পহেলা ফাল্গুন
জয়নাল আবেদীন
নীলা আমার ডান হাত চেয়ারের হাতলের সাথে বাঁধছে। খুব যত্ন করে হাত হাতলে রেখে দঁড়ি দিয়ে শক্ত করে গিঁট দিল। আমি হাত নাড়িয়ে দেখলাম বাঁধন যথেষ্ট শক্ত।
গিঁট খোলা আমার পক্ষে অসম্ভব।
হাত বাঁধা শেষ করে নীলা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। এত রূপবতী কারো হাসি এরকম বন্ধ ঘরে বসে দেখলে যে কোন পুরুষের আত্মা কর্পুরের মতো উড়ে যাওয়ার কথা। তবে আমার আত্মা উড়ছে না। খানিকটা ভয় পাচ্ছি আমি।
করছেটা কি নীলা? করবেটা কি?
হাত বাঁধা কোন ধরণের সারপ্রাইজ?
নীলা বলল, ব্যথা পাচ্ছো?
- একটু।
- একটু ব্যথা লাগার কথা। তোমাকে ব্যথা দেয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না। তবে সারপ্রাইজের জন্য একটু তো স্যাক্রিফাইস করতেই হয় তাই না?
নীলা আবারো হাসছে। মুক্তোর মতো দাঁত, কমলার মতো ঠোঁট আর পদ্মের মতো চোখ এসব পুরাতন উপমা। নীলাকে নতুন কি উপমা দেয়া যায় সেটা নিয়ে আমি ভাবছি। ভাবনার বেশি দূর এগুলো না। বারবারই মনে হচ্ছে নীলার ইচ্ছেটা কি?
আজ পহেলা ফাল্গুন।
নীলার সবচেয়ে প্রিয় দিন। গত এক মাস ধরে নীলা পরিকল্পনা করে বসে আছে আজকে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ।
পৃথিবী বিরাট জায়গা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ একেকজনের কাছে একেক রকম মনে হবে। যার পৃথিবী যত বড় তার সারপ্রাইজ তত বড়।
নীলা কি সারপ্রাইজ দেবে?
খুব সাধারণ কোন কিছুর জন্য এ রকম বদ্ধ ঘরে সে আমাকে ডাকে নি এটা সহজেই অনুমেয়।
করবেটা কি সে?
আমার একবার মনে হলো সে সম্ভবত চুমু খাবে।
প্রেমিক প্রেমিকাকে চুমু খাবে এটা খুব সাধারণ ঘটনা। তবে নীলা যদি সত্যিই এটা করে তবে এটাও আমার জন্য কম বড় সারপ্রাইজ না। আমরা অসংখ্য রাত আলাদা আলাদা ভাবে কেঁদেছি। বুকের ভেতর তীব্র শূন্যতা অনুভব করেছি।
কিন্তু গভীর আবেগে কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে চাই নি। কোন দিনও না। একটা বারের জন্যেও অসৎ কোন ভাবনার জন্ম নেয় নি আমাদের ভেতর। অদ্ভূত হলেও এটা খুবই সত্য।
নীলা বলল, ডান হাতে মশার কামড় কেন? মশারি দাও নি?
আমি বললাম, মশারি ছিল। কিভাবে মশা কামড়িয়েছে জানি না।
নীলা বলল, এবার আমি তোমার বাম হাত বাঁধব। হাত সংশ্লিষ্ট কোন কাজ থাকলে করে নিতে পারো।
আমি আমার ঘোর কাটাতে না পেরে বললাম, নীলা কি হচ্ছে এসব? কি সারপ্রাইজ বলে ফেলো।
নীলা আবারো বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলল, তোমাকে আমি খুন করব। পালাবা? পালালে এখনো সুযোগ আছে। চলে যাও..
নীলা শব্দ করে হাসছে।
আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি। সত্যিই..
যদি নীলাকে আমাকে খুন করা তো দূরে থাক, আচড় কাঁটবে এটা বিশ্বাস করতে হলে আমাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে।
:
:
আমি লেখক মানুষ।
নিজেকে লেখক বলে পরিচয় দেয়া খুবই লজ্জার বিষয়। কারণ আমার লেখার প্রতিভা ব্যাপারে খুব কম মানুষ জানে।
সবচেয়ে বেশি যে জানে সে হচ্ছে নীলা।
গতকাল রাতে নীলা ফোন করে বলল, লেখক...
