āĻŽāĻ™্āĻ—āϞāĻŦাāϰ, ā§§ā§­ āĻāĻĒ্āϰিāϞ, ⧍ā§Ļā§§ā§Ž

4862

আমি আর মাধবী শহরে এসে উঠেছি বেশ কিছুদিন হলো। শহরটাকে আমি পুরাতনভাবে দেখলেও মাধবী দেখছে একদম নতুন ভাবে। নিত্য নতুন প্রতিদিন একটু একটু করে এই শহরের উন্নতি আমি অনেক দিন ধরে দেখে আসছি।গ্রাম ছেড়েছি আরো সাত বছর আগে।আমার মনে তীব্র ইচ্ছা ছিল আইন বিষয়ে পড়বো।তাই যথাসময়ে বিষয়টি মায়ের কাছে প্রস্তাব দিলে মা আমাকে না করেনি।রাজি হয়ে গিয়েছিলো ছেলেকেও স্বামীর মতো উকিল হিসেবে দেখতে পারবে বলে।সে থেকেই এই শহরের সাথে পরিচিত আমি।এরপর আইন পাশ করার পর শহরের কোর্টে উকিল হিসেবে নিযুক্ত হলাম।মাধবীর সাথে বিয়ে হয়েছে প্রায় এগারো মাস হবে।এর মধ্যে দশ মাস অবশ্য মাধবী মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতেই ছিল।কিন্তু আমি কাজে কর্মের জন্য পড়ে রয়েছিলাম এই যান্ত্রিক কাঁচ ঢাকা শহরে।পরে ভেবে দেখলাম এই শহরের বুকে নিজের আপনজন না থাকলে বড় বেশি অসহায় মনে হয় নিজেকে।তাই আমি গ্রামে ছুটে গিয়েছিলাম মা এবং মাধবীকে এই শহরে নিয়ে আসার জন্য।এতে আমারও কিছুটা খাটুনি কম হবে; একটু আপন সঙ্গও পাওয়া যাবে। শহরে একা থাকার যন্ত্রণা খুব কম মানুষই বুঝে থাকে। কিন্তু মাধবী আমার সাথে শহরে আসার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করলেও মা আপত্তি জানিয়েছিল।আমি জানতাম বাবার শেষ ভিটে বাড়ি অংশ টুকু ছেড়ে মা কিছুতেই শহরের দিকে পা বাড়াবে না। তাই খুব বেশি জেদাজেদিও করিনি মাকে।পরিশেষে আমি আর মাধবী মাকে ছাড়াই শহরে পাড়ি দিলাম।কিন্তু ছেলে হিসেবে আমি মায়ের প্রতি অনাচার একদমই করতে পারি না।তাই শহরে একমাসের সংসার না পেরুতেই এইবার মনস্থির করে ফেলেছি যে,মাকেও শহরে নিয়ে আসবো।গ্রামে হয়ত স্বজন প্রীতি দেখানো লোকের অভাব হবে না কিন্তু ছেলে আর পাড়া প্রতিবেশীদের আলাদা যত্ন নেওয়া একদমই ভিন্ন কথা।তাই মাকে একটা চিঠি লিখে এখানে এসে থাকার কথা আগে ভাগে বলে রাখা দরকার।তাছাড়া শহরে আসার পর এখনো অবধি সময় করে চিঠি লিখতে পারিনি মাকে।তবে একদিন যদীন কাকার সাথে কোর্টে দেখা হয়েছিল। উনাকেই মৌখিক ভাবে আমাদের খোঁজ খবর দিতে বলেছিলাম মাকে।কিন্তু নিজে একটা চিঠি না লিখে দিলে মায়ের হয়তো ছেলের প্রতি অভিমান জমতে পারে।তাই টেবিলে থাকা সাদা কাগজটি নিয়ে মাকে চিঠি লিখতে বসলাম।
প্রিয় মা,
পর সমাচার এই যে, আমি এবং মাধবীলতা শহরের বেশ বড় এক আলিশান বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছি।বাড়িখানা বেশ বড়।তিনটা বড় বড় কামরা, একটি রান্নাঘর সাথে বেশ বড় একটি উঠানও আছে।দক্ষিন দিকে রয়েছে ঠাকুর ঘর।মাধবী একদম তোমার মতো করেই সে ঠাকুর ঘরটাকে সাজিয়েছে। প্রতিদিন সকালে ঠাকুরের জল খাবার তৈরি করে একমনে ভক্তি আরাধনা করে সে ঠাকুর ঘরে।বাড়ির উত্তরদিকের এককোণায় আলাদা বড় একটা ঘর রয়েছে।ভেবেছি যে, এ ঘরেই আমার আইন বিষয়ক পড়ার বইগুলোকে সাজিয়ে রাখবো।তাই মাধবী ঘরটিকে টানা দুই দিন ধরে মুছে একদম ঝকঝকে করে ফেলেছে।এখন আমার ছুটির দিনগুলোর বেশির ভাগ সময় পড়ার ঘরের বইগুলোর সাথেই কেটে যায়।