে
নিবে নাকি কাছে এসে জানতে
চাইবে ভাল আছি কিনা!জানিনা
কিছুই,এতসব কষ্টের মাঝে ফাহিমকে
মনে পড়লে আরও এলোমেলো হয়ে
যাই।কেমন যেন পাগল পাগল লাগে।
পা চালাই দ্রুত,মা বেঁচে থাকুক।মা
কে নিয়ে যেন আমি বেঁচে
থাকতে পারি।
- চৌদ্দ -
হাসপাতালে গিয়ে থমকে
গেলাম।বিথী বসে আছে নায়লার
মায়ের সাথে।আমি বাসায়
যাওয়াতে নায়লার মা বসেছিল
এখানে,কিন্তু বিথী কোথা থেকে
এল মাথায় আসছেনা।জিজ্ঞাসাও
করতে ইচ্ছে করছে না।কাছে
যেতেই বুঝলাম খুব দামি জামা
জুতো ব্যাগ হাতে বসে আছে
বিথী।মনে মনে হাসলাম।যা
চেয়েছিল পেয়েছে বিথী।
বিথীর চেহারায় সুখী ভাব ফুটে
উঠেছে প্রবলভাবে।
ভেবেছিলাম বাবা নেই,মায়ের
এই অবস্থা।বিথী বোধহয় খুব কাঁদবে।
না,বিথী সেই অনূভুতিহীন শূন্য দৃষ্টি
মেলে দেখছিল আমাকে।ঘন্টা
দুয়েক এভাবেই বসে ছিল,একবার
মনে হল একটু ঝাঁকি দিয়ে বলি
ওকে,'বিথীরে,বাবা আর নেই।মা
থাকবেতো না থাকারই মত।আমি
কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারিস!'
বলা হয়না।বিথী একসময় চলে যায়।
যাবার আগে আমার হাতে একটি
চিরকুট গুঁজে যায়,সাথে ব্যাংকের
চেক।চিরকুটে লেখা,'আপু,জানি
রেগে আছিস তবু এই চেকটা রাখ।
তোর হাসপাতাল বাবদ যত খরচ হয়
সেই অংকটা বসিয়ে নিস।'
চেকটা ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও
থমকে গেলাম।বিথীরও তো কিছু
দ্বায়িত্ব আছে মায়ের প্রতি।
তাছাড়া আমি এতগুলো টাকা
পরিশোধ করবো কি দিয়ে।তার
চেয়ে থাকুক চেকের পাতাটা
সযত্নে।
ইমন ফোন করেছিল।খুব নাকি বিপদে
আছে।সুমনের লোকেরা খুব করে
খুঁজছে ওদের।ও কোথায় তাও
জানিনা,পুলিশকেও বলি
কিভাবে!তাহলেতো ইমনও পার
পাবেনা।ভেবে ভেবে চিন্তা
বাদ দেই।মা কে বাসায় আনি।মা
যন্ত্রের মত শুয়ে থাকেন,ফ্যালফ্যাল
চাহনীতে কিছু নেই।আমিও পাত্তা
দেইনা।মা কে খাইয়ে পড়িয়ে
টিউশনি করতে যাই,ক্লাস করি।
ফাহিমকে ক্লাসে আর দেখিনা।
কেউ বলতে পারেনা ও
কোথায়,ক্লাস কেন করেনা।বরং
আমি কিছু জানিনা দেখে ওরা
আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে
তাকাতে লাগল।অসহায় হয়ে
যেতে থাকলাম।একদিন না পেরে
ফোন করলাম ফাহিমের
নম্বরে,একরাশ কথা জমিয়ে।বলা হল
না,নম্বরটা বন্ধ।হয়তো অনেক আগে
থেকেই,জানা ছিল না।ইমনটা
আসবে আসবে করে পনের দিন পার
করে দিল।এখন ওর মোবাইলটাও বন্ধ।
নায়লা পাগল প্রায় হয়ে
কলেজ,খাওয়া সব বন্ধ করে বসে
আছে।ইমনকে খুনের আসামী করা
হয়েছে,নায়লাকে এই ব্যাপারটার
চাইতেও নাড়া দিয়েছে ইমনের
সেদিনের পাঠানো মেসেজটা।
কাউকে খুব বেশি একতরফা
ভালবাসে যাওয়ার পর,ভালবাসার
মানুষটি যদি জানায় সে ও তাকে
ভালবাসে তখন তার অবস্থা
নায়লার মতই হবে।
আমি আজকাল আকাশ দেখি খুব।
আকাশের মত বিশাল কিছু কি আছে
প্রকৃতির মাঝে?এত বিশাল জায়গা
জুড়ে রোদ,বৃষ্টি,মেঘেরা ভেসে
বেড়ায়।আমারও মেঘের ভেলায়
ভাসতে ইচ্ছে হয়।ভেসে ভেসে
পৃথিবীটাকে দেখতে ইচ্ছে
হয়,পৃথিবীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে
বলতে ইচ্ছে হয় আর ফিরবো না এই
মনষ্যজগতে...