- হু।
- সারপ্রাইজের জন্য রেডি তো..
- কি সারপ্রাইজ..
- সেটা তো বলা যাবে না। তবে এমন সারপ্রাইজ যেটা দেখে তোমার লেখক জীবন ধন্য হয়ে যাবে।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, কি সেটা? এত রহস্য করার মানে কি?
নীলা তখনও হাসতে হাসতে বলল, জীবন বড্ড রহস্যময় লেখক। ভীষণ রহস্যময়।
আমি একটা এড্রেস দিচ্ছি। তুমি বিকেল ঠিক পাঁচটায় চলে এসো। আমি একা থাকব। আর কেউ ই থাকবে না।
আমি এসেছি। আসার পরই নীলা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
বদ্ধ ঘরে কেবল আমরা দুজন। আশেপাশে কোন ঘর নেই। কেউ ই নেই। এত নির্জন জায়গা নীলা কিভাবে বের করল?
আর কেনই বা?
আমাদের সম্পর্কে কোন নির্জনতার দাগ ছিল না।
নীলা প্রথমেই বলল, লেখক..তোমার সাথে আমি বেশি কথা বলব না। আমার হাতে মাত্র দুই ঘন্টা। দুই ঘন্টার জন্য এই ঘর ভাড়া করেছি। বড় রকমের টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি যাতে আশেপাশে কেউ না থাকে।
যে ভাড়া দিয়েছে সে খুবই সন্দেহ করেছে। ধরেই নিয়েছে আমি চূড়ান্ত অসামাজিক কিছু করব। তার চিন্তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না।
আমি বললাম, নীলা কেমন আছো?
- আমি ভালো আছি। আজকে আমার ভালো থাকার দিন। আজ পহেলা ফাল্গুন, সবচেয়ে প্রিয় দিন। তার উপর তোমাকে আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপহার দেব।
- কি সেটা?
নীলা অধৈর্য হয়ে বলল, বললাম তো এটা এখন বলব না। তুমি লেখক মানুষ। তোমার ধৈর্য থাকা উচিত। তোমার সব গল্পের শেষে রহস্য খুলে। এখানে তাড়াহুড়ো করছো কেন?
- আচ্ছা।
নীলা আমার সামনের চেয়ারে বসল।
ঘরে একটা মাত্র খাট। একটা ছোট্ট টেবিল, একটা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার এবং অল্পস্বল্প প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র। এত নির্জন স্থানে কে থাকে এখানে?
নীলা বলল, বলাই বাহুল্য সারপ্রাইজ হবে খুব অদ্ভূত। তার জন্য কিছু অদ্ভূত কাজ করব আমি। হজম করতে হবে।
- কি কাজ?
- তোমার হাত পা বাঁধব আমি প্রথমে..
আমি অবাক হয়ে বললাম, হাত পা কেন বাঁধতে হবে?
- তোমাকে খুন করব তাই। তোমাকে জবাই করব। তারপর রক্ত খাবো। বিশ্বাস করো?
- জবাই হয়ে গেলেও বিশ্বাস করব না।
নীলা আমার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, রাইটার..এত আত্মবিশ্বাস ভালো না।
- এটা আত্মবিশ্বাস না এটা বিশ্বাস। তোমার প্রতি বিশ্বাস।
নীলা বলল, আমার প্রতি এই বিশ্বাসটাই তোমার আত্মবিশ্বাস। তুমি ধরে নিচ্ছো তোমার বিশ্বাসে ভুল হতে পারে না। এজন্য এটা হয়ে গেছে আত্মবিশ্বাস। অতি আত্মবিশ্বাস খারাপ।
আমি বললাম, কঠিন যুক্তি দিয়েছো। হাত পা বাঁধবে? বাঁধো। দেখি কিভাবে জবাই করো।
নীলা গলা নামিয়ে বলল, রাইটার...সর্বশেষ সুযোগ দিচ্ছি। সত্যিই কিন্তু আমি খুন করতে পারি। চাইলে চলে যেতে পারো।
আমি গলা চড়িয়ে বললাম, ফাইজলামি বন্ধ করো। হাত পা বাঁধবা তো? বাঁধো। আমার ভালো লাগছে না। যে নিজে একটা জবাই করা মুরগীর দিকে তাকাতে পারে না সে মানুষ জবাই করবে। হাহ্..