মাঝে মাঝে মাধবী তোমাকেও আমাদের সাথে থাকার জন্য খুব জেদ করছে।কিন্তু তোমার ছেলে হয়ে তোমার মনের কথা বুঝবো না তা কি করে হয়! আমি জানি তুমি গ্রামের মাটির আঁশটে গন্ধ ছেড়ে এই শহরে আসবে না।শহরের দালান কোঠা তোমার একদমই পছন্দ নয়।কিন্তু মা,এইবার বড়ই সাধ জেগেছে তোমাকেও শহরে এনে আমার সাথে রাখার।তাছাড়া গ্রামের যদীন কাকার মুখে শুনলাম সেখানে নাকি আমার নিন্দে করে বেড়িয়েছে এক শ্রেনীর মানুষজন।তাই এইবার না হোক, পরের বার তুমি নিশ্চিত থেকো তোমার ছেলের কথা কিছুতেই ফেলতে পারবে না। আমি সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।মাধবী ভালো আছে।শরীরের যত্ন নিও।
ইতি
তোমার ছেলে।
.
চিঠিটি পোস্ট করে সন্ধ্যা বেলায় কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরলাম।শহর ততক্ষণে রাস্তার আলোয় সেজে ফেলেছে নিজেকে।এমন এক সন্ধ্যাক্ষণে মাধবীর বাইরে বের হতে নাকি খুব ইচ্ছে করে।কিন্তু সময়ের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে না থাকায় তার ইচ্ছা টি এখনো পূরণ করতে পারিনি আমি।এ নিয়ে মাধবীর মনে যে কোনো ক্ষোভ রয়েছে তা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি কোনোদিন। তবে, তার রাগ দেখানোটাও স্বাভাবিক। সাতাশ দিন হতে চলেছে মাধবীর শহরে আসা।কিন্তু উকিল হওয়াতে আমি সারাদিনই পরে থাকি নানান যুক্তি তর্কতে।তাই শহরের এই একটিমাত্র বাড়ি ছাড়া মাধবীর এখনো শহুরে চাকচিক্য দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি।মনেমনে ভেবেছি যে সামনের দোলের ছুটিতে শহরটাকে তাকে ঘুরিয়ে দেখাবো । আর মাকেও নিয়ে আসবো এই সুযোগে।
সেদিন সন্ধ্যায়
খুব বেশি কাজ ছিল না বলে
ধুতি টা কোমড়ে পেঁচিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় একপাশ ফিরে নিচের দিকে চেয়ে দেখি বেশ কিছু মানুষজন ভিড় জমিয়েছে চায়ের দোকানে।তাদের মুখের কথা স্পষ্ট শোনা না গেলেও ভাব ভঙ্গিতে বুঝতে পারছি যে তাদের শিরায় এক ভয়ানক রক্তের স্রোত বইছে।রাস্তার নিয়নের আলোয় চোখে পড়লো সে ভিড়ের বেশির ভাগই ছিল তরুন সমাজ।আমি খুব উৎসুক শকুনি চাহনিতে তাদের দেখছি।বেশ কয়েকদিন থেকে ঢাকা শহরকে গরম দেখছি কিছু তাজা তাজা খবরে।তার মধ্যে প্রধান খবর হলো পশ্চিম পাকিস্তানীরা এদেশে এসে তাদের অন্যায় অধিকার খাটাতে শুরু করেছে আমাদের উপর।আর তাতেই ক্ষীপ্ত পুরো বাঙ্গালি। বিশেষ করে তরুন সমাজের দিকে দৃষ্টি রাখলেই বুঝা যায় কতটা তাদের চোখে অপমানের শোধ নেওয়ার নেশা।আমি অবশ্য দেশের কোনো খবরই ভালো করে রাখি না।কোর্টে গেলে সবাই একসাথে হলে যে আড্ডা হয় সেখানেই যতটুকু যা শুনি।বলতে গেলে,আমার এইসবের প্রতি খুব যে একটা আগ্রহ আছে তা নয়।তারপরেও নানান গুঞ্জন শুনে যা বুঝতে পারছি, দেশটা মনে হয় পরের অধীনে চলে যাচ্ছে।তাই ক্ষীণ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, তাহলে কি আমি আমার বাংলাদেশকে হারিয়ে ফেলছি? তবে কি আমি সেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের গোলাম হয়ে রবো আজীবন?