- পনের -
জীবন থেকে চলে গিয়েছে
অনেকটা সময়।বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট
চুকিয়ে একটি কলেজে শিক্ষকতার
চাকরি নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে
সময়।মা চলে গিয়েছেন বছর
দেড়েক,মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আমার
হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন।কিছু
যেন বলতে চাইছিলেন,পারেন নি।
বিথীর স্বামীও মারা গিয়েছেন
স্ট্রোক করে।বিথী বোধহয় আগে
থেকেই লোকটার সম্পত্তি
লিখিয়ে রেখেছিল।স্বামীর মৃত্যুর
পর বিথীই পেয়েছে সব।বিথীর
ছেলে আছে একটা।নামটা আমিই
রেখেছি।আরিয়ান!ছেলেটা আমি
বলতে অজ্ঞান,অথচ বিথী তেমন
একটা আনে না আরিয়ান কে আমার
বাসায়।বিথী একা একা আসে
প্রায়,এসে বসে থাকে চুপচাপ।
আমার ভাল লাগেনা,যদি
আরিয়ান আসতো বেশ কেটে যেত
সময়।বিথী চলে যায়,একজন
শিল্পপতি আর কত টুকু সময়ই বা আমার
জন্য রাখতে পারে!
সামনের সপ্তাহে ইমনের জন্মদিন।
ইমনের জন্মদিন মানেই হুলস্থুল
ব্যাপার ছিল।আমি,বিথী নায়লা
বেলুন দিয়ে ঘর সাজাতাম আর ইমন
চুপচুপি একটা দুটো বেলুন ফুটো করে
দিত ঠুশঠাশ!বেঁচে থাকলে হয়তো
ইমন ডাক্তার হতো।বাবার শখ ছিল
ডাক্তার হোক ইমন,মানব সেবায়
নিয়োজিত হোক।অথচ ইমনকেই
কাঁটাছেঁড়া হয়ে কবরে যেতে হল।
আসবে আসবে বল ইমন বেশ কাটিয়ে
দেওয়ার পর পুলিশের ফোন আসে।
ফোন নম্বর ইমনের পকেটেই ছিল
কাগজে লেখা।ইমনের হাত পা
বাঁধা মৃতদেহটা পাওয়া যায় একটি
ডোবার পাশে।আমি আর নায়লা
গিয়ে লাশ সনাক্ত করেছিলাম
ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।আমি
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম
ইমনকে।কেমন ঘুমিয়ে আছে যেন।
ইমনের লাশ আনার পর ছয়মাস সময়
লেগেছিল নায়লার স্বাভাবিক
জীবনে ফিরে আসতে।এরপর
নায়লাকে আবার ধরিয়ে দেই আমি
লেখাপড়া।নায়লার মত অসম্ভব
মেধাবি মেয়েটা ঝরে যাবে
ভেবে ওর পিছনে খেটেছিলাম।
পরিশ্রম সার্থক করে মেয়েটা বুয়েট
থেকে পাশ করে বেরিয়েছে।এখনও
অফিস শেষে এসে আমার কোলে
মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে।ঠিক
মায়ের কোলে যেমন থাকতো।
আলী চাচা প্রায়ই নায়লাকে
বিয়ে দিতে চান,নায়লা তখন
আমার কাছে চলে আসে।আমি
আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসি।
আর আমিতো আছি বেশ ভালই।
শিক্ষকতার পেশায় জড়িয়ে সময়
কেটে দুপুর পর্যন্ত।বিকেলগুলো
কাটে বিষন্ণতায়।ফাহিমের স্মৃতি
হাতড়ে বিকেল কেটে যায়।
ফাহিমকে আর খুঁজে পাইনি।
কোথায় পাব,আর ক্লাস করতে
আসেনি কোনদিন।ফোন নম্বরটা
ছাড়া আর কিছুই জানা ছিল না
আমার।এখনও প্রায় বিকেলে
ফাহিমের নম্বরে ডায়াল
করি,জানি বন্ধ তবু।
জীবন কেটে যাচ্ছে জীবনের
নিয়মে।এখনও আকাশ দেখি আমি।
আকাশের মেঘগুলো জমা রয়েছে
আমার মনে।মেঘ ভেঙ্গে রৌদ্দুরের
ছটা কবে জীবনকে আলোকিত
করবে জানা নেই,তবু থাকি মেঘ
ভাঙ্গা রৌদ্দুরের অপেক্ষায়!
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