নীলা ধীরে সুস্থে হাতে দড়ি নিল। তারপর একটা বড় মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ওকে। তোমার জীবনের সেরা দিনের শুরু এখনই।
তোমার জীবনের শ্রেষ্ট দিন। আমার জীবনেরও শ্রেষ্ট দিন হচ্ছেই এটাই।
:
:
আমার হাত পা বাঁধা শেষ হয়ে গেছে।
নীলা খানিকটা হাঁপাচ্ছে। মানুষকে দড়ি দিয়ে বাঁধাও যে যত্নের কাজ সেটা এখন আরেকবার বুঝতে পারছি।
চিন্তা করতে না চাইলেও আমার মাথার মধ্যে চিন্তা ঘুরছে।
নীলা কি চায়?
কি করতে চায়?
নীলা সামনে থাকা বিছানার উপর বসল।
তারপর কয়েক মিনিট চুপ থেকে বলল, তুমি এত সহজে হাত পা বাঁধতে দিলা?
- হাঁ।
- জানতাম না করবা না। তবুও একটু অবাক হয়েছি। শেষ মুহুর্তে না করবা ভেবেছিলাম।
- আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
নীলা হাসতে হাসতে বলল, বুঝতে হবে না। তোমার লেখা নিয়ে তোমার একটু হলেও অহংকারবোধ আছে। সেটা আজকে ভাঙাব। আর কিছু না।
আমার কথা আটকে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি শ্বাসের গতি একটু একটু বাড়ছে।
নীলা আরো কিছুক্ষণ পর চোখ মুখ শক্ত করে বলল, জয়..তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি। তুমি এখনই এখান থেকে চলে যেতে পারো। নয়তো ভয়ানক সারপ্রাইজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কোনটা করবা?
আমিও মুখ শক্ত করে বললাম, যাওয়ার জন্য এখানে আসি নি। আমি শেষ দেখে যেতে চাই।
নীলা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ওকে। তাহলে সারপ্রাইজ দেখো..
আমার শ্বাস নিতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে।
হাত পা বাঁধা থাকলে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হতে পারে। তাতে হৃদস্পনে সমস্যা হবে। কিন্তু শ্বাস নিতে কষ্ট হবে কেন?
তার মানে আমি ভয় পাচ্ছি।
নীলাকে আমি কেন ভয় পাব?
নীলা আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে আসল।
তারপর অনেকটা ফিসফিস করে বলল, জয়...
- হু।
- একটা আফসোসের ব্যাপার জানো?
- কি?
- তুমি অসম্ভব ভালো লিখো।
- তাতে কিসের আফসোস?
- আফসোস আছে। কারণ তুমি এত ভালো লিখো অথচ কেউ জানে না।
- সময় হলে এবং কথাটা সত্যি হলে এক সময় সবাই জানবে।
নীলা গলা আরো নামিয়ে নিল।
প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, তারচেয়ে বড় আফসোস কি জানো?
- কি?
- তুমি তোমার লেখার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ভালো মানুষ।
- এটা আফসোস না, এটা গর্বের বিষয়।
- না এটাও আফসোসের বিষয়। কারণ এটাও তেমন কেউ জানে না।এমনকি তুমি নিজেও না।
- এটা জানার খু্ব বেশি আবশ্যিকতা নেই।
- আছে।
আমি অনেকটাই বিরক্ত হয়ে গেছি।
আমার কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। হাত পা বেঁধে কি রকম সারপ্রাইজ হয় সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। এটা কি সত্যিই কোন খেলা?
নাকি দুই ঘন্টা পর বাঁধন খুলে দিয়ে নীলা বলবে, যাও, এটাই সারপ্রাইজ। হাতে রশির দাগ পড়েছে। দাগটা মুছো না। পহেলা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, নীলা..আর কত?