এমন সময় বারান্দায় মাধবী এসে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
__কি গো ভাত বাড়বো?
__আমি চমকে উঠে পিছু ফিরে দেখে আবারো সেই ভিড়ের মাঝে দৃষ্টি দিয়ে মাধবীকে উত্তর দেই, এতো জলদি?কয়টা বাজে যে এই ভর সন্ধ্যাবেলায় খেতে বলছো?
__মাধবী মিচকে হেসে বললো,ওমা উকিল বাবু বলে কি?তা কোর্ট কাচারি করতে গিয়ে আপনার বোধ শক্তি অর্ধেক লোপ পেয়েছে নাকি?সে তো কখন এসেছেন কোর্ট থেকে। এখন কি আর সন্ধ্যা আছে?কবে রাত্রি দশটা বেজেছে।
__হুম,তাই বুঝি?আমি তো একদম খেয়াল করিনি।তুমি তো একটিবারও ডাকও নি আমায়!
___সে ডেকেছি তো তিন চার বার হবে।কিন্তু আপনার কোনো সাড়া না পেয়ে ভাবলাম হয়তো বারান্দায় বিচার আচার নিয়ে ভাবছেন কিছু।তাই বেশি আর বিরক্ত করতে চেয়েছিলাম না।
কিন্তু এখন তো দেখি উকিলবাবু কোনো এক ধ্যানে মগ্ন।তা কিসে এতো গভীর মনোযোগ?
আমি খুব ধীর গলায় মাধবীকে কাছে টেনে নিয়ে এসে সেই ভিড়ের দিকে একটু আঙ্গুল প্রশস্ত করে দেখিয়ে দিয়ে বললাম, কিছু বুঝেছো কি?
মাধবী কাঁটা ফুল গিলে খাওয়ার মত এক ভঙ্গিমা প্রকাশ করে বললো, আপনাদের পুরুষদের কি সব কথা বার্তা তা কি আর মেয়ে মানুষের বুঝার সাধ্যি আছে? সে না হয় দু একটি কথা কাছে থেকে শুনলে বুঝা যেত কিন্তু এত দূর থেকে কান বা মন কিছুতেই সজাগ হতে পারছে না আমার।
মাধবীর চোখে আমি চেয়ে থেকে বললাম, শহরটি আর আগের মতো নেই।চারিদিকে খুব খারাপ খবর শুনতে পাচ্ছি।মাধবী তখন তার মাথার চুল গুলোকে ছাড়িয়ে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে এই শহরের?
আমি তখন নির্দয় আকাশের মতো শক্ত মুখ করে বললাম,শুধু শহর নয় আমাদের পুরো বাংলাদেশই এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে।মনে হয়না বাংলাদেশের চিহ্ন আর থাকবে! মাধবী তখন খুব কৌতুহলী কন্ঠে আমাকে ফের জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বাংলাদেশের?
আমি বললাম, থাক বাদ দাও।খুব ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও তুমি।মাধবী করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমাকে সঙ্গ দিয়ে বলে, "হ্যাঁ, সারাদিন খুব খাটাখাটনি গিয়েছে। চলেন, দু'মুঠো ভাত খাবেন।"
.
পরদিন সকালে কোর্টে যাওয়ার জন্য দাঁত মাজন করতে কলের পাড় অবধি যেতেই দেখি শহরের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার বীরেন সাহা আমার বাড়িতে উপস্থিত।হকচকিয়ে উঠে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "একি রে বীরেন এতো সকালে আমার বাড়ি?কোনো খারাপ খবর নেই তো?"
বীরেন তার মুখখানা কালো করে আমার পিঠের উপর তার ডান হাতটি রেখে বললো, "কিরে, তুই কি দেশের খবর শুনেছিস কিছু?"
আমি ঝিম ধরে থাকা গলায় বললাম, হুম অনেক কিছুই তো শোনা যাচ্ছে।কিন্তু সময় নিয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু শুনিনি।তবে কি আমি যতদূর আন্দাজ করেছি তার থেকেও খারাপ খবর নিয়ে এসেছিস নাকি আবার তুই??
বীরেন তখন তার হাতের কালো ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর একটি কলম বের করে আমাকে একটি ঠিকানা লিখে দিয়ে তা হাতে ধরিয়ে দিলো।আমি কাগজখানি হাতে নিয়ে স্পষ্ট গলায় পড়লাম, "মোহাম্মদ মুহীন মিয়া,ঠিকানা-পাঁ
কশি পাড়া,রোড-১০৩।"
আমি এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বীরেন বলে উঠলো, "শোন, মুহীন ভাই খুব ভালো মানুষ।এই যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা দেশে এসে আমাদের উপর যেসব অন্যায় আবদারগুলোকে চাপিয়ে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে কিছু মানুষদের নিয়ে একটা সংঘ গঠন করছে এই মুহীন ভাই।একজন দুজন করে সে সংঘে এখন প্রায় দেড়শ জন মানুষ হয়েছে।সকলের উদ্দেশ্য এক জোট হয়ে সেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের নাস্তানাবুদ করা।তুই যদি রাজি থাকিস তবে আমি আর তুই এক সাথে সে সংঘে যোগ দিবো।তারপর সেই নিকৃষ্ট মানুষদের সাথে লড়বো।অনেক হিন্দু সম্প্রদায় এ সংঘে যোগ দিয়েছে। এ ব্যাপারে তোর কী মতামত?
আমি একটানা বীরেনের কথাগুলো হজম করলাম।কিন্তু নিজের কাছে একপ্রকার লজ্জিত হয়েই বীরেনকে না বলে দিলাম।এতে বীরেনের ফ্যাকাসে মুখ দেখে নিজেরই অস্বস্তি লাগছিল। এতে আমার প্রকৃতপক্ষে হাত থাকলেও নিজেকে দায়ী মনে করলাম না।শহরে সবে নতুন মাধবী কে নিয়ে এসেছি।আর মাকেও নিয়ে আসার জন্য মন স্থির করে ফেলেছি।এর মধ্যে এত ঝামেলা নেওয়ার কথা আমি কখনো ভাবতেই পারিনা।তাতে কেউ যদি মনে করে আমি দেশদ্রোহী তবে শুনতে রাজি আছি।কেননা নিন্দে করার মতো মানুষের অভাব হয়না।সেখানে কেউ যদি পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে লড়িনি বলে দু'চারটে মন্দ কথা বলে তবে বলুক।আমি গায়ে না মাখলেই হলো।
হয়ত
একটু নুনের ছিঁটা কাঁটা ঘায়ে পরবে তবে সয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো।এদিকে
বীরেন কে মুখের উপর না বলে দেওয়ায় বেচারা অনেক কষ্ট নিয়ে আমার বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো।যাওয়ার আগে অবশ্য তাকে মাধবীর সাথে দেখা করতে বলেছিলাম। কিন্তু হয়তো আমার উপর একপ্রকার রুষ্ট হয়েই ভোঁ ভোঁ করে হেঁটে চলে গেল সে।আমি শুধু চোখ মেলে তার হেঁটে যাওয়া পথটির দিকে চেয়ে রইলাম।
.