নীলা মুচকি হেসে বলল, আস্তে ডিয়ার! এত তাড়াহুড়ো করলে হয়? রাইটাদের অসীম ধৈর্য থাকতে হয়। পাঠকদের শেষ মুহুর্তে টেনে নিয়ে সারপ্রাইজ দিতে হয়। আজকে আমি লেখক, তুমি পাঠক। যতদূর ইচ্ছে তোমাকে টেনে নিয়ে যাব। যেভাবে ইচ্ছা।
আমি বললাম, আচ্ছা। হাতে ব্যথা করছে।
নীলা করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তার চোখ ভরা জল।
তারপর আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে আমার দুহাতে চুমু খেল!
এই প্রথম তার ঠোঁটের স্পর্শ আমার শরীরে লাগল। আমি কেঁপে উঠলাম এবং বুঝতে পারলাম সারপ্রাইজ দেয়া শেষ হয়েছে।
আমাদের এত দিনের গভীর সম্পর্কে এই স্পর্শের চেয়ে অদ্ভূত ঘটনা আর হতেই পারে না।
নীলা ভাঙা গলায় বলল, তোমাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে চাই না, জানো?
- জানি।
- না জানো না। তবে আজকে কিছু কষ্ট তোমাকে দেব। ভালোবাসি বলেই।
- মানে কি? সারপ্রাইজ এখনো বাকি?
নীলা মুহুর্তের মধ্যেই মুখ হাসিহাসি করে বলল, সবই তো বাকি ডিয়ার..
আমি চূড়ান্ত অধৈর্য হয়ে বললাম, প্লিজ সারপ্রাইজটা দিয়ে দাও। আমার রাইটার ফাইটার হওয়ার দরকার নেই। আমি নিতে পারছি না।
নীলা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
তারপর খাটের নিচে হাত বাড়াল। খাটের তলা থেকে কিছু একটা নিয়ে যখন আমার সামনে দাঁড়াল তখন নীলা আর নীলা নেই।
কঠিন এক মানবী। তার চোখ মুখ জুড়ে আগুন।
আমি বিস্মিত হয়ে বিড়বিড় করে বললাম, হাতে ছুরি কেন নীলা? কি হচ্ছে এসব?
নীলা কঠিন গলায় বলল, এটাই সারপ্রাইজ। তোমাকে খুন করব এখন!!
:
মুহুর্তের মধ্যে আমার বুক ছ্যাৎ করে উঠল!
কি বলছে এসব?
সত্যি বলছে?
কিভাবে সত্যি হয়?
মিথ্যেও তো মনে হচ্ছে না।
আমার মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কাজ করতে শুরু করল। হন্য হয়ে লজিক খুঁজে বেড়াচ্ছে নিউরন সেল।
ঢাকা থেকে এতটা দূরে কেন আসতে হবে নীলার? কেনই বা এত নির্জন একা ঘর ভাড়া করতে হবে?
কেনই বা সে আমার হাত বেঁধে নেবে?
তবে কি সত্যিই....??
সব লজিক মুহুর্তের মধ্যেই এন্টি লজিক খেয়ে ফেলল।
এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নিশ্চয়ই এটা কোন খেলা। ছুরি দিয়ে নিশ্চয়ই সে দড়ি কাটবে।
নীলা ছুরি আমার চোখের সামনে তুলে ধরল।
তারপর কঠিন গলায় বলল, তোমাকে আমি খুন করতে যাচ্ছি..
আমি বললাম, এসব একদম ভালো লাগছে না নীলা। প্লিজ স্টপ ইট। এটা কিরকম সারপ্রাইজ।
নীলা হাসল।
তবে এ হাসির সাথে একটু আগের হাসির আকাশ পাতাল ব্যবধান।
সে বলল, সত্যিই তোমাকে খুন করব। তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। এত ভালো মানুষ আমার সহ্য হয় না।
আমি মানসিক বিকারগ্রস্থ।
আমার এতটুকু বিশ্বাস হচ্ছে না কথা। তবুও কিভাবে জানি বিশ্বাস করতে চলেছি সব।
নীলা বলল, তোমাকে মারার আগে লাস্ট একটা কথা বলতে চাই।
- বলো।
- তুমি একবার বলেছিলে আমার হাতে মরতেও তোমার আপত্তি নেই। সত্যিই কি নেই?
আমি মরিয়া হয়ে বললাম, প্লিজ স্টপ ইট। অতিরিক্ত মজা করা হয়ে যাচ্ছে।
নীলা আমাকে চূড়ান্ত বিস্মিত করে আমার হাতে ছুরি বসিয়ে দিল
কব্জির একটু নিচে ইঞ্চিখানেক গর্ত হলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকল।
আমার তখন একটুও ব্যথা লাগছে না। আমার মাঝে বিস্ময়, আজন্মের বিস্ময়..
কিভাবে আঘাত করতে পারল আমাকে?
এ কোন নীলা..মহাজাগতিক কোন ক্লোন নয় তো? কি হচ্ছে এখানে?
এবং প্রথমবারের মতো আমি বিশ্বাস করলাম সত্যিই ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে এখানে।
নীলা কঠিন গলায় বলল, তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি।
তুমি যদি বলো আমার হাতে মরতে তোমার আপত্তি আছে তবে তোমাকে ছেড়ে দেব। যদি বলো নেই তবে সত্যিই খুন করব।
আমি কোন কিচ্ছু না ভেবে বলল, নেই।
- নেই?
- না।
নীলা আমার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে ধরল। গলা চিরে রক্ত বের হতে চলেছে। আমি বুঝতে পারছি এভাবে থাকলে হঠাৎ করেই ধারালো ছুরি গলায় ঢুকে যাবে।
নীলা মরিয়া হয়ে বলছে, বলো আপত্তি আছে? বললেই বেঁচে যাবা কিন্তু...নইলে গলা আলাদা করে দেব।
আমার মাঝে কি যে ভর করল জানি না।
আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বললাম, নীলা আমার মরতে একটুও আপত্তি নেই এবং আমি তোমাকে ভালোবাসি...
নীলার হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল।
সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। ছুরির টং করা শব্দ ছাপিয়ে নীলার কান্না কানে আসছে।
আমি মনে মনে ভাবলাম, যাক সারপ্রাইজ শেষ। আহা...
:
:
অনেকটা সময় কেটে গেল।
নীলা এখনো কাঁদছে..
আমি আস্তে করে বললাম, নীলা...
নীলা বলল, হু...
আমি বললাম, ভালোবাসি প্রমাণ হলো তো?
- হু। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছিল এমনই হবে। তুমি এতটা ভালোবাসো এটা সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন ছিল।
- সারপ্রাইজ তো শেষ। বাঁধন খুলে দাও।
নীলার মুখ হঠাৎ করেই আবার কঠিন হলো।
মুখ কঠিন করেই বলল, সারপ্রাইজ মোটেই শেষ হয় নি। বরং সারপ্রাইজটাকে তুমিই আরো বড় করলে।
আমি হতাশায় চেয়ারে হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম।
নীলা কি পাগল হয়ে গেল?
সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
তারপর আমার সামনে খাটে বসে বলল, তোমার কিছু ভুল কনসেপ্ট ভাঙানো উচিত। আজ সে গুলো ভাঙাব।
- যেমন?
- তুমি ভাবো তুমি বাস্তবতা অনেক ভালো বুঝো..
- এটা মিথ্যা?
- না এটা সত্য। কিন্তু তুমি বাস্তবতা বুঝতে গিয়ে খানিকটা অহংকারী হয়ে গেছো। "অনেক বুঝো" মানে এই না সব বুঝো। অনেক...নিজেই অনেক বড় একটা শব্দ। অনেকের কোন সীমা পরিসীমা নেই। এক অনেকের বাইরে হাজারটা অনেক থাকে। সেগুলো তোমার জানা উচিত।
- তাহলে জানাও।
- জানবে। তাড়া কেন ডিয়ার?
আমি চোখ বন্ধ করলাম। নিজে আর কিছুই বুঝতে চাইছি না। যা হয় হোক, যা খুশি করুক।
নীলা বলল, তোমরা যারা রাইটার তোমরা খুব কমন একটা ভুল করো।
- কি সেটা?