তিনদিন পর।
দিনটি খুব বাজে রকমেই কাটছে।সকাল থেকেই কাজের চাপ উপরন্তু সকলের মুখে সেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে একই কথা।আমি শুধু সকলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে তাদের এই এক বিষয়ের আলোচনা গুলো শুনছি।অনেকে আমাকে জিজ্ঞেসও করে এ বিষয়ে আমার কি মতামত? আমি মুখটা গাঢ় প্রশস্ত করে তাদের বলি, এই ব্যাপারটা আমি সব সময়ই এড়িয়ে চলেছি তাই কোনো মন্তব্যই আমার জানা নেই।আর সে কথা শুনেই আমার বন্ধু মহল হেসে বলে উঠলো, রমেশ দা তুমি আর শুধরেলে না।আমি তখন তাদের কৃত্রিম এক হাসি দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
সন্ধ্যা হয়েছে।বাড়ি ফিরে দেখি মাধবী তুলসি গাছতলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়েছে।প্রণাম করেই ভিতরে ঢুকে দেখি সে কাঁথা সেলাই নিয়ে ব্যস্ত।আমি মাঝেমাঝে মাধবীকে দেখে অবাক হই।সন্ধ্যার এ আবছায়া আলোতে কি সুন্দর নিদারুন ভাবে সে কাঁথাতে ফুল তুলছে।সত্যিই সে অনন্য গুণের অধিকারিণী। তাই তাকে বিরক্ত করবো না মনে করে কিছু না বলেই চলে গেলাম ঘরে।নিস্তব্ধ রাতের আঁধার কিছু গল্পের দ্বারা ছেঁয়ে আছে আজ।নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম,সত্যিই কি এ দেশের প্রতি আমার কোনো টান আছে?যদি থেকেই থাকে তবে কেনো আমি লড়ছি না?কেনো এ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েই চলেছি অনবরত ? এদেশ তো আমারই দেশ।
এমন সময় হঠাৎ মাধবী এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো, অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে আবার তোমাকে কোর্টে যেতে হবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। আমি শুধু মাধবীকে মাথা নাড়িয়ে "হুম" সূচক একটা শব্দ বলে শুয়ে পড়লাম।
.
পরদিন সকালে পাড়া মহল্লায় একটি কথাই শুনতে পাচ্ছিলাম তা হলো আগামী ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নাকি বাঙ্গালি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন।জল অনেক দূর গড়িয়েছে।শহরের মানুষজন আজ নিজেদের অধিকার আদায়ে নিবিড় সংকল্পবদ্ধ। তাদের উদ্দেশ্য একটাই।আর তা হলো কিছুতেই বাংলা ভাষাকে তারা হারিয়ে যেতে দিবে না।এ ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রান দিয়েছিল অনেক ভাষা শহীদ।এখন পাকিস্তানীদের কথা শোনা মানে সেসব ভাষা শহীদদের অপমান করা। সেই বীর বাঙ্গালীদের রক্তের কথা চিন্তা করতেই এইবার নিজের রক্তে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো।ভাবলাম মনকে জাগাতে হবে।এতটা সংকীর্ণমনা মন আমার ভাবতেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে নিজেকে।এভাবে হয়ত পালিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব কিন্তু সে বেঁচে থাকা একদমই অর্থহীন। আমাদের পায়ের শিকল গুলো হয়তো খুলে ফেলার সময় এসে গেছে।আমিও চাই আজ এ বাংলাকে রক্ষা করতে,এ বাংলার মাটির বুকে চিরটিকাল বেঁচে থাকতে। তাই মনে মনে ঠিক করে ফেললাম মাধবীকে মায়ের কাছে রেখে আসবো।শহরের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার থেকে বরং সে গ্রামে মায়ের কাছে থাকলেই ভালো হবে।তাই যথার্থ সময় মতো মাধবীকে গ্রামে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলাম।কিন্তু দেশের এ সংকটে আমাকে একা ফেলে সে কিছুতেই যেতে চাইলো না গ্রামে।তাতে আমি খুব বেশি তাকে বকাবকি করিনি।কারন আমি জানি প্রত্যেকটি স্ত্রীর মনের ভিতরে স্বামীর জন্য এক অন্য সুপ্ত ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।আর সে ভালোবাসার জোরেই আজ মাধবী আমার সাথে এই কালো শহরে থেকে গেল।অতঃপর আমি মুহীন ভাইয়ের সংঘে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
.