- তোমরা ভাবো গল্প কেবল তোমরাই সৃষ্টি করতে জানো। অথচ হাজারটা গল্প কিন্তু একদম সাধারণ মানুষও সৃষ্টি করে। একেকটা মানুষ হাজারটা উপন্যাস। দিনে রাতে গল্প সৃষ্টি হচ্ছে। গল্প সৃষ্টি হচ্ছে ঘরে, বাইরে, বিছানায়, কিংবা বাথরুমের টেপের শব্দের আড়ালে।
তোমরা গুছিয়ে সে সবের মাত্র ভগ্নাংশ লিখতে পারো বলে তোমরা লেখক। তোমরা বাহবা পাও। আর আমরা যারা বাস্তব গল্প সৃষ্টি করি তারা কিচ্ছু পাই না। কিচ্ছু না।
- তো...
- তো তোমাকে খুন করব।
- আবারো ফান?
- ফান না। সত্যিই..
আমি আবারো শরীর এলিয়ে দিলাম। অস্ফুটে স্বরে চোখ বন্ধ করে বললাম, মাই গড...
:
:
নীলা ছুরি হাতে নিল আবারো।
সে ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি আরেকটা জিনিস জানো না।
- কি?
- আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি...
- জানি।
- মোটেই জানো না। এক বিন্দুও না।
- আচ্ছা জানাও।
নীলা হাসল।
শব্দ করে হেসে হেসে বলল, আচ্ছা জয়...আমার জীবনের গল্প তো তুমি জানো?
- হু...
- বলো তো আমি এক জনমে কত কষ্ট পেয়েছি?
- অনেক।
- আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতা?
- আত্মহত্যা করতাম।
- আমি কি তোমাকে পাব?
- না।
- তবে আমি কেন বাঁচব? কাকে নিয়ে বাঁচব?
- সময় নিয়ে বাঁচতে হবে। নিজেকে নিয়ে বাঁচতে হবে।
- তাই করতাম। তবে একটা অসাধারণ আইডিয়া আমার মাথায় চলে এসেছে। এজন্য আমার গল্পে একটা টুইস্ট নিয়ে এসেছি।
- কি সেটা?
নীলা নির্বিকার গলায় বলল, আমি আত্মহত্যা করতে চলেছি। এটাই ফাইনাল সারপ্রাইজ।
:
:
আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি।
স্পষ্ট বুঝতে পারছি এখন কি হবে। সত্যিই ভয়ংকর কিছু ঘটে চলেছে। আমার ব্রেইন এবার ফাইনাল সিদ্ধান্তে চলে এসেছে।
আমার সামনের মেয়েটা চূড়ান্ত রকম মানসিক অসুস্থ হয়ে আছে। ওকে আটকাতেই হবে।
আমি বললাম, নীলা কি বলছো এসব?
- একদম সত্যিই বলছি। আমি হাতের রগ কাটব। কিংবা নিজের বুকে পেটে ছুরি বসাব। তারপর মারা যাব।
- তাতে লাভ?
নীলা বলল, অনেক লাভ।
প্রথমত এই ঘটনার পর তুমি রাতারাতি বিখ্যাত লেখক হয়ে যাবে। এই ঘটনা প্রকাশের পর দেশের সব মানুষ তোমার নাম জানবে। পরের মেলায় যখন তুমি বই বের করবে তখন তোমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এসব কেমন লজিক নীলা? আমি উল্টো খুনের মামলায় পড়ব। এখান থেকে সোজা রিমান্ডে যাব।
নীলা হো হো করে হেসে বলল, আমাকে এত বোকা ভাবো?
সে সবের কিছুই হবে না। তুমি থানায় যাবে সত্যিই, তবে তোমাকে কেউ রাখবে না।
- কিভাবে?