কোর্ট গুলোতে এখন আর তেমন কাজ হয় না।বিশেষ করে ৭ই মার্চের পর থেকে এক বিক্ষুব্ধতার আমেজ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।সেদিনের পর থেকে গ্রাম বা শহর কোথাও বাদ পড়লো না সেই পাকিস্তানীদের প্রতিহত করার জন্য এক একটি সাহসী যোদ্ধা হিসেবে নিজেদেরকে মেলে ধরার।
সকলের মুখে একটিই কথা- "বাংলা ভাষা আমাদের,বাংলাদেশ আমাদের।"
এরই মধ্যে,
দোল চলে এসেছে।কিন্তু মাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হয়নি।মাধবীও গ্রামে যায়নি।কথা ছিল এই দিনে তাকে পুরো শহরের খানিকটা জায়গা ঘুরে দেখাবো কিন্তু আশেপাশের অবস্থা খুব খারাপ বলে আর সেটাও হলো না।অবশেষে মাধবীও আমাকে আর ছাড় দিল না। বায়না ধরলো তার কাঁচের রেশমি চুড়ি চাই-ই চাই।আমিও তার ছোট্ট এই আবদারটুকু আর ফেলতে পারিনি।মেয়েদের নাকি সোনা দানার প্রতি লোভ থাকে।কিন্তু একমাত্র আমি মাধবীকেই দেখলাম এ ব্যাপারে তার লোভ খুবই স্বল্প।তাই দোলের কিছুদিন পর সন্ধ্যাবেলা বাজার থেকে মাধবীর জন্য দুই ডজন রেশমি চুড়ি নিয়ে আসলাম। তাতে তার মুখে যে হাসি দেখতে পেয়েছিলাম তা চির অনিন্দ্য আমার কাছে।কেউ কেউ তো এই হাসির জোরেই খুন হয়ে যায়।
আমিও মাধবীর মুখের হাসি দেখে খুন হয়ে গেছি কোনো এক সন্ধ্যারাতের ভালোবাসায়।
.
কয়েকদিন পর।
রাতটি ছিল ২৫ শে মার্চ।
সেদিন রাতে ঘুমিয়েছি অনেক আগে।কিন্তু হঠাৎ মাঝ রাতে এক বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল।চারিদিকে কান্না,গুলি ছোঁড়ার শব্দ বাতাসের মাধ্যমে কানে ভেসে আসছে।মাধবীও চমকে উঠে।ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠাকুর দেবতার নাম স্মরণ করতে থাকে সে।আমি বিষয়টি বুঝার জন্য বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই মাধবী হুহু করে কেঁদে উঠে। ওর আঁৎকে উঠা দেখে আমি সেদিকে আর পা বাড়ালাম না।তবে আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি বাইরে কী চলছে।হয়তো কিছু প্রান ধুলোর সাথে লুটোপুটি খাচ্ছে।হয়তো বা কেউ নৃশংস ভাবে জখম হয়ে পরে রয়েছে রাস্তার আনাচেকানাচে। আবার হয়তো বা আগুনে পুড়ে গেছে কারো সাজানো পরিবার। এই বর্বরতার কথা চিন্তা করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আমার।কিন্তু বিপত্তি বাড়লো তখনই যখন সকালে সে বর্বতার চিহ্ন নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে মাধবী তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।এ অবস্থায় নিজেকেও সামলিয়ে নিয়ে উঠতে পারছিলাম না।অতঃপর বীরেনকে একটা খবর দিলাম।বীরেনের আসতে বিলম্ব হওয়ায় ততক্ষনে মাধবীর পাশে বসে থেকে খবরের কাগজ বের করে চোখ বুলোচ্ছিলাম। বড় হেডলাইনে লেখা-"ভয়াল ২৫ শে মার্চ।বর্বতার ছাপ।শেখ মুজিব গ্রেপ্তার।বাঙ্গ
ালি জাতি দিশেহারা।"