- এই রুমে ভিডিও ক্যামেরা অন করা আছে। সব দৃশ্য এবং বেশিরভাগ কথা রেকর্ড হচ্ছে। এই ঘটনা জানাজানি হলে সবাই জানবে এটা পরিষ্কার আত্মহত্যা এবং এতে তোমার দায় নেই।
খানিকটা ঝড় আসবে সত্য। তবে সেটাকে সামলানোর ক্ষমতা তোমার আছে। বাতাসে পাল ঠিকমতো তুললে তোমার নৌকা দৌড়াবে। তুমি মুহুর্তের মধ্যেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে যাবে।
আর আমি সেটাই চাই। তুমি বিখ্যাত হও।
আমি হার্টবিট মিস হলো।
চূড়ান্ত ভয় পেলাম এবার। যে সামান্য সম্ভাবনা মনে ছিল সেটা এই কথা শোনেই উধাও হয়ে গেল।
আমার হাত বা গলা থেকে তখনো রক্ত ঝরে পড়ছে।
আমি সে দিকে খেয়ালই করতে পারছি না।
আমি নরম গলায় ডাকলাম, নীলা...
নীলা বলল, বলো..
আমি বললাম, এ পাগলামী বাদ দাও। প্লিজ..
নীলা সামনে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল।
তারপর কপালে চুমু খেয়ে বলল, কি অদ্ভূত ব্যাপার জয়...
- কি?
- মানুষ ভাবে গভীর প্রেম মানেই ছুঁয়ে দেখা,স্পর্শ করা...কিংবা আরো কিছু। অথচ এসব না করার নামই যে গভীর প্রেম মানে যে এটা কজন জানে?
আমরা কি গভীর প্রেমই না করতাম..
- হাঁ।
নীলা বলল, তোমাকে কেবল বিখ্যাত করার জন্য আমি মরব ব্যাপারটা তা না। ৮০% কারণই অন্য জায়গায়।
আমি মিনমিন করে বললাম, সেটা কি?
আর কি কারণ?
নীলা ফ্রোরে বসে পড়ল। তার হাতে ছুরি খেলা করছে।
তারপর ছোট ছোট করে বলল, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো তার প্রমাণ হয়ে গেছে একটু আগেই। আমি এতটা আশা করি নি। নিঃসন্দেহে তোমার মতো মানুষ পৃথিবীতে বিরল।
আমি একটা বড় সুযোগ নিতে চাই।
- কি সেটা?
- আমার মরে যাওয়ার পর আমার শরীর তোমার পায়ের পাশে থাকতে। এই সৌভাগ্য আমার চাই ই চাই। আর কারো সামনে আমার মৃত্যু হোক এটা চাই না।
আমি আবারো চমকে গেলাম।
"কি বলে এসব? এভাবে কি করে হয়?"
আমি এই প্রথম চিৎকার করে বললাম, কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প...
নীলা হাসতে লাগল। তাকে সম্পূর্ণ উন্মাদ মনে হচ্ছে। কোন সুস্থ স্বাভাবিক কেউ মনে হচ্ছে না।
সে বলল, থামো তো। শেষ সময়টাতে স্বাভাবিক থাকো..
আমি সর্বশেষ সুযোগ নিয়ে বললাম, নীলা তুমি একটা মিথ্যাবাদী!
নীলা চমকে গিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলি না।
- বলেছো। একটু আগেও বলেছ তুমি আমাকে খুন করবে। এখন কেন তোমাকে মারবে?
নীলা ঠোঁট বাকিয়ে বলল, আমি আর তুমি কি খুব আলাদা কিছু? একই না? আমিই তো তুমি, নাকি?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
শ্বাস প্রায় আটকে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে হাতের দড়ি খোলার চেষ্টা করছি। একটুও বাঁধন খুলছে না, একটুও না।
নীলা হাসছে। তার হাতে শক্ত করে ধরা ছুরি।
আমি একবার তার দিকে আরেকবার ছুরির দিকে তাকাচ্ছি।
নীলা সুর করে গাইছে,
"চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে..
জীবন মরণ সুখ দুঃখ দিয়ে বক্ষে রাখিব জড়ায়ে"
তুমি চাইলেও এখন চরণ সরাতে পারবা না। কি মজা...হাহাহা..