খবরের কাগজ টি পড়ে নিজের চাপা রাগ গুলোকে মিটালাম কাগজটি টুকরো টুকরো করে।সত্যিই এ অন্যায় আর সইতে পারছিনা আমি।এদিকে খানিকসময় পর বীরেন চলে আসলো। মাধবীকে দেখার পর সে আমাকে জানালো,আমি নাকি বাবা হতে চলেছি।আনন্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল।তবে সে আনন্দটা বেশিক্ষন ধরে রাখতে পারিনি।কারন আমি জানি এক অন্ধকারের হাতছানি আমার অনাগত সন্তানের উপর ছেঁয়ে আছে।খুব বিপাকে পরে গেলাম।আমাকে ভরসা দেওয়ার জন্য বীরেন মাধবীকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলো।যথারীতি এইবার আমি সেটাই করলাম মাধবীর শত অনিচ্ছা সত্বেও। অন্যদিকে ২৬ শে মার্চ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে বীর বাঙ্গালীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে।যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে।তাই আমিও মন স্থির করলাম এ যুদ্ধে আমিও অংশ নিব।কারন আমি চাই আমার সন্তান বাংলায় কথা বলুক,এ দেশের মাটির ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করুক।তাই দুইদিন পরে মাধবীকে গ্রামে রেখে আসলাম মায়ের কাছে। কারন যুদ্ধে যাওয়ার আগে আমাকে সকল সম্পর্কের মায়া ভুলতে হবে।গ্রামে মায়ের কাছে থেকে আশীর্বাদ আর মাধবী এবং আমার সেই বেড়ে উঠা ছোট্ট অনাগত সন্তানের কাছে থেকে ভালোবাসা নিয়ে পুনরায় উদ্দেশ্য হলাম শহরের দিকে।আমি জানি না এরপর কি আছে আমার জীবনে।হয়তোবা এ মানুষগুলোর সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। বিদায়বেলায় মা আর মাধবীর কান্নাদৃশ্য বারবার দূর্বল করে দিচ্ছিল মনকে। তাই তাদের কথা মনে করতেই মন খারাপের এক বিদীর্ণ বেদনায় ছেঁয়ে গেল আমার মনের আকাশ।
.
শহরের বুকে পা দিতেই
ভাবলাম,আজ
আমি ঘুমন্ত মনে জেগে থেকে সব মায়া ছিন্ন করে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পে যোগ দিব। যথানিয়মে তেমনটিই হলো। স্বাধীনতার ডাক আমার জীবনে বাংলার মাটির প্রতি ভালোবাসা ফের চিনিয়ে দিয়েছে।আমি পণ করলাম মুক্তির আশায় আর বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে লড়বো আমার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে।
এমন সময় বীরেন এসে বললো, "চল শত্রু নিধনে বের হতে হবে।" আমি বললাম, কোথায়?
বীরেন উত্তর দিলো, কাশিনগর। আমিসহ আরও বিশজন সংঘ থেকে সে অপারেশনে গেলাম। ফিরলাম জয় নিয়ে।
.
জুলাই মাস।
যুদ্ধের কেটে গেছে প্রায় ৪ মাস।এই ৪ মাসে একটি বারের জন্যও মা বা মাধবীর কোনো খবর পাইনি।কে জানে কেমন আছে তারা।মাঝেমাঝে আমার অনাগত সন্তানটির জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠে।এক ভয়ানক আশঙ্কা সব সময় আমাকে ঘিরে থাকে।শুনেছি পশ্চিম পাকিস্তানীরা নাকি গ্রাম গুলোতেও তাদের নৃশংসতার অভিযান চালিয়েছে।হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে,বাড়ির যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে।অনেকে আবার তাদের ভয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য দেশে।এসব ভাবলে এখন অবশ্য আমার গা শিউরে উঠে না আগের মতো। সব সয়ে গেছে এ চারমাসে। ম্যানি ব্যাগে থাকা মাধবীর ছবি খানি দেখে ভাবছিলাম,বাড়ির সব ঠিক আছে তো? মা তো পা নিয়ে হাঁটতে পারে না। কি জানি মায়ের পায়ের ব্যথা আবার বেড়েছে কিনা! যদি বেড়েও থাকে তবে ঔষধপত্র কীভাবে কিনছে তাও জানা নেই। অবসরতার সময় খুব অল্প থাকে আমাদের। কিন্তু যতটুকু পাই সে সময়টুকু শুধু আপনজনদের কথাই মনে পড়ে। নিয়মটা শুধুমাত্র যে আমার বেলায় এক এমন নয়। আমার সাথে থাকা বাকিদেরও ঠিক এমন অবস্থা। অনেককে দেখেছি পরিবারের কথা মনে করতেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু যখন তারা যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত তখন এক নিমিষেই সে আবেগ কেটে যেত তাদের।