আমি বললাম, নীলা পায়ে পড়ি তোমার। তুমি এরকম কিছু করলে আমি কালকেই ট্রাকের তলায় ঝাপ দেব। সিরিয়াসলিই এটা করব।
নীলা বলল, তুমি এটা করতে পারো না। কারণ আমাকে তোমার বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তোমার লেখার মাঝেই। তোমার সাথে আমিও বাঁচতে চাই। তোমার প্রিয় শিল্পী অনুপমের কি একটা গান আছে না..
"শুনো অভ্যেস বলে হয় না এ পৃথিবীতে
পাল্টে ফেলাই বেঁচে থাকা
আর একশো বছর বেঁচে থাকবই জেনে রাখো
হোক না এ পথঘাট ফাঁকা..."
আমি হাজার বছর বাঁচতে চাই জয়...
তুমি তোমার অভ্যেস পাল্টে ফেলো। অন্য কাউকে নিয়া বাঁচো। আমার তাতে আপত্তি নেই।
আমি বললাম, তুমি বেঁচে থেকেই বাঁচবে, মরে গিয়ে কেন?
নীলা বলল, না। বাঁচলেই বরং মরতে হবে। একসময় ভুল হবে। ভুল হলেই আমাদের সম্পর্ক মরে যাবে। তারচেয়ে মরে গিয়ে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখি।
- তুমি সত্যি সত্যিই এতটা পরিকল্পনা করে এসেছো?
- না। পুরোটা না।
- তবে....
- তুমি যদি তখন বলতে যে আমার হাতে তোমার মরতে আপত্তি আছে তবে তোমাকে মারতাম না, তোমার জন্য মরতামও না।
এটা বলেই তুমি প্রমাণ করেছ তোমার জন্য মরা ভুল না..
নীলা ছুরি উপরে তুলছে।
সে কাজটা সত্যিই করতে যাচ্ছে।
আমি চিৎকার করছি, সব ভুল হচ্ছে নীলা, সব ভুল হচ্ছে।
- ভুল শুদ্ধ আমরা কেউ ই জানি না।
- এমন হতে পারে না।
- পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরচেয়ে বড় সারপ্রাইজ কোন প্রেমিকা তার প্রেমিককে নিশ্চয়ই দেয় নি। তোমার মতো কেউ অবশ্য ভালোও বাসতে পারে নি হয়তো।
- নীলা....
- রাইটার...কি অবিশ্বাস্য সব কিছু তাই না?
নীলা ছুরি পেটে বসিয়ে দিচ্ছে প্রায়। আমি সহ্য করতে পারছি না।
চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।
নীলা বিড়বিড় করে বলছে, ভালো থেকো রাইটার। তোমাকে যে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছি সেটা কাজে লাগিয়ো। আজ বসন্তের প্রথম দিন। আমার সবচয়ে প্রিয় দিন। তোমার জীবন বসন্তময় হোক। বসন্তে দুএকটা কালবৈশাখী হয়। সেটা বিবেচনার বাইরে রাখতে পারো।
একটা বিড়াল কোথা থেকে যেন উঁকি দিল।
বিড়ালটাকে এখন আমার চেয়ে হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী মনে হচ্ছে।
আচ্ছা সে কি বাঁচাতে পারবে না?
আমার নীলা বাঁচবে না?
আমি চোখ বন্ধ করলাম।
চোখ বন্ধ করেই দেখলাম এত তরুণের ট্রাকে চাপা পড়া ক্ষতবিক্ষত দেহ মর্গে পড়ে আছে।
তখনই যেন অপার্থিব এক কন্ঠ কানে আসল, ভালো থেকো জয়। শুভ বিদায়...
আমার বন্ধ চোখে তরলের ছিটা এসে লাগল।
এত দূরে কিভাবে রক্ত ছিটকে পড়তে পারে?
নিশ্চয়ই নীলা পানির দিয়েছে চোখে...
চোখ খুললেই দেখব সে মিটমিট করে হাসছে। চিৎকার করে বলবে...সারপ্রাইজ...
আচ্ছা, এটা দুঃস্বপ্ন নয় তো?
কানে আসা গোঙানির শব্দটাও নিশ্চয়ই আমারই...
āĻোāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāĻ:
āĻāĻāĻি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āĻ āĻāϰুāύ