সবে ম্যানি ব্যাগে মাধবীর ছবি সযত্নে রেখেছি। এমন সময় মুহীন ভাই এসে আমাদের নির্দেশ দিলেন, সামনের মহেশপুর গ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ঘাঁটি পেতেছে।আমাদের এক্ষণি সেখানে অভিযানে যেতে হবে।আমি মুহীন ভাইয়ের কথা শোনা মাত্র যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম।বীর বাঙ্গালীর রক্ত জেগে উঠেছে।কিছুতেই রেহাই দেওয়া যাবে না আমাদের রক্ত চোষা মানুষদের।
এরপর,
মহেশপুর গ্রামের পাকিস্তানীদের ঘাঁটির দিকে আমরা ধীর গতিতে অগ্রসর হলাম।একপা দু'পা ফেলতে ফেলতে অবশেষে আমরা তাদের ঘাঁটির সম্মুখে গিয়ে পৌঁছালাম।এরপর শুরু হয়ে গেল দুই পক্ষের অতর্কিত আক্রমণ। পাকিস্তানীদের কামানের শব্দ শোঁ শোঁ করে মহেশপুরের গ্রামকে বিষিয়ে তুলছে।চারিদিকে গুলির শব্দ।দুই পক্ষের প্রায় ৫০ মিনিটের যুদ্ধে নিহত হলো অনেকে।তবুও জয়টা ছিল আমাদেরই। আমি সে জয়ে প্রফুল্ল হয়ে জয় ঘোষণার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অপর পাশ থেকে পাকিস্তানীদের ছোঁড়া একটা গুলি এসে হঠাৎ-ই বিঁধলো আমার বুক বরাবর।আমি লুটে পড়লাম ধূলিমাখা রাস্তায়।বুক থেকে অনবরত রক্ত ঝরে পড়ছে আমার। নিঃশ্বাস ক্রমশই ক্ষয়ে আসছে।চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি।শেষ বেলায় খুব করে মনে পড়ছে মা,মাধবী আর আমার ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানকে।জানি না আমি আবারও তাদের দেখতে পাবো কিনা! পারবো কিনা তাদের কাছে ফিরে যেতে। হয়ত আমার সন্তান বাবা বলে ডাকতেও পারবে না। আবার হয়ত এই বাংলার বুকে ফিরে আসা আর সম্ভবও নয়।ছুটির ঘন্টা খুব সন্নিকটে। গুলির ব্যথা যতটা না বুকে আঘাত করছে তার থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছি এ বাংলাকে ছেড়ে যেতে। সব বিদায় নাকি সুখের হয়না কিন্তু আমার বিদায়ে কষ্ট থাকলেও দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছি। আর এ শেষ বিদায় বেলায় বলতে চাই, "ভালো থেকো বাংলাদেশ।আমি আবারও আর একটি বার তোমার কোলে জন্মাতে চাই।ফিরলে আবারো তোমার তরেই মরবো।বিদায় সোনার বাংলা।"
.
তারপর একটা ধরাশায়ী লাশ পড়ে থাকলো সেখানে। কেউ হয়তো তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়বে না।আবার হয়ত বা মাটি চাপায় বিলীন হয়ে যেতে পারে সেই যোদ্ধার দেহ।নয়ত বা আহার হবে কোনো শকুনের।কিন্তু তার জীবন দান বাংলাদেশ কোনোদিনও ভুলতে পারবেনা। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এভাবেই তো জীবন দিয়ে রচিত করেছে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র।
#মুক্তিযোদ্ধা
® জান্নাতুল মমি

āĻ•োāύ āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āύেāχ:

āĻāĻ•āϟি āĻŽāύ্āϤāĻŦ্āϝ āĻĒোāϏ্āϟ āĻ•āϰুāύ